সৎ মা পর্ব-১৩+১৪

0
278

#সৎ_মা
#পর্বঃ১৩
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে একনাগাড়ে হাঁচি দিয়ে চলেছি আমি আর আরজার বাবা। তখন বৃষ্টিতে ভেজার ফল এখন ভোগ করছি। একবার আরজার বাবা হাঁচি দিচ্ছে তো আরেকবার আমি। আমাদের এমন হাঁচির প্রতিযোগিতা দেখে ওয়ার্কারে বসা আরজা আমাদের দিকে আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে আছে। মা বিরবির করতে করতে আমাদের দুজনের সামনে দু’কাপ আদা চা দিলেন। আমি চুপচাপ মায়ের হাত থেকে চা নিলেও আরজার বাবা মায়ের হাতে চায়ের কাপটা নেওয়ার সময় বললেন,

“কি দরকার ছিলো মা এই সময় চা করার। এই ঠান্ডা, জ্বর,সর্দি এমনি চলে যেতো।”

মা রাগে ফুস ফুস করতে করতে বললেন,

“আসলেই তো কি দরকার ছিলো? তোমরা তো এখনো ছোট। তোমরা কি কিছু বুঝো বলো? বাচ্চা মেয়েটা হাত কে’টে অবস্থা খারাপ। আর এরা ভর সন্ধ্যায় ছাদে গিয়েছে বৃষ্টিতে ভিজতে। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে বড় বড় বাচ্চাদের সেবা করার জন্য।”

মায়ের কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে দিলাম। মায়েদের শাসন বুঝি এমন হয়। মা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙানি দিলেন। মা চোখ রাঙানি দিতেই আমার হাসির মাত্রা বেড়ে গেলো। মা ধমক দিয়ে বললেন,

“এই একদম চুপ। আমি হাসির কিছু বলেছি? বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে এসেছে তারা। মনে হয় এখনো বাচ্চা। হ্যাবলাকান্তের মতো না হেঁসে তাড়াতাড়ি চা শেষ কর। আদা চা খেলে ভালো লাগবে।”

শীতল কণ্ঠে মাকে ডেকে বললাম,

“মা আমার পাশে এসে বসবেন প্লিজ। শুনেছি মায়েদের স্পর্শে নাকি জাদু থাকে।মৃ’ত্যু পথযাত্রীও নাকি মায়ের স্পর্শে শান্তি অনুভব করে।আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন? দেখবেন আপনার ছোঁয়ায় আমার জ্বর, সর্দি সব ভালো হয়ে গিয়েছে।”

____________________________________________

প্রতিটা সকাল মানেই একটা সুন্দর নতুন দিনের সূচনা। বেশ কয়েকদিন পার হয়ে গিয়েছে। সেদিনের সেই জ্বর থেকে আরজার বাবা সুস্থ হলেও আমাকে ভুগিয়েছে বেশ। মা বলে দিয়েছে, আর যদি কখনো বাচ্চাদের মতো বৃষ্টিতে ভিজি তো আমার খবর আছে। মায়েদের শাসনেও ভালোবাসা থাকে যা আমি এখন ফিল করি। সংসারের সবকিছু মোটামুটি আয়ত্ত্বে নিচ্ছি। স্কুলের চাকরিটা আপাতত ছেড়ে সংসারেই মন দিলাম। যেদিন মনে হবে সংসারের পাশাপাশি চাকরি করতে পারবো সেদিন থেকে আবার চাকরি করবো।

আজ আরজার হাতের ব্যান্ডেজ খুলবে। হাসপাতালের করিডোরের চেয়ারে বসে আছি আমি আর আরজার বাবা।যিনি ব্যান্ডেজ খুলবে তিনি জ্যামে ফেঁসেছে। তাই অপেক্ষা করছি। হাত দুটো ব্যান্ডেজে মোড়ানোর পর থেকে মেয়েটা অস্বস্তিতে আছে। বার বার খুলে ফেলার চেষ্টা করতো। আবরণের উপর দিয়েই হাত চুলকাতো। আজ মেয়েটা একটু স্বস্তি পাবে। বড়দের সামান্য হাত কা’টা’র পরে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ করলে কেমন লাগে। ও তো ছোটো বাচ্চা।

আরজার হাতের ব্যান্ডেজ খুলার পর হাসপাতালের ডিসপেনসারি থেকে অয়েন্টমেন্ট আর প্রয়োজনীয় ঔষধ কিনে একটা বেবিশপে এলাম।ওর জন্য টুকটাক শপিং করবো। তিনটা দোকান ঘুরাঘুরি করার পর আরজার জন্য ড্রেস নিলাম। আমার জন্য কিছু প্রসাধনী নেওয়ার পর আরজার বাবা বললো,

“আর কারো জন্য কিছু নিবেন না?”

এদিক ওদিক তাকিয়ে বললাম,

“নিবো তো মায়ের জন্য একটা শাড়ি।”

“আর কারো জন্য কিছু নিবেন না?”

আমি মুখ টিপে হেসে বললাম,

“আর কার জন্য কি নিবো? বাড়িতে তো আমরাই থাকি। মায়ের জন্য কেনা শেষ হলেই শেষ।”

ওনি মুখ কালো করে বললেন,

“ওহ।”

মায়ের জন্য শাড়িটা কেনার পর উনাকে বললাম,

“আপনি আরজাকে কোলে নিয়ে বাইরে গিয়ে রিক্সা ডাকুন আমি এগুলো নিয়ে আসছি।”

ওনি মন খারাপ করে শপিংমলের বাইরে চলে গেলেন। আমি তাড়াতাড়ি করে একটা জ্যান্টেস কর্ণারে গিয়ে একটা অফ-হোয়াইট কালার পাঞ্জাবি আর পাজামা নিলাম। তাড়াহুড়ো করে আসতে নিলেই একজনের সাথে ধাক্কা লেগে সবগুলো শপিং ব্যাগ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে গেলো। ব্যাগ গুলো গুছিয়ে মাথা তুলতেই দেখি পরিচিত একজনকে। আমাদের দুই গলি পরেই ওদের বাসা। আমাকে আপু বলে ডাকে। ওর নাম তিন্নি। তিন্নি সাথে তিন্নির মা ও আছে। তিন্নি ভালো হলেও ওর মা কেমন জানি। উনার আচার-আচরণ আমি কেন কারোরই পছন্দ না। তিন্নি আমাকে দেখে মুচকি হেঁসে বললো,

“আরে ইনসিয়া আপু যে, কতদিন পরে দেখা হলো তোমার সাথে। তা কেমন আছো?”

আমি মুচকি হেঁসে জবাব দিলাম,

“এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো? আর আন্টি আপনি কেমন আছেন?”

তিন্নি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,

“এইতো আলহামদুলিল্লাহ আপু। কিন্তু তোমার বাচ্চাদের জিনিসপত্র কেন? তোমাদের বাসায় তো কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই।”

আমার হাতে থাকা ব্যাগগুলোর দিকে তাকিয়ে জবাব দিলাম,

“আমার মেয়ের জন্য নিলাম এগুলো।”

তিন্নি অবাক হয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো,

“তুমি এসব কি বলছো আপু? তোমার মেয়ে আসবে কোত্থেকে? তোমার তো বিয়েই হলো না। পা’গ’ল হয়ে গেলে নাকি?”

তিন্নির প্রশ্নের পিঠে উত্তর দিলাম,

“এইতো কয়েকদিন হলো। কাউকে বলিনি ঘরোয়াভাবে সম্পন্ন হয়েছে বিয়েটা।”

“তা পেট কি আগেই বাঁধিয়েছিলে নাকি বিয়ে হচ্ছিলো না বলে কোনো টাকাওয়ালা বুড়ো বাচ্চার বাপকে বিয়ে করেছো?”

এমন কুরুচিপূর্ণ কথা শুনে শুধু আমি না তিন্নিও চমকে উঠলো। তিন্নি লজ্জায় মাথা নিচু করে বলে,

“মা তুমি নিজেকে সংযত করো। কি বলছো সব।আপু এমন নাকি।”

“আসলে আন্টি হয়েছে কি, আমরা না পজিটিভটা ভাবতে পারি না। আমাদের মাথায় সবসময় নেগেটিভটা ঘুরপাক খায়। আপনি এটা কেন ভাবতে পারলেন না যে, আমি ওই লোকটাকে বিয়ে করার ফলে একটা বাচ্চা মেয়ে মা পেয়েছে। এটা কেন ভাবতে পারলেন না ওই লোকটাকে বিয়ে করে আমি একটা অগোছালো সংসারের দায়িত্ব নিয়েছি। একজন অসহায় বৃদ্ধার সহায় হয়েছি। এটা কেন ভাবতে পারলেন না একটা ভাঙাচোরা মনের মানুষকে পুনরায় নতুন করে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছি। সমস্যাটা আসলে আমাদের চিন্তাধারায়। আমরা নিজের জন্য চিন্তা না করে অন্য মানুষের জন্য ফাও চিন্তা করতে করতে আ’ধ’ম’রা হয়ে যাই। চিন্তাধারা বদলান আন্টি জীবন বদলে যাবে। মানুষের যেকোনো কাজকে নেগেটিভলি না নিয়ে পজিটিভলি নেন দেখবেন সবাই ভালবাসবে।”

তিন্নিকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

“আসি তিন্নি ভালো থেকো।”

তিন্নি লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। কিছু দূর এগোতেই দেখলাম আরজা বাবা আরজাকে কোলে নিয়ে আমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে। একেবারেই স্থির। উনাকে কিছু বলতে না দিয়ে আমিই বললাম,

“এখানে সং এর মতো দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় চলুন আমি শাওয়ার নিবো।আমার মাথা গরম হয়ে আছে। মাথায় পানি না দিলে ঠান্ডা হবে না।”

বাসায় এসে শপিং ব্যাগ গুলো সোফায় রেখে আমি সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলাম। লম্বা শাওয়ার নিতে হবে। শাওয়ার শেষে ড্রয়িং রুমে এসে দেখি আরজার বাবা শপিং ব্যাগ গুলো উল্টে পাল্টে দেখছেন। আমাকে দেখামাত্র উনি জিজ্ঞেস করলেন,

“না মানে বলছিলাম কি এই পাঞ্জাবিটা কার জন্য এনেছেন?”

মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বললাম,

“কার জন্য আবার আনবো? আমার একজন প্রেমিক আছে তার জন্য এনেছি। তার বহুদিনে শখ আমার বরের টাকায় তাকে আমি একটা পাঞ্জাবি কিনে দিবো আর সে সেটা গাঁয়ে পরিধান করবে। আজ সুযোগ পেয়ে কিনেই ফেললাম। হাঁদারাম একটা। এই, এই বাসায় আর কোনো পুরুষ আছে যে তার জন্য কিনবো?”

মা পানির গ্লাসটায় মাত্রই চুমুক দিচ্ছিলো, আমার কথা শুনে উনি ফিক করে হেসে দিলো। নিজের রুমে যেতে যেতে বললো,

“আস্তো একটা গাধাঁ পেটে ধরেছি।”

আমার শেষের বলা কথাগুলো শোনার পরে উনার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসিটা ঠিকই চোখে পড়েছে। ওনি মাথা চুলকে বললেন,

” না মানে আমি ভেবেছিলাম আপনি এটা ইরফানের জন্য কিনেছেন। তাই জিজ্ঞেস করেছি।”

“শুনুন আপনার ওই আর কারো জন্য কিছু নিবো কিনা এটা জিজ্ঞেস না করলেও আমি জানি এবাসায় একটা অবহেলিত আর অসহায় এক পুরুষ আছে। আর আমি স্বার্থপর হতে পারি তবে এতোটাও না যে শুধু ইরফানের জন্য কিনবো। কিছু দেওয়ার হলে সবাইকেই দিবো। ওরা যেমনই হোক না কেন আর আমি যত কথাই বলি না কেন বুঝ হওয়ার পর থেকে আমি ওদেরকেই আপনজন জানি। আর শুনুন কালকে ভালো দেখে একজন ফটোগ্রাফার আনবেন। আজকে যা যা শপিং করেছি এগুলো পরিধান করে ফ্যামিলি ফটো তুলবো।”

কথার মাঝখানেই কলিংবেল বেজে উঠলো। সদরদরজা খুলো দেখি একটা ডেলিভারি বয় দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা আমাকে দেখেই বললো,

“এখানে ইনসিয়া ইকবাল কে?”

“জ্বি আমিই ইনসিয়া ইকবাল।”

“ম্যাম আপনার নামে একটা পার্সেল আছে। দয়া করে এইখানটায় সাইন করুন।”

পার্সেলটা রিসিভ করে সোফায় বসতেই আরজার বাবা বললো,

“কি এটা ইনসিয়া?”

“জানি না কেউ একজন আমার নামে পাঠিয়েছে। দাঁড়ান খুলে দেখছি কি আছে।”

পার্সেলটার ভেতরে থাকা জিনিসটার সাথে একটা চিঠি ছিলো।চিঠিটা অর্ধেক পড়তেই আমার চোখ থেকে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#সৎ_মা
#পর্বঃ১৪
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

আমার কান্না দেখে আরজার বাবা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,

“কি হয়েছে ইনসিয়া কাঁদছেন কেন? কি আছে এই পার্সেলের ভিতর? দেখি তো।”

একটানে পার্সেলটা আমার হাত থেকে নিয়ে নিলো।৷ চিঠিটা তখনও আমার হাতে। বড় একটা ফটো ফ্রেম। সাদা কালো একটা কিশোরীর ছবি বাঁধাই করা। আরজার বাবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কতক্ষণ ছবিটাকে লক্ষ্য করলো। আমি তখনও কাঁদছি। উনি আমাকে প্রশ্ন করলেন,

“ইনসিয়া কে এই মেয়ে?”

কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। হেঁচকি দিতে দিতে উত্তর দিলাম,

“আমার মা। আমাকে যিনি জন্ম দিয়েছে আমার জন্মদাত্রী মা।”

উনি একবার আমার দিকে তো আরেকবার ছবির দিকে তাকাচ্ছেন। আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করলেন,

“আপনার হাতে ওটা কিসের কাগজ?”

চিঠিটা পড়া অসম্পূর্ণ রেখেই এগিয়ে দিলাম উনার দিকে। উনি আমার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়া শুরু করলেন,

“প্রিয় মামনী,

আমি তোর অপরাধী বাবা। তোর জীবনে ঘটা সবকিছুর পিছনে প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে আমিই দায়ী। জানি তোর এই ক্ষত কখনো মুছবে না। তুই আমাকে মা’র, কা’ট, পুলিশে দে আর যাই কর এটা বলিস না তোকে মৃ’ত ভাবতে। কোনো পিতাই তার সন্তানকে মৃ’ত ভাবতে বা কল্পনা করতে পারে না। সন্তানকে মৃ’ত ভাবার আগে নিজে ম’রে যাওয়াও ভালো। মারে বুড়ো বাপটাকে মাফ করে দে। এই দুনিয়ায় আমার বিবেক আমাকে তাড়া করে বেরিয়েছে। তোর মায়ের মৃ’ত্যু’র পর আমি কোনো রাত শান্তিতে ঘুমোতে পারিনি। এটা তোর মায়ের ছবি। তার কোনো কিছু সঙ্গে করে না নিয়ে এলেও তার শরীরের অংশ তুই আর এই ছবিটা নিয়ে এসেছিলাম। আমি যখন মানসিক যন্ত্রণা কাতরাতে থাকতাম তখন এই ছবিটার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকতাম। আমি এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করতাম। তোর মা এখনো আমার মনের কোণে আছে। জীবনের শেষ ক’টা দিন একটু শান্তি চাই মা। আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকাতে পারি না। অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। প্রথম সন্তান তার বাবার কাছে কী শুধু একজন বাবাই জানে। আর কিছু বলবো না মা।শুধু বলবো আমাকে মাফ করে দে আর তোকে মৃ’ত ভাবতে বলিস না।

ইতি তোর অধম বাবা।”

চিঠিটা পড়ে ওনি থম মে’রে রইলেন। একটু একটু করে আমার কান্নার মাত্রা বাড়ছে।কি করবো বুঝতে পারছি না। আমার কি করা উচিৎ আমি কিছুই জানি না।কেমন দোটানায় ভুগছি। চিঠির দিকে তাকিয়ে উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

“আপনি আপনার বাবাকে এসব কখন বললেন ইনসিয়া? নাকি দৃষ্টি অগোচরে আরো কাহিনি আছে?”

হুট করে ঝাপিয়ে পড়লাম উনার বুকে। কাউকে আঁকড়ে ধরতে হবে আমার। একটা বিশস্ত বুক দরকার যেখানে মাথা রেখে আমি একটু শান্তি পাবো। ওনি ওনার হাত দু’টো একবার মেলে দিচ্ছে তো আরেকবার গুটিয়ে নিচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত উনি এক হাত দিয়ে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমার চোখের পানিতে উনার শার্ট ভিজে গিয়েছে। কান্না গতি কমিয়ে উনাকে বললাম,

“কিছু কিছু জিনিস দৃষ্টি অগোচরে থাকাই শ্রেয়। না হলে আপনজন হারানোর সংখ্যা আর যন্ত্রণা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। আপনজনকে হারানোর ভয়ে আমরা অনেক সময় অনেক সত্য চেপে যাই। জানি এটা অন্যায়। না হলে যে তাকে হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে। যাকে হারিয়েছি তাকে তো পাবো না। আর যে আছে তাকেও হারাতে চাই না। আমি যেগুলো থেকে বাঁচতে চাই সেগুলো কেন বার বার আমার সামনে আসে আরজার বাবা?”

উনি চুপ করে রইলেন।কোনো উত্তর দিলেন না। গলা খাঁকারির শব্দে আমরা দু’জন ছিটকে সরে যাই। মা মাথা নিচু করে বললেন,

“তোর কান্নার শব্দে আমি রুম থেকে বেরিয়েছি। একটু আগে তো ভালোই ছিলি।এখন কি হলো তোর কাঁদছিস কেন? সোলাইমান তোকে কিছু বলেছে?”

বলেই আমাদের সামনে এলেন মা। সোফার উপর রাখা ফটো ফ্রেমটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,

“এটা কার ছবি?”

আরজার বাবা জবাব দিলেন,

“এটা ইনসিয়ার মায়ের ছবি মা।”

মা চোখ মুখ কুঁচকে বললেন,

“মানে? এই ছবির সাথে ওর মায়ের চেহেরার কোনো মিল নেই। তাহলে এটা ওর মা হয় কেমনে? আর এইটা ওর মা হলে বর্তমানে যে আছে সে কে?”

আরজার বাবা জবাব দিলেন,

“সৎ মা।”

মায়ের চোখ মুখের প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝাই যাচ্ছে উনি ব্যপারটা হজম করতে পারছেন না। আমি সোফার এক কোণে বসে আছি। আর কান্না করার শক্তি পাচ্ছি না। অদূরে রাখা শো-পিসটার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছি। মা পুনরায় বললেন,

“একটু কি খুলে বলবি? আমি না কিছুই বুঝতে পারছি না।”

তারপর আরজার বাবা সেদিনের সব ঘটনা মাকে খুলে বললেন। মা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। মা ধীর পায়ে হেঁটে আমার পাশে এসে বসলেন। আমার মাথাটা উনার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

“যিনি জন্ম দিয়েছেন তিনিই কি শুধু মা হয়? আর বুঝি কেউ মা হতে পারে না? তোর আপন মা বেঁচে না থাকলে কি হবে তোর এই মা তো আছে। আমি তো তোর আরেকটা মা তাই না? নাকি আমাকে মা মনে করিস না কোনটা?”

কোমড় জড়িয়ে ধরলাম উনার। শব্দহীন কান্নায় অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে।এই মানুষটা এতো ভালো কেন? উনি আমাকে স্নেহের সহিত কিছু বললে বা উনার মমতাময়ী স্পর্শে আমার ভিতরে কেমন শান্তি অনুভূত হয়।ইরফান আর ইকরার মা কেন আমাকে আপন করে নিতে পারলো না?

রুম থেকে আরজার কান্নার আওয়াজ এলো।এতোক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো।নিশ্চয়ই এখন জেগে গিয়েছে। মা ওনার বুক থেকে আমার মাথা তুলে চোখের পানি সযত্নে মুছে দিয়ে বললেন,

“বুড়ো বুড়ো মায়েদের জন্য অনেক কান্নাকাটি হয়েছে।এবার পিচ্চি মাকে গিয়ে সামলা।না হলে রেগে যাবেন উনি। উনি রাগলে কিন্তু রণমুর্তি ধারন করে।”

মায়ের কথা শুনে অশ্রুসিক্ত নয়নে ফিক করে হেঁসে দিলাম আমি।
____________________________________________

“টাইম এন্ড টাইড ওয়েট ফর নান”। সময় স্রোত কাহারো জন্য অপেক্ষা করে না।সুখ কিংবা দুঃখ এই দুইয়ের মাঝেই সময় তার আপন গতিতে বয়ে চলে। ওই বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ নেই ইরফান ব্যতীত। ও মাঝে মাঝে ফোন করে। সেদিন বাসায় এসে দেখা করেও গেলো। বাবার সেই চিঠি পাওয়ার পর কেমন দোটানায় আছি। আপাতত সেদিকে মন না দিয়ে আমি সংসারে মনযোগ দিতে চাই। মনের মাঝে চেপে রাগ আর অভিমান যেদিন বিলীন হবে আমি সেদিন বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো।মাঝের দিনগুলো বাবার শাস্তি। যত যাই বলি মা তো আর ফিরে আসবে না। বাবা যতই অপরাধী হউক বাবাকে হারাতে চাই না। আজকাল নিজেকে গিন্নি গিন্নি মনে হয়। একা হাতে সংসার সামলানো। মায়ের সাথে গল্প করা। ওনার মাথায় তেল দিয়ে দেওয়া। কোমড়ে আঁচল গুঁজে রান্না করা। আমি আমার কল্পনায় যেমন সংসার সাজাতাম ঠিক তেমন। আগের ক্ষত গুলো যেন একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে সবচেয়ে তৃপ্তির দৃশ্য হলো রান্নার সময় আরজার আমার পা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা আমার আঁচল টেনে ধরা। ও রান্না ঘরে আসে বলে আমার সব সময় আমায় সাবধানে থাকতে হয়। রান্নার সময় রান্নাঘরে এলে আমার রান্না করতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু ও যখন মেঝেতে বসে অদ্ভুত শব্দ করে বা আমি ওর দিকে তাকালে নতুন নতুন দাঁত গুলো বের কিটকিটিয়ে হাসে মনে তখন প্রশান্তির হাওয়া বয়। আজকাল সোলাইমান সাহেব আমাকে ইনসিয়া বলে ডাকে না। আরজার মা বলে ডাকে। এ যেন অন্যরকম এক পাওয়া। তবে আমাদের সম্পর্কটা আর পাঁচটা দম্পত্তির ন্যায় না। এখনো সেখানে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। নিজেদের বোঝাপড়ার হিসেব চলছে। একজন আরেকজনকে একটু একটু করে চিনছি জানছি।

আমি সবসময় টাইম মেইনটেইন করে চলি।সময়ের কাজ সময়ে করা। তেমনি আমি রাত খাবার রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টার মাঝেই সেরে ফেলি। আবার আরজাকেও সামলাতে হয়। ওর পিছনে ঘুরতে ঘুরতে দেরি হয় তখন আর খেতে ইচ্ছে করে না। এদিকে আরজার বাবা বাসায় আসে সাড়ে ন’টার পরে।আর রাস্তায় ফাঁসলে তো কোনো কথাই নেই। মা খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তাই আমি উনার খাবার টেবিলে ঢাকা দিয়ে রুমে চলে আসি। কোনোদিন আরজাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে আমিও ঘুমিয়ে যাই। আর যখন চোখ মেলে তাকাই হয় মাঝরাত নয়তো রাতের শেষভাগ। উনাকে দেখি আমাদের দিকে পিঠ দিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকে। দু’দিন যাবৎ ওনি আমার সাথে ঠিকমতো কথা বলে না। আমাকে দেখলে কেমন গাল ফুলিয়ে থাকে। আরজা আমার কোলে থাকলে কিছু না বলে টান মে’রে নিয়ে যায়। উনার এই আচরণের পরিবর্তনে আমি আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থাকি।

সকাল বেলা টেবিল নাস্তা দিয়ে চেয়ারটা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আরজা আর মা মিলে মায়ের ঘরে খুনসুটি করছে। উনি অফিসের ড্রেস পরিধান করে ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে চেয়ার টেনেও বসলেন না। নাস্তা না করে বের হয়ে গেলেন। আমি বোকার মতো উনার কান্ডকারখানা দেখছি। দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে ওনাকে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু উনি লাপাত্তা। দরজা বন্ধ করতে নিবো এমন সময়,,,

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।