সৎ মা পর্ব-৭+৮

0
320

#সৎ_মা
#পর্বঃ০৭
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

বাবা সোলাইমান সাহেব কে বললেন,

“বড় করে অনুষ্ঠান করলে সমস্যা কি? আমার বড় মেয়ে ওর বিয়ে নিয়ে তো আমার অনেক আশা থাকতেই পারে তাই না?”

কথার মাঝখানে আমি উত্তর দিলাম,

“সিদ্ধান্ত টা ওনার না বাবা সিদ্ধান্ত টা আমার। যা ওনি নিজের মুখ দিয়ে বলেছেন।”

বাবা সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ টা জানতে পারি?”

“বিয়ে বাড়িতে নানারকম মানুষ আসবে। সবার মনমানসিকতা একরকম না। একেক জনের একেক রকম। যখন সব শুনবে তারা বিভিন্ন মন্তব্য করবে যা আমি মেনে নিতে পারবো না। ওইদিন আমি আমার জীবনে নতুন অধ্যায়ে পদার্পণ করবো। মানুষের বিভিন্ন কথা শুনে আমি পুরো দিনটা মাটি করতে পারবো না। পরে বলুক তাতে আমার সমস্যা নাই। আমি অন্তত চাই না কেউ ওই বিশেষ দিনে খোঁচা দিয়ে কথা বলুক।

বাবা কুঁচকে যাওয়া ভ্রু যুগল স্বাভাবিক করলেন। তারপর বললেন,

“তোমার যা মর্জি। রাবেয়া রান্নাবান্না কত দূর? দুপুর তো হয়ে এলো। ওনাদের খাবারের সময় হয়েছে।”

মা জবাব দিলেন,

“সব রান্না শেষ শুধু পায়েষ টা বাকি। আধঘন্টা পরে টেবিলে খাবার দিবো।”

মা রান্নাঘরে গেলেন। মায়ের পিছু পিছু ইকরাও গেলো। আরজা দাদি আমার কাছে আসলেন। এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

“স্যলুট জানাই তোমার চিন্তাভাবনা কে। সব মেয়ে তোমার মতো হলে কোন সংসার মাঝপথে ভেঙে যেতো না। সন্তান মা ছাড়া হতো না। কোনো সংসার অবহেলায় পড়ে থাকতো না। আমি তোমার জন্য মন থেকে দোয়া করি মা। সব সময় ভালো থাকো আর সংসার জীবনে সুখী হও।”

“দোয়া করবেন আমি যেন সবাইকে আগলে রাখতে পারি।”

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে ওনারা বিদায় নিলেন। সময় চলছে সময়ের গতিতে। দুইদিন পরে ইরফান বাড়ি আসে। আমার কাছে এসেই বলে,

“আপু, আপু, আপু কনগ্রেচুলেশন! নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা। কিন্তু আফসোস আমি সেদিন ছিলাম না।”

____________________________________________

টিফিন পিরিয়ডের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছি। দুইদিন যাবৎ শরীরটা বেশি ক্লান্ত লাগে। এই মাসের শেষে চাকরিটা ছেড়ে দিবো। চোখ বন্ধ করে এইসবই ভাবছিলাম। মোবাইলের কর্কশ শব্দে চোখ মেলে তাকাই। স্ক্রিনে সোলাইমান সাহেব এর নাম টা জ্বলজ্বল করছে। এই ভরদুপুরে ওনার কল দেখে আমার ভ্রু যুগল আপনা আপনি কুঁচকে এলো। এখন তো ওনার কল করার কথা না। মোবাইল রিসিভ করে কানে দিতেই ওনি কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন,

” ইনসিয়া কোথায় আপনি? ইনসিয়া, আমার মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। র’ক্তে,,,,

এতটুকু কথা শুনে আমার ক্লান্তি যেন হাওয়া হয়ে গেলো।বসা থেকে কখন উঠে দাঁড়িয়েছি সেই খেয়াল নেই। ওনাকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে প্রশ্ন করলাম,

” সোলাইমান সাহেব কি হয়েছে আরজার? খুলাখুলি বলেন দয়া করে।”

“আমার মেয়েটা কান্নার জন্য ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারছে না ইনসিয়া। মা ওকে মেঝেতে বসিয়ে ওয়াশরুমে গিয়েছিলো। ও হামাগুড়ি দিয়ে টি টেবিলের উপর থেকে গ্লাস নিয়ে আসে।গ্লাসটা দিয়ে খেলতে নিলে গ্লাসটা কোনোভাবে ভেঙে যায় আর আরজার দুই হাত কে’টে গলগল করে র’ক্ত পড়ছে। কোনোমতেই র’ক্ত ঝরা বন্ধ হচ্ছে না। সারা মেঝে র’ক্তে ভরে গেছে। আমার বাচ্চা মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে, ইনসিয়া। আমি না কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি প্লিজ আসুন না। মেয়েটা আমার জন্মের পর থেকেই কষ্টে কষ্টে আছে।”

কলটা ফট করে কেটে দিয়ে আমার কলিগ বলে বেরিয়ে এলাম স্কুল থেকে। রিক্সা না ডেকে সিএনজিই ডাকলাম। রাস্তা যেন শেষই হচ্ছে না। বিপদের রাস্তা নাকি সহজে শেষই হয় না। মনে হচ্ছে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। গন্তব্য আসার নাম গন্ধ নাই। হাসপাতালের সামনে সিএনজি থামা মাত্রই দৌড়ে ভেতরে গেলাম। দুই মিনিট বাদে ফিরেও এলাম। কারণ তাড়াহুড়ায় ভাড়া দিতেই ভুলে গেছি।

হাসপাতালের করিডোরে আসতেই আন্টিকে দেখলাম বসে আছে। তাড়াতাড়ি করে কোনোমতে সেখানে গেলাম। আন্টি আমাকে দেখা মাত্র আমার হাত দুটো ওনার হাতের মুঠোয় নিয়ে কপাল ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগলেন। ওনাকে কিভাবে সান্ত্বনা দিবো বুঝতে পারছিলাম না। ওনাকে সোজা করে বসালাম। হাত ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ওনার হাতে দিলাম খাওয়ার জন্য। একটু পানি ভালো লাগবে। তারপর ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম,

“আন্টি আরজা আর ওর বাবা কই?”

আন্টি ঢকঢক করে পানি খেয়ে উত্তর দিলেন,

“বাবু আরজাকে নিয়ে ওই রুমে গিয়েছে। ডাক্তার ব্যান্ডেজ করছেন। দেখো না আমার শাড়িতে কেমন র’ক্ত লেগে আছে। আমার অসতর্কতার জন্য এমনটা হলো। আমার অসতর্কতার ফল আমার নিষ্পাপ নাতনিটা ভোগ করছে।”

” এতে আপনার কোনো দোষ নেই আন্টি। ভাগ্যে যা আছে তা ঘটবেই।”

সামনে তাকিয়ে দেখি সোলাইমান সাহেব আরজাকে নিয়ে আসছে। নরম তুলতুলে হাত দুটো সাদা ব্যান্ডেজে আবৃত। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে বাবার বুকেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। কান্নার ফলে চোখ মুখ ফোলা ফোলা লাল হয়ে আছে। মেয়েটা সুস্থ থাকলে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আমার বুকে লুটিয়ে পড়তো। ওনার কাছে গিয়ে আরজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ওনাকে আর আন্টি কে বললাম,

“আপনারা দুজন নিজের বাড়িতে না গিয়ে আমার বাসায় আসুন।”

সোলাইমান সাহেব জবাব দিলেন,

“এখন আপনার বাড়িতে কেন যাবো?”

“কারণ আমি বলেছি তাই।”

অনেকটা জোর করেই দু’জনকে আমার বাড়িতে নিয়ে এলাম। বেল বাজানোর সাথে সাথে মা দরজা খুলে দিলেন। এই সময় মেইনডোরের বাইরে আমাদের সবাইকে দেখে ভ্রু কুটি করে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন,

“এই সময় তোমরা? ইনসিয়া কি আজ স্কুলে যাওনি?”

সোলাইমান সাহেবের কোল থেকে আরজাকে আমার কোলে নিয়ে বললাম,

“বলছি আগে ভেতরে আসতে দাও।”

ওনাদের দু’জনকে সোফায় বসতে বলে মা কে জিজ্ঞেস করলাম,

“আজ কি বাবা অফিস গিয়েছি?”

মা জবাব দিলেন,

“হুম গিয়েছে তবে লাঞ্চ আওয়ারে চলে আসার কথা। হয়তো রাস্তায় জ্যামে আঁটকা পড়েছে। এই আরজার হাতে কি হয়েছে? দুই হাত তো ব্যান্ডেজ করা।”

সোলাইমান সাহেব কে বললাম,

“আপনি মা কে বলুন কি হয়েছে আমি এই ফাঁকে আরজার শরীর টা ভেজা টাওয়াল দিয়ে মুছে দেই। শরীরটা মুছে দিলে ওর একটু ভালো লাগবে।”

খুব সতর্কতার সাথে আরজার শরীরটা মুছে দিচ্ছি। যেন ঘুম ভেঙে না যায়। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলে না। মেয়েটা জেগে গেলো। চোখ মেলে আমাকে দেখা মাত্র নিষ্প্রাণ হাসলো। তার পরপরই ঠোঁট ভেঙে কান্না করে দিলো। মেয়েটার নিষ্প্রাণ হাসি আর ঠোঁট ভেঙে কান্না দেখে আমার ভেতরটা কেমন ছ্যাৎ করে উঠলো। আমার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলাম। ওকে শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে ড্রয়িং রুমে এলাম। এসে দেখি বাবা চলে এসেছে। আর ওনাদের নাস্তা দিয়েছে। বাবা আমাকে দেখে প্রশ্ন করলো,

“তুমি নাকি ওনাদের কিছু না বলে প্রায় জোর করে নিয়ে এসেছো। এর কারণটা কি?”

“বাবা আমি আজ এখনই সোলাইমান সাহেবকে বিয়ে করতে চাই।”

বাবা “কি” বলে উঠে দাঁড়ালেন। আমার দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

“তুমি তো বলেছিলে শুক্রবার বিয়ে করবে তাহলে আজ কেন?”

“বাবা আমি মূলত আরজার জন্য বিয়েটা করছি যেন ও মা পায়। দেখো না বাবা ওর হাত দুটো। নরম হাত দুটো আজ ব্যান্ডেজ করা। আন্টি তো নিজেই বয়স্ক মানুষ। ওনাকেই তো আরেকজন সেবা করার কথা। সার্বিক দিক বিবেচনা করে আমি আজই বিয়ে করতে চাইছি। আরজার বাবা আপনার এখানে কিছু বলার আছে?”

ওনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,

“আপনি হয়তো আমার মেয়ের ভালোর দিকটা চিন্তা করে আজকেই বিয়ে করতে চাইছেন। সেখানে আমার আপত্তি মানায় না। তবে আপনার বাবা যেই সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই হবে। সবটাই যে আমাদের মনমতো হবে এমন টা না।”

“আর আন্টি আপনি কি বলেন?”

“আমার ছেলে যা বললো তার সাথে আমি একমত।”

আরজার বাবা আর দাদি চুপচাপ সোফায় বসে আছে। আমি বাবাকে মানানোর চেষ্টা করছি। কারণ মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি সবার আগে। বাবার এককথা আমার কথা মেনে ওনি কোনো রিসিপশন ছাড়াই শুক্রবার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। আজ কোনোমতেই রাজি হবেন না। গয়না বানাতে দিয়েছেন সেগুলো শুক্রবার দিন দিয়ে যাবে দোকান থেকে। বাবাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে অসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে এসব দেখছিলো ইরফান। আমি যখন বাবাকে বোঝাতে ব্যর্থ হলাম তখন ও বাবার পায়ের কাছে বসলো। বসে বললো,

“ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকাও বাবা আর ওর হাত দুটোর দিকে। কতটা গভীরভাবে কেটেছে তা সোলাইমান ভাইয়ার শার্ট আর আন্টির শাড়িতে শুকিয়ে যাওয়া র’ক্তের দিকে তাকালে বোঝা যায়। ওর বাবা তো অফিসে চলে যাবে আর বয়স্ক মহিলাটা কি পারবে ওই বাচ্চা মেয়েটাকে সামলাতে? এখন এটা বলো না যে ওনারা এতোদিন কিভাবে সামলাতো? ওনারা এতোদিন সামলাতো কারন ওনারা জানতো ওনাদের কাজ ওনাদেরকেই করতে হবে। কিন্তু এখন ওনারা আপুর আরজার প্রতি ভালোবাসা দেখে একটু একটু করে আপুর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। দেখো মেয়েটা কেমন আপুর সাথে মিশে আছে। তাছাড়া আপু তো বলেছে কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াই বিয়ে করবে। তাহলে আজ বিয়েটা দিতে এতো আপত্তি কোথায়?”

সন্ধ্যা নাগাদ আমার আর সোলাইমান সাহেবের বিয়েটা হয়েই গেলো। একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলাম আমরা। আজ থেকে আমার একটা নতুন পরিচয় হলো “মিসেস সোলাইমান সাদিক” আর আরজার মা। রেস্টুরেন্ট থেকে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পরপরই আরজা দাদি ও বাড়িতে চলে গেলেন বরণের বন্দবস্ত করার জন্য।ও বাড়িতে তো আমার কিছু নেই তাই আমার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র লাগেজে করে নিচে নেমে এলাম। সোলাইমান সাহেব কে বললাম,

“আপনি জানতে চেয়েছিলেন না কেন আমি আপনাকে বিয়ে করছি? আর ইরফান তুই জানতে চেয়েছিলি আমার কিসের এতো কষ্ট?জবাবে আমি বলেছিলাম তো যেদিন কারো হাত ধরে এবাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়ে অন্য কোথাও যাবো সেদিন বলবো।

আরজার মতো আমিও মা হারা। আমারও মা নেই। পার্থক্য হলো আমার মা আকাশের তারা হয়ে গেছে আর মা অন্য কারো হাত ধরে চলে গেছে।”

চলবে,,,

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#সৎ_মা
#পর্বঃ০৮
#রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

বাবা সোফায় বসা ছিলো আমার মুখ নিঃসৃত বাক্য ওনার কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই এক ঝটকায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।একবার আমার দিকে তো একবার মায়ের দিকে তাকাতে লাগলেন। হয়তো বাবা কোনোদিন কল্পনা না ও করিনি আমি সত্যিটা কোনোদিন জানতে পারবো। ইরফান, ইকরা আর সোলাইমান সাহেব আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তবে সবচেয়ে বেশি অবাক বোধ হয় মা হয়েছে। ইরফান আমার কাছে এসে আমার হাত দুটো ধরে বলল,

“আপু তুমি এসব কি বলছো? আমাদের মা তো আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”

ইরফানের দিকে নিষ্প্রাণ চাহনি নিক্ষেপ করলাম।বাবা উত্তেজিত কন্ঠে মা কে প্রশ্ন করলেন,

“ইনসিয়া এটা কিভাবে জানলো,রাবেয়া? তুমি বলেছে তাই না? সেজন্যই আমার মেয়েটা দিনকে দিন এমন পরিবর্তন হচ্ছিলো। ওর মা নেই সেটা জেনে যেন মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে সেজন্য সবকিছু ছেড়েছুড়ে এখানে এসেছিলাম। আর তুমি সেটাই করলে। একটু একটু করে মেয়েটা কে তুমি ভেতর থেকে শেষ করে দিলে। এমনটা কেন করলে রাবেয়া? আমি কি তোমায় কোনো কিছুর অভাব দিয়েছিলাম?”

বাবার কথার প্রেক্ষিতে মা হন্তদন্ত হয়ে উত্তর দিলো,

“বিশ্বাস করো তুমি আমি এসবের কিছুই ওকে বলিনি। ও তো এখানেই আছে ওকে জিজ্ঞেস করো। এই ইনসিয়া আমি তোমাকে কখনো মে’রে’ছি না বলেছি এসব কথা?”

মায়ের কথা শুনে আমার ঠোঁটের কোণে আপনা আপনি তাচ্ছিল্যের হাসি ফোঁটে উঠল।বাবা মা কে ধমকে রাগী গলায় বললেন,

“তুমি আর আমি ছাড়া তো কেউ জানেনা। তাহলে ও কোথা থেকে জানতে পারলো?”

“তোমরা তোমাদের এসব কথা পরে আলোচনা করো। আগে আমি আমার কথাগুলো শেষ করি। আমি প্রথম থেকে শুরু করি।সবটা শুনলে বুঝতে পারবে আমি কোথা থেকে জানলাম।”

ড্রয়িং রুমে পিনপতন নীরবতা। বাবা সোফায় বসে গাঁ হাত পা ছেড়ে দিলেন। চোখে-মুখে অসহায়ত্বের ছাপ। ইরফান সোফার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। আরজা এতকাল ঘুমিয়ে ছিলো কথার আওয়াজে জেগে গেছে। তাই আরজার বাবা ওকে কোলে নিয়ে সোফায় বসলো। ওপাশে মা দাঁড়িয়ে আছে মুখের ভাব গতি দেখে কিছুই আন্দাজ করা যাচ্ছে না।

“আরজার বাবা আপনার মনে হচ্ছে না কেন এইসব কথা গুলো এতোদিন না বলে আজ আপনাকে সামনে রেখে বলছি?”

ওনি আমার দিকে ভাবলেশহীন চাহনি দিলেন। ওনাকে কিছু বলতে না দিয়ে পুনরায় আমিই বললাম,

“আপনার জানা উচিৎ আপনার বউয়ের মা নেই। সে এতিম। এই যে ওনি সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ওনি আমার নামে মাত্র মা। আজ পর্যন্ত কোনোদিন আমাকে সন্তানের নজরে দেখেছে বলে আমার মনে হয় না।তাই বলবো শ্বশুর বাড়ি এলে কেউ আপনাকে জামাই আদর করবে সেই আশা রাখবেন না। আপনাকে বিয়ে করার মেইন কারন হচ্ছে এটা। আমি জানি মা না থাকার যন্ত্রণা। আর থেকেও না থাকার যন্ত্রণা তো আরো প্রখর। আমি তো আর জানতাম না ওনি আমার মা না। ওনাকে দশবার ডাকলে একবার সাড়া দিতো। অথচ ইরফান বা ইকরা ডাকার আগেই ওনি হাজির হতেন।আমি চেয়েছিলাম আরজা টা একটা মা পাক।আমি সেটা প্রমাণ করবো যে পেটে না ধরেও সন্তানের মা হওয়া যায়। আমার উচিৎ ছিল আপনাকে সব আগে বলা। আমার মনে হয়েছিল সব শুনে যদি পরে আমাকে আপনি বিয়ে না করেন তো আমি আরজার মা হবো কেমনে? আমি না সত্যি আরজার মায়া এই ইহকালে কা’টা’তে চাই না।”

“ইরফান একটু পানি খাওয়াবি? গলাটা না কেমন শুকিয়ে গিয়েছে। অনেক দিনের জমানো কষ্ট তো কান্না আঁটকে রাখতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।”

এক গ্লাস পানি দিলো ইরফান আমাকে।এক ঢুকে পুরো এক গ্লাস পানি খেলাম। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্থির করলাম।

“আচ্ছা মা, বাবা তো তোমাকে কোনোকিছুরই অভাব দিতো না তাহলে ওদের সবকিছু কিনে দেওয়ার পরই যখন আমার জন্য কিছু কিনতে যেতে তখনই কেন তোমার টাকা শেষ হয়ে যেতো? বাবা তো আমাদের তিনজনের শপিং এর টাকাই দিতো তাই না। আমার ভাগ্যে কেন ফুটপাতের কাপড়ই জুটতো? আচ্ছা ইরফান ছোটবেলায় কখনো দেখেছিস মা তোদের সাথে আমাকে খেতে দিতে? দেয়নি কেন জানিস তোদের ভাগ্যে লেগ পিস জুটলেও আমার ভাগ্যে জুটতো মুরগির গলা, চামড়া আর এক চামচ ঝুল।প্লেটে ভাত তরকারি দিয়ে ওনি কি বলতো জানিস? বলতো, মুরগির ভালো ভালো টুকরো গুলো তোর বাবার জন্য রেখেছি।এগুলো তুই খেয়েনে।তোর বাবা তো সারাদিন কষ্ট করে তাই না। বড় মেয়েরা সংসারের দরদ বুঝে। আমিও সাদা মনে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে উঠে যেতাম। আসলে কি বাবা, বলো তো মা না ওপস সরি তোমার স্ত্রী না খুব চালাক। শারীরিক ভাবে অ’ত্যা’চা’র করলে তা দাগ থাকবে তাই ওনি আমাকে আমার অজান্তে মানসিকভাবে অ’ত্যা’চা’র করেছে। কেউ বুঝতেই পারেনি। ইরফান তোর কি খারাপ লাগছে এসব শুনতে? কষ্ট লাগলেও আমার কিছু করার নাই ভাই। বলেছিলাম না বিদায়ের দিন সকল কষ্ট আমি এখানেই রেখে যাবো। আমাকে হালকা হতে দে।”

আবারও এক গ্লাস পানি খেলাম আমি। আজ কেন জানি গলারা বার বার শুকিয়ে যাচ্ছে।

“আমার বাবার অঢেল আছে কিন্তু আমার কিছুই নেই। পনেরো বছর বয়সে আমি জানতে পারি ওনি আমার আপন মা না সৎ মা। আমি না সেদিন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি মনে করেছি আমি ভুল শুনেছি। তবে মায়ের বলা প্রত্যেকটা কথা এখনো আমার কানে বাজে।”

ইরফান মা কি বলে ছিলো জানিস? মা কার সাথে যেন ফোনে বলছিলো,

” সতীনের মেয়ে কে এতো আদর যত্ন কে করে।না মে’রে দুটো ডালভাত খাওয়াচ্ছি এটাই তো বেশি।”

–……….

“এই মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো দেখবো বলে বিয়ে করেছি বলে কি নিজের মেয়ে মনে করতে হবে? নেহাৎ বাবা চুরি করে বলে বিয়ে হচ্ছিলো না। তাই এই লোককে বিয়ে করেছি। বাবার চুরির ব্যপার টা ওনি জানে না বলে বেঁচে গেছি। শুন পরের মেয়ে পরের মেয়েই হয়। নিজের মেয়ে হয় না। এখন খাচ্ছে পড়ছে আবার বিয়ের সময় একগাদা নিয়ে যাবে।মায়ের সাথে মেয়েটা ম’রে গেলেও ভালো ছিলো। আমার কোনো ঝামেলা ছিলো না।”

-……….

“আরে না পাগল নাকি ওকে মা’র’বো আমি। ওর বাপ ওর শরীরে আ’ঘা’তের চিহ্ন দেখলে সেদিনই আমাকে তালাক দিবে। আমি বাবা আবার ওই অভাবের সংসারে যেতে পারবোনা। কথায় আছে না ” হাতে মা’র’তে না পারলে ভাতে মা’র’বো।” আমি সেই বুদ্ধি অবলম্বন করছি আরকি। আমাদের সবার বেঁচে যাওয়া খাবার যখন ওকে দেই তখন খুব শান্তি লাগে। মেয়েটাকে যেভাবে বোঝাই সেভাবেই বুঝে। ভাত নূন দিয়ে নূন দিয়েই খায়।”

-………..

” না না ও ওর বাবাকে বলে না। তাই তো বেঁচে গেছি। বললাম না আমি যেভাবে বুঝাই সেভাবেই বুঝে। ওকে বলি তোর বাপের টানাপোড়েন চলছে তোরা কষ্ট পাবি বলে ওনি মুখ খুলে বলে না। আর সেটাই বিশ্বাস করছে।”

” ওনি এর থেকেও নিকৃষ্ট নিকৃষ্ট কথা বলেছে। যা আমার মুখে আনতেও রুচিতে বাঁধে। সেদিন থেকেই আমি একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। ইকরা কে নিজের মতো করে গড়ে তুললেও ইরফান কে পারেনি। ও ছোটবেলা থেকেই আমার গাঁ ঘেঁষা ছিলো। এরপর ইরফান মায়ের কাছে আবদার করে আমার সাথে বসে এক টেবিলে খাবে। নেহাৎ ছেলের আবদার ফেলতে পারবে না তাই আমাকেও ওদের সাথে খেতে দিতো।”

“জানো বাবা আমি কেন সব জেনেও না জানার মতো ছিলাম? কেন তোমাকে কিছু বলেনি? আমার মনে হতো আমি যদি বলে দেই তাহলে আমি এই লোক দেখানো ভালোবাসাও পাবো না। তুমিও মায়ের মতো এমন করবে। আমার মায়ের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে ওনার নাম না দিয়ে আমার সবকিছুতে আমার মায়ের নামটাই দিতে। মায়ের একটা ছবি রাখতে যেন মা কে আমি মন ভরে দেখতে পারি।”

শত চেষ্টা করেও আর নিজের ভেতরে চেপে রাখা কান্না আর আঁটকে রাখতে পারলাম না। ফ্লোরে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলাম। আরজা কে ওর বাবা ইরফানের কোলে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমাকে আগলে ধরতেই ওনাকে বললাম,

” আরজার বাবা আমাকে প্লিজ যতক্ষণ এ-ই বাড়িতে আছি সান্ত্বনা দিতে আসবেন না। এই বাড়িতে যতক্ষণ আছি ততক্ষণ নিজের ঢাল আর অবলম্বন নিজেই হতে চাই। যখন এই ছেড়ে যাবো তখন আমাাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আপনার। প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব আপনার।”

আমার কথা শুনে ওনি হাত বাড়িয়ে দিয়েও আবার ফিরিয়ে নিলেন। আমি ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ালাম। চোখের পানি মুছে বাবার পাশে গিয়ে হাত জড়িয়ে বসলাম। আমার মাথাটা রাখলাম বাবার কাঁধে।বাবাকে বললাম,

“বাবা, আমার সকল নালিশ আর অভিযোগ তোমার বিরুদ্ধে।”

ফুঁপানোর শব্দে মাথা তুলে দেখি বাবা কাঁদছে।

“বাবা, ওনি না আমার মা না কিন্তু তুমি তো আমার বাবা। তুমি সারাদিনে একটু আমার খোঁজ নিতে। একদিন জিজ্ঞেস করতে আমি কি খাচ্ছি কি পড়ছি জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু না তুমি আমার সকল ওনার উপর ছেড়ে দিয়ে অবসর নিয়ে নিলে। রোজ রাতে নিয়ম করে যে চকলেট আনতে কোনোদিন জিজ্ঞেস করেছো আমি খেয়েছি কি না? না বাবা সব দিন আমার ভাগ্যে চকলেট জুটতো না। ওনি বলতো, বড়দের খেতে হয় না তুই না বড়। ও ছোট ওই খাক।”

চলবে,,

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।