হতে পারি বৃষ্টি পর্ব-২৪+২৫

0
492

#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৪

সূর্য ডুবতে বসেছে। চারিদিকে ধীরে ধীরে আঁধার ছেয়ে যাচ্ছে। মানুষ ব্যস্ত ভঙ্গিতে পা চালিয়ে নিজে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলছে। মিমি যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে হেঁটে যাচ্ছে। আজ তার দেরি হয়ে গিয়েছে। নিশানটা আজ তাকে ছাড়তেই চাচ্ছিল না। বহু কষ্টে তাকে বুঝিয়ে চলে এসেছে। সেমিস্টারের পরীক্ষা শেষ, এখন সে অফিস আর নিশানকে পড়িয়েই দিনাতিপাত করছে। বর্তমানে সে একটা নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। রিকশা পায়নি সে। হঠাৎ করে একটা কালো রঙের গাড়ি তার পথ আগলে দাঁড়াল। মিমি ভড়কে গিয়ে হাঁটা থামিয়ে দিল। আশে পাশে কেউ নেই, মিমির ভয়ে বুক কাঁপছে। গাড়ির মধ্যে থেকে কয়েকটা লোক এসে তাকে ধরে ফেলল। মিমি চেঁচামেচি শুরু করে দিল।

— কারা আপনারা? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? ছেড়ে দিন। ছেড়ে দিন

কারোর কানে তা গেল না। মিমি পুনরায় চেঁচায়–

— কেউ আছেন? সাহায্য করুন আমাকে। কেউ আছেন!

মিমির চেঁচানো কাজে দিল না। তারা তাকে টেনে হিচড়ে গাড়িতে তুলল। অতঃপর মুখে রুমাল চেপে ধরল, মিমি জ্ঞান হারাল। তার ব্যাগসহ সব কিছু রাস্তায় পড়ে রইল।
——

চিন্তিত হয়ে বসে আছেন মিসেস মুক্তা। মিমি এখনও বাড়িতে ফেরেনি। রিহা তাকে এক নাগাড়ে ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু কেউ তুলছে না। বাজতে বাজতে কেটে যাচ্ছে। রিহা বলল–

— আপু এখনও ফিরছে না কেন মা? আমি কি তানি আপুকে কল দিয়ে দেখব? যদি কিছু জেনে থাকে?

মিসেস মুক্তা জড়ানো গলায় বললেন–

— হ্যাঁ তাই দিয়ে দেখ।

রিহা তানিয়াকে কল লাগায়। তানিয়া রিসিভ করে সহাস্যে বলল–

— কি খবর রিহু? এতো দিন পর আমার কথা মনে পড়ল?

রিহা তানিয়ার কথাকে পাত্তা না দিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল–

— আপু কি তোমার সাথে আছে তানি আপু?

তানিয়া অবাক হয়ে বলল–

— না। মিমু তো আমার সাথে নেই। তাছাড়া আজ তো ওর সাথে আমার কথাই হয়নি।

রিহা ফুঁপিয়ে উঠে বলল–

— আপু বাড়িতে ফেরেনি। অনেক বার কল দিয়েছি কেউ ধরেনি। আমার আপু কোথায় গেল?

তানিয়া দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। মিমি কাউকে না বলে কোথাও যাওয়ার মেয়ে নয়। তানিয়া রিহাকে বলল–

— তুমি চিন্তা কোরো না। আমি আসছি।

তানিয়া ফোন কেটে দিয়ে তৎক্ষণাৎ মেঘকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। মেঘ বাড়িতেই ছিল। মিমি দের বাড়িতে এসে দেখল, মিসেস মুক্তা ও রিহা কান্না কাটি করছে। তানিয়াকে দেখে তাদের কান্না যেন বেড়ে গেল। তানিয়া তাদের সামলাতে পারছে না। এরই মধ্যে মিসেস মুক্তা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তার প্রেশার ফল করেছে। মেঘ তাকে ধরে রুমে নিয়ে শুইয়ে দিল। অতঃপর ডাক্তারকে কল করে আসতে বলল। তানিয়া কেঁদে উঠে তাকে বলল–

— মিমু কোথায় গেল মেঘ? তুমি যেখান থেকে পারো আমার মিমুকে এনে দাও।

সে নিজের চোখ মুছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কান্নারত রিহাকে আগলে নিল। তার চোখ মুছিয়ে সান্তনা দিয়ে বলল–

— কাঁদছ কেন পাগলি? তোমার আপু ঠিক চলে আসবে দেখো? আর তুমি কাঁদলে আন্টিকে কে দেখবে বলো? তুমি না শক্ত মেয়ে? কেঁদো না।

তানিয়া বলছে ঠিকই কিন্তু তার নিজেরই চোখ বারংবার ভিজে যাচ্ছে। মেঘ নিজেও অনেক চিন্তায় পড়ে গিয়েছে। ডাক্তার এসে মিসেস মুক্তাকে দেখে ঘুমের ইনজেকশন দিলেন এবং তাকে চিন্তা করতে বারন করলেন। চিন্তা করলে উনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

মেঘ কাইফকে কল করল। কাইফ রিসিভ করে বলল–

— বল মেঘ।

— তুমি কোথায় ভাইয়া?

— আমি অফিসে। কেন কি হয়েছে?

— মিমিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ভাইয়া। সে বাড়িতে ফেরেনি। যে ছ’টার মধ্যে চলে আসে এখান ন’টা বাজতে চলল, এখনও আসেনি।

কাইফের অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। সে কল কেটে দিল। তার প্রায় পনেরো মিনিট পর কাইফ হাজির। যেখানে সময় লাগে আধঘন্টা, সেখানে কাইফ অর্ধ সময়ে চলে এসেছে। মেঘ বিস্ময়ে হা হয়ে আছে।‌কাইফ মিমির মায়ের কাছে গেল, সে বর্তমানে ঘুমিয়ে আছে ‌। কাইফ তাকে আগে দেখেনি। এই প্রথম দেখল তাও এমন পরিস্থিতিতে। কাইফের হঠাৎ করে নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। সে নিজেকে সামলে নিয়ে রিহা ও তানিয়াকে বলল–

— তোমরা চিন্তা কোরো না। মিস মিমিকে ঠিকই পাওয়া যাবে। তোমরা ওনার খেয়াল রেখো। আমরা তাকে খোঁজার চেষ্টা করছি।

বলে সে মেঘকে নিয়ে পুলিশ স্টেশনে চলে গেল। পুলিশ চব্বিশ ঘন্টা হওয়ার আগে রিপোর্ট লিখতে চাইলেন না। কাইফ রাগারাগী করতে নিলে মেঘ তাকে ধরে বাইরে নিয়ে এলো। কাইফের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কোথায় গেল মিমি? কাইফ বুকের মধ্যে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করছে। সে মেঘকে বলল–

— মেঘ! তুই চলে যা। ওখানে তিন জন একা আছে। ওদের দেখ গিয়ে।

— তুমি যাবে না ভাইয়া?

— হ্যাঁ। আমি একটু পরে আসছি। তুই গাড়ি নিয়ে চলে যা।

— কিন্তু গাড়ি!

কাইফ চোখ রাঙিয়ে বলল–

— আমি তোকে কোনো প্রশ্ন করতে বলিনি। যা বলেছি তাই কর।

অগত্যা মেঘ বাধ্য হয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। কাইফ সেদিকে তাকিয়ে নিজের গন্তব্যে পা বাড়াল।
——

ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরছে মিমির। সে পিটপিট করে চোখ মেলে অপরিচিত জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করল। এটা কোনো পরিত্যক্ত জায়গা। সে খেয়াল করে দেখল, তার মতো অনেক মেয়েই এখানে আছে। সকলেরই তার মতো হাত পা বাঁধা। তার গুনগুনিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। মিমি বুঝল যে সে পাচারকারী চক্রের হাতে পড়েছে। তার চোখ ভেঙ্গে কান্না আসতে চায়ল। তার কিছু হয়ে গেলে মা বোনের কি হবে? তাদের কে দেখবে? মিমি কান্না আটকাতে পারল না। কেঁদেই দিল। সাথে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল। পাহারা দেওয়া লোক এসে ধমকে উঠে বলল–

— এই মেয়ে! চুপ! একদম চুপ করে থাক।

মিমি কেঁদে কেঁদে বলল–

— ছেড়ে দিন আমাদের। ছেড়ে দিন।

— চুপ! নাহলে জানে মেরে ফেলব শা/লি।

মিমি তবুও থামে না। লোকটা তেড়ে এসে তাকে কষিয়ে থাপ্পড় মারে। ফলস্বরূপ সে হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। সেভাবেই কাঁদতে লাগে আর চেঁচায়। এর মধ্যে তাদের বস এসে হাজির। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল–

— কি হচ্ছে এখানে?

— বস মেয়েটা তখন থেকেই চেঁচিয়ে যাচ্ছে। এতো করে থামতে বলছি থামেই না।

বস ইশারা করে মিমিকে সোজা করে বসাতে বলল। লোকটি মিমিকে সোজা করে বসিয়ে দেয়। বস মিমিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। অবশ্যই তা নোংরা দৃষ্টিতে ‌। মিমির নারী দেহ তার মনে ধরল। একবার যাকে তার মনে ধরে তাকে ভো/গ না করা পর্যন্ত সে ছাড়ে না। সে বিশ্রি হেসে বলল–

— বাহ! মা/ল/টা তো জোস! তেজও আছে দেখছি। একে আমার রুমে পাঠিয়ে দে। একে টে/স্ট না করে পাচার করাটা বোকামি। যা, নিয়ে যা।

লোকটা মিমিকে টেনে হিচড়ে নিয়ে গেল। বস লোকটা আর কেউ নয় রায়হান তালুকদার! অনেক আগে থেকেই সে নারী পাচারকারী দের বস। এছাড়াও তার অনেক অনৈতিক কারবার আছে। মোবারক তালুকদার এখন মোটামুটি সুস্থ। তবে কিং এর ভয়ে তিনি চুপসে আছেন। মেয়েদের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছেন না। প্রতিজ্ঞা করেছেন সব খারাপ কাজ ছেড়ে দেবেন তারপর হজ করতে যাবেন। কিং এর ভয় তাকে পুরোপুরি কাবু করে ফেলেছে। তিনি ছেলেকে বলেছিলেন–

— এসব কাজ ছেড়ে দে রায়হান! কিং এর হাতে পড়লে বাঁচতে পারবি না। তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। আমার কথা শোন।

কে শোনে কার কথা? রায়হান তার কথা শোনেইনি এমন ভাব করে ছিল। রায়হান দমে যাবার পাত্র নয়। সে তার কাজ ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। এইসব কাজ করলে শুধু টাকা আর টাকা, এতো টাকা তো কোনো মূর্খই হাত ছাড়া করে। রায়হান তো মূর্খ নয়। কিং সামনে আসলে সে ঠিক তাকে দেখে নেবে। সে কোনো কিং ফিং কে ভয় পায় না। সে মুখ বিকৃত করে বলল–

— আমার সামনে একবার আয় কিং! এই রায়হান তালুকদার তোকে দেখে নেবে। সকলে তোকে ভয় পেলেও রায়হান তালুকদার তোকে ভয় পায় না।‌‌

সে মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে পুনরায় বিশ্রি হেসে চলে গেল। বর্তমানে তারা সমুদ্র বন্দরের আশে পাশে খুবই গোপন জায়গায় ঘাটি গেড়েছে। যেন পুলিশে ঘুনাক্ষরেও টের না পায়। ধরে নিয়ে আসা যে মেয়েকে তার ভালো লাগে তাকেই সে ভো/গ করে। অতঃপর তাকে পাচার করে দেয় বিদেশে।

চলবে?

#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৫

মিমির হাত পা খুলে একটা রুমের মধ্যে ফেলে রেখে গিয়েছে লোকটা। মিমি চারপাশে তাকায়। পরিষ্কার একটা রুম, একটা বিছানাসহ কিছু আসবাবপত্র। বলতে গেলে থাকার জন্য উপযোগী একটা রুম। এখানে তাহলে এদের বস থাকে? মিমি খুবই দূর্বল অনুভব করছে। এখন কটা বাজে? কতক্ষন সে এখানে বন্দি আছে? সে জানে না। আর কি কখনো পরিবারের সাথে দেখা হবে না? তার মা, রিহা, তানি আর! আর মিস্টার খান! তার সাথেও কি আর দেখা হবে না? তার গম্ভীর মুখের দর্শন কি আর পাওয়া হবে না? মিমি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। পাগলের ন্যায় বের হবার চেষ্টা করে। কিন্তু বের হবার কোনো পথই খোলা নেই। মিমি হাল ছেড়ে দিয়ে বিছানায় বসে কাঁদতে থাকে। হুট করেই দরজা খোলার শব্দ হয়। মিমি তাকিয়ে দেখে মুখে বিশ্রী হাসি নিয়ে রায়হান প্রবেশ করেছে। দরজাটা পুনরায় বন্ধ করে দিয়েছে। তার নোংরা দৃষ্টি মিমির সর্বাঙ্গে বিচরণ করছে। মিমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকাল। রায়হান তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মিমি আকুতি করল–

— আ আমার সর্বনাশ করবেন না দয়া করে। ছেড়ে দিন আ আমাকে।

রায়হান এগোতে এগোতে বলল–

— এই রায়হানের দৃষ্টি এক বার যার দিকে পড়েছে, রায়হান তাকে ছাড়েনি সুন্দরী। তোমাকে ছাড়ার প্রশ্নই আসে না।

রায়হান মিমির দিকে হাত বাড়াতে নিলেই সে সরে যায়। রায়হান এগোয়। মিমি চিৎকার করে ওঠে। রায়হান বিরক্ত হয়ে তার মুখ চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল–

— যা হচ্ছে চুপ চাপ দেখে যা। এমনিতেও বাঁচতে পারবি না। কাল রাতেই তোদের সব কটাকে পাচার করে দেব।

মিমি গায়ের সব টুকু শক্তি দিয়ে রায়হানকে ধাক্কা মারে। রায়হান ধপ করে বিছানায় পড়ে যায়। মিমি বিছানা থেকে নেমে দরজা ধাক্কাতে থাকে।

— কেউ আছেন? দরজাটা খুলে দিন প্লিজ।

রায়হান পেছন থেকে তেড়ে এসে মিমির চুল মুঠো করে ধরে। ব্যথায় মিমি কুঁকড়ে ওঠে। রায়হান তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ঠাঁটিয়ে থাপ্পড় মারে। মিমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। ঠোঁট ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়। রায়হান পুনরায় আঘাত করে। দূর্বল মিমি নেতিয়ে পড়ে। রায়হান তার চুলের মুঠি ধরে হিসহিসিয়ে বলল–

— খুব তে/জ না তো? আজ তোর তে/জ আমি ছোটাব।

মিমি প্রাণপণে ছাড়া পাবার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। রায়হান তাকে বিছানায় ছুড়ে মারে। তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে নিলেই বিকট শব্দে দরজা ভেঙে যায়। রায়হান পিছু ফিরে হতভম্ব হয়ে যায়। কালো পোশাক ধারি একজন দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা যার মুখোশে ঢাকা। রায়হান চমকিত কন্ঠে আওড়াল–

— কিং!

কিং তার বুক বরাবর লাথি মারে। রায়হান ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। কিং লাগাতার তাকে লাথি মারতে থাকে। হিংস্র কিং এর আঘাতে কাতরাতে থাকে রায়হান। কিং তার গাল চেপে ধরে বলল–

— চুপ করে ছিলাম বলে কি ভেবেছিলি? ছাড়া পেয়ে যাবি? কিং এর হাত থেকে ছাড়া পাওয়া এতো সহজ? জা/নো/য়া/র!

কিং তার নাক বরাবর ঘুষি মারে। অতঃপর তার লোকদের ইশারা করে রায়হানকে নিয়ে যেতে বলে। তার আধমরা রায়হানকে ধরে নিয়ে যায়। কিং আগে থেকেই খোঁজ পেয়েছিল নারী পাচারকারী চক্রের। আজ সে নিজের দলবল এনে হাতে নাতে ধরল। একটু পর পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে করে নেবে। কিং লম্বা শ্বাস নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা মিমির দিকে এগিয়ে গেল। তাকে ধরে বসাল। মিমি নিভু নিভু চোখে এক পলক তাকে দেখে চোখ বন্ধ করে নিল। জ্ঞান হারাল সে। কিং তাকে বুকের মাঝে আগলে নিল।

কিং প্রস্থান করার পরপরই পুলিশরা জায়গা টা ঘিরে ফেলল। প্রতিটি মেয়েকে নিজেদের বাড়িতে সুস্থ ভাবে পৌঁছে দিল। কেউ একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর কে ইনফর্ম করেছিল। কিন্তু তার পরিচয় সম্পর্কে ইন্সপেক্টর অবগত নন। সকলে সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছে চিরঋণী।

মিমি চোখ খুলে নিজেকে নিজের বাড়িতে নিজের রুমে আবিষ্কার করল। হাত পুরো শরীর ব্যথা করছে। নড়তে গিয়ে হাতে ব্যথা অনুভব করল। মৃদু শব্দে ব্যথাতুর আওয়াজ করল। তার হাতে সেলাইন দেওয়া। তার আওয়াজে তৎক্ষণাৎ হুড়মুড় করে তানিয়া আর রিহা তাকে ঘিরে ধরল। তানিয়া প্রশ্ন করল–

— কি হয়েছে মিমু? কোথায় ব্যথা করছে? বল আমাকে?

পাশ থেকে রিহা বলল–

— আমাকে বল আপু? ডাক্তারকে আসতে বলব?

— আমি এখনই মেঘকে ডাক্তার নিয়ে আসতে বলছি।

মিমি দূর্বল কন্ঠে বলল–

— ব্যস্ত হোস না তানি। আমি ঠিক আছি। একটু পানি খাবো।‌‌ গলা শুকিয়ে গিয়েছে।

তানিয়া তাকে আলতো করে তুলে পানি খাইয়ে দিল। মিমি বালিশে মাথা ঠেকিয়ে বলল–

— মা কোথায়?

— আন্টি তোকে এভাবে দেখে কাঁদছিলেন অনেক। তাই তাকে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।

মিমি স্বস্তির শ্বাস ফেলল। কিছু মনে পড়ার ভঙ্গি করে বলল–

— আমি এখানে কীভাবে এলাম তানি? আমাকে কে এনেছে?

রিহা পাশ থেকে বলে উঠল–

— পুলিশে তোমাকে বাঁচিয়েছে আপু। সেখান থেকে কাইফ ভাইয়া তোমাকে নিয়ে এসেছে।

মিমি কিছু বলল না। ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ভাবে, তখন কে ছিল? পুলিশ যাবার আগে ওখানে কেউ গিয়েছিল। যে মিমিকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু কে? মিমি তাকে দেখেনি। নিভু নিভু চোখে শুধু এইটুকু দেখেছিল যে তার মুখ একটা মুখোশ দিয়ে ঢাকা। তারপরে মিমির আর কিছু মনে নেই।

তানিয়া সেদিনের মতো চলে গেল। মেঘ মিমির সাথে একবার কথা বলে তানিয়াকে নিয়ে চলে গেল। কিন্তু কাইফ মিমির সাথে দেখা করল না। মিমি তাকে মনে মনে খুঁজেছে কিন্তু তার দেখা পায়নি। এতে তার কিঞ্চিত মন খারাপ হলেও সে তা গিলে ফেলল।
———

সকাল সকাল বাইরে হইচই শুনে ঘুম ভেঙে গেল মিমির। সে উঠে দূর্বল শরীর টেনে নিয়ে বাইরে গেল। বসার ঘরে অনেক মানুষ ভীড় করেছে। অধিকাংশ তাদের প্রতিবেশী। হঠাৎ করেই তাদের বিষবাক্য শুনে মিমির হৃদয়ের সাথে কান জ্বলে উঠল।

— এই ন/ষ্টা মেয়েকে কীভাবে ঘরে তুলতে পারলে মুক্তা? আমার মেয়ে হলে তার গলা টিপে মেরে ফেলতাম।

— না জানি কার সাথে রাত কাটিয়ে এসেছে। আর গল্প দিচ্ছে কিডন্যাপ হয়েছিল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ

— এমন নোংরা মেয়ে আমাদের ‌‌এলাকায় থাকতে দেব না। হয় তোমার মেয়ে দূর করো। নয়তো স্ব পরিবারে এলাকা ত্যাগ করো।

— হ্যাঁ হ্যাঁ এই মেয়ে আমাদের এলাকায় থাকলে এর সাথে আমাদের মেয়েরাও খারাপ হবে। আমরা তা কিছুতেই হতে দেব না।

মিমি মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস মুক্তা একপাশে দাঁড়িয়ে মুখে আঁচল গুজে কেঁদে যাচ্ছে। রিহা মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে ফোন আর ফোনের ওপাশে তানিয়া রাগে ফুঁসছে। মিসেস মুক্তা তাদের অনুনয় বিনয় করলেন–

— আপনারা বিশ্বাস করুন। আমার মেয়ে কোনো খারাপ কাজ করেনি। সে সত্যিই বিপদে পড়েছিল।

— হ্যাঁ মেয়ের দোষ ঢাকতে তো এখন এসব কথা বলবাই। আমরা কোনো কথা শুনছি না। যেকোনো একটা কথা মানতেই হবে।

মিমির ইচ্ছে করল মরে যেতে। তাকে জঘন্য অপবাদ দিচ্ছে সকলে। তার বাবা বেঁচে থাকতে কি সুন্দর বাক বাকুম করত সকলে। বাবা মারা যাবার পর থেকে তারা এক ঘরে হয়ে আছে। প্রতিবেশীরা ভুলেও খোঁজ খবর নিতে আসেনি। অথচ আজ দেখো! একটা কথা শুনেছে তাই নিয়ে শোনাতে চলে এসেছে। মিমি কি করবে জানে না। সে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। যেন সে জীবন্ত পুতুল। তন্মধ্যে একজন প্রস্তাব রাখল–

— একটা কাজ করো মুক্তা, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও। পাত্র তো এখানেই উপস্থিত আছে। এই যে দোকানদার হাসেম আলী। সে তো মিমিকে কবে থেকেই পছন্দ করে। এখন মিমির কুকির্তী শুনেও সে রাজি।

হাসেম আলী তাদের এলাকার মুদির দোকানদার। তার নোংরা দৃষ্টি মিমির ওপর পড়েছিল। সে মিমিকে তার তৃতীয় বউ বানাতে চায় বয়স তার পঞ্চাশ। সে মিমির দিকে তাকিয়ে লাল দাঁতের বিশ্রী হাসি দিল। মিসেস মুক্তা আঁতকে উঠে বললেন–

— আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে ভাবি। এমনটা করবেন না। আমি আপনাদের পায়ে পড়ি।

কাজ হলো না। তাদের এক কথা হয় হাসেম আলীর সাথে বিয়ে দাও, নাহয় এলাকা ছেড়ে দূর হও। সকলকে অবাক করে দিয়ে মিমি বলে উঠল–

— আমি রাজি! আপনারা বিয়ের আয়োজন করুন।

হাসেম আলী খুশিতে গদগদ হয়ে গেল।‌‌ মিসেস মুক্তা বিস্ফোরিত চোখে মেয়ের দিকে তাকান। মিমি অনুভূতি শূন্য, তার মুখে কোনো ভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে না। পরিস্থিতির কাছে সে হার মেনে নিয়েছে।

চলবে?
{ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, ধন্যবাদ।}