সৎ মা পর্ব-১১+১২

0
319

#সৎ_মা
#পর্বঃ১১
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

ইকবাল সাহেব কোনোরকম নিজেকে সামলে রুমের ভিতরে গেলেন। সিলিং ফ্যান চালু করে বিছানায় বসলেন। মন মস্তিষ্ক তার এলোমেলো হয়ে আছে। মাথার উপর সিলিং ফ্যান শাঁই শাঁই করে ঘুরছে। তারপরও ওনার শরীর বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগলো।পাশের সেন্টার টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে পান করলেন। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্থির করে পুনরায় মেসেজটি পড়তে লাগলেন ওনি।

” প্রিয় বাবা,

জানো বাবা, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি? আবার তোমার প্রতি সমপরিমাণ ঘৃনাও অনুভব করি। বাবা, তোমার নীল রঙের মোটা কভারের ডায়রিটা আমার কাছে। তোমার বুকসেল্ফের এককোণে খুব সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলে। তোমার বই পড়ুয়া মেয়ে যে বই খুঁজতে গিয়ে পেয়েই গেলো ডায়রিটা। মায়ের প্রতি তোমার সকল অনুভূতির কথা লিপিবদ্ধ করেছো বলেই হয়তো ডায়রিটা আগুনে পুড়ানোর সাহস তোমার হয়নি।তুমি ঠিক বলেছিলে বাবা, মানুষ যেমন আবেগ অনুভূতির কথা ডায়েরি তে লিখে তেমনি সে তার জান্তে, অজান্তে, ইচ্ছাকৃত এবং অনিচ্ছাকৃত করা সকল অপরাধের কথাও লিখে রাখে। তেমনি তোমার এই ডায়রিটাও সবকিছুর সাক্ষী। মায়ের সাথে তোমার প্রথম দেখা তারপর বিয়ে, মায়ের প্রতি অনুভব করা প্রতিটা মুহূর্তের অনুভূতির কথা, কাটানো সময়ের কথা আমার পৃথিবীতে আসার কথা যেমন লিপিবদ্ধ করেছো ডায়রিতে, তেমনি মা কে খু’ন করার কথাও লিপিবদ্ধ করেছো। কাঁপা কাঁপা হাতে লিখেছো লেখা গুলো। হয়তো তখন তোমার ডায়রি লিখার অভ্যাস ছিলো বলে না চাইতেও এগুলো লিখে ফেলেছো।জানো বাবা, প্রথম যেদিন জানতে পেরেছিলাম কথাটা আমার যেন পুরো পৃথিবীটাই উল্টে গেল। তুমি নাকি শর্ট টেম্পার ছিলে। অল্পতেই রেগে যেতে। আর তোমার রাগই আমার মাকে এই পৃথিবী থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিলো।এক ঠুনকো বিষয় নিয়ে ঝগড়া করলে।তারপর রাগারাগির এক পর্যায়ে সিঁড়ি থেকে মা কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের ফলে মা আমার মা’রা গেলো। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে না বাবা? ওই যে, “রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।” আসলেই বাবা তুমি হেরে গেছো। তুমি তোমার জীবনের কাছে হেরে গেছো। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তুমি একজন সফল পুরুষ হলেও, আভ্যন্তরীন দৃষ্টিতে তুমি ব্যর্থ একজন পুরুষ। তুমি ব্যর্থ একজন স্বামী আর ব্যর্থ একজন পিতা। মা নাকি তোমাকে হাজার বার বলেছিলো রাগ কমানোর জন্য। অথচ আমার মাই তোমার রাগের স্বীকার হলো। মা যখন মা’রা গেলো সে তখন আবারও অন্তর্সত্ত্বা ছিলো। সেদিন তুমি মায়ের অযথা ঝগড়া না করলে আজ আমাদের একটা সুখী পরিবার থাকতো। আমাকে এভাবে ধুঁকে ধুঁকে ম’র’তে হতো না। মায়ের মৃ’ত্যু’র পর তুমি একেবারেই শান্ত হয়ে গেলে। আমার রাগি বাবার রাগ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। এই পরিবর্তন মা বেঁচে থাকতে করলে কি খুব ক্ষতি হতো, বাবা? আগেই এই পরিবর্তনটা নিজের ভেতর করলে আজ আমার মা বেঁচে থাকতো। তোমায় এমন অন্তর্দহনে পুড়তে হতো না৷ মায়ের মৃ’ত্যু’র মাস কয়েক পরে এভাবে রাতারাতি বিয়ে করে পালিয়ে আসতে হতো না। তুমি তোমার জন্মস্থান আমার জন্মস্থান ছেড়ে চলে এলে এইখানে। যদি কখনো ধরা পড়ে যাও তাই। কিন্তু বাবা শেষ রক্ষা কি হলো? বাবা সত্য কোনোদিন চাপা থাকে না। জানো বাবা, আমি কাঁদছি। খুব করে কাঁদছি। নৈঃশব্দের কান্না। যদি একটু হাউমাউ করে কাঁদতে পারতাম খুব হালকা লাগতো। আজ মাকে খুব মনে পড়ছে৷ মা বেঁচে থাকলে আমার একটা পিঠোপিঠি ভাই হতো নাকি বোন হতো? আমরা বুঝি সারাদিন খুব ঝগড়া করতাম? আজ আমার জীবনের এই বিশেষ আমার মা আমার পাশে নেই। দু’হাত তুলে দোয়া করার মানুষ নেই। সদরদরজা অব্দি এগিয়ে দেওয়ার মানুষ নেই। বুকে জড়িয়ে কান্না করার মানুষ নেই। সেজন্য তোমার ওই বাড়ি নামক জাহান্নাম থেকে সারাজীবনের জন্য বিদায় নিয়ে এলাম। তুমি নিজেও কাঙ্গাল হয়েছো আর আমাকেও কাঙ্গাল করেছো। কতবার মনে হয়েছে তোমার শাস্তি পাওয়া দরকার। পরক্ষণে ভাবলাম যার বিবেক তাকে প্রতিনিয়ত শাস্তি দিচ্ছে আমি তাকে নতুন করে কি শাস্তি দিবো। এটা জরুরি না যে মানুষ জেলে গিয়ে শাস্তি ভোগ করে। চার দেয়ালের বাইরে মুক্ত ভাবে থেকেও মানুষ শাস্তি ভোগ করে। আজ থেকে মনে করো তোমার বড় মেয়ে মা’রা গেছে। এটাই তোমার শাস্তি আমার তরফ থেকে। ভালো থেকো বাবা।

ইতি
তোমার বড়,,,,,,

কি হই সেটা না হয় নাই বা বললাম।”

ইকবাল সাহেবের চোখের পানিতে বুকের উপরাংশ ভিজে গিয়েছে। তিনি বসা থেকে উঠে আলমারির কাছে গেলেন। লক খুলে আলমারির গোপন লকার থেকে বহু বছরের পুরোনো সাদা কালো এক কিশোরীর ছবি বের করলেন। তারপর সেই ছবি বুকে নিয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। মিনিট বিশেক কান্নার পরে সেই ছবিটা নিজের সামনে আনলেন। আলতো হাতে এতে হাত বুলিয়ে ছবির সাথে কথা বলতে লাগলেন,

“আমাদের ইনসিয়া অনেক বড় হয়ে গেছে সালেহা। আজ ওর বিয়ে ছিলো। জানো সালেহা, তোমার মেয়ে আমাকে কি মেসেজ পাঠিয়েছে? আমি নাকি জীবনের কাছে হেরে গেছি। আসলেই সালেহা আমি আমার জীবনের কাছে হেরে গেছি।তোমার কাছে হেরে গেছি। তোমার ভালোবাসার কাছে হেরে গেছি। আমি স্বামী হিসেবেও ব্যর্থ আর বাবা হিসেবেও। আমি তোমায়ও খু’ন করেছি আর আমার অনাগত সন্তানটাকেও। আমাকে তুমি মাফ করবে তো সালেহা? তোমার মেয়ে আমায় শাস্তি দিয়েছে সালেহা। আমি জানি না মেয়েটা আমার আর কখনো বাবা বলে ডাকবে কি না। কোনো দিন এই দূরত্ব ঘুচবে কি না৷ ও যে আমার প্রথম সন্তান। তবে আজ আমার বুক থেকে অনেক বড় পাথর নেমে গেলো। আমি যার কাছে অপরাধী সে স্বয়ং আমায় শাস্তি দিয়েছে।”

____________________________________________

মোবাইলটা বুকে নিয়ে কাঁদছি আমি। আরজার দাদির রুমের সাথে এটাচ একটা বারান্দা আছে। সেখানেই বসে আছি আমি। সেই মুহূর্তে আরজা দাদি আমায় ডাকলো।

“ইনসিয়া তুমি কি বাথরুমে? সেই কখন বিছানা ছেড়ে গেলে এখনো যে এলে না।”

চোখে পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলাম। তারপর রুমে গিয়ে ওনাকে বললাম,

“আসলে হয়েছে কি আমি না আমার বিছানা ছাড়া সহজে ঘুমোতে পারি না। সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশে এসেছি তো তাই ঘুম আসছে না।”

আবছা আলোয় ওনার মুখভঙ্গি বুঝতে পারলাম না। ওনি আমার শুনে বললেন,

” তুমি কি কান্না করছিলে?”

ওনার কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি জবাব দিবো বুঝতে পারছি না।তাই মাথা নিচু করে চুপ করে আছি। উত্তর দিচ্ছি না বলে ওনি আবার বললেন,

“তোমার মা কি তোমাকে রোজ তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতো?”

আমি মাথা তুলে তাকালাম ওনার দিকে। চেপে রাখা কান্না টা যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে। ওনার হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি বাধ্য মেয়ের মতো ওনার কাছে গিয়ে বসতেই ওনি আমার মাথাটা ওনার কোলে রাখলেন। নমনীয় স্বরে বললেন,

“মনে করো আজ থেকে আমি তোমার মা। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি তুমি ঘুমাও। একটু পরেই সকাল হয়ে যাবে। আমি এই সংসারের দায়িত্ব তোমার হাতে একটু রেস্ট নিবো।”

আমি আহ্লাদী গলায় প্রশ্ন করলাম,

“আমি আপনাকে মা বলে ডাকবো নাকি মামনী বলে?”

ওনি আমার কথায় হেসে উঠলেন। মুখে হাসির রেখা টেনে উত্তর দিলেন,

“তোর মন চায় ডাক। মা বলেও ডাক মামনী বলেও ডাক। আমার খুব শখ ছিল একটা মেয়ের। কিন্তু সোলাইমানের জন্মের পর আর কনসিভই করতে পারলাম না। তোকে দিয়েই না হয় মেয়ের স্বাদ পূর্ণ করবো।”

ওনি আমার মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। মায়েদের ছোঁয়ায় বুঝি এতো ভালোবাসা থাকে। প্রতিটা স্পর্শ যেন মায়া মমতায় ঘেরা। ওনার স্পর্শে যেন আমার অক্ষি যুগলে নিদ্রা নেমে এলো। হঠাৎই আরজার চিৎকারে আমি ধড়ফরিয়ে উঠলাম। মা ও উঠে বসলো। নিশ্চয়ই আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ওনার চোখ লেগে গিয়েছিলো। দ্রুত আমি আর মা ড্রয়িং রুমে আসলাম। আরজার বাবা আরজার কান্না থামানোর জন্য চেষ্টা করছে। আমাদেরকে দেখে বললো,

“দেখো না মা ও হাতের যন্ত্রণায় ঘুমোতে পারছেনা। কেমন যেন করছে। আমার খুব ভয় করছে মা। আমার অবুঝ মেয়েটা কত কষ্ট পাচ্ছে।”

ওনার কোল থেকে আরজা কে আমার কোলে নিয়ে এলাম। ওনাকে বললাম,

“আমি তো এই বাসার কিছুই চিনি না। দয়া করে ওর খাবার টা যদি বানিয়ে আনতেন।কাল থেকে আর বলবো না।”

ওনি ছুটলেন রান্নাঘরের দিকে। মা কে বললাম,

“মা আপনিও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।আরজা কে আমি দেখছি। পরে দেখা যাবে ছোট মেয়ের পাশাপাশি বড় মেয়েও অসুস্থ হয়ে গেছে। ”

মা আমার কথায় মুচকি হেসে স্থান ত্যাগ করলো। আরজা চোখ খুলে আমাকে দেখে কান্না বন্ধ মনযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। কিন্তু চোখে পানি টলমল করছে। হয়তো মনে মনে ভাবছে আমি এখানে কি করছি। আমি ওর চোখে পানি মুছে দিয়ে বললাম,

“আমার মা টার বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?”

ও চোখ মুখ কুঁচকে ঠোঁট ভেঙে আবার কান্না করে দিবে দিবে অবস্থা। ও আমার কাঁধে মাথা রাখলো। অনেক্ক্ষণ পরে আরজার বাবা খাবার বানিয়ে এসে আমাদের দেখে আহাম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

“মেয়ে জন্ম দিলাম আমি এতটুকু করলাম আমি। মেয়ের কান্না থামানোর জন্য আমার জান যায় যায় অবস্থা। অথচ এক রাত পার হওয়ার আগেই মেয়ে মা চিনে গেলো। পুরুষ রা সব জায়গায় অবহেলিত। স্বামী হিসেবেও আর বাবা হিসেবে।”

আমি সাবধানে আরজাকে এক হাতে জড়িয়ে অন্য হাতে ওনার হাত থেকে খাবারের বাটি টা নিলাম। আর বললাম,

” ভুল বললেন মেয়েরা বাবা ভক্ত হয়। আর শুনুন মেয়ে হাতে ব্যথা পাচ্ছে বলে মেয়ের সাথে কান্না করলেই হয় না। মেয়ের খিদে পেয়েছে কি না সেই দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। সেই সন্ধ্যায় কি না কি খেয়েছে। সরুন তো আর বিরক্ত করবেন না।”

আরজা খাওয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে খেয়াল করলাম ওনি দেয়ালে ঠেস দিয়ে পলকহীন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাই ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম,

“আমাদের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছেন স্যার?”

ওনি আমাদের দিকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

“একা একজন মা সন্তানের জন্য যথার্থ হলেও বাবা কিন্তু যথার্থ না। মায়ের সবদিক নজর থাকে কিন্তু বাবার থাকে না। সেজন্যই বোধ হয় আপনার বাবা আপনার কথা ভেবেই বিয়ে করেছিলেন।”

“আমি ওই অধ্যায়টা পিছনে ফেলে এসেছি আরজার বাবা। সেগুলো আর মনে করতে চাই না। আমি আপনাদের নিয়েই সুখী থাকতে চাই। এখন টিস্যু এনে দিন তো ওর মুখ মুছে দিবো।”

ওনি টিস্যু এনে আমার হাতে দেওয়ার পর আরজার মুখ মুছতে মুছতে বললাম,

“আমি যদি কখনো পরিবর্তন হয়ে যাই? আরজা কে যদি নিজের মেয়ে র মতো মনে না করি?”

#চলবে,

#সৎ_মা
#পর্বঃ১২
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

ওনি কোনো উত্তর না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি ভ্রুকুটি করে আবারও জিজ্ঞেস করলাম,

“কি হলো কোনো কথা বলছেন না যে?”

ওনি একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন,

“তাহলে ভেবে নেবো আপনার মতো আমার মেয়ের ভাগ্যটাও মন্দ ভাগ্য।”

“আমাকে তালাক দেওয়ার চিন্তাভাবনা মাথায় আসবে না?”

“যে পেটে ধরেছে সেই তো ফেলে চলে গেছে। আপনি তো পরই। তারপরও আমার মেয়ের জন্য আমাকে বিয়ে করেছেন। আমি জানি আপনি কখনো আমার মেয়েকে অবহেলা করবেন না। বছরের পর বছর একসাথে থেকেও মানুষ চেনা যায় না। আবার কোনো কোনো সময় মানুষের চোখ দেখলে আন্দাজ করা যায় সে কেমন।”

ওনি আরজার কপালে চুমু দিয়ে বললেন,

“তাই না মামনী?”

দুই বাপ মেয়ে খুনসুটিতে মেতে উঠেছে। আমি ওনাকে বললাম,

“আর পাঁচটা দম্পতির ন্যায় আমরাও সুখে সংসার করবো তাই না?”

ওনি আরজার সাথে খুনসুটি করতে করতে উত্তর দিলেন,

“আল্লাহ যদি চায় অবশ্যই। ইনসিয়া, আগেও বলেছি আবারও বলছি আমি যদি মা’রা যাই তখন আপনি যেখানেই যান না কেন আমার মেয়েটা কে আপনার সাথে করে নিয়ে যাইয়েন। আল্লাহর পরে মা এরপর আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। আমি জানি আমার মেয়ে আপনার কাছে একদম সেইফ থাকবে।”

“আপনার আজেবাজে কথা শেষ হয়েছে? ক’টা বাজে খেয়াল আছে? এখনি ফজরের আজান দিবে। যান তো মশাই ঘুমোতে যান।”

আরজা কে ওনার কোলে দিয়ে আমি মায়ের রুমের দিকে পা বাড়ালাম ওমনি ওনি আমায় ডাকলেন।

“ইনসিয়া।”

ওনার দিকে ফিরে তাকাতেই ওনি আমতা আমতা করতে লাগলেন। তাই সোলাইমান সাহেব কে বললাম,

“কিছু কি বলবেন?”

ওনি বললেন,

“না মানে বলছিলাম কি আপনি যদি আমার রুমে এসে ঘুমোতেন?

” ঘন্টা দুয়েক আগে না কে জানি খুব বড় গলায় বলেছিলো সে আরজা কে সামলাতে পারবে?”

ওনি আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,

“তখন কি আর জানতাম নাকি মেয়ে আমার মা পেয়ে বাপ কে ভুলে যাবে। তাছাড়া তো ওর এভাবে কখনো কাঁ’টা’ছে’ড়া হয়নি। তাই বুঝে উঠতে পারছি না।”

“তবে চলুন।”

আরজা কে মাঝখানে রেখে আমরা শুয়ে পড়লাম। আরজা নিজের হাতের ব্যান্ডেজ খোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কখনো কখনো চোখ মুখ চোখা করে হাতের দিকে তাকিয়ে থাকছে। মেয়ের এমন খেলা দেখতে দেখতে কখন যে চোখ লেগে গেলো টেরই পেলাম না।

____________________________________________

কড়াইয়ে তেল দিয়ে রান্নাঘর থেকে একটু দূরে থাকা আম গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে রাবেয়া বেগম । যেখানে একটা মা টুনটুনি পাখি মুখে করে খাবার এনে তার বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে। মনযোগ সহকারে সেই দৃশ্যটাই দেখছেন ওনি। রাবেয়া বেগম সম্বিত ফিরে পেলো ইকরার চিৎকারে। ইকরা আতংকিত চেহারায় বললো,

“মা তোমার মন কোথায়? দেখো তেল পুড়ে পুরো রান্নাঘর অন্ধকার হয়ে গেছে। এখনই তো একটা বিপদ হতো।”

রাবেয়া বেগম মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পুনরায় গাছটার দিকে তাকালো। মা পাখি টা নেই। তবে লোমহীন ছোট পাখির বাচ্চাটা হা হয়ে আছে। ইকরা মায়ের কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে ওনাকে হাত ধরে টেনে রান্নাঘরের বাইরে নিয়ে আসলো। একটা চেয়ারে বসিয়ে ওনার মুখের সামনে ধরলো।রাবেয়া বেগম ওনার মেয়ের দিকে তাকালেন। চেহারায় স্পষ্ট মলিনতার ছাপ। ইকরা ইশারা করলো পানি খাওয়ার জন্য।

ইকরা রাবেয়া বেগম কে চেয়ারে বসিয়ে নিজে সবার জন্য রুটি আর ডিম ওমলেট করে টেবিলে রাখলো। ইকবাল সাহেব ফরমাল ড্রেসআপে সদর দরজার এগিয়ে যেতেই ইকরা ডেকে বললো,

“বাবা, নাস্তা করবে না?”

ইকবাল সাহেব সামনে পা ফেলতে গিয়েও ফেললেন না। পিছু ফিরে ইকরার দিকে তাকিয়ে শুকনো হেসে বলে,

“যেখানে বেঁ’চে থাকার ইচ্ছেটাই ম’রে গিয়েছে সেখানে নাস্তা খেয়ে কি করবো?”

ইকরার বাবার কথার পিঠে জবাব দেওয়ার আর সাহস পেলো না। রাবেয়া বেগম ইকবালের সাহেবের কথাটা শোনামাত্র মাথা নিচু করে নিলো। ইকবাল সাহেব রাবেয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“তোমার মা কেই খেতে বলো। ভালো ভালো খাবার, আর জামাকাপড়। দরকার পড়লে বলো যতটুকু সম্পদ অর্জন করেছি সব তোমাদের নামে লিখে আমি অজানার পথে পা বাড়াবো।”

এক মুহুর্ত দেরি না করে ওনি চলে গেলেন। ইকরা মাকে কিছু বলতে গিয়েও ওনার করুন চেহারা দেখে কিছু বললো না।

____________________________________________

আরজা কোলে নিয়ে এবাসা টা ঘুরে ঘুরে দেখছি। সাথে মা ও আছে। কোথায় কি থাকে ওনি দেখিয়ে দিচ্ছে। তখনই আমার ফোনটা বেজে উঠলো। ইরফানের নামটা মোবাইল স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে। মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“তুই কথা বল। আমি আরজা কে নিয়ে বসার ঘরে যাচ্ছি।”

কল রিসিভ করে হ্যালো বলার সাথে সাথে ইরফান বলা শুরু করলো,

“কি করছিস আপু? আর আরজাটা কি করছে? কেমন আছে ও?”

ভালো মন্দ টুকটাক কথা বলার পর দুজনেই চুপচাপ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইরফান বললো,

“আপু?”

“হুম।”

“আজকে বাবা নাস্তা না করেই বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছে।”

কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে চুপ দেখে ইরফান বললো,

“যেই বাবা কোনোদিন না খেয়ে বাসা থেকে বের হতো না সেই বাবা আজ কিছু না খেয়ে চলে গেলো। এক গ্লাস পানিও না। মাও কিছু মুখে তুলছে না। আমি আর ইকরা কত করে রিকুয়েষ্ট করলাম।”

“আমি বোধ হয় তোদের সংসারে অশান্তি আর যন্ত্রণা তৈরি করে এলাম?”

অশান্তি আর যন্ত্রনা কি না তবে আপু তুই ও চলে গেলি আর আমাদের বাসাটা ও প্রাণহীন নির্জীব হয়ে গেলো। প্রতিটা কোণায় কোণায় যেন বিষন্নতার ছাপ।পুরো বাড়িতে দুঃখ নেমে এসেছে। কোথাও এক টুকরো সুখ নেই। তবে এমনটা হওয়ার দরকার ছিল। সব কিছুরই একটা বিহিত করা দরকার।”

“আসলে কি বলতো, মানুষের তার নিজের সুখটা নিজের মাঝেই খুঁজে নেওয়া উচিৎ। কেউ যদি মনে করে তার সুখটা অন্যের উপর নির্ভরশীল তাহলে সে কখনোই প্রকৃত সুখী না। নিজের সুখ নিজের মাঝে খুঁজে নিয়ে আমার মতো স্বার্থপর হয়ে যা ভালো থাকবি। আমি তো চেয়েছিলাম সবকিছু ভুলে তোর মা কে আমার মা মনে করে একটু সুখ খুঁজতে। কই পেলাম না তো। শুধু চাপা যন্ত্রণা অনুভব করেছি। কারো ইচ্ছে কে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের প্রাধান্য দে। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকবি। আমাকেই দেখ আমি কারো কথায় কান না দিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে সোলাইমান সাহেবকে বিয়ে করেছি। আজ সত্যি আমার নিজেকে সুখী মনে হচ্ছে। কারন আমি আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছি। এখন আমি জীবনের কাছে হেরে গেলেও আমার আফসোস থাকবে না।”

“আপু এগুলো আদৌও তোর মনের কথা তো? মানুষ কি আসলেই একা একা সুখী হতে পারে?”

থমকে গেলাম আমি ইরফানের প্রশ্নে। আসলেই কি মানুষ একা একা সুখী হতে পারে?নাকি চাপা কষ্ট যন্ত্রণা আর তিক্ততায় সুখের সংজ্ঞাই ভুলে গেছি?

বিকেলে সবার জন্য চা বানাচ্ছি। আরজা ঘুমোচ্ছে আর আরজার বাবা সোফায় বসে টিভি দেখছে। আর মা আসরের নামাজ পড়ে তজবি পড়ছে ওনার রুমে। চা বানিয়ে সবাই কে দিয়ে আমি এই বাসার ছাদে এলাম একটু পরিবেশ টা কে অনুভব করার জন্য। আকাশে মেঘ করেছে। এইতো বৃষ্টি বৃষ্টি নামবে নামবে করছে। আজ বহু বছর পরে খুব করে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে। ভাবনার মাঝেই অনুভব করলাম আমার গায়েঁ ঝিরঝিরে বৃষ্টির পানির স্পর্শ করছে। দুহাত মেলে এই সময় টাকে ফিল করতে লাগলাম। শরীর যখন আমার কাকভেজা সিঁড়ি ঘরের দরজা থেকে সোলাইমান সাহেব বললেন,

” এক বাচ্চার মায়ের এমন বাচ্চামো করা কি মানা যায়?মেয়ের সাথে সাথে মেয়ের মা অসুস্থ হলে মেয়ের মাকে সামলাবো নাকি মেয়েকে?

বলেই ওনি আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তখনই বৃষ্টির মাত্রাটা বেড়ে গেলো। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

” এখন যে মেয়ের বাবা বাচ্চামো করছে সেই বেলা?”

মুখে হাসির রেখা ঝুলিয়ে ওনি উত্তর দিলো,

“একটু না মেয়ের মায়ে সাথে মেয়ের বাবাও বাচ্চামো করলো।”

চুপচাপ দাঁড়িয়ে দুজনে বৃষ্টি বিলাস করছি। আমার খুব ইচ্ছে করছে ওনার হাতটা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখি।কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা এখনো সেই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়নি। আবার ইচ্ছের কথা চিন্তা করে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমার ভাবনার মাঝেই আরজার বাবা বললো,

“মিসেস সোলাইমান সাদিক ওরফে আরজার আম্মু, মানুষ কখনো একা-একা সুখী হতে পারে না। যখন সে একা একা থাকে তখন তাকে একাকীত্ব গ্রাস করে ফেলে। মানুষ আশেপাশের সবাইকে নিয়েই সুখী হয়। একাকীত্ব মানুষ কে মৃ’ত্যু’র দিকে ঠেলে দেয়।”

ওনার কথা শুনে বুঝতে পারলাম সকালে আমার সব কথাই ওনি শুনেছেন। সামনের দিকে আমার দৃষ্টি স্থির রেখেই উত্তর দিলাম,

“আমার মতো যাদের জীবনটা বিষন্নতায় ভরপুর সে একাকীত্বেই নিজের সুখ খুঁজে।”

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।