হক নিবাস পর্ব-০২

0
296

#গল্প
#হক_নিবাস
#পর্ব_২
-শাতিল রাফিয়া

সেই ঘটনার পর থেকে আমি বাবাকে কখনোই মায়ের বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে দেখিনি। মা তো বাবার সাথে কথাই বলেন না, কিন্তু মা যেটা বলতেন, সেটা বাবা চুপচাপ মেনে নিতেন।

যেমন, একবার আপুর স্কুল বদল করানো হবে কি না, সেটা নিয়ে বাসার সবাই আলোচনা করছিল। বাবার ইচ্ছে ছিল না।

কিন্তু মা আপুকে ডেকে বললেন, মৌসুমী আমি তোকে নতুন স্কুলে ভর্তি করাবো। এই স্কুলের বড় ক্লাসের পড়াশোনা ভালো নয়।

কথাটা বাবার কানে গেল এবং বাবা দ্বিতীয় কোন কথা না বলে আপুর জন্য নতুন স্কুলের ফর্ম কিনে আনলেন।

আবার একবার ঈদে আমার একটা জামা খুবই পছন্দ হয়েছিল। একই রঙের আরেকটি জামা আমার আছে।
বাবা তবুও কিনে দিতে চেয়েছিলেন।

মা আমাকে বললেন, আর কোন জামা কিনবি না। অনেক জামা হয়েছে। জামাকাপড়ের হিসেব দিতে হবে, জানিস তো?

আমি আশা নিয়ে বাবার চোখের দিকে তাকালাম।

বাবা তখন বললেন, থাক আম্মু। পরের ঈদে নিয়ো।

এরকম ছোট থেকে বড় যে কোন কথায় মায়ের সিদ্ধান্তই ছিল শেষ কথা, অন্তত সেই ঘটনার পর থেকে। আর এর আগে তো জানি না, আমার তো মনেই নেই!

আজও এর ব্যতিক্রম হল না। মায়ের কথা শুনে বাবা আর একটি কথাও বললেন না। চুপ করে রাগে কাঁপতে কাঁপতে ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

মা আপু আর মজনু ভাইকে বললেন, তোমরা আমাদের সাথে আমার ঘরে এসো।

মজনু ভাইকে বেশ উৎসাহের সাথে হেঁটে যেতে দেখলাম। আর আপু পেছন পেছন মাথা নামিয়ে গেল।
সমুদ্র ভাইয়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আপু এক মূহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল। কিন্তু একবারও মাথা তুলে তাকাল না। এরপর আবার হেঁটে চলে গেল।

আমি সমুদ্র ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাইয়া স্থির দৃষ্টিতে একদিকে তাকিয়ে আছে। সে যেন কিছু দেখেও দেখছে না।

আমি ধীরে ধীরে ডাক দিলাম, ভাইয়া!

ভাইয়া আমার দিকে তাকাল। তার চোখ টকটকে লাল হয়ে গেছে!

বিড়বিড় করে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি কি কোন দোষ করেছিলাম মাধুরী?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না।
– তাহলে ও কেন এরকম করল?

আমি কোন জবাব দিতে পারলাম না।

সমুদ্র ভাই হতবিহ্বল হয়ে জবাব দিল, বল না মধু। ও কেন করল এটা?
আমি বললাম, জানি না। জেনে আসি।

যেতে যেতে ভাবলাম, আসলেই তো কেন আপু এরকম করলো? এরকম সুন্দর একটা ভালোবাসার অপমান করলো?

মায়ের ঘরে ঢুকব নাকী আড়ি পাতব সেই চিন্তা করতে করতে এগিয়ে গিয়ে দেখি আমার ভাই মানিক আর চাচাতো বোন রেহনুমা আগেই মায়ের ঘরের দরজায় কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রেহনুমা চাপা গলায় বলল, মধু আপু! মৌ আপু বলেছে মৌ আপু আর মজনু ভাইয়ের নাকী প্রেম ছিল! কেউ মেনে নিবে না বলে পালিয়ে বিয়ে করেছে।

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম!

এরপর প্রশ্ন করলাম, সত্যি?

মানিক মাথা নাড়ল।

আমি তাকে ‘সর’ বলে সরিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকে গেলাম।

আচমকা আমি ঢুকে যাওয়ায় আপু অবাক হয়ে তাকাল! আর মজনু ভাই দেখলাম সব দাঁত বের করে একটা হাসি দিল।
মা আমার দিকে দৃষ্টি দিয়ে আবার আপুর দিকে তাকালেন।

এরপর জিজ্ঞেস করলেন, এরকম একটা ছেলেকেই পছন্দ হলো তোমার?

আপু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।

মা এবার মজনু ভাইকে বললেন, এই ছেলে! আমার দিকে তাকাও।

মজনু ভাই হাসি বন্ধ করে মায়ের দিকে তাকাল।

মা বললেন, বিয়ে করার সাহস আছে আর ওকে তোমাদের বাসায় তোলার সাহস নেই?

মজনু ভাই নড়েচড়ে দাঁড়ালেন।

মা এবার ধমকে উঠলেন, বলো! বাসায় বউকে তোলার সামর্থ্য নেই, তো কেন বিয়ে করেছ?

মজনু ভাই আপুর দিকে তাকালো।

আপু বলল, আম্মু। আসলে কী হয়েছে যে ওর বাসায়…
– আমি তো তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি, মৌসুমী।
আপু বলে, না আম্মু। ও আসলে বলতে বিব্রতবোধ করছে। আমিই বলি। ওর বাসায় এখন মেনে নেবে না, ইয়ে, না মানে ওর বাবা এখন ব্যবসার কাজে বাইরে আছে। আর ওর মা-ও এখন এখানে নেই। উনারা ফিরে আসলে বলব আমরা, আপু মিনমিন করে বলল শেষের দিকে।
– আর তোমাদের এই সময়টাকেই উপযুক্ত মনে হয়েছে?

কেউ কোন জবাব দিল না।

মা বললেন, আমার ভাবতেই অবাক লাগছে আমার মেয়ে এরকম করতে পারে!

আপু এবার ফিচফিচ করে কান্না শুরু করলো।

মা মজনু ভাইকে বললেন, তোমার বাবা-মা যখন এখানে নেই, তুমি তো ওকে নিয়ে বাসায় উঠতেই পারতে।
আপু আবার বলল, আম্মু আমি-ই নিষেধ করেছি। না মানে, আম্মু এটা কি ভালো দেখায়?

মা কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আপুর দিকে তাকালেন।

আপু মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, আর ও তো এখন বাসায় থাকছে না। মানে এই ক’দিন। ওর বাবা-মা আসলে আবার যাবে…

এরপর মা মজনু ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় থাকো এখন?
– এই তো বন্ধুবান্ধবদের বাসায়, মজনু ভাইয়ের জবাবটা আপুই দিল বরাবরের মতো।
মা প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, তুই কেন জবাব দিচ্ছিস ওর সব প্রশ্নের? ও কি কথা বলতে পারে না?
আপু সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ওর আব্বু-আম্মু আসার আগ পর্যন্ত আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দাও। প্লিজ আম্মু।

মা মাথা নাড়লেন।

– ভুল করেছ, ভুলের মাশুল দাও। যেখানে খুশি যাও।
আপু বলল, চলে যাব আম্মু। সত্যিই চলে যাব। প্লিজ আম্মু ক’টা দিন।

আপু খপ করে মায়ের পা ধরে বসে পড়ে। আর মজনু ভাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল।

মা কিছুতেই পা ছাড়াতে পারছেন না।

আপু বলল, যতক্ষণ না রাজি হবে, আমি পা ছাড়ব না আম্মু।
মা বললেন, ওকে ছেড়ে দে। এরপর আমাদের বাসায় থাক।

আপু হঠাৎই থমকে গেল।

এরপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ওকে ছাড়া তো আমি বাঁচব না মা।

আম্মু আপুকে ধরে দাঁড়া করিয়ে দিলেন।

এরপর বললেন, তুই আর আমার সামনে আসবি না।

এরপর আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে বললেন, ওদের জানি কেউ তাড়িয়ে না দেয়। আমিয়ো দেখি এই রংতামাশা কয়দিন চলে!
আম্মু এবার হুংকার ছাড়লেন, বের হও সবাই আমার ঘর থেকে।

আম্মুর ঘর থেকে বেরিয়ে আপু পুরো ভোল পাল্টে ফেলল!

কায়দা করে মুখ করে আমাকে বলল, মধু, আমার ঘরটা একটু ঝেড়ে মুছে দে দেখি।

আমি অবাক বিস্ময়ে আপুর দিকে তাকিয়ে রইলাম! আমার এই বোনকে আমি চিনতে পারছি না।

মজনু ভাই বলল, আমার একটু ভাতরুম যাওয়া দরকার।
আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, ভাতরুম নয়, কথাটা বাথরুম।
দাঁত কেলিয়ে মজনু ভাই বলে, একই কথা। হে হে হে।

তক্ষুনি এদিকে সমুদ্র ভাইয়া এল। ভাইয়ার মুখ থমথমে হয়ে আছে।
আপু ভাইয়াকে দেখেও না দেখার ভান করল।
আমি নিজে সেখানে থাকতে চাইলাম না, আর মজনু ভাই সেখানে থাকুক সেটাও চাইলাম না। আমি চাচ্ছিলাম, আপু আর সমুদ্র ভাইয়া একসাথে কথা বলুক।

আমি মজনু ভাইকে বললাম, চলুন। আমি আপনাকে বাথরুম দেখিয়ে দিচ্ছি।

মজনু ভাইকে বাথরুম দেখিয়ে দিয়ে আপুর ঘরে যাওয়ার সময় শুনি আপু সমুদ্র ভাইকে বলছে, তোমাকে আমার অসহ্য লাগছে। যাও তো।

আমি আবারও হতবাক হয়ে গেলাম। আপুকে মজনু লোকটা কী জাদু করেছে এমন! আর তাদের দেখে কিন্তু মনেও হচ্ছে না যে তারা খুব খুশি বিয়ে করে! কেন যেন মনে হচ্ছে আপু মেকী আনন্দের নাটক করছে।

আপুও এরপর চলে এল ঘরে।

আমাকে জিজ্ঞেস করে, মুছেছিস ঘরটা? আচ্ছা আমি মুছে নিচ্ছি।
মজনু ভাই এসে বিছানায় পায়ের ওপর পা তুলে বলল, শালিকা! একটা গামছা দাও।

আমার প্রচন্ড বিরক্ত লাগল।

আমি আপুকে বললাম, তোর বরকে গামছা দে। যতসব অসহ্য!

ড্রয়িংরুমে এসে দেখি সমুদ্র ভাইয়া চুপ করে বসে আছে।

আমাকে ভাইয়া বলল, মৌসুমী বলল, ও আমার সাথে নাকী টাইম পাস করছিল। এও কী সম্ভব মাধুরী?
আমি গম্ভীরমুখে জবাব দিলাম, মিথ্যে বলেছে।
– মানে?

মানেটা বলার আগেই হন্তদন্ত হয়ে প্লাবন এল।

সে উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে, মধু, মৌ আপু নাকি মজনুকে বিয়ে করে এনেছে?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোকে কে বলল?
– আরে! পুরো পাড়ায় জানাজানি হয়ে গেছে।

আমি হতাশ হয়ে মাথা নাড়লাম।

প্লাবন জিজ্ঞেস করে, মানিক কোথায়?
– বাসায়ই ছিল। বেরিয়েছে মনে হয়।

প্লাবন যখনই আসুক, যখনই ওর সাথে আমার কথা হোক, সে সবসময়ই মানিকের কথা জিজ্ঞেস করে। সর্বদা। মানিককে সে অসম্ভব আদর করে।
আমি একদিন জানতেও চেয়েছিলাম বিষয়টি কী?
সে খুব অদ্ভুত একটা জবাব দিয়েছিল।

সে বলেছিল, মধু আমি কোন কিছু বোঝার আগেই মা চলে গেছেন, জানিসই তো।

আমি মাথা ঝাঁকিয়েছিলাম।

– এরপর আমাকে খালা বড় করেছেন। আমি খালার মধ্যেই মাকে খুঁজে পেয়েছি।
– হ্যাঁ। এর সাথে মানিকের সম্পর্কটা কী?
– মানিককে দেখলে আমার কেন জানি খালার কথা মনে হয়!

আমি হতবাক হয়ে, চমকে বলেছিলাম, মানে কী? তোর খালা যখন মারা যান, তুই তখন অনেএএক ছোট।
সে হালকা করে হেসে মাথা নেড়ে বলল, আমিয়ো জানি না!

যাই হোক, আপু এসে বলল, দে না মধু তোর দুলাভাইকে একটা টাওয়াল। আমি ঘর মোছার পানি নিয়ে আসি।

প্লাবন জিজ্ঞেস করে, আপু তুমি বিয়ে করে ফেলেছ?
সমুদ্র ভাইয়ার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে আপু জোর করে হাসি টেনে বলল, হুমম…

আপু চলে গেলে আমি সমুদ্র ভাইয়া আর প্লাবনকে বললাম, আপুকে দেখে কেউ বুঝতে পারছ না কোথাও কোন একটা ঘাপলা আছে?
চোখ লাল করে ভাইয়া বলে, না। ওকে তো বেশ খুশিই মনে হচ্ছে।
– আপু খুশি না ভাইয়া। তুমি ভালো করে খেয়াল করে দেখো।

আপু রুম থেকে আওয়াজ দিল, মধু গামছা দে।

আমি যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে টাওয়াল নিয়ে আপুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম।

ঢোকার আগে হঠাৎই শুনলাম, আপু চাপা গলায় বলছে, হাত ছাড়ো। আঁউ!

আমি দড়াম করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখি মজনু ভাই আপুর হাত চেপে ধরে আছে।

আপু হেসে বলল, দেখ কী পাগল! আমায় এত ভালোবাসে! এই হাত ছাড়ো তো!

মনে হল, আপু চোখের জল লুকিয়ে তাড়াতাড়ি আমার সামনে থেকে চলে গেল।

আমি মজনু ভাইয়ের দিকে টাওয়াল এগিয়ে দিয়ে ভয়ানক কণ্ঠে বললাম, কী করছিলেন আপনি?
মজনু ভাই আবার সব দাঁত বের করে দিয়ে বলল, তুমি কী করেছ শালিকা?
আমি খেঁকিয়ে উঠলাম, মানে?
মজনু ভাই হাসি মুছে বলল, চিল্লাবে না। রাহাতকে ভুলে গেছ?

আমি তার কথা শুনে আঁতকে উঠলাম!

[চলবে]