স্রোতস্বিনী পর্ব-১০

0
118

#স্রোতস্বিনী
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
পর্ব ১০

সকাল হয়ে গেছে।শহরের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে,উদ্দেশ্য স্রোতের বাড়ি।মেহরাদ এক ধ্যানে গাড়ি চালাচ্ছে, মাঝে মাঝে দু-একটা কথা বলছে,স্রোত হু হ্যা তে জবাব দিচ্ছে।গাড়িতে আবার নিরবতা,কথা যেনো ফুরিয়ে গেছে।স্রোত একটু পর পর লুকিয়ে লুকিয়ে মেহরাদকে দেখছে।মেহরাদ তা খেয়াল করেছে।সে সামনের দিকে তাকিয়েই দুষ্টুমি করে বললো,

“আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে আপনার কষ্ট হচ্ছে স্রোতস্বিনী। সোজা হয়ে বসে দেখুন। আমি পুরোটাই আপনার।”
স্রোত বোকা বনে গেলো,লজ্জাও পেলো অনেক।কিন্তু সেসব পাত্তা না দিয়ে এক অদ্ভুত কাজ করে বসলো।সিট বেল্টটা খুলে গাড়ির সিটে হাঁটু ভর দিয়ে মেহরাদের মাথার দিকে এগিয়ে গেলো,মনে হচ্ছে কিছু যেনো খুঁজছে।মেহরাদ বুঝে উঠতে পারলো না স্রোতের কাজকর্ম,জিজ্ঞাসা করলো,
“কি করছেন?”
“দেখছি।”
“কি দেখছেন?”
“দেখছি আপনার কানের উপরে চোখ লাগানো আছে নাকি আপনি ক্যামেরা লাগিয়েছেন!”
স্রোতের কথা প্রথমে বুঝতে না পারলেও যখন সে বুঝতে পারলো তখন সে শব্দ করে হেসে ফেলে।যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে ভেবে গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষলো।ব্রেক কষতেই স্রোত সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়তে নিতেই মেহরাদ তাকে দু হাতে ধরে বুকে জড়িয়ে ফেললো।মেহরাদের হাসি থামছেই না।আর এদিকে স্রোতের অবস্থা খারাপ,তার মাথা মেহরাদের বুকে,সে মেহরাদের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে।মেহরাদের পারফিউমটার মাতাল করা গন্ধ,স্রোত যেনো তলিয়ে যাচ্ছে।স্রোত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানে,সে “ছাড়ুন” বলে এক ধাক্কা দিয়ে মেহরাদকে সরিয়ে পাশের সিটে গিয়ে বসে পড়লো।কথা ঘুরাতে বললো,
“তাড়াতাড়ি বাসায় চলুন।আমার ক্লাস আছে সাতটায়।”
“ইশশশশশ কি সুন্দর মুহুর্তটা!!বুঝে উঠার আগেই নষ্ট করে দিলেন।” নাটকীয়ভাবে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো মেহরাদ।
“অ সভ্য লোক।”
“আপনার কাছেই তো।পুরো পৃথিবী জানুক আমি সভ্য,গম্ভীর,শুধু আপনি জানুন আমি কতটা অ সভ্য,পা গল,মা তাল।”
স্রোত নিরব রইলো।বাসার সামনে গাড়ি এসে থেমেছে।স্রোত নামার আগে বললো,
“ধন্যবাদ মেজর সাহেব,আমাকে এতো সুন্দর একটা রাত উপহার দেওয়ার জন্যে।”
“আপনাকেও ধন্যবাদ আমাকে বিশ্বাস করে সুযোগ দেওয়ার জন্য।”

সন্ধ্যায় স্রোত মেডিকেল থেকে ফিরতেই মান্ধবী তাকে জানায় শুক্রবারে বাদ যোহর ওদের বিয়ে।মান্ধবী ভেবেছিলো স্রোত তাকে বিয়ের তারিখ এগিয়ে দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করবে।কিন্তু মান্ধবীর ভাবনা ভেঙ্গে চূড়ে তচনচ করে দিয়ে বিমূঢ় স্বরে “ওহ” বলে স্রোত ফ্রেশ হতে চলে যায়।মান্ধবী তো জানে না তার বোনই বিয়ের ডেট এগোনোর কথা বলেছে।
দু বাড়িতেই মহা ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে।যতোই ঘরোয়া বিয়ে হোক তবুও বিয়ে বলে কথা,কত আয়োজন।বনলতা বেগমের হাত এখন অনেকটাই ভালো,তবে ভারী জিনিস উঠানো বারণ।ডক্টরের মতে উনার সুস্থ হওয়ার প্রবণতা বেশি ছিলো বলোই সময়ের আগে ঠিক হয়ে গেছে। মেহরাদের বাড়িতে ওর চাচিআম্মা জাহানারা বেগম আর উনার ছেলে রায়হান ঐ দিন বিকেলেই চলে এসেছে।নোলক সাহেবের পরিবারের সবাই এসেছে পরেরদিন সকালে।স্রোতদের বাড়িতে স্রোতের মামা-মামী আর দূর সম্পর্কের এক ফুপি আছেন।আজ বুধবার,শুক্রবারে বিয়ে।বাড়ির পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে কোনো মহাউৎসব লেগে গেছে।সবার কেনাকাটা শেষ।শুধু স্রোতেরটা বাকি, স্রোত দিনের বেলায় ব্যস্ত থাকে বলে সে যেতে পারে নি।সে জানিয়ে দিয়েছিলো তার কোনো পছন্দ নেই,বাড়ির সবাই যা পছন্দ করবে তাই।কথানুযায়ী স্রোতের পরিবার কেনাকাটা করলেও বনলতা বেগম করেনি। তিনি স্রোতকে নিয়ে রাতে শপিংমলে যাবেন,করলেনও তাই।

সন্ধ্যার পরে মেহরাদ, বনলতা বেগম স্রোতদের বাড়ি থেকে মান্ধবী আর স্রোতকে নিয়ে যান।আউটলেটে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ পছন্দ-অপছন্দের শেষ তিনটে শাড়ী পছন্দ হয় উনাদের, একটার রঙ সাদা,আরেকটা লাল টুকটুকে আরেকটা লালচে খয়েরী।স্রোত বলে দিয়েছে বনলতা বেগমের যেটা পছন্দ সেটাই,তখন মেহরাদ টুকটুকে লাল শাড়ীটা নিয়ে বললো,
“মা এটা নাও,উনাকে ভালো লাগবে।”
শেষে এটাই নেওয়া হয়।আরো যা যা লাগে সব কিছু নিয়ে আউটলেট থেকে বেরিয়ে যায় সবাই। এখন গয়নার দোকানে যাওয়ার পালা,পুরনো অনেক গয়না থাকলেও নতুন বউকে নতুন গয়না তো দিতেই হবে। তখন মেহরাদ বলে,তোমরা যাও,আমি একটা কাজ সেরে আসছি।

কেনাকাটা শেষে রাতের খাবার সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে যায়।ফ্রেশ হয়ে শুতেই মেহরাদের ফোন।স্রোত প্রথমেই রিসিভ করলো না,তার কেন জানি ভাল্লাগে মেহরাদকে অপেক্ষা করাতে।তিনটা কল শেষ হওয়ার পর চার বারের মাথায় সে রিসিভ করে সালাম দেয়,
“কি করছেন?”
“ঘুমোচ্ছি।আপনি কি করছেন?”
“কল্পনায় আঁকছি,ভাবছি,শুনছি আর চাচ্ছি”
“কাকে?”
“আপনাকে।”
“কেনো এতো চান আমায়?”
“কে বললো আপনাকে চাই?”
“তাহলে?”
“আমি নিজের সর্বনাশ চাই না।”
“আমাতে আঁটকেছেন?”
“কবেই।আপনি কবে আটকাবেন?”
“যদি না আটকাই?”
“জোর করে বেঁধে নিজের সাথে আটকাবো।”
“বিয়ে না করে যদি পালিয়ে যাই?
” পৃথিবী তচনচ করে দিবো,গুড়িয়ে দিবো সব।” শক্ত গলায় জবাব দেয় মেহরাদ।
“ভালোবাসেন?”
“তোমাকে কাছে পেতে চাওয়া যদি তোমাকে ভালোবাসা হয়,তাহলে আমি তোমাকে ভালোবাসি।তোমাকে নিজের করে পাওয়ার ইচ্ছে যদি তোমাকে ভালোবাসা হয়,তাহলে আমি তোমাকে ভালোবাসি।তোমাকে নিজের নামে দলিল করে নেওয়ার ইচ্ছে যদি ভালোবাসা হয়,তাহলে আমি তোমাকে ভালোবাসি।তোমাকে নিজের পাশে নিজের অর্ধাঙ্গিনীরূপে দেখার প্রবল ইচ্ছে যদি ভালোবাসা হয়, তাহলে আমি তোমাকে ভালোবাসি স্রোতস্বিনী।”

স্রোত যেনো এই উত্তর আশা করেনি।মা*দকতা মেশানো এই নে*শাক্ত কন্ঠ শুনে ওর বুকটা ধ্বক করে উঠে,ওর বাম হাতটা নিজে নিজেই বুকে চলে যায়।জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে।ঐ পাশের মানুষটা যেনো ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো।নিজে নিজে হেসেই আবার সম্বোধন করলো,
“স্রোতস্বিনী…”
স্রোত খট করে কলটা কেটে দিলো।আর সহ্য হচ্ছে না।সে বুঝতে পারছে না এই বয়সে এমন কিশোরী বয়সের অনুভূতির মানে কি?তবে কি তার জীবনে প্রেম এসে ধরা দিলো?সে কি মেহরাদের প্রেমে পড়ে গেলো?

মেহরাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে হয়তো ফোনের ওপাশের স্রোতের চেহারাটা কল্পনা করেছে।
মনে মনে আওড়ালো,

“আপনি চান বা না চান আপনি আমার প্রেমে পড়ে গেছেন স্রোতস্বিনী,আমাতে আটকে গেছেন।আপনাকে আমার নামে লিখে নিবো স্রোতস্বিনী,অপেক্ষা একদিনের।”

#চলবে….