সৎ মা পর্ব-৯+১০

0
306

#সৎ_মা
#পর্বঃ০৯
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

“বাবা, আমি কেন কারো ভালোবাসা পেলাম না? না মা আর না বাবা। আমি সবার কাছে দায়িত্ব নামক বোঝা। কেন পেলাম না ভালোবাসা? ও বাবা বলো না। তুমি তো আমার জন্য মা এনেছিলে। কিন্তু সে তো আমার মা না শুধু তোমার স্ত্রীই হয়েই থেকে গেলো। ওনি তো শুধু ইরফান আর ইকরার মা।জানো বাবা, আমি কত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি? কত রাত চোখের পানিতে আমার বালিশ ভিজেছে? বাবা, আমার মা দেখতে কেমন ছিলো গো? মায়ের কোনো একটা স্মৃতি রাখতে আমার জন্য। অন্তত বলতে তো পারতাম এটা আমার মায়ের স্মৃতি। বাবা, আমার না বড্ড ইচ্ছে করে আমার মায়ের শরীরের গন্ধ নিতে। কেন ছাড়লে তোমার জন্মস্থান আমার জন্মস্থান? মা কে না দেখি মায়ের কবর টা তো দেখতাম। সপ্তাহে একদিন হলে কবর জিয়ারত করতাম বা তুমি করতে। রোজ তোমার মোনাজাতে আমার মা থাকে তো? নাকি একেবারে ভুলে গিয়েছ। সাতাশ বছর জীবনে আমার অপূর্ণ ইচ্ছে কি জানো? হঠাৎ করে মায়ের আঁচল টেনে বলবো, “ভালোবাসি মা তোমায় প্রচুর ভালোবাসি”। সেই ইচ্ছে আর পূরন হলো না। আমি তোমার স্ত্রীর আঁচল ঠিক যতবার টেনে ধরেছি ঠিক ততবারই ওনি আমার হাত ঝাড়া মে’রে ফেলে দিয়েছেন। যেদিন থেকে জানলাম ওনি আমার মা না সেদিন থেকে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম যে, যদি কখনো বিয়ে করি তো কোনো মা সন্তানের বাবাকে বিয়ে করবো। আগে মা হবো তারপর স্ত্রী। তোমার স্ত্রীর অবহেলা মানসিক যন্ত্রণাগুলো আমার অনুপ্রেরণা ছিলো।নিজের প্রতিজ্ঞায় অটুট থাকতে সাহস দিতো। আজ আমার একটা ইচ্ছে পূরণ হলো।আমি আজ আরজার মা হতে পেরেছি। রিসিপশন ছাড়াই বিয়ে করবো কেন বলেছি জানো? কারন ওনি বলেছিলেন বিয়ের সময় নাকি আমার পিছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচা হবে। তাই কোনো খরচা ছাড়াই বিয়ে করলাম। আমার প্রথম মাসের স্যালারী দিয়ে তোমাদের কাউকে না জানিয়ে ওনাকে একটা স্বর্ণের চেইন বানিয়ে দিয়েছিলাম। চেইনটা দেখার পর ওনি কি বলেছিল জানো? ওনি বলে, ওমা এটা তো একেবারে পাতলা ফিনফিনে। গলায় দিলে দেখা যাবে না। বাবা বলো আমার নিজের মা হলে এমনটা কখনো বলতে পারতো? আমার মা হয়তো আবেগে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিতো।”

বাবার কাঁধ থেকে মাথা তুলে উঠে দাঁড়ালাম। বাবা আমার কাঁদছে। হেঁচকি তুলে কাঁদছে। খানিক বাদে বাদে কেঁপে কেঁপে উঠছে ওনার শরীর। কাঁদুক কাঁদলে মানুষের মন হালকা হয়। আজ আমারও হালকা লাগছে।নিজের ভেতরের সকল কষ্ট বলতে পেরে শান্তি লাগছে। বাবার কাছ থেকে আমি ইরফানের কাছে গেলাম। ওর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকণা সযত্নে মুছে দিলাম। ওর ডান হাতটা নিজের মুষ্টিবদ্ধ করে কপাল ঠেকালাম। আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলাম আমি। কোনোরকম নিজেকে সংবরন করে ওকে প্রশ্ন করলাম,

“আজ যে জানতে পারলি আমার তোর আপন বোন না সৎ বোন তুই কি আমাকে ভুলে যাবি? বোন বলে আর মানবি না?আমি তো আর এই বাড়িতে আসবো না আর মনে রাখবি না আমাকে? আমি জানি এই পরিবারের কেউ ভালো না বাসলেও একমাত্র তুই আমাকে ভালোবাসিস। কেন বাসিস তা জানি না কিন্তু ভালোবাসিস। এখন কি আর আমাকে ভালোবাসবি না? এই বল না।”

ও কিছু না বলে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। দুই ভাই বোন কাঁদছি। খুব করে কাঁদছি। ওর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ইকরার সামনে গেলাম।
ইকরাও কাঁদছে। তাই ওকে জিজ্ঞেস করলাম,

“ইকরা তুই কাঁদছিস কেন? তোর তো আজ খুশি হওয়ার কথা। আজ থেকে আর কোনো জিনিস ভাগ করতে হবে না পুরোটাই তোর। ফুটপাত থেকে কেনা কারো সস্তার জামাকাপড়েও হাত বুলিয়ে বলতে হবে না, ইশ জামা টা তো সুন্দর। তোর জামা টা দিয়ে দে আপু। পরেরে বার বাবা টাকা দিলে আবার কিনে নিস তুই। বড় মাছ আনলে এখন আর আগে আগে বলতে হবে না, মাছের মাথাটা তুই খাবি। খাবার টেবিলে বসে কাউকে আর মুখ ভেংচি দিতে হবে না। তোর তো আজ আনন্দিত হওয়ার দিন।”

মেয়েটা আমার সামনে বসে পড়লো। আমার হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। মেয়েটা কাঁদছে আমার কেন জানি ওর কান্না সহ্য হচ্ছে না। হাজার হউক ছোট বোন তো।মা দুই হতে পারে একই বাবার র’ক্ত শরীরে বইছে। একটানে ওকে বসা থেকে উঠিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলাম। ওর কান্না বন্ধ হচ্ছে না। অনবরত হেঁচকি উঠছে। ও ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,

“আমাকে মাফ করে দিস আপু। আমি না বোঝে ভুল করে ফেলেছি। মা আমাকে যেভাবে বুঝিয়েছে আমি সেভাবেই বুঝেছি। ছোট ছিলাম সত্য মিথ্যা বোঝার ক্ষমতা আমার ছিলো না। ছোটরা তো না বুঝে অনেক ভুলই করে। মাফ করে দিস প্লিজ।”

ইকরার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম,

“ছোট বলে এখনো এডভান্টেজ নিবি?”

ও ফিক করে হেসে দিলো। ইকরা কে ছেড়ে মা থুড়ি বাবার স্ত্রীর সামনে গেলাম। ওনার চোখের কোণেও পানি। ওনাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

” আজ রাতে একটা শান্তির ঘুম দিবেন। আজ আপনার ঘাড় থেকে বোঝা নামছে। আমার জন্যই এতোদিন আতংকে থাকতেন যদি বাবা আমাকে সব দিয়ে দেয়। ওই মধ্যবিত্ত লোকটা বিয়ে করছি বলে আপনি ভয়ে থাকতেন যদি বিয়ের পর আমি আমার ভাগের সম্পদের জন্য আসি। ভয় পাবেন না ওই লোকটা যদি আমাকে কখনো ছেড়েও দেয় আমি এখানে আমার ভাগের জন্য আসবো না।”

বাবা কে ডেকে বললাম,

“বাবা আমার জন্য যে গয়নাগাটি গুলো বানিয়েছো ওগুলো ইকরা কে দিয়ে দিও। এগুলো আমার পক্ষ থেকে ওকে দিয়ে দিলাম। আর তোমার অর্থসম্পদের কিছু হলেও তো আমি পাই। সেগুলো তুমি ইরফানের নামে লিখে দিও। আমার কোনো দাবি নেই।”

মা কে বললাম,

” নিন আপনার সকল ভয় আজ এখানেই শেষ করে গেলাম। আজকের পর আর আপনাকে আতংকে থাকতে হবে না। আসলে কি জানেন তো? দোষ কারোর না দোষ আমার কপালের আমার ভাগ্যের। মা বাবার ভালোবাসা পাবো সেই কপাল নিয়ে আমি আসিনি।”

সবার সাথে কথা শেষ করে আমি সোলাইমান সাহেব এর দিকে এগিয়ে গেলাম। ওনার শীতল চাহনি। ওনার চোখে চোখ রাখলাম আমি।

“আমি কিন্তু এখন নিঃস্ব। কিছুই নেই আমার কাছে। এখন আপনার যদি মনে হয় আমার মতো নিঃস্ব কাউকে নিয়ে সংসার করবেন না। সংসার করেও ফয়দা হবে না বলে দিতে পারেন। আপনাকে মুক্তি দিয়ে হারিয়ে যাবো।”

ওনি ওনার কোল থেকে আরজাকে আমার কোলে দিলেন। দিয়ে বললেন,

” এই আপনার কোলে তুলে দিলাম দায়িত্ব, আদর, স্নেহ, মায়ামমতা আর ভালোবাসা। দেখি এসব উপেক্ষা করে কিভাবে যান। কে বললো আপনি নিঃস্ব? আমার সম্পদ যে আমি আপনার হাতে তুলে দিলো। আপনি ফিল করুন আপনি সবচেয়ে ধনী। আমি যদি কখনো আজকের দিনে যা যা ঘটেছে বা আমি শুনেছি তা নিয়ে কথা শোনাই তো সেদিনই আমাকে নিজের হাতে খু’ন করে ফেলবেন। সেই অনুমতি আপনাকে আমি দিলাম। আপনার যে যে ইচ্ছে আর আশা গুলো আমার সাধ্যের মধ্যে আমি চেষ্টা করবো সেগুলো পূরণ করার জন্য। আমাকে সমানে রেখে এইসব বলার কারন হয়তো আপনি একটু ভালোবাসা চান”

“না আপনার জানা দরকার কেন আমি আপনাকে বিয়ে করেছি এর কারন কি। তাই সবটা ক্লিয়ার করলাম। অনেক রাত হয়েছে চলুন আপনার বাড়িতে। আপনার মা হয়তো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ইরফান আয় আপুকে এই বাড়ি থেকে শেষ বিদায় তুই দিয়ে যা। আর কাউকে আসতে হবে না।”

ইরফান আমার দিকে এগিয়ে এলো। এসে বললো,

“তুই তো আর এই বাড়িতে আসবি না
আমি জানি তুই আসবি না যখন বলেছিস আর কখনোই আসবি না। আপু আমাকে কি ওই বাড়িতে যেতে দিবি? নাকি ঢুকতে দিবি না বাসায়? তোর সাথে আমি দেখা কিভাবে করবো?”

ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবলাম এই ছেলেটা এতো ভালো কেন? এতো ভালো কেন বাসে আমাকে?

মেইনডোর অব্দি এগিয়ে গিয়েও পিছু ফিরে তাকালাম বাবার দিকে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন ওনি। “বাবা” বলে ডাকলাম। মাথা তুলে বাবা আমার দিকে তাকালেন। চোখ দুটো তার কান্নার ফলে অগ্নিবর্ণ ধারণ করেছে। বাবাকে ডেকে বললাম,

“বাবা অনেক ভালোবাসি তোমায়।”

বাবা ছোট বাচ্চাদের ন্যায় আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো।

বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। আমি ইরফানের হাত দুটো ধরলাম।

“আমার কসম তোরা কেউ মা কে কিছু বলবি না। আমার ভেতরের সকল কষ্ট আমি তোদের সবাইকে সামনে রেখে বলেছি কারণ আমি বোঝাতে চেয়েছি এতোগুলা বছর আমি ভেতরে ভেতরে কতটা অসহায় ছিলাম। নিজের চাপা কষ্ট গুলো যদি বলতাম তাহলে হয়তো দমবন্ধ হয়ে মা’রা যেতাম আমি। দেখ না একটা সুযোগ দিয়ে আজকের এই ঘটনার পরে ওনি নিজেকে শুধরে নেয় কি না। আসি ভালো থাকিস সব সময়।”

ওদেরকে বিদায় দিয়ে ইরফান ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলো। ওর মা কে উদ্দেশ্য করে বললো,

“কাকে নিজের শত্রু মনে করতে মা? এতো কিছুর পরও সে এখন কি বলে গেল জানো? বলে গেল, তোমাকে যেন আমরা কোনো প্রকার কথা না শুনাই। যা হওয়ার হয়ে গেছে। তোমার নিজেকে শুধরে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। তুমি আমাদের মা। তোমাকে আমরা কি বলবো বলো। তুমি আমাদের কি শিক্ষা দেওয়ার কথা ছিলো আর কি শিক্ষা দিলে? বাবা, আমার অন্য কোথাও পড়াশোনা করার ব্যবস্থা করো।আমি আর এখানে থাকতে চাই না।”

ইকরা ওর মা কে বললো,

“আপুর বিরুদ্ধে আমাকে ফুসলিয়ে আজ মানুষ নামক অমানুষে আমাকে পরিণত করেছো। আজকের এই ঘটনা আরো আগে ঘটার দরকার ছিল।”

ইকবাল সাহেব বললেন,

“আমার কি বলা উচিত জানি না।আমার মেয়ের কাছে সবচেয়ে বড় অপরাধী আমি। তিনকাল গিয়ে এককালে এসে ঠেকেছি। তোমার ছেড়ে দিতে পারবো না। তবে আজ থেকে তোমার আর আমার বিছানা আলাদা। যেদিন মন থেকে নিজের ভুল বুঝতে পারবে সেদিন আমার কাছে এসো।”

____________________________________________

সোলাইমান সাহেব কে বললাম,

“আরজার বাবা এখন কোনো গাড়ি বা রিক্সা পাবো না। তাহলে কিভাবে যাবো?”

ওনি মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখুন আজ ভরা পূর্ণিমা। এই পূর্ণিমার রাতে পিচঢালা রাস্তায় একসাথে হাঁটার মধ্য দিয়ে আর পাঁচটা সুখী দম্পত্তির ন্যায় নিজেদের পথচলা শুরু করি?”

চলবে,,

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#সৎ_মা
#পর্বঃ১০
#রূপন্তি_রাহমা(ছদ্মনাম)

“এই ফাগুনী পূর্নিমা রাতে, চল পলায়ে যাই।”

ওনার দিকে সরু দৃষ্টিপাত করেই সুরহীন ভাবে বললাম। ওনি আমার দিকে ভাবলেশহীন চাহনি দিলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

” কি আশ্চর্য পালিয়ে যাবো কেন? একেবারে তিন কবুল বলে সবার সামনে দিয়ে মেয়ের মা বানিয়ে নিয়ে এসেছি। বাই দ্যা ওয়ে, আপনার গলা কাকের কন্ঠের ন্যায় সুন্দর।”

বলেই দাঁত কেলানি মার্কা হাসি দিলো।

“এই এই আমার গলা নিয়ে কোনো বাজে কথা বলবেন না। আমি স্কুলে সব সময় গান গেয়ে পুরস্কার পেতাম”

“হয়তো বিচারকদের কান আগে থেকেই খারাপ ছিলো না আপনার গলার গান শুনে খারাপ হয়ে গিয়েছিলো সেজন্য পুরস্কার পেতেন। আচ্ছা বলুন তো কি এমন নিয়েছেন লাগেজে? এতো ভারি কেন এটা? টেনে আনাই যাচ্ছে না।”

ওনাকে দাঁত কটমট করে বললাম,

“দেখুন আপনার এই বকবকানির জন্য যদি মেয়েটা জেগে যায় তো আপনার একদিন কি আমার একদিন। এখন মেয়েটা জেগে গেলে হাতের যন্ত্রণায় কান্নাকাটি করবে।একদম ঘুমোবে না।”

“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে এই আমার ঠোঁটে আঙুল দিলাম।”

চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে আশপাশ। এদিক ওদিক থেকে ঝিঝি পোকার ডাক আসছে। আবার মাঝে মাঝে কারো পোষা কুকুর ঘেউঘেউ করে ডাকছে।দুজনেই চুপচাপ শুধু। দুজন তাল মিলিয়ে হাঁটছি। এই নিস্তব্ধতায় লাগেজ টানার আওয়াজও বিকট মনে হচ্ছে। হঠাৎই আরজা আমার কাঁধ থেকে তুলে চারপাশে চোখ বুলালো। আবার আমার কাঁধে ঠাস করে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলো। আরজার কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে ওর বাবা বললো,

“আসলেও ওর মা এমন ছিলো। হঠাৎই ঘুম থেকে বসে যেতো আবার ঠাস করে শুয়ে ঘুমিয়ে যেতো।”

হাঁটতে হাটঁতে গম্ভীর গলায় ওনাকে বললাম,

“ভুল বললেন আমার এমন কোনো অভ্যাস নেই।”

ওনি আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলেন।

“এখন যদি কেউ সাদা শাড়ি পরিধিত অবস্থায় খোলা চুলে আপনার সামনে এসে তার চিকন সরু দুটো দাঁত দেখিয়ে বলে, তোর র’ক্ত খাবো। আপনি ভয় পাবেন?”

“আশ্চর্যজনক কথাবার্তা ভয় পাবো বলে কি দুই মা মেয়ে আপনাকে বডিগার্ড বানিয়ে নিয়ে এসেছি সাথে করে?”

ওনি আমার শুনে হুহা করে জোরে জোরে হাসতে লাগলেন। ওনাকে একটা ঝাড়ি মে’রে বললাম,

“এই সুনশান-নিস্তব্ধ পরিবেশে আপনার রাক্ষসের মতো হু হা হাসির শব্দে আমার মেয়েটা তো জেগে উঠবেই সাথে আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষও ভূত ভেবে ভয় পাবে।”

আবারও দু’জন একসাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছি। একেবারেই চুপচাপ কোনো শব্দ নেই। হঠাৎই ওনি ওনার হাঁটা বন্ধ করে দিলেন। আমি দু’কদম সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার পিছু ফিরে তাকালাম। ওনি আমাকে ডাকলেন, “ইনসিয়া।” ওনার কন্ঠস্বর শান্ত এবং মলিন। ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

“আপনি কি আবারও মজা করার এমন করছেন?”

ওনি আবারও আমায় শীতল কণ্ঠে ডাকলেন, “ইনসিয়া।”

ওনার এই শীতল কণ্ঠের ডাক যে কাউকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। আমি পুরো স্থির হয়ে গেলাম। ওনি শান্ত গলায় বললেন,

“এই মুহূর্তে যদি আমি আপনার নিকট কোনো আবদার করি আপনি রাখবেন?”

আমি ওনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। ওনি আকুলতা ভরা কন্ঠে বললেন,

“অবশিষ্ট পথটা আপনার হাত ধরে হাঁটতে দিবেন? বিশ্বাস করুন আজকের দিনে ঘটা প্রতিটা ইন্সিডেন্ট আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আজ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সুখী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন মনে হচ্ছে। আমি আবারও নতুন করে জীবন শুরু করবো আমার মেয়েটা একটা মা সবকিছুই যেন আমার কাছে নিছক কল্পনা লাগছে। সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে৷ দিবেন আপনার হাতটা ধরতে?”

এমন আকুলতা ভরা কন্ঠে করা আবদার উপেক্ষা করার সাধ্যি কি আমার আছে?

____________________________________________

ডাইনিং টেবিলের চেয়ারের সাথে ঠেস দিয়ে মেঝেতে বসে আছে রাবেয়া বেগম। নিষ্পলক তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। এতোক্ষণ এখানে দাঁড়িয়েই ইনসিয়া তার এতোদিনের পোষে রাখা কষ্ট ব্যক্ত করে গিয়েছে। কেউ একজন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। রাবেয়া বেগম মাথা তুলে দেখে ইকরা। ইকরা মায়ের এমন অসহায়ত্ব দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মায়ের সামনেই মেঝেতে বসে পড়ে।

“কি পেলে মা একটা মেয়েকে অবহেলা করে তিলে তিলে শেষ করে দিয়ে? মানুষের টাকা পয়সা ধন-দৌলত দুই দিনের কিন্তু আচার ব্যবহার সারাজীবনের। ব্যবহারের জন্য একজন আরেকজনকে মনে রাখে।তার দোয়ায় রাখে। সে তোমার নিজের পেটের সন্তান হলে এমন করতে পারতে? তোমার ভিতর এমন মানসিকতা আসতো?মানুষ তার করা সকল ভুল ইচ্ছাকৃত হউক আর অনিচ্ছাকৃত হউক বুঝতে পারে তবে সময় খোয়ানোর পরে। মাগো ভালোবাসা দিয়ে পুরো পৃথিবী জয় করা সম্ভব। হিংসা বিদ্বেষ মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে। মনের মাঝে হিংসা লালন করে মানুষের মন জয় করা সম্ভব না। তোমার ভিতর যে নেগেটিভিটি আছে সেটা তুমি আমার মাঝেও ছড়িয়ে দিয়েছো। আজ এতো বছর আপুর সব কথা শুনে ওর জায়গায় নিজেকে বসালাম। মা আপু দেখে সব সহ্য করেছে। মা গো আমার এতো সহ্য ক্ষমতা নেই। হয়তো অনেক আগেই নিজেকে শে’ষ করে দিতাম।”

নিজের মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে আঁতকে উঠল রাবেয়া বেগম। নিরবে চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।ইকরা মায়ের সামনে আর একটু এগিয়ে গেলো। ওনার চোখের পানি সযত্নে মুছে দিলো।ওনার হাত দুটো মুঠোবন্দি করে বললো,

” মাগো তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছো।তোমাকে জ্ঞান দেওয়া বা কথা শোনানো আমার সাঝে না। তারপরও অনেক কিছু বলে ফেলেছি। কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক অন্তত এটা তো বুঝি।আমাকে মাফ করে দিও মা কতকিছু বলে ফেলেছি।আমাদের সবাইকেই মাফ করে দিও। তুমি মন থেকে আমাদের উপর অসন্তুষ্ট থাকলে আমরা জীবনেও সুখী হবো না। এখানে আর বসে থেকো না। এখন বাবা তোমার উপর রেগে আছে। রাগ পড়লে ঠিক আবার ডাকবে। এখন আমার রুমে চলো কিছু একটা খেয়ে ঘুমোবে। তাহলে শরীরটা ভালো লাগবে।”

____________________________________________

কলিং বেল বাজিয়ে অনেকক্ষন যাবৎ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নতুন দম্পতি। প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে দরজা খুললেন সেলিনা খাতুন। ছেলে আর ছেলের বউকে গম্ভীর দৃষ্টিতে অবলোকন করছেন।

“আজকে আর এলি কেন? রাস্তায় রাতটা কাটিয়ে আসতি। ইরফান সেই কখন কল করে বললো তোরা বেরিয়েছিস। অথচ তোদের আসার নামগন্ধও নেই। কল দিলাম মোবাইল বন্ধ। জানিস কতটা টেনশন হচ্ছিল?”

দাঁতে জীভ কাটে সোলাইমান সাহেব। লাগেজটা নিচে রেখে আলতো করে ওনার মাকে জড়িয়ে ধরে। আহ্লাদী গলায় বলেন,

” ভুল হয়ে গেছে মা। মোবাইলের ব্যাটারী যে ডাউন হয়ে গিয়েছে বলতে পারবোনা। আসার সময় কোনো রিকশা পাইনি তাই হেঁটেই আসতে হলো।”

“কি তোরা এতখানি পথ হেঁটে এসেছিস?”

“বকাবকি পরে করো। আগে ফ্রেশ হতে দাও।”

মিনিট ত্রিশ পরে দু’জনে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসলাম। আরজার দাদিও এখানেই আছে। গলা খাঁকারি দিয়ে আরজার বাবা বলল,

“মা,আজকে রাতটা ইনসিয়া তোমার সাথে ঘুমোবে।”

ওনি আরজার বাবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে বললেন,

“তুই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি? আজ তোদের জীবনের বিশেষ দিন। আর ইনসিয়া আমার সাথে ঘুমোবে? তুই বরং দিদিভাই কে আমার কাছে দিয়ে যা।”

“আজকের এই বিশেষ রাতটাকে স্মরণীয় করে রাখতেই আমি এই কথা বলেছি। ইনসিয়া আপনি বলেছিলেন না মায়ের গায়ের গন্ধ নেওয়ার খুব শখ আপনার? নিন আজকের রাতটা আমার মাকে আপনায় ধার দিলাম। শুধু আজকের রাতটাই কিন্তু হুম।আমি আবার আমার কিছু অন্য কাউকে দেই না।দেখেন মা মা ফিলিংস আসে কিনা।”

বলেই হাসতে লাগলেন। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে আছি নির্বাক হয়ে। আদৌও কি আমার কিছু বলা সাঝে?

____________________________________________

বারান্দায় দাঁড়িয়ে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ইকবাল সাহেব। হিসেব কষছে এই জীবনে কি কি করলো। অতীতে করা তার একটা ভুল তার আর মেয়ের জীবনটা একেবারে এলোমেলো করে দিলো। আত্মগ্লানি তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। যতদিন বেঁচে থাকবে এই অপরাধবোধ নিয়েই বাঁচতে হবে। মোবাইলের মেসেজ টিউনের শব্দে ভাবনাচ্ছেদ হয় ওনার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাঞ্জাবির পকেট হাতরে মোবাইল বের করেন। ইনবক্সে গিয়ে মেসেজ ওপেন করে প্রথম দুই লাইন পড়েই দরদর করে ঘামতে লাগলেন ওনি।

চলবে,,,

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।