সৎ মা পর্ব-১৫+১৬

0
275

#সৎ_মা
#পর্বঃ১৫
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

উনি দৌড়ে এসে হুট করে আমায় জড়িয়ে ধরে সেকেন্ডের মাথায় চট করে ছেড়ে দিলেন। সেকেন্ডের মাঝে কি হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। উনি আমায় বললেন,

“ওহ আপনি? আমি ভাবলাম মা বুঝি।”

বলেই আমাকে পাশ কাটিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসলো। আমি ওনার পিছু পিছু গিয়ে উনাকে ইশারা করে আঙুল উঁচু করে দাঁত কটমট করে বললাম,

“আমাকে কোন এঙ্গেলে মা মনে হয়? কোন দিক দিয়ে বয়স্ক মনে হয়?”

উনি সোফায় গাঁ হাত পা ছেড়ে দিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলেন,

“আচ্ছা আমি কি বলেছি আমার মা? নাকি আমার নাম ম্যানশন করেছি? অন্যকারো মাও তো হতে পারে মানে আরজার মা। আমিও আরজার মা মনে করেই জড়…..”

নাক মুখ ফুলিয়ে বললাম,

“দেখুন আপনি কিন্তু কথা ঘুরাবেন না বলে দিলাম।”

ওনি সোজা হয়ে বসলেন।শরীর টানা দিয়ে বললেন,

“বেশি বকবক না করে আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসুন তো।আপনার সাথে কথা বলে আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছে। গলায় খরা অনুভব করছি।”

অগত্যা বাধ্য হয়ে কোনো কথা না বলে গেলাম ডাইনিং টেবিলের কাছে। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালছি। গ্লাসটা অর্ধপূর্ণ হওয়ার পর উনার বলা কথাগুলো আমার মস্তিষ্ক বুঝতে সক্ষম হলো। তারমানে উনি ইচ্ছে করেই আমাকে,,,,,। কথাটা ভাবতে গিয়ে আপনা-আপনি প্রসারিত হলো আমার ঠোঁটের কোণ।

পানি পূর্ণ গ্লাসটা উনার হাতে দিতেই উনি গ্লাসটা উনার ঠোঁটের কাছে নিয়ে চুমুক না দিয়ে টি-টেবিলের উপর রেখে দিলেন। আমি উনার কান্ডকারখানা দেখছি। আমার দিকে অসহায় চাহনি নিক্ষেপ করে বললেন,

“একটু অপেক্ষা করলে কি খুব ক্ষতি হয়?”

আমি উনার দিকে প্রশ্নসূচক চাহনি দিলাম। উনি আবার বললেন,

“আমি জানি তো আপনি সময়ের কাজ সময়ে করেন। খাবারটাও টাইমলি খান। আপনি আপনার খাবারটা খেয়ে আমার জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষা করতে তো পারেন নাকি? যখন মনে হয় আমার জন্য কেউ একজন অপেক্ষা করছে তখন বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে। তখন মনে হয় আমি বাড়ি গেলেই একজনের অপেক্ষার অবসান হবে। কেউ একজন না খেয়ে আমার জন্য বসে আছে একসাথে খাবে বলে। আপনি না হয় খেয়েই অপেক্ষা করলেন আমার জন্য। সব কলিগরা যখন বলে তাদের ওয়াইফরা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে তখন আমারও বলতে ইচ্ছে করে। বলবো কি করে আমার জন্য তো আর কেউ অপেক্ষা করে না। একজন স্বামীর কাছে এটাই বড় প্রাপ্তি। জানি তো আমি ভালো স্বামী বৈকি স্বামী হওয়ারও যোগ্যতা রাখি না তাই বলে,,,,,।”

কথা অসম্পূর্ণ রেখেই উনি চলে গেলেন। পিছু ফিরে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছেন। মা কিছু না বলে আবার নিজের রুমে চলে গেলেন। আমি পুনরায় আমার কাজে মনযোগ দিলাম।

____________________________________________

দুপুরের খাবার খেয়ে মায়ের সাথে মায়ের রুমে শুয়ে আছি। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।এক পর্যায়ে মা বললেন,

“বুঝলি ইনসিয়া পুরুষ মানুষকে সবাই বুঝে না। যে নারী পুরুষকে বুঝতে পারে তার মন পড়তে পারে সেই নারীই বুদ্ধিমতি।নারীর ভালোবাসায় পুরুষ যেমন নরম মনের হয় আবার তেমনি নারীর অবহেলায় পুরুষ পাথরে পরিণত হয়। তুই যদি অন্য কোনো পুরুষের সাথে তার তুলনা না করে, কোনো প্রকার রাগারাগি ছাড়াই ভালোবাসার সহিত কিছু আবদার করিস আমার বিশ্বাস সেই পুরুষ নিজের সর্বস্ব দিয়ে তোর সেই আবদার পূরণ করবে।”

খুব মনযোগ দিয়ে মায়ের কথা শুনছি।আমার দিকে তাকিয়ে মা মুচকি হাসলেন। আবার বলতে শুরু করলেন,

“আজ সকালে আমি সোলাইমানের সব কথাই শুনেছি। তোদের দু’জনর ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার নাক গলানো সাজে না। তোদের দু’জনের প্রথম শর্ত হচ্ছে আরজা। তারপর বাকি সব কিছু। আমার ছেলেটা একটু একটু করে তোর উপর দূর্বল হয়ে পড়ছে।বয়স তো আর কম হলো না। এইটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার আছে। তাছাড়া তুই আমাদের যেভাবে আগলে রাখিস তোকে ভালো না বেসে থাকা যায়? সোলাইমান অফিস থেকে আসার পর ওকে এক গ্লাস লেবুর শরবত আর ওর জন্য খাবার টেবিলে বসে অপেক্ষা করিস। তখন ওর মুখের দিকে তাকালেই হ্যাপিনেস দেখতি পাবি। নিজে একা একা হাহু করে হাসার নাম হ্যাপিনেস না। অন্যের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি আর তার তৃপ্তির কারণ হওয়াও এক প্রকার হ্যাপিনেস।

গাল ফুলিয়ে মা কে বললাম,

“আপনি এসব আগে কেন বললেন না? আসলে সেরকম ভাবে কাউকে এসব জিজ্ঞেস করা হয়নি বা মাকেও এসব করতে দেখিনি। আমি আমার জগৎ নিয়েই ছিলাম। তাই এতো বড় হওয়ার পরও এসব বিষয়ে আমি অজ্ঞ।”

____________________________________________

আজ আর আরজাকে শুয়ে শুয়ে ঘুম পাড়াইনি। দেখা যায় আমিও আরজার সাথে ঘুমিয়ে পড়ি। আরজা ঘুমানোর পরে ওকে রুমে শুইয়ে এসেছি। ড্রয়িং রুমে বসে বসে ফেসবুক স্ক্রল করছি আর আরজার বাবার জন্য অপেক্ষা করছি। প্রায় এগারোটা বাজতে চলল এখনো ওনার আসার নামগন্ধ নেই। আজ আমি অপেক্ষা করছি তো এমন করছে। মহারাজ এলেন তো এলেন সোয়া এগারোটায়। এইরাতের বেলায় উনার শার্ট ঘামে ভিজে চিপ চিপে হয়ে আছে। উনি রুমে যেতেই আমি চট করে রান্নাঘরে গিয়ে একগ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে রুমে গেলাম। গিয়ে দেখি উনি কাঁধে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছে। দরজা থেকেই ডেকে বললাম,

“আগে লেবুর শরবতটা খেয়ে নিন তারপর ওয়াশরুম যান।”

উনি একবার আমার দিকে তো আরেক আমার হাতের দিকে তাকাচ্ছেন। সামনে এগিয়ে যেতেই আমার হাত থেকে গ্লাসটা নিলেন।জিজ্ঞেস করলাম,

“আজ এতো দেরি হলো যে?”

উনি এক চুমুকে শরবতটা শেষ করে বললেন,

“একটা মালবাহী লড়ি রাস্তার মাঝামাঝি আটকা পড়েছে। সেই কারণে বিশাল জ্যাম লেগেছে। বাকি রাস্তা হেঁটে এসেছি। তাই এতো দেরি হলো।”

“রাতের বেলা হেঁটে এসেছেন যদি রাস্তায় কোনো বিপদ হতো?”

“আরে না আমি একা এসেছি নাকি? সবাই হেঁটেই এসেছে।”

খাবার গরম করে উনার জন্য বসে আছি। উনি চুল মুছতে মুছতে চেয়ারে এসে বসলেন। প্লেটে খাবার নিয়ে খাওয়া শুরু করবে ওই সময় আমি রুমে চলে এসেছি। সকালে কত জ্ঞান দিয়ে গেলো অথচ এখন একবারও জিজ্ঞেস করলো না খেয়েছি কি না? একবার সাধলোও না। ঠাস করে এসে আরজার পাশে শুয়ে পড়েছি। মিনিট দশেক বাদে উনি রুমের লাইট অন করে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে রইলেন। উনার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পিছু ফিরে বলি,

“লাইট অন করে এমন সং এর মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনি কি চাইছেন আরজা জেগে যাক আর আমাকে এই রাতের বেলা জ্বালাক? আরজার যদি ঘুম ভেঙে যায় তো দেখবেন কি করি?”

উনি শান্ত গলায় বললো,

“খাবেন না?”

কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিলাম,

“আমি সাড়ে আটটা বাজে খেয়ে নিয়েছি। আপনারও খাওয়া হয়ে গেলে এসে শুয়ে পড়ুন।কালকে আপনাকে আবার অফিস যেতে হবে।”

“কিন্তু চোখ মুখ তো তা বলছে না।চোখ মুখ যে বলছে না খেয়ে আছেন।”

“চোখ কথা বলতে পারে নাকি যে বলবে? সেই কখন খেয়েছি এখন প্রায় বারোটা বাজতে চললো এমন লাগারই কথা। আমি খাবো না আপনি যান।”

“আপনি না উঠলে আমিও যাবো না। এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো। আর বেশি করলে মাকে ডাকবো।”

বাঁধ্য হয়েই গেলাম ড্রয়িং রুমে। টেবিলের কাছে গিয়ে দেখি দু’টো প্লেটে ভাত নেওয়া। উনি চেয়ার টেনে আমাকে বসতে বললেন। একটা প্লেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

“এতো তাড়াহুড়ো করে অভিমান করলে হয় না। অভিমান একটু ধীরে সুস্থে করবেন।আগে দেখবেন তো কি করি আমি।না উনি চট করে চলে গেলেন। আসলেই মেয়ে মানুষ বোঝে বেশি।”

“দেখুন আপনি কিন্তু,,, ”

“কি বেশি করছি তাই তো? করলে করছি এখন খান।”

____________________________________________

অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছি। বাপ মেয়ে নাক টেনে ঘুমোচ্ছে। নাস্তা বানানোর পর রুমে এসে দেখি ওনি প্রায় রেডি হয়ে গিয়েছে। আরজা মোচড়ামুচড়ি করছে। বলতে বলতে উঠেও গেলো। ওর নিয়ে ওয়াশরুমে গেলাম। ফ্রেশ করিয়ে উনাকে বললাম,

“টেবিলে নাস্তা দেওয়া আছে। আপনি যানে আমি আরজাকে নিয়ে আসছি।”

নাস্তা শেষে উনি বের হয়ে যাচ্ছিলেন উনাকে ডেকে বললাম,

“দু’মিনিট অপেক্ষা করুন আমি আসছি।”

লাঞ্চ বক্সটা ওনার সামনে ধরলাম। উনি আমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলেন। মা মিটিমিটি হেসে নাস্তা শেষ করে নিজের রুমে আরজাকে নিয়ে চলে গেলেন।

“কি হলো ধরুন।”

আমার কথায় উনি সম্বিত ফিরে পেলো। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“এসবের দরকার ছিলো না।আমি ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নেই তো।”

“ক্যান্টিন থেকে খেতেন কিন্তু এখন আর খাবেন না। এখন থেকে অফিসে বসেও বউয়ের রান্না খাবেন। নাকি অফিসে বসে বউয়ের রান্না খেতে লজ্জা পাবেন?”

উনি কিছু না বলে আমার হাত থেকে বক্সটা নিয়ে চলে গেলেন।

আরজার মা হয়ে এই বাড়িতে এসেছি প্রায় ছয়মাস হতে চললো। এই ছয়মাসে আরজার বাবার অনেক পরিবর্তন দেখেছি। মাঝে মাঝে উনার বাচ্চাসুলভ আচরণ দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। দুপুরের রান্না করছি। আরজা গুটি গুটি পায়ে রান্নাঘরের এসে দাঁড়ালো। হুট করে বহুল কাঙ্খিত শব্দটি কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই আমার হাত থেকে খুন্তিটি ঠাস করে মেঝেতে পড়ে গেলো। চোখের কোণ গড়িয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#সৎ_মা
#পর্বঃ১৬
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

আমার কানে এখনো বাজছে আরজার কোমল গলায় আধো আধো বুলিতে মা ডাক। তপ্ত মরুভূমিতে যেন বহুদিন অপেক্ষার পরে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। শীতলতা বইছে আমার হৃদয়ে। শরীরে বল পাচ্ছি না। এলোমেলো পায়ে আরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। একটানে কোলে তুলে চু’মু’তে চু’মু’তে ভরিয়ে দিতে লাগলাম আরজার মুখশ্রী। কতদিনের প্রতীক্ষার ফল আমার। আধো আধো বুলিতে বাবা দাদা ডাকলেও কখনো মা বলে ডাকেনি।মা ডাকটা বুঝি এতো মিষ্টি? আরজাকে কোলে নিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছি। আরজা ওর তুলতুলে হাত দিয়ে আমার সারা মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ম,,,মা, ম,,,,মা করছে।

মা দৌড়ে এলেন রান্নাঘরে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগলেন,

“কিসের শব্দ হলো ইনসিয়া? গরম কিছু ফেলে দিয়েছিস পায়ে নাকি হাতে ছ্যাকা লেগেছে?”

মায়ের প্রশ্নের কোনো জবাব দিলাম না। অশ্রুসিক্ত নয়নে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা টেনে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মা কোনো উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন করলেন,

“বলবি তো কি হয়েছে? তুই ব্যথা পেয়েছিস নাকি আরজা? চোখের কোণে পানি টলমল করছে আবার ঠোঁটে মুচকি হাসি। চুপ করে না থেকে কিছু একটা বল।”

“আপনার নাতনি আমায় “মা” বলে ডেকেছে মা।”

“তাই তুই এভাবে কাঁদছিস?”

নাক টেনে টেনে জবাব দিলাম,

“হুম মা সুখের কান্না। আমার অপেক্ষার ফল পেয়েছি আমি কাঁদবো না?”

মা তড়িঘড়ি করে আমাকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরের ভেতরে গেলেন। আমি পিছন ফিরে দেখি মা তাড়াতাড়ি করে চুলোর আ’গু’ন নিভিয়ে কড়াইটা তুলে রাখলেন। হাসতে হাসতে বললেন,

“মা” ডাক শোনার খুশিতে তরকারি পুড়ার গন্ধও নাকে লাগছে না তোর? “মা” ডাক শুনে মেয়ে আমার পা’গ’ল হয়ে গিয়েছে।”

রান্না অসম্পূর্ণ রেখে মেয়েকে নিয়ে বসে আছি। মা বলেছেন বাকি রান্না উনি সারবেন।আজ আর আমাকে রান্নাঘরে যেতে হবে না। চট করে মাথায় আসলো আরজার বাবাকে জানানো দরকার। কল করলাম উনাকে। নাম্বার ওয়েটিং দেখাচ্ছে। ভ্রু জোড়া আপনা-আপনি কুঁচকে এলো আমার। অফিসে বসে আছে অফিসের কারো সাথে কথা বলার প্রশ্নই আসে না। তিনবারের মাথায় কল রিসিভ করলেন উনি। শক্ত গলায় বললেন,

“দেখছন না ওয়েটিং দেখাচ্ছে বার বার কল কেন দিচ্ছেন?”

উনার শক্ত গলার স্বর শুনে আমার কেমন কান্না পেয়ে গেলো।উনি কখনো আমার সাথে এমন করে কথা বলেননি।তারপরও নিজেকে সামলে আজকের ঘটনা উনাকে বলার জন্য বললাম,

“আরে আমার কথাটা তো শুনবেন?”

উনি ঝাঁঝি গলায় বললেন,

“এখন কোনো কথা শুনতে পারবো না আমি। কাজে ব্যস্ত আছি। বাসায় এসে সব শুনবো। এখন রাখছি।”

বলেই ফোন রেখে দিলেন। যেই আনন্দ নিয়ে উনাকে ফোন করেছিলাম আনন্দটাই মাটি হয়ে গেছে। মা নিজের রুম থেকে বেরিয়ে ফ্রিজের কাছে গেলেন। ফ্রিজ থেকে একটা মাংসের পলিথিন বের করে ভিজিয়ে রাখলেন। মাকে জিজ্ঞেস করলাম,

“মা এখন মাংস কিসের জন্য? মাছ তো প্রায় রান্না হয়েই গিয়েছে।”

মা হাত মুছতে মুছতে জবাব দিলেন,

“আজ আরজা তোকে মা বলে ডেকেছে সেই খুশিতে কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করবো।”

“কিন্তু মা আমি তো কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করতে পারি না।”

“তুই রান্না করবি কেন? বিরিয়ানি রান্না করবো আমি। এটা তোর মা ডাক শোনার খুশিতে আরেক মায়ের পক্ষ থেকে ভালোবাসা।”

“থাক মা এই অসুস্থ শরীর নিয়ে এসব করার কোনো দরকার নেই আপনার। আর আমি দুপুরেও খাবো না।আপনি কষ্ট করে একা একা খেয়ে নিয়েন।আরজাকে গোসল করিয়ে খাইয়ে ঘুম পাড়াবো সাথে আমিও ঘুমাবো। অনেকদিন ঠিকমতো ঘুমোতে পারি না।”

“কিছু হয়েছে ইনসিয়া? এইতো একটু আগে বেশ হাসিখুশি ছিলি এখন কি হলো?”

“কিছু হয়নি মা। এমনিতে ভালো লাগছে না। আর আপনার এসব ঝামেলা করার দরকার নেই।”

মাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুমে চলে এলাম আমি। উনার এমন শক্ত গলায় বলা কথাগুলো আমার ভেতরে অভিমানের ঝড় তুলছে। আরজাকে গোসল করিয়ে রুমে এসে দেখি মোবাইল বাজছে। আরজার বাবা কল দিয়েছে। রিসিভ করবো কি করবো না ভাবতে ভাবতে রিং বাজা বন্ধ হয়ে গেলো। সেকেন্ডের মাথায় আবারও রিং বাজতে শুরু করলো। রিসিভ করে কানে ধরতেই উনি হালকে ধমক দিয়ে বলেন,

“মোবাইল ফেলে কোথায় থাকেন আপনি? একবারের বেশি ফোন দিতে হয় কেন? কাজে ব্যস্ত থাকার পরও উনার কল রিসিভের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়। শুনুন তখন বলতে ভুলে গিয়েছি। আজ রাতে আমি বাসায় আসবো না। খুব জরুরি কাজে কোনো এক জায়গায় যাবো।”

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবারও উনি ফট করে মোবাইল রেখে দিলেন। আমি মোবাইল কানে রেখেই কেঁদে দিলাম। যাকে বেশি আপন মনে করি তার হালকা ধমকেও মনে অভিমানের সৃষ্টি হয়।

আরজাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আমিও শুয়ে আছি। কিন্তু ঘুম আসছে না। মা কতবার করে ডেকে গিয়েছে খাওয়ার জন্য। কিন্তু আজ আর আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না। সাবধানে শোয়া থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। নীল আকাশ দেখছি এক ধ্যানে। আকাশে কিছুক্ষণ বাদে বাদে এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে। হুট করে মনে হলো, আমি যদি পাখি হতাম?অনেক ভালো হতো। কোনো টেনশন থাকতো না। আর থাকতো কোনো দো-টানা। মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। দু’কাপ চা নিয়ে মা এসে দাঁড়িয়েছেন। আমার হাতে চায়ের কাপ দু’টো দিয়ে দু’টো মোড়া নিয়ে আসলেন বসার জন্য। একটা কাপ আমার হাত থেকে নিয়ে ইশারা করলেন চা খাওয়ার জন্য। মা কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,

“তোর আজ মন খারাপ কেন? সোলাইমান তোকে কিছু বলেছে?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলাম,

“না, উনি আমাকে কি বলবে।এমনি কিছু ভালো লাগছে না।”

“দুপুরের দিকেই তো আরজা মা বলে ডেকেছে বলে কত খুশি ছিলি তাহলে?”

“এমনি বাদ দিন তো মা।”

মা আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন,

“আচ্ছা ঠিক আছে বাদ দিলাম।”

খানিক বাদে মা উত্তেজিত গলায় বললেন,

“ইনসিয়ারে সন্ধ্যার পরে বাইরে যাবি? শ্বাশুড়ি বৌমা মিলে আজ সকল প্রকার স্ট্রিট ফুড খাবো। আজ নাকি সোলাইমানও বাসায় আসবে না।কোনো টেনশন নেই। না করবি না কিন্তু।”

আনন্দে উনার চোখ চকচক করছে। মনে হচ্ছে অনেক দিনের আশা আজ পূরণ হবে। যাবো না বলে আর উনার আনন্দটা মাটি করতে ইচ্ছে হলো না।

____________________________________________

ফুটপাত ধরে আমি আর মা হাঁটছি। আরজা রঙবেরঙের আলোর ঝলকানি দেখে খিলখিল করে হাসছে। আরজাকে একবার আমি কোলে নিচ্ছি তো আরেকবার মা। একটা ফুচকা স্টলে গিয়ে বসলাম আমি আর মা। দু’প্লেট ফুচকা অর্ডার করলেন খুব ঝাল দিয়ে। দোকানে থাকা ছেলেটা ফুচকার প্লেট দিতেই মায়ের চোখ দু’টো চকচক করে উঠলো। তেঁতুলের টক দিয়ে একটার পর ফুচকা তৃপ্তির সাথে খাচ্ছেন। আমি মায়ের খাওয়া দেখে আমার ফুচকা খাওয়া ভুলে গিয়েছি। এতো ঝাল ফুচকা খাওয়ার পর মায়ের চোখ মুখ একেবারে লাল গিয়েছে। মা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললেন,

“তোর বর আমাকে এসব খেতে দেয় না।বলে আমার নাকি বয়স হয়েছে। এসব খাওয়া নাকি ভালো না।আনহাইজিন এগুলা। আচ্ছা বলতো কি এমন বয়স হয়েছে আমার? আর এতো হাইজিনিটি মেইনটেইন করে কি হবে? অসুস্থ হবো করে করে আমাকে এসব ভাজাপোড়া কিছুই খেতে দেয় না। অথচ তোর শ্বশুর বেঁচে থাকতে রোজ সন্ধ্যায় আমার জন্য কিছুনা কিছু নিয়ে আসতেন। কোনোদিন ফুচকা তো কোনোদিন চটপটি আবারও কখনো গরম আলুর চপ, বেগুনি, পিয়াঁজি আরো কতো কি। খুব মিস করি আগের দিনগুলো। তোর শ্বশুর যদি বেঁচে থাকতো কত ভালো হতো। মানুষটা বেশ রসিক ছিলেন।”

ব্যপারটা মন খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে মায়ের মন অন্য দিকে ঘুরানোর জন্য আমার জন্য নেওয়া ফুচকার প্লেটটা ওনার দিকে দিয়ে বললাম,

“নিন মা এটাও খেয়ে নিন।”

মা টিস্যু দিয়ে নাক মুছতে মুছতে বললেন,

“হায় হায় তুই এখনো খাসনি? ফুচকা সামনে নিয়েও বসে থাকা যায়? আমি আর ফুচকা খেতে পারবো না। শুধু ফুচকা খেয়ে পেট ভরালে হবে? আমি আজ সকল প্রকার স্ট্রিট ফুড খাবো। কতদিন পরে আজ সুযোগ পেলাম।”

মায়ের কথায় মুচকি হাসলাম আমি। আরজার দিকে ইশারা করে বললাম,

” আপনার গুণোধর নাতনি খেতে দিলে তো। আর মা বেশি পরিমাণে খেলে কিন্তু সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে যাবেন”

” আরে একদিন খেলে কিছু হবে না।দে ওকে আমার কাছে দে।”

আরজাকে মায়ের কাছে দিয়ে একটা ফুচকা মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বললাম,

“মা বাবা এত ভালো ছিলো তাহলে আপনার ছেলেটা কার মতো হলো? উনি এতো খাড়ুস কেন? একেবারে বেরসিক।”

মা আমার কথায় অট্টহাসিতে মেতে উঠলেন।

____________________________________________

আরজার বাবা বাসায় আসলেন পরদিন সকাল দশটায়। দরজা খোলা মাত্রই কিছু না বলে রুমে চলে গেলেন। আমি লেবুর শরবত নিয়ে গেলেও উনি গ্লাসটা ছুঁয়েও দেখলেন না। চোখে মুখে উনার আজ অন্য রকম আনন্দ। আমি যতবারই উনার সামনে গিয়েছি ঠিক ততবারই উনি আমাকে এড়িয়ে গেলেন। আর সারাদিন পরে পরে ঘুমিয়েছেন।

শুধু সেদিনই না আজ বেশ কয়েকদিন হলো উনি আমাকে অবহেলা করছেন। ঠিকমতো কথা বলেন না। রাতে উনি একা একা খেয়ে উঠে যান আমাকে একবার জিজ্ঞেসও করেন না খেয়েছি কিনা। অবহেলার মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। উনার এই অবহেলা আমি নিতে পারছি না। বুকের ভেতর কেমন ভাংচুর হয়। একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলেছি আমি উনাকে। উনার এড়িয়ে যাওয়া দেখলে মনে হয় আমি উনাকে হারিয়ে ফেলছি। আজকে একটা বিহিত করতেই হবে। উনার এই অবহেলা আমি আর নিতে পারছি না।

____________________________________________

রাতে উনি বাসায় আসার পর যখন রুমে গেলেন তখন আমিও উনার পিছু পিছু রুমে আসলাম। উনার কলার ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

“আমাকে এভাবে এভয়েড কেন করছেন? কি করেছি আমি? আমি আপনাকে সময় দেই না বলে আপনার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করি না বলে আপনি অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে গেছেন তাই না? আপনি আমার সাথে ঠিকমতো কথা বলেন না বলে আমার খুব কষ্ট হয়। আমাকে দয়া করে অবহেলা করবেন না। আপনার করা অবহেলা বি’ষে’র চেয়েও বি’ষা’ক্ত। লাগে আমার কাছে।”

উনি রাগে কটমট করতে করতে বললেন,

“আমি বলেছি আমি অন্য নারীতে আসক্ত? নাকি এমন কোনো হিন্টস দিয়েছি, কোনটা?

“না হলে সেদিন রাতে আপনি কোথায় ছিলেন আর বাসায় আসার পর সারাদিন ঘুমিয়েছিলেন কেন?”

“আমি সারাদিন ঘুমিয়েছি বলে আপনি এতো কিছু ধরে নিয়েছেন?

বলেই বের হয়ে গেলো রুম থেকে। রাতে রুমেও আসলেন না খাবারও খেলেন না। পরেরদিন সকালেও নাস্তা না করে চলে গেলেন। মায়ের কাছে বলে গেলেন জরুরি মিটিং আছে। আমি যে দরজা কাছে গিয়ে লাঞ্চ বক্সটা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম উনি যেন দেখেও দেখলেন না।

আজকে সারাটা দিন দীর্ঘ মনে হয়েছে। আমি অপেক্ষা করেছি কখন রাতে হবে আর আমি কখন উনাকে দেখবো। রাতে উনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ কোনোকিছুর পড়ার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। অন্ধকার হাতরে দেখি পাশে আরজা নেই। বুকের ভেতর কেমন ছ্যাঁৎ উঠলো। দিনকাল ভালো না কোনো বিপদ হলো না তো? হঠাৎই কোনো কালো ছায়া দেখে,,,,,

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।