হক নিবাস পর্ব-১১

0
202

#গল্প
#হক_নিবাস
#পর্ব_১১
– শাতিল রাফিয়া

মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তখন তোমার চাচী প্রেগন্যান্ট ছিলেন। ওর বাবা ওকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
চাচী বললেন, হ্যাঁ। আমার প্রেগ্ন্যাসির চার মাসে বাবা আমাকে নিয়ে যান। এরপর রেনুর তিনমাস বয়সে আমি ফিরে আসি।
মা নির্জীব কণ্ঠে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার চাচা তো তোমার বাবার-ই ভাই! একই মায়ের সন্তান!
চাচী প্রায় চিৎকার করে বললেন, ত.. তার মানে রেহনুমার বাবা সব জানে?
মা মাথা নেড়ে জবাব দিলেন, হ্যাঁ, জানে।
চাচী কাঁপা গলায় বললেন, অথচ সে আমাকে কিচ্ছুই বলেনি। কিছুই জানায়নি।
মা কঠিন কণ্ঠে বলেন, কী করে জানাবে বলো? মায়ের কাছ থেকে পারমিশন পায়নি তো! তাদের মা তো মরে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন!
চাচী বিস্মিত গলায় হঠাৎ বললেন, ওহ! এইবার আমি বুঝতে পেরেছি।
সমুদ্র ভাইয়া জিজ্ঞেস করে, কী মামী?
চাচী গম্ভীরমুখে উত্তর দিলেন, রেনুর জন্মের সময় আমি এতদিন বাবার বাসায় থাকলেও কেন আম্মা টু-শব্দটি করেননি! উল্টো উনি আমি চলে আসতে চাইলে উনি বারবার বাঁধা দিয়েছেন। বলেছেন, এই সময় বাবার বাড়িতেই নাকী আমি আরামে থাকব। এই বাসায় আসলে আমি নাকী কোন না কোন কাজে হাত লাগাবই! আর আমি যখন জোর করে আসতে চেয়েছি তখন বলেছিলেন, শরীরের এই অবস্থায় এতবার এত দূরে জার্নি করা ভালো না! এমনকি রেহনুমার জন্মের পরেও আমি তিনমাস ওখানে থেকেছি আম্মার কথাতেই। উনি বলেছিলেন এত ছোট বাচ্চা নিয়ে এত রিস্ক নিয়ে আসতে হবে না! রেনুর জন্মের আগে ওর বাবা আর ওর জন্মের পর ওর বাবার সাথে আম্মাও গিয়েছিলেন রেনুকে দেখতে। এ… এইবার বুঝতে পেরেছি, এত ঘটনা লুকোতেই আম্মা এতসব করেছেন!
সমুদ্র ভাইয়া প্রশ্ন করে, তুমি হুট করে এসে মানিককে দেখেছ? মামা তোমাকে একেবারে কিছুই জানাননি?
মাথা নেড়ে চাচী বললেন, বলেছে। বলেছিল ভাবীও প্রেগন্যান্ট। আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম! কারণ আমি যখন আসি, ভাবীকে দেখে আমার এরকম কিছুই মনে হয়নি! পরে ভেবেছি হয়তো প্রথমদিকে ছিল বলে আর ভাবী ঢিলে জামাকাপড় পরে বলে বুঝিনি! আমি যখন ফিরে আসি মানিকের দেড়মাস। আর রেনুর তিনমাস।
মা হঠাৎ ম্লান হেসে বললেন, আমি জানার আগে তুমি জেনেছো ব্যাপারটা! বাহ! কারণ আমি তো জেনেছি যখন জোহরা সাত মাসের প্রেগন্যান্ট ছিল!
আপু ধরা গলায় বাবাকে প্রশ্ন করে, এতদিন এই কথাটা মায়ের কাছে কী করে লুকিয়ে রাখলে বাবা তুমি? তোমার কি মায়ের জন্য একটুও মন কাঁদলো না?
আমি তীব্র রাগে হিসহিসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আর আজ হঠাৎ এত কথা কেন বলছ? আজ কেন সত্যিটা স্বীকার করলে?
মা বললেন, ওমা! মেয়েরা জেনে গেছে, ছেলে আরেকজনকে মেরে রক্তাক্ত করেছে! নিজের মা আজ আর নিষেধ করছেন না, নিজের মা আর মৃত্যুর হুমকি দিচ্ছেন না, এখন তো বলে দেওয়াই যায়! পনেরো বছরের পাথর চাপা দেওয়া সত্য উন্মোচন করে দেওয়াই যায়! এখন আর কে কী বলবে!

বাবা মুখ নামিয়ে রাখলেন!

ফুপু বললেন, এরপর?
মা উত্তর দিলেন, এরপর আর কী! বেশ ক’মাস ধরে খেয়াল করেছিলাম তোমার ভাই একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। কথা বলছে না, সারাক্ষণ কী যেন চিন্তা করছে, নিজের মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করছে! আমি জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারিনি।তবে আমি কখনো ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করিনি সে এই ঘৃণ্য অপরাধ করবে! তার প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল। তারপর একদিন সে আমাকে জানালো! তার মা-ও সঙ্গে ছিলেন। আমি প্রথমে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম! বিশ্বাস হচ্ছিল না! যখন বুঝতে পারলাম সত্যি ঘটনা, আমার হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল! আর মনটা পাথরে পরিণত হল! আমার ভরসা নিয়ে সে ছেলেখেলা করেছে! এটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া একেবারেই অসম্ভব ছিল। আমি সেদিনই ব্যাগ গোছালাম। ভেবেছিলাম, ভাইয়ের বাসায় গিয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করে মৌ আর মধুকে নিয়ে যাব। কিন্তু কিন্তু…

মা হঠাৎ চুপ করে গেলেন।

আপু প্রশ্ন করে, কিন্তু কী মা?
ধরা গলায় মা বললেন, কিন্তু যে বললাম… আমার পড়াশোনার জোর নেই, ছিল না মা-বাবার জোর। ভাই-ভাবী সব শুনল। এরপরে বলল, দুই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে যেতে। আমি চেয়েছিলাম আইনী ভাবে পাকাপাকি আমার দুই মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু তোমাদের দাদীর হুমকি-ধামকিতে আমার ভাই ভয় পেয়ে গেল। আর ভাইয়ের সেরকম টাকাও ছিল না উকিলের পেছনে খরচ করার মতো। তার ওপর তোমরা আবার ‘হক’ পরিবার! নামী বংশ! টাকা আর ক্ষমতা আমাকে পরাজিত করল। আমার ভাবী দুই মাস অনেক কষ্টে সহ্য করল! এরপর পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলো! আমি চলে আসার সময় তোমাদের বাবা আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন। এই দুইমাসে ফিরিয়ে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন। আমি রাজি হইনি। কিন্তু এবারে অনেক ভাবলাম… অনেএএএক। প্রথমে মাথায় এলো আমার দুই মেয়ের কী হবে আমি না থাকলে? যেই লোক স্ত্রী থাকা অবস্থায় অন্য সম্পর্কে জড়াতে পারে, স্ত্রী চলে গেলে সে তো আবার বিয়ে করবেই! আর যাকে বিয়ে করবে সেই মহিলা কি আমার মেয়েদের এত সহজে আপন করে নেবে? জায়গা দে…
মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই মানিক আচমকা বলে, একদম ঠিক! যেমন তুমি! তুমি জায়গা দিয়েছিলে আমাকে নিজের হৃদয়ে?

মা ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকলেন!

মায়ের কথা শুনতে শুনতে আমাদের চোখ ভিজে উঠেছিল।মানিকের কথা শুনে এবার বুকের ভেতরটা কামড়ে ওঠে! আসলেই তো! ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটা মায়ের আদর পাওয়ার জন্য কতই না তৃষিত! আপু হঠাৎই মানিককে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ওঠে!

মানিক আপুর কাঁধে মাথা রেখে মাকে বলল, তোমাকে থামিয়ে দিলাম। স্যরি। তারপর বলো!

আপু মানিককে জড়িয়ে ধরেই রাখলো।

মা কাঁপা গলায় বললেন, মৌ আর মধুর কথা চিন্তা করে, আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই ভেবে ফিরে আসতে রাজি হলাম এই বাসায়! তোমাদের দাদী তখন মুখ বাঁকালেন! যা নয়, তাই বললেন। আমি নাকী মুখ বাঁকিয়ে, দেমাগ দেখিয়ে চলে গিয়েছিলাম। এখন নাকী ফিরে আসতে চাইলেই হবে না! আমার জন্য সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার ছিল মানিক আমার চোখের সামনে থাকবে সেটা মেনে নেওয়া!

মানিকের চোখেমুখে একটা তীব্র আঘাতের ছাপ ফুটে ওঠে!

মা বললেন, যেদিন আমি বাসায় ফিরে এসেছি, সেদিন মানিকও এলো। আমি জানতাম না সেদিন তাকেও হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসবে তোমার বাবা আর দাদী।
আমি বললাম, আমার ঝাপসা ঝাপসা মনে আছে, তুমি, বাবা আর মানিক একসঙ্গে ঢুকেছিলে। তোমার কোলে মানিক ছিল!
মা আবার বললেন, তোমার বাবার কোলেই ছিল মানিক। কিন্তু সে হঠাৎ এমন চিৎকার করে কান্না শুরু করে, তোমার বাবা সামলাতে পারছিল না। বাধ্য হয়ে আমি কোলে নিয়ে চুপ করাই।
মানিক ফিসফিস করে বলে, তবুও মায়া জন্মালো না! কী করে মানুষ এতো পাষাণ হয়! এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ এরকম কেন? দাদী, মা-বাবা, চাচা! ছি!
হঠাৎই সে আপুর হাত ধরে বলল, এদের ভিড়ে তুমি আর মধু আপু একেবারে অন্যরকম কী করে হলে আপু?

আপু তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো!

সমুদ্র ভাইয়া জিজ্ঞেস করে, জোহরা বেগম যে আত্মহত্যা করলেন, সেটা কবে জানতে পারলে?
বাবা এতক্ষণ পরে জবাব দিলেন, এনাম ভাই প্রতীক, প্লাবন আর সেই কাজের মানুষকে নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। উনি বদলীর চেষ্টা করছিলেন। বদলী হয়েও গিয়েছিল। বাসায় ঢোকার পরেই তার নাকে একটা তীব্র গন্ধ এসে ধাক্কা দেয়! এরপর… এরপর…

বাবা হঠাৎ ফোঁপাতে লাগলেন।

মা চিল চিৎকার করে বললেন, বলতে খুব কষ্ট লাগছে তাই না? মেয়েটাকে তিলে তিলে কষ্ট দেওয়ার সময় খারাপ লাগেনি? ওর স্বপ্নগুলো ভঙ্গ করার সময় একবারও মনে হয়নি? মানিককে ওর মায়ের কাছ থেকে আলাদা করার সময় একবারও জোহরার বুকফাটা আর্তনাদ কানে ঢুকেনি? তোমরাই তো মেয়েটাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছ! এখন কাঁদছ কেন?
মা এরপর বললেন, উনি ঘরে ঢুকে দেখেন, জোহরার মৃতদেহ পরে আছে। সে নিজের হাতের রগ কেটে আত্মহত্যা করেছিল। সে নিজের পায়ের রগও কেটেছিল। তার মৃতদেহে পচন ধরে গিয়েছিল!

মানিক ডুকরে কেঁদে ওঠে।

সমুদ্র ভাইয়া এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসে ওর মাথায় হাত রাখল।

এরপর আবার প্রশ্ন করে, এতকিছু হয়ে গেল আর কোন পুলিশ কেস হলো না?
– হয়েছিল। কিন্তু তাতে কী এসে যায়? প্লাবনের বাবা জানতেন জোহরা বেগম ওর বাবার বাসায়। ওর বাবা জানতেন, জোহরা এখানে। এমনকী এখান থেকে জোহরা ওর বাবার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেছে। এনাম ভাইয়ের সাথেও কথা বলেছে। এনাম ভাইয়ের দিকেই সন্দেহ গেল। কিন্তু এনাম ভাই তো কাজের জন্য এখানে ছিলেনই না। কারো বিপক্ষেই জোরদার প্রমাণ পাওয়া গেল না। কেস একসময় বন্ধ হয়ে গেল।
আমি হুট করে প্রশ্ন করলাম, এর পেছনেও কি দাদীর হাত ছিল? কেস বন্ধ করানোর পেছনে?
বাবা খুব ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, কাউকেই দোষী সাব্যস্ত করা যাচ্ছিলো না। পুলিশে আমাদের পরিচিত দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন। মা বলেছিলেন এনাম ভাই আমাদের বন্ধু মানুষ। উনি এর সাথে জড়িত থাকতেই পারেন না! মা উনাদের সাথে কথা বলে কলকাঠি নেড়েছিলেন! তবে এই কেস বন্ধ হবার-ই ছিল। এই ঘটনার পর থেকে এনাম ভাই, প্লাবন আর প্রতীকের সাথে ওদের নানা বাড়ির সম্পর্ক একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়!
সমুদ্র ভাইয়া বলে, বড় মামী! একটা কথা বলি। কিছু মনে করো না। তুমি কিন্তু চাইলেই পারতে তখন পুলিশকে সব খুলে বলতে!
মা মৃদু হেসে বললেন, তোমার নানীর আসল রূপটা দেখনি বলে এত কিছু বলতে পারছ বাবা! তবে হ্যাঁ! তখন হয়তো বলতে পারতাম! কিন্তু আমাকে চিরতরে আমার মেয়েদের কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হত। বাসা থেকে বের করে দেওয়া হতো! জোহরা মারা যাবার পরে আমি তোমার নানীকে একবার এই কথা বলাতে উনি বলেছিলেন “আমাদের এতে দোষ নেই। আমরা আমাদের বংশের ছেলেকে নিয়ে এসেছি। ওকে তো আর আমরা মারিনি। নিজে নিজে মরেছে কেন?”

অনেকক্ষণ সবাই চুপ করে রইল!

আমি এবারে জিজ্ঞেস করলাম, আপু! এসবের সঙ্গে মজনু ভাই আর রাহাতের সম্পর্ক কী?
মানিক চোখ মুছে বলে, আমি বলছি বাকীটা।

[চলবে]