হক নিবাস পর্ব-০১

0
440

#গল্প
#হক_নিবাস
#পর্ব_১
-শাতিল রাফিয়া

আজ দীর্ঘ পনেরো বছর পরে আমার মা বাবার সঙ্গে এতগুলো কথা বললেন। তাও সেটা বড়ো আপুর কারণে।

পনেরো বছর অনেক দীর্ঘ সময়। এতগুলো দিন একই বাসায় থাকা সত্ত্বেও কী করে মানুষ আরেকজন মানুষের সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারেন, সেটা আমি মাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। অথচ আপু বলেছে আগে নাকী এরকম ছিল না। আপু আমার চার বছরের বড়। ঘটনার যখন সূত্রপাত, আপুর বয়স সাত বছর আর আমার তিন বছর।

আমাদের বাসার হর্তাকর্তা ছিলেন আমার দাদী। অনেক অল্প বয়সে বিধবা হওয়ায়, অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে, দাদী শক্ত হাতে তিন সন্তানকে মানুষ করেছেন। সমাজের কারণেই দাদীকে কঠোর হতে হয়েছে। এভাবে কঠোর থাকতে থাকতে দাদী নিজের চারদিকে এক দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করে ফেলেছেন। সেই দেয়াল ভাঙার সাহস আমার বাবা-চাচাদের কখনোই হয়নি।
দাদী এখন চলাফেরা করতে পারেন না, কথাবার্তাও বলতে পারেন না, তবুও তার হাতের এক ইশারায় আমাদের ‘হক নিবাস’ কেঁপে ওঠে। তবে হ্যাঁ, আমার মা তাকে ভয়ও পান না, তার কাছেও যান না। আমার মা-ও নিজের চারদিকে একটা প্রাচীর তৈরি করে রেখেছেন। সেটাও দুর্ভেদ্য।

আমার দাদী কখনোই মাকে পছন্দ করতেন না। কারণটা আমাদের আজও অজানা। আমার মা আগে খুব হাসিখুশি ছিলেন। কলকল করে কথা বলতেন, জোরে জোরে খিলখিল করে হাসতেন, সারা বাড়ি পাখির মতো উড়ে বেড়াতেন। কখনো মন খারাপ করলেও আবার নিজে নিজেই সেটা ভুলে গুনগুনিয়ে গান করতেন। আমার দাদী এসব কখনোই পছন্দ করতেন না। দাদীর পর বাড়ির পরবর্তী কর্তা আমার বাবা। বাবা এসব পছন্দ করতেন, কিন্তু নিজের মায়ের ওপর কথা বলতে পারতেন না। তাই বাবা মাকে বলেছিলেন, যখন তারা একাকী সময় কাটাবেন, মা যেন তখন এসব হাসাহাসি করেন।
এগুলো সবই আমার শোনা কথা। কিছু শুনেছি আপুর কাছে, কিছু শুনেছি আমাদের বাসার পুরনো সহকারী শেফালী নানুর কাছে।

বাবা এসব তখন পছন্দ করলেও, এখন আর করেন না। আমরা আজও এগুলো করতে পারি না। বাবা আজও নিজের মায়ের কথার বাইরে যেতে পারেন না। আর সেই ঘটনার পরে বাবাও যেন কেমন হয়ে গেছেন। আমাদেরও উচ্চস্বরে হাসি-তামাশা করা বারণ। সন্ধ্যার পরে বাসার বাইরে যাওয়া বারণ। আর বন্ধুদের সাথে হ্যাং আউট, আর গ্রুপ স্টাডি! ও বাবা! সে কথা মুখে আনাও নিষেধ। আমরা শুধুমাত্র কলেজে যাই আর আসি। এত সবের মধ্যে আমার বন্ধুও মাত্র একজন। সে হলো প্লাবন। আমাদের পরিবারে অবশ্যই ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্ব করা নিষেধ, এবং করলে সেটা পাপ বলে গন্য করা হয়। তাই ছেলে বন্ধু থাকলে, প্রেম ভালোবাসা থাকলে সেটা লুকিয়ে করতে হয়। তবে প্লাবনের সাথে বন্ধুত্ব সবাই মেনে নিয়েছে। তার কারণ প্লাবন সেই ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাসায় আসা-যাওয়া করে। তাদের বাসা আগে আমাদের বাসার ঠিক পাশেই ছিল। আমার মা আর ওর মা বান্ধবী ছিলেন। আমরা একসঙ্গে পুতুল খেলেছি, ক্রিকেট খেলেছি, চোর-পুলিশ খেলেছি। সেই ছোট্ট থেকেই বন্ধুত্ব বলে তার সাথে আমার বন্ধুত্বটা সবাই মেনে নিয়েছে। প্লাবনের মা নেই। আমরা খুব ছোট থাকতে হুট করেই একদিন মারা গেলেন। আমার মা তখন তাকে একেবারে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। এরপর তারা অন্যত্র বাসা নিয়ে চলে যায়।
তখন তার খালা এসে তাদের সাথে থাকতেন, কিন্তু একদিন তার খালাও মারা যায়, শুনেছি উনি নাকী আত্মহত্যা করেছিলেন! সে বর্তমানে তার বড়োভাইয়ের সাথে থাকে। তার বাবা অন্য শহরে চাকরি করেন। মাঝেমধ্যে আসেন। তার ভাইও চাকরি করে।

তো যেটা বলছিলাম, আমাদের অত্যন্ত হাসিখুশি প্রিয়, ফূর্তিবাজ মা হঠাৎই একদিন চুপ হয়ে গেলেন। দাদীর ঘরে মা, বাবা, আর দাদী কীসব মিটিং করলেন। প্রচন্ড চিৎকার-চেঁচামেচি হলো। এরপরে মা থমথমে মুখে ব্যাগ গুছিয়ে নিলেন। বাবা আটকাতে চাইছিলেন।

কিন্তু দাদী মুখ শক্ত করে বলেছিলেন, মেয়ে মানুষের এত তেজ ভালো না।

মা যেন কোথায় চলে গেলেন! এর প্রায় দুইমাস পরে মা আবার ফিরে এলেন। বাবা, মাকে ফিরিয়ে আনলেন। মায়ের কোলে আমি আমাদের ছোট ভাই মানিককে দেখতে পেলাম। মা ফিরে এলেন, কিন্তু তার সেই আমোদ ফূর্তি কোথায় যেন জলাঞ্জলি দিয়ে এলেন। মা আর আগের মতো কথা বলেন না, হাসেন না। আর বাবার সামনে তো যান-ই না। কথাও বলেন না। বাবা কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু মায়ের দৃঢ় জেদের কাছে পরাজিত হলেন। মা-বাবার ঘরটাও একসময় আলাদা হয়ে গেল। মা আমাদের সাথে কথা বলেন। কিন্তু বাবার কথা উঠলে বা বাবার সামনে পড়লে উনি যেন বোবা হয়ে যান।

দাদীর এসব একেবারেই পছন্দ ছিল না। উনি প্রচন্ড বিরক্ত হতেন মায়ের এই কাজে।
এরপর থেকে দাদী প্রায়ই মায়ের সাথে মুখ ঝামটা দিয়ে কথা বলতেন। কিন্তু তবুও মা নির্বিকার।

এসব ঘটনার কিছুই আমার মনে নেই। ওই যে সব-ই আপু নয়তো শেফালী নানু বলেছে।

আপুকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী এমন হয়েছিল যে মা এরকম হয়ে গেলেন?

আপু প্রথমে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল। কিছু বলল না।

আমি আবার প্রশ্ন করলাম, তুমি জানো?
আপু বলল, জানি। দাদী বলেছেন আমাকে।
এরপর ধীরে ধীরে বললেন, এই কারণ জানতে চাস না মধু।

‘মধু’ নামটা শুনে কেমন লাগছে? আমার নাম ‘মধু’ নয়, মাধুরী। আমার মা আগে যখন স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন, উনি সিনেমার পোকা ছিলেন। মৌসুমী আর মাধুরী দীক্ষিত মায়ের প্রিয় দুইজন নায়িকা। তাই আপুর নাম রেখেছেন মৌসুমী আর আমার নাম মাধুরী। সেটা ছোট করে ‘মধু’। আমাদের ভাইয়ের নাম মানিক, সেটা দাদী রেখেছেন।

দাদী আদর করে ভাইকে ‘আমার মানিক, আমার রতন’ করতে করতে তার নাম মানিক হয়ে গেছে।

তো সেই ঘটনার পনেরো বছর পরের কথা। আজ আপু পাড়ার উঠতি কবি মজনু ভাইকে পালিয়ে বিয়ে করে বাসায় এসেছে।
মজনু ভাই পড়াশোনা করতে করতে ছেড়ে দিয়েছে।তার এখন কাজ হল, দিনরাত কবিতা লেখা আর পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে সেটা স্কুল-কলেজের মেয়ে দেখলেই জোরে জোরে আবৃতি করা! মজনু ভাইয়ের কোন বাবা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কিছুর ব্যবসা করে প্রতিবার লস খান, আর তার মা এলাকার মহিলাদের সঙ্গে চুলোচুলি করে বেড়ান।

আমি আপুর বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা মাত্র শেষ হয়েছে। আর কিছুদিন আগেই আমার একটা খুবই খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেটা নিয়ে আমি প্রচুর চিন্তিত এবং মর্মাহত!

সেই ঘটনার কথা ভাবতে ভাবতে, কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম, হঠাৎই প্রচন্ড চিৎকার চেঁচামেচিতে আমার ঘুম ভাঙলো। শব্দের উৎস অনুসরণ করে দেখি ড্রয়িংরুমে আপু আর মজনু ভাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আপুর মাথায় একটা লাল ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা আর দুইজনের গলায়ই মালা।
বাবা রাগে ফোঁসফোঁস করছেন। মনে হচ্ছে এক্ষুনি আপু আর মজনু ভাইকে জবাই করে ফেলবেন!

আমার চাচাতো বোন রেহনুমা আমার কানের পাশে এসে জিজ্ঞেস করে, কী মনে হয় মধু আপু? চাচা কী করবে? আপুর কী এই বাড়িতে আর জায়গা হবে?

আমি তার উত্তর দিলাম না। আমার চোখজোড়া সমুদ্র ভাইকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সমুদ্র আমার ফুপাতো ভাই। তাদের বাসাও একই এলাকায়। সমুদ্র ভাইয়া আর আপুর ভালোবাসার কথা কেউ না জানলেও আমি জানি। আমি নিজেই কতবার তাদের ধরা খাওয়া থেকে বাঁচিয়েছি। এই সময়টা ভাইয়া আমাদের বাসায় আসে। হঠাৎই ড্রয়িংরুমের এক কোণায় ভাইয়াকে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে! আসলেই তো! আপু তো সমুদ্র ভাইয়াকে এত ভালোবাসে! আপু কীভাবে একটা বখাটে ছেলেকে বিয়ে করে বাসায় নিয়ে আসতে পারে! আমার সহজ-সরল আপু!

বাবা হঠাৎই গর্জন করে উঠলেন, দুই মিনিটের মধ্যে এই বাড়ি থেকে তোরা বের না হলে, আজ ক’টা লাশ যে পড়বে আমি জানি না!

বাবার এই বাণীতে আপু ডুকরে কেঁদে উঠলো। মজনু ভাইকে দেখে মনে হচ্ছে যেন নাটক চলছে! বাবার বাক্যে তাকে বেশি বিচলিত হতে দেখলাম না!

বাবা আরেকবার বোমার মতো ফেটে বললেন, এক মিনিট আছে আর!

এমন সময় মা ধীরে ধীরে হেঁটে ড্রয়িংরুমে এলেন।

বাবার সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে বললেন, মৌ-য়ের সম্পূর্ণ কথা না শুনে, ও কেন এমন করেছে সেটা না জেনে আমি ওকে কোথাও যেতে দেব না।

[চলবে]