স্রোতস্বিনী পর্ব-১১

0
141

#স্রোতস্বিনী
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
পর্ব ১১ (হলুদ স্পেশাল)

স্রোতদের পরিবারে স্রোত-মান্ধবী দুইজনই মেয়ে,আর কেউ নেই। তাই স্রোতের বিয়ে সাদামাটা ভাবে হবে এটা স্রোতের বাবা-মামা কেউই চান না।কিন্তু সময় কম।আবার,মান্ধবী বায়না ধরেছে বিয়ে ঘরোয়া ভাবে হোক, হলুদে একটু আনন্দ করতে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে হলুদের অনুষ্ঠান একটু জমজমাট হবে।হলুদের আসর বসে ওদের বাড়ির ছাদে।স্রোতের বিয়ে উপলক্ষে স্রোতের কয়েকজন বান্ধবী রিমা,নুড়ি,সোহানা চলে এসেছে।স্রোতের কোনো ঘনিষ্ঠ বান্ধবী না থাকলেও এদের সাথেই ওর চলাফেরা। মা মা রা যাওয়ার পর তো সে জীবন থেকে সব রঙ মুছে ফেলেছিলো।এখন মেহরাদ আবার সেই রঙ ফিরিয়ে আনছে।তাছাড়া,
মান্ধবীর ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই নাহিদা, তিথি,তানজিনা, তামান্না,মহিমা চলে এসেছে।এদের এই গ্রুপটাকে অনেক মজার,যেখানে যায় সেখানটা মাতিয়ে রাখাই তাদের কাজ।তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা সবাই মিলে নাচবে।তাই তারা সকাল থেকেই রিহার্সাল করছিলো। তাদের দেখাদেখি স্রোতের বান্ধবীরাও জানায় তারাও নাচবে।স্রোত যেনো নিরব দর্শক,সে সব দেখেই যাচ্ছে।কেউ একজন বলেছিলো না?”যার বিয়ে তার খবর নাই,পাড়া পড়শীর ঘুম নাই?স্রোতের এখন ঠিক তেমনই লাগছে।তার মন চাচ্ছে ঐ লোককে একটা অ্যাওয়ার্ড দিতে।

ঐদিকে সিরাজ সাহেব বনলতা বেগমকে জানিয়ে দিয়েছেন হলুদের অনুষ্ঠানের কথা আর এটাও বলেছেন বাড়ির বড়রা না আসলেও ছোটরা সবাই যাতে আসে।বনলতা বেগম জানিয়েছেন ছোটরা যাবে।

সন্ধ্যাবেলা,বাড়িতে হুলস্থুল কান্ড,বিয়েবাড়ি বলে কথা।সিরাজ সাহেব এই ভবনের সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছেন। তার স্ত্রীর মেয়েদের বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো।আগে যত যাই করুক না কেনো এখন তিনি পরিবর্তন হয়ে গেছেন। তারও ইচ্ছে ছিলো ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিবেন।কিন্তু হুট করেই সব হয়ে গেলো,হাতে সময় নেই।তাই অল্প সময়ে যতটুকু করা সম্ভব সব করবেন তিনি।তাছাড়া স্রোতের মামাও নিঃসন্তান। স্রোত-মান্ধবীই উনার সব,উনারও ইচ্ছে যতটুকু করা সম্ভব, সব করার।
ছাঁদে স্টেজ করা হয়েছে,পুরোটা ছাঁদ মরিচবাতি আর ফুলে সাজানো হয়েছে।মেয়েরা সবাই সাজতে ব্যস্ত।স্রোত সাজতে না চাইলে মান্ধবী তাকে ধম কে জোর করে সাজায়।ধম কে বলে উঠে,
“তোর বিয়ে কি প্রতিদিন হবে?এতো ঘ্যানঘ্যান করছিস কেন?কত প্ল্যানিং ছিলো তোর বিয়ে নিয়ে,তার কিছুই হয়নি।এমনিতেই মেজাজ খারাপ,তুই আরো খারাপ করিস নি।”

বোনের কথা শুনে স্রোত আর বাঁধা দেয় নি,করুক যা ইচ্ছে, দু’টো দিনই তো। স্রোতকে হলুদ আর কলা পাতা রঙের শাড়ী পড়ানো হয়েছে,হলুদ গোলাপের গহনা দিয়ে তাকে সাজানো হয়েছে।হলুদ গোলাপ স্রোতের অনেক পছন্দের।সব মেয়েরা হলুদ রঙের শাড়ী পড়েছে।একে একে সব মেহমানরা, পরিবারের সবাই ছাঁদে চলে গিয়েছে,অপেক্ষা নতুন কনের।মেয়েদের সবার সাজগোজ শেষ হলে তারা ছাঁদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে।মান্ধবী তো বোন দেখে নাটকীয় স্বরে বলতে শুরু করে,
“হায় আপু তোকে দেখে তো আমি ফিদা।এতো সুন্দর কেনো তুই?মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ। আমি যদি ছেলে হতাম আর তোর বোন না হতাম সিউর মেহরাদ ভাইকে কি ড ন্যাপ করে তোকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম।”
মান্ধবীর কথা হাসির রোল পড়ে যায়।স্রোত বোনকে জড়িয়ে ধরে।যতই হাসিখুশি থাকুক না কেনো মান্ধবীর যে বোনের জন্য কষ্ট হচ্ছে তা তো স্রোত বুঝতেই পারছে।

সবাই স্রোতকে ছাঁদে নিয়ে স্টেজে বসিয়ে দেয়।তারপর যত নিয়ম কানুন আছে সব শেষ করা হয়।মায়ের পরিবর্তে স্রোতের মামী সব করেন।উনার কোনো সন্তান নেই বলে স্রোত-মান্ধবী উনার কাছে উনারই সন্তান। স্রোত যখন পৃথিবীতে আসে তখন ওর মায়ের কিছু জটিলতার জন্যে প্রায় ১ মাস স্রোত তার মামীর কাছে ছিলো।এই দুধের শিশুর সব কাজ, সব দায়িত্ব তখন উনার ছিলো।যার জন্যে স্রোতের প্রতি তার ভালোবাসা একটু বেশিই।বিয়ে বাড়িতে স্রোতের মায়ের দায়িত্ব উনিই পালন করছেন।নিয়ম কানুন শেষে উনি স্রোতের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“সুখী হ মা।নতুন জীবনে পা রাখছিস,নতুন সংসার, নতুন দায়িত্ব, সব ঠিকঠাক করে সামলে নিস।”
বলতে বলতে উনার চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। স্রোত উনাকে জড়িয়ে ধরে।
সব নিয়ম কানুন শেষ, এখন আনন্দ করার পালা।প্রথমেই স্রোতের বান্ধবীরা নাচবে বলে ঠিক হয়,তারপর মান্ধবীর দল।সাউন্ডবক্সে গান চালু হলে ওরাও তাল মিলিয়ে নাচতে শুরু করে—–

“কন্যা যে বধূ সাইজাছে রে
আজ তারে ফ্যান্টাস্টিক লাগতাছে।”

নাচ শেষে সবাই যখন হাত তালিতে ব্যস্ত। তখন হঠাৎ আরেকটা গান বেজে উঠে।
Yaara teri kahaani mein ho zikr mera
Kahi teri khaamoshi mein ho fikr mera

সবাই অবাক হয়ে যায়, কারণ ওদের স্ক্রিপ্টে এই গান ছিলো না।মান্ধবী তখন স্রোতের পাশে বসা।হঠাৎ দেখে গানের তালে তালে ছাদের দরজা দিয়ে কিছু মানুষ হেঁসে প্রবেশ করছে।সামনে মেহরাদ, তার দুই পাশে রিহানা, নয়না আর তাদের পেছনে রায়হান, আরিফ,নবীন।মেহরাদের পড়নে কলাপতা রঙের পাঞ্জাবি, বাকিদের হলুদ রঙের। সবাই তাদের দেখে “ওওওও” বলে চিৎকার করে উঠে।স্টেজের সামনে এসে তারা গানের তালে তালে নাচতে শুরু করে।
O Maahi O Maahi O Maahi O Maahi
Meri wafa pe haq hua tera……
স্রোত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে,ঐ বাড়ি থেকে মানুষ আসবে এটা স্রোতের অজানা ছিলো।মেহরাদ নাচ করছে তার মুখে হাসি,চোখ স্রোতের চোখে আবদ্ধ।

Baaton ko behne do, baahon mein rehne do
Hai sukoon inmein…
Raste woh begaane, jhoote woh afsaane
Tu na ho jinmein….
Ho thodi umar hain pyaar zyaada mera
Kaise bataaye saara tera hoga?
…………..
……………
O Maahi O Maahi O Maahi O Maahi
Lo main qayamat tak hua tera….

অন্যদিকে,মান্ধবী আর ওর বান্ধবীরা একজনকে দেখে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।সবার মনে একটাই প্রশ্ন এই ব্যক্তি মেহরাদের সাথে এখানে কি করছে!এতোক্ষণ খুশি থাকলেও ঐ ব্যক্তিকে দেখে মান্ধবীর মন খারাপ হয়ে যায়।ঐ ব্যক্তি নাচে ব্যস্ত, সে এখনো মান্ধবীকে খেয়াল করে নি।মান্ধবীর মন খারাপ দেখে ওর বান্ধবীরা স্টেজে বসা অবস্থাতেই ওকে বলে যেনো মন খারাপ না করে,হলুদে মনোযোগ দেয়।

মেহরাদদের নাচ শেষ হলে সবাই হাততালি দেয় আর সে স্রোতের দিকে এগিয়ে যায়।সে স্রোতের দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দেয়, স্রোত ইতস্তত বোধ করছে।সবার দৃষ্টি ওদের দিকে।মেহরাদের মুখের ভঙ্গিমা, চোখ যেনো বলে দিচ্ছে,

“আমি অপেক্ষা করছি তো স্রোতস্বিনী।হাত ধরুন,উঠে আসুন।”

স্রোত মেহরাদের হাতে হাত রাখে।মেহরাদ তাকে স্টেজের সামনে নিয়ে এসে হাত ছেড়ে দেয়।স্রোত আর বাকি সবাই মেহরাদের দিকে তাকিয়ে আছে,বোঝার চেষ্টা করছে আসলে সে কি করতে চায়! স্রোতের হাত ছেড়ে দিয়ে মেহরাদ এক হাটু ঘেরে বসে স্রোতের দিকে একটা ডায়মন্ডের রিং এগিয়ে দেয় আর বলে,

“উইল ইউ বি মাই বেটার হাফ্, স্রোতস্বিনী? সারাজীবনের জন্য আমাকে আপনার স্রোতে গা ভাসানোর জন্যে সম্মতি দিবেন,স্রোতস্বিনী?”

মেহরাদের কথা শুনে সবাই স্রোতের দিকে তাকায়।স্রোত শান্ত দৃষ্টিতে মেহরাদের মুখপানে তাকিয়ে আছে।মেহরাদ স্রোতের উত্তরের অপেক্ষায়,চোখ যেনো বলে দিচ্ছে,
“এতো সময় নিচ্ছেন কেনো স্রোতস্বিনী? তাড়াতাড়ি করুন!”

স্রোত এবার তার বা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে শান্তভাবেই বলে উঠে,
“ইয়েস,আই উইল।”

মেহরাদের অধর প্রসারিত হলো, চোখেমুখে প্রশান্তির ছোয়া। সবাই চিৎকার করে উঠলো।মেহরাদ স্রোতের বা হাতের অনামিকায় রিং টা পড়িয়ে দিলো।

এখন স্রোতের পাশে মেহরাদকে বসানো হয়েছে।বাকিদেরও আপ্যায়ন করা হয়েছে।এর মাঝেই ঐ ব্যক্তি মান্ধবীকে খেয়াল করে,সেও বুঝে উঠতে পারে না মান্ধবী এখানে কি করছে!এবার মান্ধবীদের নাচের পালা।মান্ধবীরা নাচবে আর এদিকে স্রোতকে মেহেদী দেওয়া হবে।মান্ধবী নিজেই গেয়ে উঠলো-
হেই চাঁদ উঠেছে ঐ,
ফুল ফুটেছে ঐ,
সোনার মেয়ে নাচবে কি
মাথার চুল খুলে?
ঘর সাজাবো কই?
ফুল সাজাবো সই।
সাদা সাদা আলপনাতে,
জবা ফুল তুলে
—————
————–
সোহাগ চাঁদ বদনী ধ্বনি
নাচো তো দেখি,
বালা নাচো তো দেখি…

মেহেদী দেওয়ার পুরোটা সময় মেহরাদ এক দৃষ্টিতে স্রোতের হাতের দিকে তাকিয়ে ছিলো।আরেকটা চমৎকার ব্যাপার হলো,মেহরাদ একটা ডিজাইন করিয়েছে ওর বাম হাত আর স্রোতের ডান হাত মিলিয়ে,যেটার শুরু মেহরাদের হাতে আর শেষ স্রোতের হাতে।স্রোত চুপচাপ মেহরাদের কান্ড দেখেছে।স্রোতের বান্ধবীরা তো হেঁসে কুটিকুটি, একজন তো স্রোতের কানে কানে বলেই দিলো,
“স্রোত জিতেছিস।”

অনুষ্ঠান শেষে সবার খাওয়া-দাওয়ার পালা।সবাই নিচে চলে যায়।মেহরাদ স্রোতের পরিবারের সবার সাথে তার ভাই-বোনকে পরিচয় করিয়ে দেয়।রিহানা রায়হানের ছোট বোন,কলেজ খোলা থাকায় সে আজ বিকেলে আসছে।পরিচয়পর্ব শেষে মান্ধবী বুঝতে পারে সেই ব্যক্তি মেহরাদের চাচাতো ভাই।

মান্ধবী খেয়াল করলো তার ফোনটা তার হাতে নেই,ছাঁদে ফেলে এসেছে।সে ছাঁদে চলে যায় ফোন আনতে।ঐ ব্যক্তিও মান্ধবীর পেছন পেছন ছাঁদে চলে যায়। মান্ধবী ফোন নিয়ে পেছনে ঘুরতেই দেখতে পায় রায়হান তার সামনে দাড়ানো। হঠাৎ রায়হানকে তার পেছনে দেখে সে ভয় পেয়ে যায়।তবুও তাকে এড়িয়ে চলে যেতে সামনের দিকে কদম ফেলে মান্ধবী।কদম ফেলতেই রায়হান তার পথ আটকায় এবং শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“তোমাকে আবার খুঁজে পাবো কখনো ভাবি নি।”
“খুঁজেছেন নাকি?”
“অনেক খুঁজেছি,অনেক।তোমার ফ্রেন্ডরা কেউ তোমার খোঁজ দেয় নি।”
“আমি নিষেধ করেছিলাম।”
“হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার কারণ?”
“আপনার অজানা নয়।বাদ দিন,কেমন আছেন রায়হান ভাই?” তাচ্ছিল্যের সাথে জিজ্ঞাসা করে মান্ধবী।
“ভালো।”আকাশের দিকে বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে রায়হান।
“ইরা আপু কেমন আছে?বিয়ে করবেন কবে?যাক আত্মীয় হয়ে গেলাম, বিয়ের দাওয়াত পাবো।” স্মিত হেসে বলে মান্ধবী।
মুখে সবসময় হাসি রাখা প্রয়োজন।এই হাসি শ ত্রুকেও কনফিউজড করে দেয়।
মান্ধবীর মুখে হাসি দেখে রায়হান অবাক হয় বটে।এক বছর আগে যে মেয়েটা তার পেছনে পা গ লের মতো ঘুরতো,ইরার সাথে সম্পর্ক আছে শুনে যে মেয়েটা সবার সামনে কান্না করেছিলো,সেই মেয়েটা তার সামনে দাড়িয়ে হেঁসে হেঁসে দাওয়াত চাচ্ছে।বুক ভরা নিঃশ্বাস ফেলে রায়হান বলে,
“ঐ দিনের এক উইক পরেই আমি জানতে পারি ইরা আমাকে ঠকিয়েছে।শী ওয়াজ ইন অ্যা রিলেশনশিপ উইদ অ্যানাদার ওয়ান।শী চিটেড উইদ মি।”

মান্ধবী বিস্ময়কর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।তারপর হেঁসে ফেললো,
“তাই বুঝি আমাকে খুঁজছিলেন?”
“তুমি হাসছো কেনো?”
“এই যে আপনি আমাকে অপশন হিসেবে খুঁজছিলেন।”
“তুমি চলে যাওয়ার পর আমি বুঝেছিলাম আমি তোমাকে মিস্ করছি।প্রতিদিন কোচিং এ আমার দিকে ঢ্যাপ ঢ্যাপ করে তাকিয়ে থাকা, ভালোবাসি ভালোবাসি বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা মেয়েটাকে আমি মিস্ করছিলাম।”
“আপনি ইরা আপুকে ভালোবাসতেন। সবার সামনে বলেছিলেন।”
” এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো।সে আমাকে ঠকিয়েছে।” শক্ত গলায় বলে রায়হান।
মান্ধবী চুপ করে রইলো।রায়হান এবার মান্ধবীর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“আমাকে কি এখনো ভালোবাসো মান্ধবী?”
এই প্রশ্ন আশা করে নি মান্ধবী। সে সময় নেয়,স্মিত হেঁসে বলে,
“পৃথিবীর কত অদ্ভুত নিয়ম তাই না রায়হান ভাই?আমরা যাকে ভালোবাসি সে ভালোবাসে আরেকজনকে,সেই আরেকজন আবার ভালোবাসে অন্যজনকে।আমরা কেউই মনের মানুষটাকে পাই না।কোথাও কেউ নেই আসলে।”

কথাটা বলে মান্ধবী নিচে চলে যায়।তার টলমলে চোখগুলো রায়হান দেখতে পায় না।সে মান্ধবীর যাওয়ার পানে চেয়ে আছে।মান্ধবীর শেষ কথাটা ভাবতেই রায়হানের অধর প্রসারিত হয়।সে মান্ধবীর যাওয়ার পানে চেয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
“এবার তোমাকে হারাতে দিবো না আমি,মান্ধবী। নিজের করা ভুল নিজেই এবার শুধরে নিবো।এক বছর ভুলের শা স্তি ভোগ করেছি,এবার প্রায়শ্চিত্ত করার পালা।”

মান্ধবীর রুমটা বেশি বড় হওয়ায় সবাই এই রুমে আড্ডা দিতে বসেছে।ড্রইংরুমে বড়রা আছে বলে তারা সবাই এই রুমে চলে আসে।এখন বাজে রাত বারোটা। বাড়িতে এই তরুণরা ছাড়া আর কেউ নেই।বড়রা সবাই যার যার রুমে চলে গিয়েছে আগেই।মেহমান যারা ছিলো তারা এই বিল্ডিংয়েরই,তারাও যার যার বাসায় চলে গিয়েছে।স্রোতের এতো ভীড় ভালো লাগে না,কিন্তু কিছু করার নেই,সবাই জোর করে বসিয়ে রেখেছে।সে একবার বিরক্তি নিয়ে উঠতে নিচ্ছিলো,তখন মেহরাদ বলে,
“থাকুন না স্রোতস্বিনী, ভালো লাগছে তো।”

মেহরাদের কথা সে ফেলতে পারে না,কেনো জানি!সে বসে রইলো।সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত।এর মাঝে স্রোত বলে,
“তোমরা আনন্দ করো।আমি ফ্রেশ হতে যাই।এই ভারী সাজ-পোশাক আমার বিরক্ত লাগছে।”

সবাই জানে স্রোত কেমন,তাই এখন আর কেউ আটকায় নি।অনেক রাত হয়ে গিয়েছে,কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।মেহরাদের ভাই-বোনেরা জানিয়েছে,তারা একটু পর রওয়ানা হবে,বিয়ে বাড়িতে আনন্দ না হলে কি ভালো লাগে?ওদের বাড়িতে তো মনেই হয় না যে বিয়ে।
স্রোত চলে যাওয়ার একটু পরে মেহরাদও ওয়াশরুমের নাম করে বেরিয়ে যায়।টেবিলের উপর থেকে একটা বাটি নিয়ে স্রোতের রুমে চলে যায়।রুমে গিয়ে বুঝতে পারে স্রোত ওয়াশরুমে, সে দরজা লাগিয়ে রুমের আলো নিভিয়ে দেয়।
স্রোত হাত-মুখ ধোয়ার জন্য ওয়াশরুমে গিয়েছিলো।বেরিয়ে এসে রুম অন্ধকার দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে যায়,সে অন্ধকার ভয় পায়।ওয়াশরুমের আবছা আলো রুমে আসে,এতে স্রোত বুঝতে পারে রুমে কেউ আছে।সে রেগে ধমকে উঠে,
“কে এখানে?আমার এসব ফাজলামো একদম পছন্দ না।”

কারো সাড়াশব্দ নেই।স্রোত আবার কিছু বলতে যাবে তখনই টের পায় সেই মানুষটা তার পেছনে,মানুষটার গরম নিঃশ্বাস স্রোতের ঘাড়ে পড়ছে,সাথে অতিপরিচিত পারফিউমের ঘ্রাণ তো আছেই।মেহরাদ তার পেছনে বুঝতে পেরেই চকিতে পেছনে ফেরে সে আর বিস্ময়ের সাথে বলে,
“মেজর সাহেব আপনি এখানে?”

মেহরাদ হাসলো।কোনো কথা না বলে তার হাতের বাটিটা থেকে হলুদ নিয়ে স্রোতের গালে লাগিয়ে দিয়ে বললো,
“শুভ হলুদ স্রোতস্বিনী। ”

স্রোত যেনো অবাক হতেও ভুলে গিয়েছে।সে এখানে হলুদ লাগাতে এসেছে? মেহরাদ এবার রুমের আলো জ্বালিয়ে বিছানায় বসে বলতে শুরু করলো,
“আমার বিয়ে,আমার হলুদ সন্ধ্যা,আমার বউ আর আমি নাকি হলুদ ছোঁয়াতে পারবো না।এটা কি ঠিক আপনিই বলুন স্রোতস্বিনী?”
স্রোত আগের জায়গাতেই দাড়িয়ে আছে,সে বিস্ময় নিয়ে মেহরাদের কথা শুনছে। মেহরাদ আবার বললো,
“ঐখানে দাড়িয়ে আছেন কেনো?এখানে আসুন,আমাকে হলুদ লাগিয়ে দিন।সময় নেই,চলে যাবো তো এখন।”

স্রোত সামনে হেঁটে গিয়ে বললো,
“আপনি কি আসলেই পা গল?”
“বউয়ের সাথে পাগ লামি করবো না তো কার সাথে করবো, আজিব!নিন নিন হলুদ লাগিয়ে দিন।আপনি আমায় হলুদ না লাগালে হলুদ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে না তো।”

কিছু একটা মনে করে মেহরাদ আবার বললো,
“এই ওয়েট ওয়েট,আপনার হাত দুটো দেখি মেহেদীর কেমন রঙ ধরেছে।”

স্রোত হাত বাড়িয়ে দেয়।হাত দেখে মেহরাদ আনন্দের সাথে বলে,
“মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর রঙ ধরেছে।জানেন তো,কনের মেহেদীর রঙ যত গাঢ় হয় স্বামী নাকি তত বেশি ভালোবাসে।দেখুন আপনার মেহেদীর রঙ কতটা গাঢ় হয়েছে।তবুও আপনি বুঝলেন না আমি আপনাকে কতটা ভালোবাসি।”

শেষের কথাটা নাক টেনে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে মেহরাদ।মেহরাদের কান্ডে স্রোত হেঁসে ফেলে।তখন আবার বলে,
“হাসবেন না, সত্যি বলেছি।নিন এখন আমায় হলুদ লাগিয়ে দিন তো।”

হলুদের বাটিটা স্রোতের সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো মেহরাদ।
মেহরাদের পা গলামি গুলো স্রোতের ভাল্লাগছে,খুউউউউব ভাল্লাগছে।সে বাটি থেকে হলুদ নিয়ে মেহরাদের গালে ছুঁয়ে দিলো।মেহরাদ হাসলো,প্রশান্তির হাসি।
এবার সে উঠে দাড়িয়ে বললো,
“আজ আসি।কাল আপনাকে নিজের নামে লিখে নিতে চলে আসবো।কাল থেকে আপনি আমার,পুরোটাই আমার স্রোতস্বিনী,একান্তই আমার।”

মেহরাদ দরজা খুলতেই দেখতে পায় দরজার বাহিরে সবাই কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ানো।মান্ধবী দুষ্টুমি করে বললো,
“ভাইয়া এটা আপনার ওয়াশরুম?”

মান্ধবীর কথা শুনে সবাই জোরে হেঁসে ফেললো।মেহরাদ বোকা হাসি দিয়ে একবার পেছনে স্রোতের দিকে তাকায়, তো একবার বাহিরে সবার দিকে তাকায়।স্রোত কটমট করে মেহরাদের দিকে তাকিয়ে আছে,যেনো চোখ দিয়েই জ্বালিয়ে দিবে।এর মাঝেই নবীন, আরিফ আর রায়হান মেহরাদকে ধরে বলে,
“ভাই আমাদের বাসায় অনেক ওয়াশরুম আছে,তুমি তাড়াতাড়ি চলো।”

এই কথা শুনে আরেক দফা হাসির রোল পড়ে যায়।ওরা চলে যায়।স্রোত শান্ত ভঙ্গিতে দরজার সামনে আসলে দেখতে পায় বিচ্ছুবাহিনী হাসছে।স্রোতকে দেখতেই বলে উঠে,

“তুমি ওয়াশরুমে কি করছো স্রোত আপু?”

স্রোত ওদের কথার মানে বুঝতে পেরে “ধ্যাত” বলে মুখের উপর ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়।সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে জোরে হেঁসে ফেললো।

#চলবে…..