হলদে প্রজাপতি পর্ব-১০+১১

0
202

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

দশ

ক্যামেলিয়া সাইনেন্সিস।
একেবারে ব্রহ্মতালুতে ঢুকিয়ে নিয়েছি।
কখনোই ভুলবো না।
কিছুতেই ভুলবো না।
সেদিন ফিরে এসেই আগে বই থেকে খুঁজে বার করে চা’গাছের সাইন্টিফিক নামটা মাথার মধ্যে গেঁথে নিয়েছি । ছি ছি ছি ! কি লজ্জার কথা ! আমি বোটানি অনার্সের স্টুডেন্ট হয়ে কিনা চোখের সামনে সর্বক্ষণ যে সবুজের মেলা দেখছি, সেই চা গাছগুলোর সাইন্টিফিক নামটা যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তখনই বলতে পারলাম না? মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার। এ লজ্জা রাখি কোথায় ? তবে সোনু দা জিজ্ঞাসা না করে, অন্য কেউ যদি জিজ্ঞাসা করত, তখন যদি আমি সাইন্টিফিক নেম’টা না বলতে পারতাম, তখনও কি এতটাই লজ্জা পেতাম? জানিনা । মনে হয় যেন পেতামনা । সাইন্টিফিক নামটা বলতে না পারা – তার চেয়েও বড় লজ্জার হয়ে দাঁড়ালো সোনু’দা আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করল, তার মধ্যে প্রায় কিছুই আমি উত্তর দিতে পারলাম না ? এমন কেন হলো ঠাকুর ? তুমি আমায় এতোখানি লজ্জা কেন দিলে ? সেই সময়ের জন্য মাথাটা একেবারে ব্ল্যাংক কেন করে দিয়েছিলে? কি ভাবল ও ? আমি কিছুই জানিনা ? আমি একটা হাঁদা ক্যাবলা? এমনিতেই নিজের জড়তার কারণে প্রথমদিন থেকেই আমি ওকে অ্যাভয়েড করে চলতাম । সেদিনের পর থেকে রীতিমতো ভয় পেতে আরম্ভ করলাম। বান্টি বিকেলবেলা বেরোনোর সময় আমাকে ডাকলেও, প্রতিদিনই কিছু না কিছু বাহানায় আমি এড়িয়ে যেতাম। বাংলো থেকে আর বেরোতামই না। শুধু কলেজ যেতাম আর আসতাম । সামনাসামনি পড়লেই আবারো যদি ঐরকম ধরনের কিছু প্রশ্ন করে, আমি যদি আবারো না পারি ! মোটের ওপর কথা, বাড়ি থেকে বের হচ্ছি না মোটেই বটে , তবে মনটা সর্বক্ষণ তার প্রতিই পড়ে রয়েছে। কি ভেবেছে আমার সম্পর্কে? কি ধারণা হলো? কতখানি বাজে স্টুডেন্ট ভাবলো আমায় ? এই সমস্ত তোলপাড় করে ভেবে চলেছি।

এদিকে বান্টি আমার কাছে গল্প করতো , জানিস তো তরু দিদি , তুই তো আর বেরোস না আমার সঙ্গে এখন । সোনু দাদা তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল –
এই একটা কথা শোনা মাত্রই আমার কান খাড়া হয়ে যেত। আমি বান্টির সঙ্গে বেরোচ্ছি না বলে, আমাকে দেখতে পাচ্ছে না বলে, সে আমার কথা জিজ্ঞাসা করেছে ? মনের ভেতরটা ছটফট করত জানার জন্য কি বলেছে। কিন্তু, বাইরে কোনো আগ্রহ দেখাতাম না। চুপ করে থাকতাম । দেখতাম, বান্টি নিজেই কথাটা শেষ করে কিনা । আর কিছু ও না বললে, তখন খুব নির্লিপ্ত গলায় বলতাম , কলেজ থেকে ফিরে এসে মাথাটা খুব ধরেছিল রে । তা, কি বলছিল ?
‘জিজ্ঞাসা করছিল তোর কিছু হয়েছে কিনা, ঠিক আছিস কিনা তুই। বিকেলে বেরোস না কেন ?’
কোনরকমে দায়সারা গোছের উত্তর দিতো । তারপরেই বলতো, তরু দিদি , তুই আজকাল আর আমার সঙ্গে বেরোস না । ভালো লাগে না আমার। কালকে বেরোবি?
বলতাম, দেখি কাল কলেজ থেকে ফিরে শরীর ঠিক থাকলে বেরোবো ।
সে সময়ের জন্য মনে একটা আলাদা শক্তি পেতাম । ভাবতাম , কালকে ঠিক বেরোবো । একদিন ওরকম প্রশ্ন করেছে বলে কি সবসময় করবে ? কি করে দেখাই যাক না । কিন্তু , তারপরে যেই পরের দিন বিকেলবেলাটা আসতো , তখনই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেতো । কল্পনায় দেখতে পেতাম, ও আমাকে অজস্র প্রশ্ন করে চলেছে , একের পর এক, আমি একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারছিনা । ব্যাস্। বেরোনোর ইচ্ছে উবে যেত । আমি আবার কোন একটা এক্সকিউজ খাড়া করে বলতাম, আজকে হচ্ছে নারে বান্টি । কালকে যাব ।

তবে মনটা অকারণেই ম্যানেজারের বাংলো , আর তার বিশেষ বাসিন্দাটির দিকেই পড়ে থাকতো । দেখতাম সে সকালে আর বিকেলে বেশ কিছুটা সময় ধরে চা বাগানে ফিতেয় করে কি সব মাপছে । তারপর ট্রাইপডের মত একটা স্ট্র্যান্ড এর ওপরে কি একটা যন্ত্র রেখে কি সব দেখছে । আর খচাখচ করে প্যাডের ওপর সঙ্গে সঙ্গে কি সব লিখে নিচ্ছে। আমাদের বাংলোর কাছাকাছি চা বাগানগুলোতে, আবার কখনো কিছুটা দূরে গিয়েও এসব মাপামাপি করে আসতো । আমি কলেজ যাওয়া-আসার পথে দেখতে পেতাম । সে সব দেখেশুনে আমার ভেতরের ভয় ভয় ভাবটা আরো বেশি করে জাঁকিয়ে বসতো । কি জানি বাবা , কত কিছু জানে ! কত পড়াশুনো করে! আমি যে ওর কাছে কতখানি তুচ্ছ , কোন তুলনাতেই আনতে পারতাম না ।

এমনি ভাবে প্রায় সপ্তাহ দুই তিন কাটলো । রাত্রি তখন ন’টা হবে । আমি নিজের ঘরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শরৎচন্দ্রের ‘পরিনীতা’ পড়ছিলাম । ঘরের লাইট বন্ধ ছিল। বিছানার ওপর একটা টেবিল ল্যাম্প নিয়ে, তার নিচে বই রেখে পড়ছিলাম। বরাবরই রোমান্টিক গল্প, উপন্যাস আমার খুব ভালো লাগে । তবে আজকাল পড়াশুনোর সময় থেকেও কেটেছেঁটে বাদ দিয়ে বেশ কিছুটা সময় ধরে কিছু কিছু বিশেষ উপন্যাস দুবার চারবার ছ’বার করে পড়তে ইচ্ছা করে । কিছু গল্পের বই আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম । নিজের যেগুলো খুব প্রিয় । ভামিনী কাকিমার সংসারে বুকশেলফে কত্ত বই থরে থরে সাজানো । এতটাই নতুন আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন যে হাত দিতে ভয় হয়। তাই সেইসব বুকশেলফের দিকে শুধু জুলজুল করে তাকিয়ে থাকতাম । সেখান থেকে বই নিয়ে আর পড়া হতো না । নিজের আনা দশবার করে পড়া সেই উপন্যাসগুলোই বারবার করে পড়তাম । শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ – বিগ্রহপালের সেই হঠাৎ করে আড়াল থেকে এসে রাজকুমারীর হাতের ওপর নিজের হাত রাখা, উফ্! কিম্বা , ‘ন হন্যতে’র মির্চা ইউক্লিডের অমৃতাকে হঠাৎ করে কাছে টেনে নিয়ে তার ঠোঁটে কামড়ে একটা ছোট্ট দাগ করে ছেড়ে দেওয়া- এসব পড়তে পড়তে কি যে হয়, কি বলবো ! আগে রোমান্টিক গল্প পড়তে শুধু ভালো লাগত। এখন পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হয় । ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায়। খেয়াল থাকে না।

— কি রে তরু দিদি ! কি করছিস ? তোকে ডাকলাম শুনতে পেলি না ?
বলতে বলতে হুড়মুড় করে দরজা খুলে একেবারে ঘরের মধ্যে ঢুকে এসেছে বান্টি। আমি এতটাই গল্পের মধ্যে বুঁদ হয়েছিলাম যে, এই জগতে আর ছিলাম না । ও হঠাৎ করে ঘরে ঢুকে আসায়, চমকে উঠে তাকালাম । তাকিয়ে যা দেখলাম , তাতে ভীষণভাবে চমকে উঠলাম ।
বান্টি একমুখ হেসে বলল , দেখ, কাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি তোর ঘরে ।
এদিকে আমার অবস্থা তখন সাংঘাতিক রকমের সঙ্গীন । ধড়মড় করে উঠে বসতে বসতে খেয়াল হল নাইটিটা কখন প্রায় জঙ্ঘার কাছে উঠে এসেছে । আমি উপুড় হয়ে হাতের ওপর থুতনি রেখে দুটো পায়ের পাতা ওপরের দিকে করে দোলাতে দোলাতে নিজের মনে বই পড়ছিলাম । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাতে করে নাইটিটা নামিয়ে নিয়ে উঠে বসলাম । তবে সোনুদার চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। ইস্, কতটা উঠে গেছিল নাইটিটা ? মানস চোখে দেখতে পেলাম , সোনু’দা ঘরে ঢুকেই আমার নগ্ন পা দুটো দেখেছে। কতখানি দেখেছে ? হাঁটুর ক’ ইঞ্চি ওপরে ছিল ? এভাবে একজন পুরুষ আমার অনাবৃত পা দেখে নিল ? কি হবে এবার? মা বলে, আমার পুরুলিয়ার বন্ধুরাও বলতো , বিয়ে হওয়ার আগে কোন পুরুষ কোনভাবে কখনো যেন মেয়েদের শরীরের যা-কিছু পোশাকে ঢাকা থাকে, তার কোন অংশ দেখে না ফেলে । দেখে ফেললেই নাকি সেই মেয়ের চরিত্রের দোষ হয় । আমার কি তবে আজকে চরিত্রের দোষ হয়ে গেল ? মাথার মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে ! সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ছে ওই বান্টিটার ওপরে । কি বেআক্কেলে মেয়ে রে বাবা ! ‘তরু দিদি’ , ‘তরু দিদি’ করে যখন তখন তুই নিজে চলে আসিস বলে আজকে সোনু দা’কে সঙ্গে নিয়েও একইরকম ভাবে দুম করে ঢুকে পড়বি? একবারও নক করবি না ? দরজা হাট করে খুলে তো আর রাখিনি । ভেজানো ছিল ।

দুটো কান গরম হয়ে উঠলো । অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে পায়ের পাতা পর্যন্ত নাইটিতে ঢেকে বসে রইলাম।
বান্টি বলল , এই তরু দিদি , আজকে তো সোনু দাদা আমাদের সঙ্গে ডিনার করবে ।
ক্ষীণ গলায় কষ্ট করে একটু হেসে বললাম, আচ্ছা তাই ?
— হ্যাঁ। তাই সোনু দাদা কিছুক্ষণ আগেই চলে এসেছে । এতক্ষণ তো আমরা নিচে বসে গল্প করছিলাম । তোকে ডাকলাম কয়েকবার । তুই শুনতে পেলিনা । নে দ্যাখ্ । সোনু দাদা তোকে কি জিজ্ঞাসা করছে । উত্তর দে।

আমি তবুও তার দিকে তাকালাম না। শরীর যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে । মুখটাকে আরও একটু নিচে নামিয়ে খোলা বইয়ের পাতার ওপর চোখ রেখে বসলাম। তার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম সে গুটিগুটি পায়ে আমার বিছানার কাছে এগিয়ে আসছে ।
আমি তাও তার দিকে তাকাচ্ছি না..
তাকাচ্ছি না কিছুতেই..
না ..
কিন্তু সে আমার দিকে মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বান্টি তোমার তরু দিদি কি দেখতে পেয়েছে আমি তার ঘরে এসেছি?
এইবারে আর না তাকালেই নয় । পৃথিবীর সব লজ্জা ভিড় করেছে আমার দু’চোখে । মাথার ওজন মনে হচ্ছে যেন কয়েক মণ। সেটাকে কোনমতেই আর ওপরের দিকে আমি তুলতে পারবো না। তবুও সে সমস্ত বাধা অতিক্রম করতেই হল । জোর করে মুখটা ওপরের দিকে তুলে তার মুখের দিকে তাকালাম । একরকম অদ্ভুত ধরনের ছেলেমানুষি মাখা দুষ্টু-দুষ্টু একটা হাসি লেগে রয়েছে ঠোঁটে । আলো-আঁধারি খেলা করছে তার মুখে। কৌতুক মাখা দুচোখে আমার মুখটা যেন জরিপ করছে সে।
আমি মরলাম !
সেই ছেলেমানুষি মাখা হাসি আর দুষ্টুমি ভরা দুটো চোখের সামনে আমার দুনিয়া দুলতে লাগল । ওই চোখের দিকে তাকালে কেমন যেন বিদ্যুতের শক্ লাগে আমার । সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলেও, শরীরের মধ্যে বিদ্যুতের ক্রিয়াকর্ম শুরু হয়ে গেল ।
আমি সেদিনই মরেছিলাম ।
কিন্তু তখন বুঝিনি এই ‘মরা’ কেমন ‘মরা’ ।
এইসময় বান্টি হঠাৎ ‘যাই মা ‘ বলে ঘর থেকে চলে গেল । ভামিনী কাকিমা ওকে যে কখন ডাকলেন, সেসব আমি কিছুই শুনতে পাইনি। বিশেষ অনুভূতি যখন শরীর-মন জুড়ে পেয়ে বসে, তখন অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
বান্টি চলে যেতে ও আরেকটু ঝুঁকে পড়ে আমার বইয়ের খোলা পাতাটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, কি করা হচ্ছে? এখন না তোমার পড়াশোনা করার সময় ?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, সব সময় আমি পড়িনা। অনেক সময় গল্পের বই পড়ি ।
— কি গল্পের বই পড়া হচ্ছে শুনি ?
এইবার পূর্ণদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, বা রে ! দেখতে পাচ্ছেন না ?
— অমনি একটা পাতা দেখে বোঝা যায় বুঝি ?
— বাহ্, এমন সব গল্প, এরকম সব উপন্যাস, আমি তো একটা লাইন দেখেই বলে দিতে পারব কোন উপন্যাস ।

শুনে ওর দুটো চোখে দুষ্টু বুদ্ধির ঝিলিক খেলে গেল । তারপর হঠাৎ করে বইটা আমার বিছানার ওপর থেকে তুলে হাতে নিয়ে দু-একটা পাতা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে নিয়ে আবার সেটা সেখানে রেখে দিয়ে কৌতুক মিশ্রিত গলায় বলল, ‘পরিণীতা’! হুম, বুঝলাম।
বলে আমার বিছানার অন্য কোণে গিয়ে ঝপ্ করে বসে পড়ে বললো , দেখো আজকে কিন্তু আর তোমার পারমিশন নিলাম না ।
বলে মুচকি হেসে বলল, তা পরিণীতা যে পড়ছো , ‘পরিণীতা’ মানে কি বলতো ?

আবার প্রশ্ন !
এবার আর প্রশ্নের উত্তর দিলাম না । যদিও উইথ কনফিডেন্স উত্তরটা খুব ভাল করেই জানা ।
বললাম, আপনি আমাকে কি ভাবেন বলুন তো ? আমি স্কুলে পড়ি না, কলেজে পড়ি।
এবার হো হো করে কয়েক সেকেন্ড হাসল ও । এই প্রথম আমি ওকে প্রাণ খুলে হাসতে শুনলাম। গায়ে কাঁটা দিতে লাগলো ।
হাসি থামিয়ে ও বলল, কিন্তু তুমি যে কলেজে পড়ো সেটা তো বোঝার উপায় নেই ।
অবাক হয়ে বললাম, কেন ?
— বা রে ! যে সমস্ত মেয়েরা কলেজে পড়ে, তাদের তো দুটো করে ডানা গজায়। উড়ে বেড়ায় তারা । তোমার ডানা কই ?
কথার কোন উত্তর দিলাম না। মুখ নিচু করে বসে রইলাম।
মিটমিটে দুষ্টুমি মাখা গলায় ও বলল, আমি তো প্রতিদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি ।
জিজ্ঞাসু চোখে একবার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম।
ও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল । আমি যদি কোন প্রশ্ন করি -।
কোন প্রশ্ন করলাম না দেখে বলল , আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি তো, কখন তুমি উড়ে উড়ে এসে আমার ঘরের সামনের বারান্দায় বসবে।
এবার বুঝতে পারলাম কত বড় ভুল করেছি । কলেজে পড়লে কি কেউ সেটা ওভাবে বলে ? ‘আমি স্কুলে নয় কলেজে পড়ি’? এটা কি একটা বলার বিষয় ? লজ্জায় সারা শরীর আড়ষ্ট হয়ে এল। কেন যে এই ছেলেটার সামনে আমি একটা কথাও ঠিকঠাক বলতে পারি না, কে জানে? সব সময় কি ভুল করতেই হয় ? অথচ কলেজের কথা আলাদা , কলেজে এখনো সেভাবে কারো সাথে সেরকম বন্ধুত্ব হয়নি। খুব যে গল্প করি তা নয়। তবে স্কুলের বন্ধুরা আমায় বলতো, আমি নাকি খুব সুন্দর কথা বলি । তবে এই ছেলেটা সামনে থাকলেই কেন আমার মাথাটা গুলিয়ে যায়?
এবার সে অল্প একটু ঝুঁকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল , কই , দেখি তাকাও আমার দিকে ।
আমি চোখ তুলতে পারলাম না ।
— কি হলো ? তাকাও !
তার কথার মধ্যে যেন একটা অর্ডারের সুর রয়েছে । এবার চোখ তুলে তাকাতে বাধ্য হলাম ।
আমি তাকাতে সে ছদ্ম গাম্ভীর্যের সুরে বলল, সেদিনের পর থেকে বিকেলবেলা আর বাইরে বেরোও না কেন ?

আমার একসঙ্গে দুটো অনুভুতি হলো প্রশ্নটা শুনে। এক, অসম্ভব বুক ধড়ফড় করতে লাগলো । এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবো ভেবে পেলাম না । তবে তার সাথে মাথার মধ্যে একটা রিনরিনে সুর বেজে উঠল । সেই সুর সারাটা শরীরে যেন অদ্ভুত একটা আমেজ ছড়িয়ে দিলো । ও জানতে চাইছে আমি বিকেলবেলা আর বেরোচ্ছি না কেন । তার মানে, আমি বেরোলে ওর ভালো লাগে । ভালো না লাগলে , আমি বেরোচ্ছি , কি বেরোচ্ছি না , ওর ভারী বয়েই যেত। জিজ্ঞাসা করতো নাকি ? জিজ্ঞাসা করছে মানে নিশ্চয়ই আমি বেরোলে ভালো লাগে ।
আমি আমতা আমতা করে বলতে আরম্ভ করলাম, আমি .. ওই .. কলেজ থেকে কিরে শরীরটা একটু ম্যাজম্যাজ-
আবার ওর ঠোঁটের হাসিটা ফিরে এলো । বললো, তুমি একেবারে মিথ্যে বলতে পারো না । তাই চেষ্টাও কোরো না ।
— মিথ্যে ? মিথ্যে কেন বলব ?
— মিথ্যে কেন বলবে ? সত্যিটা বলতে পারছ না , তাই মিথ্যে বলছো ।
— মিথ্যে হবে কেন ?
— সত্যিটা আমি বলব কি ?
— কি সত্যি?
— আমি সেদিন তোমাকে কয়েকটা কোশ্চেন করেছিলাম । তুমি উত্তর দিতে পারো নি । তাই আর বেরোচ্ছো না । বেরোলেই যদি আমি আবার প্রশ্ন করি, আবার যদি উত্তর দিতে না পারো, তাই ।
যেন আমার সামনে বসে আমার মনটা ও গড়গড় করে পড়ছে আর বলে যাচ্ছে । একি ! আমার মুখে কি মনের কথাগুলো সব দেখা যাচ্ছে নাকি আজকাল ? নাকি , ও মন পড়তে পারে ? অদ্ভুত ছেলে তো ! কোথাও কোনো জড়তা নেই । একবারও ভাবে না, কোনটা বলা উচিত , কি নয় । গড়গড় করে সব কিছু বলে যায় । বলে দিল বেমালুম? আমার মুখের উপর বলে দিল, আমি ওর করা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি বলে আর যাচ্ছি না ? কিন্তু, যা বলেছে, তা তো অক্ষরে অক্ষরে সত্যি । আমি মুখ নামিয়ে বসে থাকলাম । বিছানার চাদরে ডান হাতের তর্জনীতে করে আঁকিবুকি কাটতে লাগলাম। মুখে কোন কথা বললাম না ।
— হুম ঠিক ধরেছি তবে । সেই জন্যেই তুমি আর যাচ্ছ না । তুমি কি আমাকে তোমার কলেজের স্যার ভেবেছো নাকি? যে প্রশ্নের উত্তর না বলতে পারলে আমি তোমাকে বকে দেবো ? তাছাড়া , সবাইকে কি সব কিছু জানতে হবে ? বলতে পারতে হবে ? এমন অনেক কিছু তো তুমিও জানো, যেটা আমি জানিনা । এখনই প্রশ্ন করলে বলতে পারবো না ।
ও কথাগুলো বলছিল, আর আড়চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিচ্ছিল ।
কথা শেষ করে আমার মুখে দিকে তাকিয়ে কথাগুলোর রিআ্যকশন বোঝার চেষ্টা করল ।
তারপর বলল , ঠিক আছে । আমি আর কোন প্রশ্ন করবো না । তাহলে আশা করি বেরোবে তুমি বিকেলবেলা ? আগে যেমন বেরোতে ?
আমি একটা ক্ষীণ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম। বললাম , প্রশ্নের সঙ্গে কি আছে ? আমার কলেজ থেকে ফেরার পর শরীরটা-
— ঠিক আছে , ঠিক আছে । বুঝেছি । যা বললাম সেটা শুনবে। কাল থেকে বিকেলবেলা যেন বান্টির সঙ্গে তোমাকেও দেখতে পাই । কেমন ?
বলে আমার দিক থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করেই উঠে দাঁড়ালো । বলল , ঠিক আছে দেন । তুমি এখন –
প্রথমবার যেমন ঘরের মধ্যে ঝড়ের বেগে বান্টি ঢুকে পড়েছিল , আবারও ঠিক তেমনটাই করল ।
ঢুকেই বলল , কিরে তরু দিদি ? নিচে চল । বাপি মা ড্রইংরুমে ওয়েট করছে । ডিনার করার টাইমও তো হয়ে এলো ।
আমার ঘরে যে ওয়াল ক্লকটা ঝোলানো রয়েছে , সেটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ন’টা পনেরো বাজে ।
বললাম , তোরা যা বান্টি । আমি আসছি এখনই ।
— আয় , এস সোনু দা – ।
বলে বান্টি আর সোনু দা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । আমি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম । ইস্ , ঢিলেঢালা একটা ফতুয়া মার্কা নাইটি । ভেতরে অন্তর্বাস নেই । কেমন যেন লাগছে । এই নাইটিটা পরে কি নিচে যাব? যদি চেঞ্জ করি , তাহলে ও কি ভাববে ? ও এসেছে বলে আমি শুধু ডিনার করতে যাওয়ার জন্য আবার ড্রেস চেঞ্জ করেছি? কিন্তু , এভাবে ক্ষ্যাপার মতো যাওয়া যায়? গুটিসুটি মেরে নিজের বিছানায় খাটের ওপর বসেছিলাম, সেটা একরকম। না , এভাবে কিছুতেই ওর সামনে যাওয়া সম্ভব নয় । ওয়াল আলমারিটা খুলে হাতের সামনে একটা নেবি ব্লু কালারের চুড়িদার পেলাম । ঝটপট চেঞ্জ করে নিলাম। অবশ্যই অন্তর্বাস পরলাম । না হলে কেমন যেন বিশ্রী লাগে । আয়নায় নিজেকে দেখতে ভালো না লাগলে, কি করে একটা ছেলের আমাকে দেখে ভালো লাগবে?
ভালো লাগতেই হবে কেন ?
এটা একবারও ভাবলাম না ।
ওর আমাকে ভালো লাগতে হবে কেন ?
এই ধরনের চিন্তা আমার মাথায় আসছেই বা কেন ? নিজের অজান্তেই আসছে । নিজের অজান্তেই আমি অগোছালোভাবে গার্ডার জড়িয়ে রাখা চুলটা মুক্ত করে দিলাম । দু’বার ব্রাশ করলাম চুলে । ভামিনী কাকিমার দাক্ষিণ্যে আমার সেই লম্বা চুলটা এখন জাস্ট কাঁধের কিছুটা নিচে গিয়েই শেষ হয়ে গেছে । একটা ছোট্ট মেরুন টিপ পড়লাম দুটো ভুরুর মাঝখানে । প্রথম কোন একজন পুরুষকে কেন্দ্র করে, শুধুমাত্র তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে বলে সাজলাম ।
এরপর কত সাজ সেজেছি শুধু ওর জন্য । কতবার সেই সাজ ও ঘেঁটে দিয়েছে –
ঠিক ন’টা পঁচিশে ডিনার টেবিলে গিয়ে বসলাম । বাকিরা আগেই বসেছিল । একবার চোরা চোখে তাকালাম ওর দিকে । দেখলাম ও আমার দিকে হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে আছে । ওর চোখে অ্যাপ্রিসিয়েশন । চোখ নামিয়ে নিলাম সঙ্গে সঙ্গে । সেদিন ডিনারে অনেক কিছু আয়োজন ছিল। বাসন্তী পোলাও, মটন কষা, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, ক্ষীর, আইসক্রিম। বুঝলাম সবই আজ এই বিশেষ অতিথিকে নিমন্ত্রণ করার কারণে বিশেষ আয়োজন । সবকিছুই খেলাম খুব অল্প অল্প করে। তবে কোনো কিছুরই কোন স্বাদ পাচ্ছিলাম না ।

তখন আমার সমস্ত অনুভূতিটুকু জুড়ে শুধু একজন!

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

এগারো

যখন হুঁশ ফিরল, তাকিয়ে দেখি চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে । ওমা, একি ! এক্ষুনি ঝুপ করে সন্ধ্যে হয়ে গেলে, চা বাগানের বুক চিরে সরু সরু যেসমস্ত মেঠো রাস্তাগুলো চলে গেছে , সেগুলো ঘন অন্ধকারে ঢেকে যায় । মাঝে মাঝে দু একটা আলো থাকলেও, সব রাস্তাই চাপ চাপ অন্ধকারের মধ্যে ডুবে থাকে । তখন রাস্তা ঠিক করা খুবই মুশকিল । চেনা রাস্তাই তখন ঠিকঠাক চিনে যাওয়া যায় না । আর এ তো অচেনা রাস্তা । পাঁচজনকে জিজ্ঞাসা করে আসার সময় এসে পড়েছিলাম । তারপর অতীতের স্মৃতিচারণ করতে করতে কখন নিজের মধ্যে হারিয়ে গেছি । খেয়াল ছিল না । প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে । আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সূর্যের আলোর শেষ বিকিরণটুকুও মুছে যাবে। কি হবে? ফিরতে পারব তো ? তাড়াতাড়ি করে গিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং এ বসলাম । আসার সময় যে রাস্তায় এসেছি , সেই অনুযায়ী ধারণা করে করে গাড়ি চালাতে লাগলাম । এসব অঞ্চল অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মোটামুটি জনমানব শূন্য হয়ে যায়। মধ্যে কয়েকবার ভুল বাঁক ধরে গাড়ি চালিয়ে ফেললাম । ভাগ্যে দু-একজন মানুষজনকে পেলাম রাস্তায় । তাই কোনোরকমে জিজ্ঞাসা করতে করতে শেষে চেনা রাস্তায় এসে পড়লাম । এবার আর আমার কোন অসুবিধা হবেনা । এখান থেকে আমি ফিরে যেতে পারবো বাংলোয় ।

তখনো প্রায় মিনিট কুড়ির রাস্তা বাকি । যেখান দিয়ে যাচ্ছি, সেখানে কোথাও কোনো আলো নেই। গাড়ির হেডলাইটই ভরসা । দু’পাশে চা বাগান গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে রয়েছে । কেমন যেন রোমাঞ্চকর অনুভূতি! গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ করে মনে হলো – সেই তো ! এক মাস হয়ে গেল এখানে রয়েছি। একদিনও সন্ধ্যার পর চা বাগানের মেঠো রাস্তার মধ্যে দিয়ে তো হাঁটতে বেরোনো হয়নি । বেরোতে হবে একদিন । ব্যাপারটা খুবই রোমাঞ্চকর হবে যে, তাতে সন্দেহ নেই । হঠাৎ করে যদি কোন হিংস্র জন্তু সামনে এসে পড়ে, কিংবা তার থেকেও আরও এক কাঠি ওপরে গিয়ে ভাবতে লাগলাম, যদি অশরীরী জাতীয় কিছু থেকে থাকে এখানে, হঠাৎ করে উদয় হয় এখন আমার সামনে ? কেমন হবে ? কল্পনাপ্রবণ মানুষদের এই এক অসুবিধা। সবসময় সমস্ত পরিস্থিতিতেই তারা আকাশকুসুম কল্পনা করতে থাকে । বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে গুলিয়ে ফেলে অনেক সময় ।

এই সমস্ত ভাবতে ভাবতে গাড়ি চালাচ্ছি, হঠাৎ করে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। কিছুটা দূরে একটা অবয়ব ফুটে উঠল । গাড়ির আলোয় দেখতে পেলাম একটা বাচ্চা মেয়ে হবে । কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আমার গাড়ির উদ্দেশ্যে দুটো হাত নাড়ছে । হঠাৎ করে যেন রাস্তার মাঝ-মধ্যিখানে ভুঁই ফুঁড়ে উঠলো মেয়েটা । বেশ চমকে উঠলাম । ওরকম একটা অলৌকিক পরিবেশ, তার মধ্যে যে অলৌকিক চিন্তাভাবনা মাথায় আসছিল না একেবারে, তা নয় । তার মধ্যে ওইভাবে মেয়েটা হঠাৎ করে গাড়ির সামনে চলে আসায় চমকে ওঠার যথেষ্ট কারণ ছিল। আমি ব্রেক কষলাম । মেয়েটার থেকে কিছুটা দূরত্বেই গাড়িটা ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড গাড়ির আলোয় মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করলাম। বাচ্চা মেয়ে । দশ-বারো বছর বয়স হবে। হাঁটুর ওপর পর্যন্ত একটা হালকা রংয়ের ফ্রক পরেছে । এখানে সেখানে ধুলোর ছাপ । দেখলাম , মেয়েটা এগিয়ে আসছে আমার গাড়ির দিকে। লক্ষ্য করলাম, মেয়েটা ভালো করে হাঁটতে পারছে না । মনে হল যেন সে একটু খোঁড়াচ্ছে । মেয়েটা আমার গাড়ির উইন্ডোর পাশে এসে দাঁড়ালো। উস্কোখুস্কো চুল , খড়ের মতো । বিশেষ চিরুনি পড়ে বলে মনে হলো না । কপালের অর্ধেকটা আর বাঁপাশের চোখটা চুলে ঢাকা রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, কেমন যেন একটা গা ছমছমে অনুভূতি হল । এইরকম জনমানব শূন্য অন্ধকার চা বাগান ! তার মধ্যে হঠাৎ করে এই মেয়েটা কোত্থেকে আমার গাড়ির ঠিক সামনে এসে পড়ল কে জানে !
মেয়েটা হাতে করে চুলগুলোকে কানের পাশে সরিয়ে নিয়ে রিনরিনে গলায় বললো , আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে ?
চুপ করে থেকে মেয়েটার মুখের দিকে দেখলাম কিছুক্ষণ । মুখের মধ্যে কেমন যেন ভয়ের ছাপ । তবে মুখটা ভারী মিষ্টি । চোখ দুটো বড় বড় , উজ্জ্বল।
বললাম , তোমার বাড়ি কোথায়?
— আমাকে গাড়িতে তুলে নাও । আমি আমার বাড়ি দেখিয়ে দেবো ।
অল্পক্ষণ ভাবলাম । মেয়েটাকে কি গাড়িতে তুলে নেওয়া উচিত হবে ? কি জানি বাবা ! আজকাল আবার নানারকম ঝামেলা ঝঞ্ঝাট হচ্ছে তো। তারপরেই মনে হল, বাচ্চা একটা মেয়ে , এখানে এই অন্ধকারে চা-বাগানে একা দাঁড়িয়ে থাকবে , অথচ আমার গাড়িতে লিফট চাওয়া সত্ত্বেও আমি মেয়েটাকে এখানে ফেলে রেখে দিয়ে চলে যাব, সেটা তো আর কোনোমতেই সম্ভব নয়।
তাই জিজ্ঞাসা করলাম , কতদূরে তোমার বাড়ি এখান থেকে?
সামনে দিকে হাত তুলে দেখালো সে ।
— এই সামনে গিয়ে ডানদিকে -, তারপর চল না -, আমি তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি ।
গাড়ির ভেতরের লাইটটা অন করে, বাঁ হাত বাড়িয়ে ওপাশের দরজাটা খুলে দিলাম।
বললাম, এসো –
মেয়েটা গাড়িতে উঠে বসলো। লক্ষ্য করলাম , সে বাঁ পা’টা ফেলছে না । সিটের ওপর বসে সে ডান হাতে ধরে রাখা একটা হাওয়াই চটি তার সিটের নিচে ফেলল। দেখলাম , সে ডান পায়ে চটি পরে থাকলেও, বাঁ পা’টা খালি ।
জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কি বাঁ পায়ে কিছু হয়েছে ?
আমার দিকে উজ্জল দুটো চোখ তুলে বললো , কাঁটা ফুটে গেছে একটা ।
— কই দেখি তোল একবার তোমার পা’টা।
সে বাঁ পায়ের চেটোটা ডান হাতে করে তুলে ধরে আমায় দেখাল। দেখলাম বেশ বড়সড় একটা কাঁটা ফুটেছিল । সেটাকে সে যদিও বার করে ফেলে দিয়েছে। তবে রক্ত জমে রয়েছে সেখানটায় । দেখে বোঝা যাচ্ছে কাঁটাটা কিছুটা গভীর পর্যন্ত ঢুকেছিল । আমি দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলাম ।
বললাম , এখানে এত সন্ধ্যাবেলা তুমি একা একা কি করছিলে ?
— আমি এখানে খেলা করি । আজকে খেলতে খেলতে পায়ে কাঁটা ফুটে গেল । বাড়ি ফিরে যেতে পারিনি ।
— তুমি এখানে খেলা করো ? কাদের সঙ্গে খেলো ?
— আমার তো কোনো বন্ধু এখানে থাকেনা । আমি একাই খেলি।
— তুমি একা একা খেলা করো?
— হুম ।
— তোমার পায়ে তো রক্ত বেরিয়েছে । বাড়িতে গিয়ে বোলো, বাবা-মা যেন ডাক্তার দেখান তোমায়।
— আমার বাবাই আমায় ওষুধ দিয়ে দেবে।
— তাই নাকি ? কি করেন তোমার বাবা ?
— আমার বাবা তো ডাক্তার ।
এখানে ডাক্তার থাকতে পারে ? থাকতে পারে কেন, নিশ্চয়ই থাকবে । প্রতিটা ব্লকেই তো ডাক্তার থাকেন। তবে এই মেয়েটির বাবা কিরকম ডাক্তার, কে জানে । মেয়েটি যেমন যেমন বলছিল , তেমন ভাবেই গাড়ি চালাচ্ছিলাম । অবশ্য রাস্তা আমার বাংলোয় ফেরার দিকেই । কাজেই আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না ।
কিছুক্ষণ পর একটা রঙ-চটা শ্যাওলাধরা বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে গাড়ি পৌঁছতে মেয়েটি বলল , এখানে দাঁড়াও । এটাই আমার বাড়ি ।
আমি গাড়ির ব্রেক কষে বাড়িটার দিকে তাকালাম । একতলা শ্যাওলা ধরা একটা সরকারি কোয়ার্টার মনে হল । ঠিক মনে হল কিনা অবশ্য জানিনা । গেটের কাছে ছোট একটা চৌকো টিনের পাতের ওপর নাম খোদাই করা আছে- ডক্টর ইন্দ্রাশিষ গাঙ্গুলী , এমবিবিএস ।

আমি হাত বাড়িয়ে গাড়ির দরজাটা খুলে দিলাম । মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমে পড়ল । সিটের নিচ থেকে হাওয়াই চটিটা হাতে তুলে নিল ।
জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কি ?
বড় বড় উজ্জ্বল দুচোখ মেলে তাকালো আমার দিকে মেয়েটি । বলল , উপমা ।
নামটা শুনে বেশ আনকমন লাগলো । এমন নাম এ অঞ্চলে শুনতে পাবো আশা করিনি । ঠিকঠাক শুনলাম কিনা যাচাই করার জন্য ঘুরিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম, কি নাম তোমার ?
— উপমা গাঙ্গুলী ।
বলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো সে। ঢোকার আগে একবার পিছন ফিরে আমাকে হাত নেড়ে টা-টা করল । আমিও হাত নাড়লাম । একবার ভাবলাম তার বাড়িতে গিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে ঘটনাটা বলে আসবো কিনা। তারপর ভাবলাম , থাক আজকে বড় দেরি হয়ে গেছে । না হয় পরের দিন এসে একবার দেখা করে বলে যাব । বাংলো থেকে তো গাড়িতে বেশিক্ষণ টাইম লাগবে না । মিনিট পনেরো বড়জোর । ভেবে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিলাম । বাকি রাস্তাটা বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই গেলাম । অদ্ভুত লেগেছে আমার কয়েকটা ব্যাপার । মেয়েটার বাবা ডাক্তার । কোনো হাতুড়ে জাতীয় ডাক্তার নয় । এমবিবিএস ডাক্তার । অথচ মেয়েটাকে দেখলে মনে হয় যেন সে তার বাড়িতে এতোটুকুও কেয়ার পায় না । সাজ-পোশাক , চেহারার মধ্যে কেমন একটা অযত্নের ছাপ । তারপরে, এইরকম সন্ধ্যাবেলায় অন্ধকার চা বাগানের মধ্যে মেয়েটা একা একা বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে কি করছিল ? পায়ে কাঁটা ফুটেছে , বাড়ীতে ফিরে আসতে পারেনি, কেউ তার খোঁজ করতে যায়নি কেন ? সমস্তটাই বেশ অদ্ভুত ধরনের গোলমেলে ব্যাপার । ভাবতে ভাবতেই বাংলোয় ফিরে এলাম ।

টগর দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করল , মেম আজ ফিরতে দেরি হল?
আমি বললাম , ওই একটু দূরে গেছিলাম , তাই ফিরতে একটু দেরী হয়ে গেল। তুমি চা বানাও । মাথাটা ধরেছে। একটু বেশি করে দুধ দিয়েই বানিও । র’চা এখন খাব না। আদা দিয়ে দুধ চা করো । আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি ।

বলে আলনা থেকে নাইটি আর টাওয়েলটা নিয়ে বাথরুমের দিকে হাঁটা দিলাম । বাথরুমে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে বেশ অনেকক্ষণ ধরে মাথা-গা ভিজিয়ে স্নান করলাম । সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে ফিরে এসে প্রতিদিনই গা ধুই। তবে মাথা ভেজাই না । আজকে একটা ঘটনাবহুল দিন । এত বছর পর অতীতের মুখোমুখি দাঁড়ানো খুব চাট্টিখানি কথা ছিল না । তারপরে ফিরে আসার সময় যে ঘটনাটা ঘটলো, সেটাও আমাকে যথেষ্ট ভাবাচ্ছে । প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট পর বেরোলাম বাথরুম থেকে । ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলাম। টগর খুব যত্ন করে পুরু দুধের চা বানিয়েছে । একটা কফিমগে প্রায় ভর্তি করে দিয়েছে চা। সাথে ভেজ পকোড়া । টগরের রান্নার হাত অসাধারণ । টুকটাক যাইবা বানাক, বড় যত্ন করে বানায় । গরম চায়ে চুমুক দিতে মাথাটা বেশ ফ্রেশ লাগলো ।

টগর চা খাচ্ছিলো আমার সামনে বসে । আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে বলল, নেম আজকে বাংলা চিনেলে ভাল বই দিইচে ।
অল্প হেসে বললাম, কটা থেকে?
— নয়’টা ।
পাশে মুড়ে রাখা খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে বললাম, দেখবে, তাইতো ? ঠিক আছে। রান্না বান্না সেরে রেখো । কোন চ্যানেলে বোলো, চালিয়ে দেব।
টগর খুব খুশি হয়ে বলল, রান্ধা তো আমার হই যাবে । বেশি টাইম নাগবে না । কাটন বাটন সঅব করি রেকেচি কিনা?
— ঠিক আছে । নটার আগে আমাকে একবার নক করো । না হলে ভুলে যেতে পারি ।
— ঠিক আছে মেম ।
তার দুচোখে আনন্দ উপচে পড়ছে । আমি অবাক হয়ে ভাবি, এদের কত অল্পেই আনন্দ হয় ।
বলল , পোসেনজিতের বই আমার খুব ভালো নাগে।

আমি কিছুক্ষণ কাগজটার এদিকে সেদিকে চোখ বুলিয়ে, তারপর , কাগজের ওপরেই চোখ রেখে টগরকে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা ! এখানে এই কিছুদূর এগিয়ে একজন ডাক্তার থাকেন বুঝি ? জানতাম না তো ।
টগর চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাল। বলল , ডাক্তার ! একেনে ডাক্তার –
তারপরেই খিলখিল করে হেসে প্রায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর কি!
বললো, আচ্ছা মেম, আপনি কি ইন্দোর ডাক্তারের কতা কইচেন ?
— ইন্দোর ডাক্তার !
— হ্যাঁ, ডাক্তারবাবুর একটা ছুঁড়ি , মে’ আছে কিনা?
— হ্যাঁ একটা বাচ্চা মেয়ে আছে ।
— হ্যাঁ হ্যাঁ মেম ওই ডাক্তারের কতাই বলচেন । আর তো কোন ডাক্তার একেনে থাকে না কিনা ?
— ও আচ্ছা ! ইন্দোর মানে বলছ ইন্দ্র ডাক্তার ? তাইতো ?
— হ্যাঁ , সেই-
— ডাক্তারবাবুর নামটা ইন্দ্রাশিষ গাঙ্গুলী বটে । তোমরা বুঝি ইন্দ্র ডাক্তার বল ?
আবার এক প্রস্থ হেসে কুটোপাটি টগর । বলল , ওই ডাক্তার তো পাগলা ডাক্তার।
— পাগলা ডাক্তার ?
— হ্যাঁ একেনে তো সক্কলে জানে কিনা। ওই ডাক্তার এক্কেরে পাগলা ডাক্তার ।
— পাগলা ডাক্তার মানে ? পাগল হলে ডাক্তারি করবেন কী করে? নাকি পাগলের ডাক্তার বলছো ?
হাসতে হাসতে বিকৃত গলায় টগর বললো , ও ডাক্তার এত রুগী দেকে যে.. এত্ত রুগী দেখে .. যে নিজেই পাগল হই গেইচে । আপনি দেকেননি কিনা । দেকলেই বুইতে পারতেন। এক্কেরে পাগলা ডাক্তার।
আমি চুপ করে রইলাম। এখন টগরকে কোনো প্রশ্ন করার মানে হয়না । ও হাসতে এত ব্যস্ত যে ওর কথা আমি ভালো করে বুঝতেই পারছি না । অপেক্ষা করে থাকলাম কখন ওর হাসি থামে । তারপরে না হয় প্রশ্ন করা যাবে । আমার মনেও বেশ কিছু প্রশ্ন জমা হয়েছে বটে । বাচ্চা মেয়েটার ব্যাপার-স্যাপার আমার খুব একটা স্বাভাবিক লাগেনি। অবশ্য টগরের হাসি থামার পর আমাকে কোনো প্রশ্ন করতেই হলো না । সে নিজেই গড়গড় করে বলতে আরম্ভ করলো-

— পাগলা না হলে কোন ডাক্তারে ওই অত্ত কাঁড়ি কাঁড়ি রুগী দেকে মেম ? ও ডাক্তার তো রুগী দেকতে এমন মত্ত থাকতো কিনা, যে ওই অত্ত সুন্দরী বউটা পয্যন্তি একটা বকাটে ছুড়াকে বাগিয়ে নি কাট্টি দিলা –
— কি ! ডাক্তারবাবুর স্ত্রী ওনাকে ছেড়ে চলে গেছেন?
— তবে আর কইচি কি মেম ? সে এক্কেরে ঢিঢি চাদ্দিকে । ডাক্তারবাবুকে তো একেনে সবাই চিনে কিনা ? শোদ্দা ভক্তিও করে । পাগলা ডাক্তার নিজের ভটভটিটা চালায়ে হুই শউরে যাবে । ঘর ভাড়া নিয়া আছে সেকেনে । পোচুর রুগী আসে হোতা । সব গরিবের গরিব , হদ্দ গরিবের দল । পালে পালে আসে গো । ডাক্তারবাবু হাসপাতলে কাজ করি বেইরে আসেই চিম্বারে বসে কত্ত রাত অব্দি রুগী দেকবা ।
হাতের পাঁচটা আঙ্গুল মেলে ধরে সে দেখালো, এই পাঁচ টেকা করি নিবে –
আবার হাসতে আরম্ভ করল টগর । কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে ঢোঁক গিলে বলল,
— ভাবেন মেম ! পাঁচ টেকা করি নিবে । তা, গ্যাদ্দা রুগী আইবেনা? কেশো, জ্বোরো, খোস-পাকলা ভত্তি সব রুগি দলে দলে আইবে । তাদের মদ্যি, যাদের ওষুধ দিই দিতে পারলে ভালো , না পারলে নিজের গেঁট থিকে বার করি টেকা দিবে ওষুধ-পথ্যি কেনার জন্যি। নিজে ওই একখানা ভাঙ্গা ফুটো ঘরে রইবে । আর রুগীর পিছে স’অব টেকা ঢালবে । মে’টা আচে । দেকার মোট্টে কেউ নেই । ইদিক-সিদিক খেলে বেড়ায় । মে’টাকে দেকেই কষ্ট হয় কিনা ? কেউ দেকার নেই যে । বুড়ি মা থাকে । বাতে নড়তে চড়তে পারে নেকো। তার কাছে ওই মে’কে রেকে, নিজে সারাটা দিন রুগি দেকে বেড়ায় । ফিরে আইবে সেই কোন রাত নয়টা, দশটা, এগারোটা, কোত্তাও কোনো ঠিক নেই । কোনো দিকে কোনো খোঁজ-খিয়াল নেই গো । কেবল রুগী দেকতে ব্যস্ত । মে’টা এদিক-সিদিক করে বেড়ায় , তা বেড়াবা না? বাড়ন্তের সময় যে, ঘরে কি তার অমনি মন টেঁকে নাকি ? দেকে কি মায়াটাই নাগে। দেকে বোঝাই যায় কেউ যন্ন-আত্যি করে নেকো । নোকে কয়, ডাক্তার নাকি গরিব মানষের ভগবান । কতাটা ভুল নয় অবশ্যি। কিন্তু , এমন করে বেড়ালে , বউটা তো পাইলিচে, মে’টার কি হইবে বলুন মেম ? তুমি রুগী দেকবে দ্যাকো। নিজের ঘরটাও তো দেকতে হইবে কিনা?

এই হচ্ছে এক ব্যাপার । এক ভীষণ ব্যাপার ! অর্থাৎ, ধরে নিয়ে আসতে বললে , বেঁধে নিয়ে আসা । ঘরের কথা জিজ্ঞাসা করলে, একেবারে ঘরের মধ্যে ঢুকে রান্নাঘরে ভাতের হাঁড়িতে চাল টিপে বলে দেওয়া চাল কতটা সেদ্ধ হয়েছে। উফ্, বাপরে বাপ ! কি প্রশ্ন করেছিলাম আমি ? – এখানে কোনো ডাক্তার থাকেন ? টগর যদি ডাক্তারবাবুর আগের জন্মের ইতিহাস জানতো, আমি নিশ্চিত সেটাও বলে দিত । যাইহোক, চুপচাপ শুনলাম । বুঝলাম মেয়েটার এইরকম ছন্নছাড়া ভাবে ঘুরে বেড়ানোর কারণ। টগর তার সম্পূর্ণ বক্তৃতার মধ্যে সুখ্যাতি-কুখ্যাতি যাই করুক , এটা স্পষ্ট যে ওই বাচ্চা মেয়েটার জন্য তার কোথাও একটা মায়া হয় । সেটা অমূলক নয় । ওই মেয়েটাকে আজকে ঐটুকু সময়ের জন্য মাত্র একবার দেখার পরে , এই কথাগুলো শুনে আমারও বড় মায়া হচ্ছে ।

ক্রমশ..