হলদে প্রজাপতি পর্ব-৮+৯

0
236

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

আট

(পূর্বকথা : তরুশী একটি ছোট টি এস্টেট এর ম্যানেজার হয়ে নর্থ বেঙ্গল এ আসে । সে অবিবাহিতা । অবিবাহিত একজন মহিলার চা বাগানের ম্যানেজার হয়ে আসা নিয়ে সেখানে অনেকেরই অনেক প্রশ্ন রয়েছে । বিশেষ করে ওই রকম ফাঁকা জায়গায় একটা বাংলায় একজন মহিলা হয়ে সে কি করে একা থাকবে? এস্টেটের লেবার’রাও মহিলা একজন ম্যানেজারকে পেয়ে খুশি নয় । তরুশীর চা-বাগানে প্রায় দেড় যুগ আগের অনেক স্মৃতি রয়েছে । সে এস্টেটের কাজকর্ম সামলানোর পাশাপাশি সেই সমস্ত স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে। )

কখনো সোজা , কখনো ডানদিক , কখনো বাঁদিক করতে করতে দু’ চারজনকে জিজ্ঞাসা করে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই হাজির হলাম ‘রায়ভিলা’য় ।
গাড়ি থেকে নেমে কিসুক্ষণ শ্বাস রুদ্ধ করে চেয়ে রইলাম । তারপরে বুঝতে পারলাম, আমার কেমন যেন শীত করছে । হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ভয়ে, নাকি উত্তেজনায় , না কিসের জন্য কে জানে ? কাছেই একটা গাছের গুঁড়ির ওপর গিয়ে বসে পড়লাম । দুটো চোখে হাত দিয়ে চেপে ধরে রইলাম কিছুক্ষণ । বুঝতে পারলাম , ভেতরের উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে । কিছুক্ষণ পর প্রাথমিক উত্তেজনা কাটিয়ে উঠে আমি চোখ মেলে চাইলাম । কেমন যেন ঝাপসা লাগছে। তা কি আমার হাতে করে চোখ দুটো চেপে ধরে রাখার জন্য ? নাকি, স্মৃতির কুয়াশা? বুঝতে পারলাম না। যাই বা হোক না কেন, কয়েক মিনিটের মধ্যে সেটা কেটে গেল। আমার চোখের সামনে ‘রায়ভিলা’। তার পূর্ব কোণে কিছুটা দূরে ঐতো ম্যানেজারের বাংলো! যেখানে জীবনের অমূল্য দুটো বছর সর্বক্ষণ মন পড়ে থাকতো। থাকবে না? মন দিয়েছিলাম যে।

বিরাট দোতলা ‘রায়ভিলা’টা এখনো সেই রকমই দাঁড়িয়ে । শুধু সেই জৌলুস আর নেই। রং পুরনো হয়েছে , খসে গেছে। কিছু জায়গায় শ্যাওলা ধরেছে। ছোপ ছোপ বাড়িটা জুড়ে । মেইনটেনেন্স এর অভাব বোঝা যায় । সামনের লনে বড় বড় ঘাস, আগাছা , জঙ্গল। হাঁস চরার সিমেন্ট বাঁধানো পুকুরটা এখনো রয়েছে । জলও রয়েছে তাতে । তবে শ্যাওলাধরা। ঐতো কিছুটা দূরে উত্তরের দিকে চোখ রাখলে দেখা যাচ্ছে ওই শিরিষ গাছটা । ওই তো , ওই শিরিষ গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে নিজেকে এদিক থেকে সম্পূর্ণ আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে তরুশী। সে আজকের ‘তরু’ নয় । সে অষ্টাদশি তরুণী । ওই তো , ওই যে দূরের ওই চা বাগানের ফাঁকে ফাঁকে সরু মতো মেঠো রাস্তাটা চলে গেছে, সেখান দিয়ে একটা মেয়ে ছুটে যাচ্ছে । বাসন্তী আঁচল উড়ছে তার বাতাসে । মাটীতে তার পা পড়ছে না। সে যেন শ্রীরাধা । শ্রীকৃষ্ণ সঙ্গম অভিলাষে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে ছুটে চলেছে । এখন সে ওই ম্যানেজারের বাংলোয়, গায়ে বুটি বুটি দেওয়া আঁচল খসে পড়েছে তার, উন্মুক্ত দুটো স্তন বড় আবেগভরে ধরে রেখেছে দুটো পুরুষালী হাত। মুখ নেমে আসছে স্তনবৃন্তে !

নাহ্, কেমন যেন অসাড় হয়ে আসছে দেহ। আমি দু’ হাতে আবার চোখ ঢেকে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ কাটলো ওইভাবে। কত কিছু মনে পড়ছে । কুয়াশার আঁচল সরিয়ে স্মৃতি সব আজও তেমনই স্পষ্ট । ফিরে তাকালে মনে হয় যেন আজ থেকে এতগুলো বছর আগেকার নয়, এইতো , সবেমাত্র ঘটে যাওয়া । যেন অতীতেও ঘটেছে, বর্তমানে আজও ঘটে চলেছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে-! অনন্তকাল ধরে আমি সেই অষ্টাদশী তরুণী ।

বিক্ষিপ্তভাবে এই সমস্ত স্মৃতি রোমন্থন ভালো লাগছেনা। বড় ইচ্ছা করছে সেই প্রথম দিন থেকে যেভাবে ধীরে ধীরে আমি ভালোবেসেছিলাম, সমস্ত ঘটনাগুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে ঠিক সেইভাবেই আমার কল্পনার উঠোনে আবার ঘটে চলুক । ঠিক যেভাবে ঘটেছিল, আজও ঠিক সেভাবেই ঘটুক । আমি সব দেখি । উপলব্ধি করি । ভালোবাসি । আজ আবারো । আরেকবার । সেই প্রথম থেকে ।

একেবারে প্রথম দিন , যেদিন সে এসেছিল এ বাড়িতে। সেদিন এ বাড়িতে বেশ একটা সাজো সাজো রব । যেন বিশেষ কোনো একজন অতিথি আসছেন। যত দুর আমি শুনেছিলাম, বান্টির দাদা জয়ন্ত দা’র কলেজের একজন সিনিয়র দাদা আসছেন । নাম শৌণক দত্ত । সে চাকরি পেয়ে গেছে। কিন্তু দু’বছরের সার্ভিস লিভ নিয়ে নিজের রিসার্চের কাজ কমপ্লিট করবে বলে সেখানে আসছে। তার কাজ চা বাগানের বায়ো ডাইভারসিটির ওপরে । তাই সে সেখান থেকে নিজের রিসার্চের কাজ করবে । তাদের বাড়িতে নাকি জয়ন্তদা কলকাতা কলেজে পড়ার সময় তিন বছর ছিল। তার বাবা অজিত কাকুর প্রথম দিকের বিজনেস পার্টনারও ছিলেন । আবার বন্ধুও বটে। তার ওপর নিজেদের ছেলে তিন বছর যাদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছে, তাদের বাড়ির ছেলের কদর তো আলাদা হবেই। একটা কথা মনে হয়েছিল তখন। আমি আসার আগে কি এই সমস্ত তোড়জোড়ের বিন্দুবিসর্গও হয়েছিল? কিছুই হয়নি সেটা আমি না দেখেও বুঝতে পেরেছিলাম । কেমন একটা তীক্ষ্ণ ঈর্ষার ভাব কাজ করেছিল প্রথম থেকেই। সেই মানুষটাকে দেখার আগেই ।

ম্যানেজারের বাংলোটা ছিল কিছুটা দূরে। বাড়ির পূর্ব দিকে । একতলা বাংলো । খুব সুন্দর করে সাজানো , ছিমছাম। ভেতরে পাঁচ-ছ’টা ঘর , বারান্দা । পিছনের দিকে বেশ বড় একটা উঠোন মত, বাগান , সবই ছিল। তখনকার যিনি ম্যানেজার ছিলেন, তিনি একজন বয়স্ক মানুষ। তাঁর বাংলোয় তিনি কমই থাকতেন । বিভিন্ন কাজে শিলিগুড়ি যাতায়াত করতে হতো তাঁকে। সপ্তাহের মধ্যে বড়জোর এক কি দু’দিন তিনি তাঁর বাংলোয় থাকতেন। বাকি সময় বাংলো চাবি দেওয়া পড়ে থাকতো । সেই কারণে সেই বাংলোতেই তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

তখন বিকেল বেলা । ভামিনী কাকিমার তরফ থেকে ডাক পড়লো। বিশেষ প্রয়োজনে এরকম মাঝে মাঝে ডাক পড়তো। গিয়ে হাজির হলাম নিচের তলার ড্রইংরুমে । সেখানে গিয়ে দেখি , সেখানে অলরেডি অজিত কাকু , কাকিমা, বান্টি বসে আছে । আর একজন নতুন মানুষ বসে রয়েছে। তাকে কি হ্যান্ডসাম ইয়াং ম্যান বলা চলে ? নিশ্চয়ই চলে। তবে আমি তখনো কলেজের সেই সমস্ত কালচারে অভ্যস্ত হইনি – ‘ওয়াও! ‘ , ‘কি হ্যান্ডসাম দ্যাখ্’, ‘হ্যান্ডসাম গাই’ … অভ্যস্ত হলে বোধহয় মনে মনে একবার বলেও ফেলতাম সে কথা । লম্বা, ফর্সা, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মুখে একটা ছেলেমানুষীর মত হাসি লেগে রয়েছে। ব্র্যান্ডেড শার্ট জিন্স । তবে ব্র্যান্ডের ব্যাপারটা তখনও আমি বুঝতে শিখিনি । হালকা আকাশী শার্ট আর চকলেট কালারের জিন্সের কম্বিনেশনটা বেশ ভালো লেগেছিল । একটা ম্যানলি পারফিউমের গন্ধ আসছে । চুল ব্যাক ব্রাশ করা। মুখটা একটু লম্বাটে, দৈহিক উচ্চতার সঙ্গে মানানসই । চোখ দুটো যেন কথা বলে । এই ফিচারটা পুরুষদের মধ্যে একটু বিরল। তখন আমি প্রথম যৌবনের সাহিত্যানুরাগী একজন তরুণী । কালজয়ী সাহিত্যের মধ্যে জীবনের প্রেম খুঁজে পাই । ছেলেটাকে দেখেই হঠাৎ করে মনে হল , একে কি ‘নরেনে’র মত দেখতে ? কিংবা ‘নরেন’ চরিত্রটা কী এইরকমই ? ‘নরেন’ তখন আমার কাছে এক নস্টালজিয়ার নাম । ‘দত্তা’র নরেন । বিজয়ার ভালোবাসা । সেই একখানা গৌরবর্ণ ছিপছিপে লম্বা শরীর .. তাই কি? নাহ্, এর চেহারায় , হাবেভাবে বেশ অ্যাটিটিউড রয়েছে । ঐরকম খ্যাপাটে ভাবটা নেই । তাই নরেনের ইমেজের সঙ্গে সুপার ইম্পোজ করা গেল না । তবে আমার জীবনের প্রথম প্রেম যদি কোন কাল্পনিক চরিত্রের ওপর থেকে থাকে, তা ছিল নরেন । সেই হিসেবে নরেনের সঙ্গে প্রচুর গরমিল থাকা সত্বেও আমি বুঝতে পারলাম , আমার একটা হালকা শিরশিরে অনুভুতি হচ্ছে । পশ্চিমের জানলা দিয়ে ত্যাড়ছা নরম রোদ পড়েছে সেই আগন্তুকের ক্লিন শেভড গালের ওপর । সেদিন চৈত্রমাস না হলেও, নবীন আগন্তুকের চোখে আমার সর্বনাশ দেখতে না পেলেও , সেই দিনই ছিল আমার সর্বনাশের সূত্রপাত !

কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থেকে আমি সেদিন চোখ নামিয়ে নিয়েছিলাম ।
ভামিনী কাকিমা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন , এ হচ্ছে আমার ছেলে জয়ন্তর কলেজের সিনিয়ার । খুবই ভালো পড়াশোনায় । স্টুডিয়াস, ব্রিলিয়ান্ট ইয়ং ফেলো। নাম শৌনক দত্ত। আপাতত একটা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে জয়েন করলেও , ওর অনেক হাই আ্যম্বিশন রয়েছে । তাই এখন নিজের রিসার্চের কাজ কমপ্লিট করতে স্কুল থেকে সার্ভিস লিভ নিয়ে এসেছে এখানে । থিসিস সাবমিট করে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে অন্য কোনোরকম ভাবনা চিন্তা করবে। খুব ভালো ছেলে । আমার জয়ন্ত তো শৌণক দা বলতে অস্থির ।
আমি একবার কষ্ট করে লাজুক চোখ দুটো তুলে তাকিয়ে অল্প হাসলাম । তখন ছেলেদের দিকে তাকালেই কেমন একটা অস্বস্তি হত । শরীরের ভেতর কেমন একটা অস্থির প্রতিক্রিয়া হত । একে তো প্রথম যৌবন, তার ওপরে বরাবর গার্লস স্কুলে পড়েছি। ছেলেবন্ধু, বা ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশার হ্যাবিট একেবারেই ছিল না ।
নবীন আগন্তুক কিন্তু যথেষ্ট সপ্রতিভ । সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল , আই থিঙ্ক আন্টি, সি ইজ তরুশী, রাইট ?
আমার নামটা কেটে কেটে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলো ।
কাকিমা বললেন, হ্যাঁ ।
আগন্তুক হেসে বলল, আন্টি তো শুধু লম্বা-চওড়া করে আমার ইন্ট্রোডাকশন দিয়ে যাচ্ছেন । ওর সাথে আমায় ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিন ।
কাকিমা একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করলেন। যদিও মুখে বললেন না কিছু , তবে ভাবটা এমন, ওর সঙ্গে আবার ইন্ট্রোডিউস করার কি রয়েছে? তবে আমতা আমতা করে বলতে আরম্ভ করলেন, বললাম তো , তোমাকে একটি মেয়ে –
বান্টি তার মা’কে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে নদীর স্রোতের মতো বলতে আরম্ভ করল, ও আমার দিদি । আমার তরু দিদি । কলেজে পড়ে। এই বছরই এইচ এস দিয়ে এখানে এসে কলেজে ভর্তি হয়েছে । খুব ভালো পড়াশুনায় । আমি যখন স্কুলে যাই, আমার সঙ্গে দিদি কলেজে যায় । আবার আমরা দুজনে একসঙ্গে ফিরে আসি । আমাদের স্কুল আর কলেজ খুব কাছাকাছি । তরু দিদি খুব ভালো । আমার সঙ্গে কত গল্প করে ।
আগন্তুক হেসে বলল , বাবাঃ, আমাদের শ্রীতমা তো দেখছি তার তরু দিদির বিশাল বড় ফ্যান ।
— বা রে, ফ্যান হবো না কেন? তরু দিদি তো ফ্যান হওয়ার মতই।
যাইহোক একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলাম । যেভাবে আমার অস্তিত্বটাকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন কাকিমা, বান্টি ঠিক সেটা সফল হতে দিল না । আমারও যে কোথাও একটা অস্তিত্ব রয়েছে, সেটা সে প্রমাণ করেই ছাড়লো ।
আগন্তুক আমার দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে বলল, কি হলো? দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বোসো।
জড়োসড়ো হয়ে বাকিদের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে একটা কৌচে বসলাম।
অজিত কাকু আগন্তুককে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার ক’বছর জয়নিং হল চাকরিতে, শৌণক ?
— আমি এই দু’বছর জয়েন করেছি ।
কাকু বললেন, ভালো! ভালো ! এখানে থাকো । ভালো করে রিসার্চ কমপ্লিট করো । তোমাদের সব অনেক আ্যম্বিশন রয়েছে নিজেদের লাইফ নিয়ে। সে সমস্ত ফুলফিল হোক ইন ফিউচার । অনেক আশীর্বাদ করি । তোমাদের মত ব্রাইট সমস্ত ছেলেমেয়েদের দেখলে আমার খুব আনন্দ হয় । পড়াশুনো আমি খুব ভালোবাসি ।
— সিওর আঙ্কেল ।
কাকু বললেন , অল্প কিছু খেয়ে নাও, বুঝলে ? তারপর পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আগে চারপাশটা এক চক্কর মেরে এস । ভালো লাগবে বুঝলে তো ? তোমার তো রিসার্চ ফিল্ড এটাই ।
বলে অল্প হাসলেন।
ঘরের মধ্যে আমি বাদে বাকি চারজন প্রত্যেকেই আলোচনায় অংশগ্রহণ করলো । বেশ কিছুক্ষণ ধরে বিভিন্ন কথাবার্তা চলল । কিছুক্ষণ পরে আমি আবিষ্কার করলাম , সে ঘরে আমিই একমাত্র একজন, যে এসে থেকে একটা কথাও বলিনি। কোন রকমে নিজের অস্তিত্বটাকে সবার থেকে আড়াল করে গুটিসুটি মেরে বসে রয়েছি। দুটো হাতের তালু ঘেমে উঠেছে। সেই শিরশিরে অনুভূতিটাও বাড়ছে । নিজের অজান্তেই আমি মাঝে মাঝে চোরা চোখে তাকিয়ে নিচ্ছিলাম আগন্তুকের দিকে । তার মুখের দিকে তাকালেই কেমন একটা অচেনা অনুভূতি হচ্ছিল , যেটা আগে কখনো হয়নি । অবশ্য আগে কখনো আমাকে এভাবে কোন পুরুষের সঙ্গে পরিচিত হতেও হয়নি । কলেজে ছেলেরা রয়েছে বটে , তবে আমি তাদের দিকে ভাল করে চোখ তুলে তাকাইও না। তারাও যে খুব একটা যেচে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করায় আগ্রহী, তেমনটা নয় । কাজেই এই পরিস্থিতিটা আমার সম্পূর্ণ অজানা । কোনো সমবয়সী, বা , আমার থেকে কিছুটা বড় পুরুষের সঙ্গে কিভাবে পরিচিত হতে হয় , কীভাবে তার সাথে প্রথম কথাবার্তা শুরু করতে হয়, এসমস্ত সম্পর্কে আমার কোনো ধারনাই নেই । তার ওপরে তো ভামিনী কাকিমার চাপিয়ে দেওয়া অনুশাসন আছেই । কথা বলতে গিয়ে যদি মুখ ফসকে পুরুলিয়া ঘেঁষা কোন কথা বেরিয়ে যায়, তাহলেই কাকিমা আমাকে সকলের সামনেই অপমান করে বসবেন । সেটা একেবারেই কাঙ্ক্ষিত নয় । মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে বসে রইলাম । তাছাড়া বলার মতো কোন কথা খুঁজেও পাচ্ছিলাম না । আমার অস্তিত্বের তো সেখানে কোনো মূল্যই নেই । হচ্ছে কথা হোস্ট আর গেস্ট এর মধ্যে । আমি সেখানে কে ? সম্পূর্ণ থার্ড পারসন । অথচ বান্টি , সে আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট । সে কিন্তু কলকল করে কথা বলে যেতে লাগলো । একে তো সে কোএড স্কুলে পড়েছে প্রথম থেকে । তার ওপরে এখনো কিশোরী বয়স । যৌবনের প্রতিক্রিয়াগুলো তার মধ্যে এখনও আরম্ভ হয়নি । ওই চৌহদ্দিটার মধ্যে যত মানুষজন এসে উপস্থিত হয়, তার ততই ভালোলাগে ।
কিছুক্ষণ পর ট্রে-তে করে খাবার এলো।
অজিত কাকু বললেন, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও , শৌনক। তারপর বরঞ্চ একটু ঘুরে দেখো চারপাশটা।
দেখলাম , আগন্তুকের মধ্যে কোন জড়তা নেই । এতটা তুলে নিন, ওইটা পারবোনা..ও সমস্ত কিছু নেই । সে সিম্প্লি খাবারগুলো সমস্ত খেয়ে নিল ।
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন তাহলে আঙ্কেল, চারপাশটা একটু ঘুরে দেখা যাক ।
অজিত কাকু বললেন, আরে না না । আমাদের মত বুড়োদের সঙ্গে ঘুরতে তোমার ভালো লাগবে কেন ?
তারপর বান্টির দিকে তাকিয়ে বললেন, যা তুই আর তোর তরুদিদি, দুজনে মিলে শৌণককে চারপাশটা একটু ঘুরিয়ে দেখিয়ে নিয়ে আয়।
আমার যাওয়ার কোন ইচ্ছেই ছিলো না । তবুও বাধ্য হয়ে যেতে হলো। বান্টি ‘তার’ সাথে সাথে , পাশে পাশে, ঘুরে অনেক কিছু বলছিল। আমি বেশ কিছুটা দূরে আস্তে আস্তে হাঁটছিলাম। এক অদ্ভুত আড়ষ্টতা আমাকে চেপে বসেছিল। কিছুটা যাওয়ার পর একটা চা বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়ে বান্টি স্যাটাসাট করে আঙ্গুলের ফাঁকে চা পাতা তুলতে তুলতে কি সব বলছিল ।
বলতে বলতে হঠাৎ করে পিছন ফিরে কিছু একটা দেখে সে বললো, দাঁড়াও শৌণক দা। আমি আসছি। তুমি যাও না । ওই তো ওইখানে তরু দিদি রয়েছে । তরু দিদির সঙ্গে গিয়ে গল্প করো । আমি এক্ষুনি আসছি ।
বলে সে ছুটে চলে গেল ।
আমি তখন একটা শেড-ট্রী’র নিচে দাঁড়িয়ে যেন পশ্চিম আকাশে অস্তগামী সূর্য দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে রয়েছি, এমন ভাব । বুঝতে পারলাম কেউ একজন আসছে আমার দিকে। বুকের ভেতর কেমন যেন অস্থিরতার সৃষ্টি হল ।
‘সে’ এসে হাত দুটো জিন্সের পকেটে চালান করে দিয়ে আমাকে বলল, কি তরুশী খুব রোমান্টিক বুঝি ?
আমি বুঝতে পারলাম আমার হাতের তালু দুটো ঘেমে উঠেছে । কী উত্তর দেবো বুঝতে পারলাম না । শুধু চকিত লাজুক একটা চাউনিতে তাকালাম তার দিকে।
ঠোঁটের কোণে অল্প একটু ব্যাঁকা হাসি হেসে সে বলল , কি ব্যাপার? তুমি তো আমার সঙ্গে একটাও কথা বলছো না ? ‘আমি’ মানুষটাকে বুঝি পছন্দ হয়নি?
— ন্না .. না.. নাহ্, তা কেন ..
সেটাই ছিল আমার প্রথম কথা তার সঙ্গে। হেসে ফেলে সে বলেছিল, আচ্ছা । সো ইউ লাইক মি।
অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, ইয়ে-
ফিক করে হেসে সে ডানহাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে বলেছিল, হাই আই আ্যম শৌনক দত্ত।
— হ্যাঁ , সে তো –
— ইউ নো দ্যাট , এটাই তো বলতে চাইছো ? অন্য কেউ ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দেওয়া, আর নিজেদের মধ্যে ইন্ট্রোডাকশন-, ড্যাটস্ ডিফারেন্ট, রাইট? ডু ইউ আ্যডমিট দ্যাট?
অসহায় ভাবে তাকালাম তার দিকে।
আবার ফিক করে হেসে সে বললো , হাত মেলাবে না, নাকি ? তুমি আমাকে কি ভাবছো বলতো? বাঘ-সিংহ কিছু ?
বলে কৌতুকবশে তাকালো আমার দিকে। আমি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম । কপালে জমে উঠলো বিন্দু বিন্দু স্বেদ । অনেক চেষ্টা করেও ডানহাতটাকে তুলতে পারলাম না তার উদ্যত হাতের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার জন্য।
সেই ছিল প্রথম দিন। প্রথম দেখা। প্রথম পরিচয় । প্রথম কথা। এরপর অনেক কিছুই আস্তে আস্তে সে আমায় দিয়েছিল । যা আমার জীবনে প্রথম পাওয়া এবং এখনো পর্যন্ত শেষ-

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

নয়
(পূর্বকথা : তরুশী একটি ছোট টি এস্টেট এর ম্যানেজার হয়ে নর্থ বেঙ্গল এ আসে । সে অবিবাহিতা । অবিবাহিত একজন মহিলার চা বাগানের ম্যানেজার হয়ে আসা নিয়ে সেখানে অনেকেরই অনেক প্রশ্ন রয়েছে । বিশেষ করে ওই রকম ফাঁকা জায়গায় একটা বাংলায় একজন মহিলা হয়ে সে কি করে একা থাকবে? এস্টেটের লেবার’রাও মহিলা একজন ম্যানেজারকে পেয়ে খুশি নয় । তরুশীর চা-বাগানে প্রায় দেড় যুগ আগের অনেক স্মৃতি রয়েছে । সে এস্টেটের কাজকর্ম সামলানোর পাশাপাশি সেই সমস্ত স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে। )

বান্টি তার শৌণকদা’কে ছোট করে সোনুদা করে নিয়েছে । আমিও তার দেখাদেখি তাই বলি । যদিও সোনুদা’র সঙ্গে কথা আমি মোটেও বলি না । গল্প তো একেবারেই না । স্কুল থেকে ফিরে এসে বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে বান্টি ঠিক একবার করে ম্যানেজারের বাংলোর দিকে যেত । তারপর বেশিরভাগ দিনই তার সোনুদা’কে পাকড়াও করে নিয়ে আসতো। তারপর যথারীতি সেই প্রথম দিনের মতোই সে তার সোনুদার সঙ্গে কলর বলর করে বকতে বকতে পাশে পাশে যেত। আমি কিছুটা দূরত্ব মেনটেন করতাম। তবে মাঝে মাঝে পিছন ফিরে আমাকে ডাক দিত – তরু দিদি ! দূরে কেন ? এখানে এসো ।
তখন নিতান্ত নিরুপায় হয়েই আবার কিছুটা কাছে যেতে হতো। তবে ওদের কথাবার্তা বা গল্পে কখনোই আমি অংশগ্রহণ করতাম না । গল্প করার মতো কথাই খুঁজে পেতাম না। বান্টি যে অত কি করে কলকল করে বকে সেটাও ভেবে পেতাম না। তবে সপ্তাহে দুদিন ওর বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে গান শেখা আর আঁকা শেখা থাকতো । সেই দুদিন ও বাইরে বের হতে পারত না। আমিও সেই দুটো দিন আর কলেজ থেকে ফিরে এসে বাংলো থেকে বের হতাম না ।

সেদিন কলেজ যাইনি । পরেরদিন খুব সম্ভবত একটা ক্লাসটেস্ট ছিল । তাছাড়া, কলেজে সেদিন তেমন ইম্পরট্যান্ট কোনো ক্লাসও ছিল না। সেদিন বিকেলে বান্টির কাকলি মিস গান শেখাতে এসেছিলেন । সেই কারণে সে আর বেরোয়নি । কিন্তু সেদিন সারাদিন ঘরের মধ্যে থেকে আমার বিকেলের দিকে একটু বাইরে বেরোনোর জন্য মনটা টানছিল । তাছাড়া সারাদিন ধরে বোটানির ট্যাক্সোনমি, সাইন্টিফিক নেম গলাধঃকরণ করে মাথাটাও ছাড়ানোর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল ।

একা একাই বেরোলাম বাংলো থেকে । বেরিয়েই পা দুটো নিজের অজান্তেই যেন ম্যানেজারের বাংলোর দিকে টানছিলো । কিরকম যেন একটা চুম্বক আছে সেদিকে । যেতে না পারলেই নয় । কেন এমনটা হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারলাম না । মনকে বোঝালাম বাংলোটার পিছনের রক্তকাঞ্চন গাছটার নিচের দিকের ডালটার কাছে যে ঝোপটা রয়েছে, সেখানে বুলবুলি পাখির যে বাসাটা দেখেছিলাম দুদিন আগে , সেটা ঠিক তেমনি আছে কিনা দেখতে হবে । সেই কারণেই যাচ্ছি । মোট পাঁচটা ডিম ছিল । ডিমগুলো কি সব তেমনিই আছে, নাকি ফুটে ছানা বেরোলো ? এইসব দেখার জন্যই আগ্রহ হচ্ছে । কিন্তু মাথা যে অন্য কথা বলছে । মাথা বলছে , আমি নাকি বুলবুলি পাখির বাসার থেকেও বেশি কৌতুহল নিয়ে দেখতে চাইছি সোনু দা তার বাসার মধ্যে কি করছে । এই দুই পরস্পর বিরোধী কার্যকারণ বিশ্লেষণ করতে করতে পায়ে পায়ে কখন বাংলোর প্রায় কাছে চলে এসেছি । বুঝতে পারলাম , বুকটা অসম্ভব দুরুদুরু করছে । কেমন যেন ভয় করছে । ওই বাংলোর ভেতরে যেন কোন মানুষ থাকে না , ভূত বেরিয়ে আসবে সেখান থেকে। বুঝলাম , এতোখানি দুরুদুরু বুকে হঠাৎ করে সোনুদা’র সামনে গিয়ে পড়লে মুশকিল । তার মুখের মধ্যে কেমন একটা ছেলেমানুষি মিশ্রিত কৌতুকের ভাব, যেন আমার একরকম অসহায় অবস্থাটা খুব এনজয় করছে । সে কারণেই আমি তার সংস্পর্শ আরো বেশি করে এড়িয়ে চলি । সেটা মনে হতেই খুব তাড়াতাড়ি , প্রায় ছুটে সেখান থেকে চলে এলাম ।

তারপর, বাংলো থেকে সোজা যে রাস্তাটা চলে গেছে উত্তরের দিকে শিমুল গাছটার কাছে , সেখানে গিয়ে বসে পড়লাম । ঠিক শিমুল গাছটার নিচে একটা কাঠের বেঞ্চ ছিল বসার জন্য । এখানে বসলে চোখের সামনে শুধু সবুজ , সবুজ আর সবুজ । পশ্চিম আকাশে গোধূলি নেমে আসছে । বিভিন্ন ধরনের পাখি ঝাঁক বেঁধে তাদের সন্ধ্যের আস্তানার দিকে ফিরে চলেছে । পাখিদের ডাক, ইতস্তত ওড়াউড়ি, ডানা ঝাপটানো , কা-কা , কিচিরমিচির, ফড়িং আর প্রজাপতিদের ডানায় ভর করে চক্কর কাটা – এ যেন সূর্যের গোলাপী আলো মিলিয়ে যাওয়ার আগে প্রত্যেকের শেষবেলার চঞ্চলতা । শিরিষ গাছের নিচে বসে প্রকৃতি দেখতে বড় ভাল লাগে । আমি কিছুটা তন্ময় হয়েই পড়েছিলাম ।

হঠাৎ করে ঠিক ঘাড়ের পেছনে থেকে কে যেন চাপা গলায় বলে উঠলো, ম্যাডাম বুঝি খুব চিন্তায় রয়েছেন?
হঠাৎ করে চমকে উঠলাম । তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সোনুদা’কে দেখেই একেবারে ঘাবড়ে গেলাম । বুঝলাম, অকারণে কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে। সোনু দা কাঠের বেঞ্চটার ঠিক যেখানটাতে আমি পিছনে হেলান দিয়ে বসেছিলাম, সেখানে আমার কাঁধের পিছনে কাঠের ধার বরাবর দুটো হাত রেখে ঝুঁকে প্রায় আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কথাগুলো বলেছিল । পিছন দিকে ডানপাশে মুখ ঘুরিয়ে তাকে দেখেই একেবারে কাঠের মত হয়ে গেছিলাম । বুঝেছিলাম , আমার ঘাড়ের কাছে রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে । আমার মুখ থেকে তার মুখের দূরত্ব সম্পূর্ণ একহাতের তালুর সমানও নয় , আরো কাছে । এত কাছ থেকে কোন পুরুষের সঙ্গে কোন দিন কথা বলিনি আজ পর্যন্ত । প্রশ্নটা সে যে কি করেছিল মাথায় রইলোনা । প্রশ্নকর্তাই একটা বিশাল বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে তখন । সে কেন ? সে কখন ? সে কিভাবে ? .. তখন সেখানে? আমার অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হেসে সোনু দা বেঞ্চটার ব্যাকরেস্টের ধার থেকে হাত তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো ।
আমার দিকে তাকিয়ে চোখের কোনে একটু হেসে ডানহাতটা বাড়িয়ে বলল , আমি কি বসতে পারি ?
— আ্যঁ..হ্যাঁ .. হ্যাঁ নিশ্চয়ই .. বসুন ।
— যাক।
বলে এগিয়ে এসে আমার ডানপাশে বসল সে । আড়চোখে দেখলাম একটা হলুদ রঙের গোল গলা টি-শার্ট আর একটা ব্ল্যাক ক্যাজুয়াল ট্রাকসুটের প্যান্ট পরেছে সে। মুখে সেই মিটিমিটি হাসিটা লেগেই রয়েছে।
বসে বলল, তাহলে বসার অনুমতি পেয়েছি।
যদিও বুকের ভেতরটা দুরুদুরু করছিল , তবুও তার কথা বলার ধরনে হেসে ফেললাম ।
বললাম , অনুমতি নেওয়ার কি প্রয়োজন ?
সে আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল । আমিও তার অবাক মুখের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলাম। কেন যে সে অবাক হয়েছে বুঝতে পারলাম না ।
কয়েক সেকেন্ড পর বলল , যাক, একটুও না ভেবে তাহলে একটা কথা বলতে পেরেছ।
— কি?
— কী আবার ? অনুমতি না নিয়েই আমি বসতে পারি, বলেছ । এবার থেকে তাহলে আর নো আস্কিং, আই মিন নো নিড অফ টেকিং পারমিশন , রাইট? সরাসরি এসে ঝপ্ করে বসে পড়তে পারি , তাইতো ?
অল্প একটু হেসে মুখ নামিয়ে ফেললাম । এই সমস্ত পরিস্থিতিতে আমি খুব আতান্তরে পড়ে যাই । একটা ছেলে আমার সাথে স্মার্টলি কথা বলছে, আমি কিভাবে তার সাথে স্মার্টলি আলাপচারিতা চালিয়ে যাব , সেটা তখনও অভ্যাস হয়নি। খুবই বেকায়দায় পড়ে যেতাম ।

সে আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বলল, কি ব্যাপার ? ওইদিকে ম্যানেজারের বাংলোর দিকে যাওয়া হলো, তারপরে ফিরে চলে আসা হলো কেন , শুনি ?
মাথার মধ্যে কেমন যেন ঝনঝন্ করতে লাগলো । মনে হল কি বিশাল একটা অপরাধ করতে গিয়ে যেন ধরা পড়ে গেছি ।
আমি মুখটাকে নিচু করে প্রায় বুকের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে বললাম , ওইদিকে .. ওই একটু .. একটা দরকার-

ওর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম ও মুচকি মুচকি হাসছে ।
বলল, হ্যাঁ দরকার তো কিছু একটা ছিলই। তবে দরকারটা না সেরে ফিরে চলে এলে কেন ?
আমতা আমতা করে বললাম, ওই যে ওখানে পিছনে একটা ঝোপের মধ্যে পাখির বাসা আছে । সেটা দেখতে যাব ভাবছিলাম।
— সো ইউ থট, আ্যন্ড দেন রিটার্নড ব্যাক । তা তোমার পাখির বাসাটা দেখে এলে না কেন ?
কিরে বাবা? এ যে একেবারে গোয়েন্দাদের মতো জেরা করছে! বিষয়টা ছাড়তেই চাইছে না । অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ। বুঝতে পারলাম না কি উত্তর দেব ।
তারপর বললাম, ওই দিকটাতে একটু জঙ্গল মত আছে তো । তাই আর –
— কিন্তু তুমি তো ওদিকে যাও, রাইট ? তবেই না জানলে ওখানে একটা পাখির বাসা আছে ? সো লেট মি নো, কি আছে বাসার মধ্যে ?
— কি আবার থাকবে ? ডিম-
— বুঝলাম ।
— কি বুঝলেন?
— দুটো জিনিস ।
বলে হাসল ও । বলল, নাম্বার ওয়ান , ইউ আর এ নেচার লাভার । নাম্বার টু , ইউ আর গেটিং টু বি এ লিটিল বিট ফ্র্যাঙ্ক উইথ মি ।
আমার হাতের তেলো দুটো ঘামতে লাগলো। ইংলিশ কনভারসেশন স্টার্ট হলেই ঘামতো । সবই বুঝতে পারতাম, মনের মধ্যে রিপ্লাই দেবার জন্য কিছু একটা ঘোরাফেরাও করত, কিন্তু মুখ ফুটে সেটা আর কিছুতেই বলতে পারতাম না । তাই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতাম যেন ইংলিশ কনভারসেশন আর না এগোয় ।
ও বলল , লিভ ইট । আচ্ছা , আজকে একটু তাড়াতাড়ি বৈকালিক ভ্রমণে বেরোনো হয়েছে মনে হচ্ছে যেন ।
আমি বললাম , আজকে কলেজ যাইনি বাড়িতেই ছিলাম তাই।
— তা কলেজে যাওয়া হয়নি কেন ?
— কালকে একটা ক্লাস টেস্ট আছে। তাই পড়াশোনা করছিলাম ।
— ওহো স্টুডিয়াস স্টুডেন্ট।
বলে চোখ নাচিয়ে বলল, ইউ আর এ স্টুডেন্ট অফ বোটানি অনার্স, রাইট ?
‘ই’ বলেও ‘ইয়েস’টা বেরোলো না মুখ থেকে । বললাম, হ্যাঁ।
— ওকে । কি পড়ছিলে? কিসের পরীক্ষা আছে কালকে ?
— ট্যাক্সোনমির ওপর ।
কিরকম যেন একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল তার দুটো চোখে ।
বলল, আচ্ছা দেখি । তোমার সাবজেক্টের একটা কোশ্চেন করি তোমায় । ভেরি ইজি। বলতো , এই যে চোখের সামনে এত সবুজ আর সবুজ ,টি প্লান্ট ,রাইট ? টি প্লান্টের সাইন্টিফিক নাম কি বলতো ?
গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল । না ,চা গাছের সাইন্টিফিক নেম’টা তো মনে পড়ছে না । পড়েছিলাম কোথাও একটা । কিন্তু এখন তো একেবারেই মনে পড়ছেনা । কি লজ্জা ! কি লজ্জা ! চোখের সামনে সারাক্ষণ ধরে যে গাছগুলো দেখছি, সেগুলোর সাইন্টিফিক নামটা তো আগে জেনে রাখা উচিত ছিল । ‘কি করিস তুই তরু, মাথায় কি গোবর ভরা ! একফোঁটা বুদ্ধিও নেই ?’ – নিজের মনে মনে নিজেই নিজেকে বলতে লাগলাম । কিন্তু , প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না। চুপ করে লজ্জায় প্রায় বেঞ্চের সঙ্গে মিশে বসে রইলাম।
— কই?
আমি চুপ।
ভুরু নাচিয়ে সে বলল, কই? বোটানি অনার্সের স্টুডিয়াস স্টুডেন্ট, বল ?
শুকনো গলায় চিঁচিঁ করে কোনরকমে বললাম, এখন ঠিক মনে পড়ছে না।
অল্প নরম হেসে সে বলল, আচ্ছা ! ঠিক আছে । বলতো, এইযে আমরা চা খাই , তুমি জানো সেটা কিভাবে প্রসেসিং হয় ?
‘প্রসেসিং? ‘ বিড়বিড় করে বললাম । বলতে পারলাম না কিছু ।
ও বললো, হ্যাঁ প্রসেসিং । চা খাও তো তুমি ? চা পাতা কেমন হয় বলতো দেখতে ?
খুব নিচু গলায় কোনরকমে বললাম , ঐতো , গুঁড়ি গুঁড়ি বা পাতা পাতা , দু’রকম হয় ।
হেসে ফেলল ও। বলল, কি কালারের হয়?
— কালার তো কালো।
— কালো হয় কি করে জানা আছে? কিভাবে চা পাতার প্রসেসিং হয়?
এই ব্যাপারে অজিত কাকুর কাছে অনেক বার অনেক কিছু শুনেছি । কিন্তু তখন কিছুই মাথায় এলো না । চুপচাপ মুখ নীচু করে বসে রইলাম।
ও বলল, আচ্ছা , বল, চা গাছের কোন অংশটা তোলা হয় চা পাতা বানানোর জন্য ?
এইটা এতোবার শুনেছি যে ঠোঁটের ডগায় থাকে । বললাম , দুটো পাতা একটা কুঁড়ি ।
— এগজ্যাক্টলি । তারপরে সেটা কালেক্ট করার পর ড্রাই করা হয় । দেন প্রসেসিং । প্রসেসিং এর মধ্যে স্টীম ট্রিটমেন্ট , দেন কাটিং , শেপিং, এভরিথিং । যেটাকে তুমি গুঁড়ি গুঁড়ি আর পাতা পাতা বললে । সেই রকম করা হয় । দেন প্যাকিং । লং প্রসেস । স্টেপ বাই স্টেপ হয়, বুঝলে?
ঘাড় নিচু করে অল্প মাথা ঝাঁকালাম । বললাম, হুঁ।
বলল , চা গাছ কি ধরনের গাছ বল তো?
— কি ধরনের ?
ওর প্রশ্নটাই ঘুরিয়ে আবার ওকে করলাম । মাথাটা তখন ব্ল্যাংক হয়ে গেছে । সে যে আমাকে হঠাৎ করে মাস্টারমশায়ের মতো প্রশ্ন করতে আরম্ভ করবে ভাবতে পারিনি । ওই প্রশ্নটাই আর একবার উচ্চারণ করে নিজের মাথায় ঢোকালাম , ঠিক কি জিজ্ঞাসা করতে চাইছে।
তারপর কোনরকমে বললাম, চিরহরিৎ –
ফিক করে হাসল ও। বলল , তোমাদের বোটানি অনার্স কি বাংলায় পড়াচ্ছে ?
আমি প্রায় লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে বললাম , না মানে.. তা নয় ।
— তাহলে ?
জানি সব জানি আমি – এভারগ্রীন শ্রাব। তবুও বলার সময় এতদিন ধরে বাংলায় পড়ে আসার অভ্যাসটা ছাড়তে পারিনা । মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় ‘চিরহরিৎ গুল্মজাতীয় ‘।
এবার জোর করেই বললাম , এভারগ্রীন।
বেশ একটা চওড়া হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে, এইতো ! এভারগ্রীন । এইবার আসল ওয়ার্ডটা বেরিয়েছে মুখ থেকে। আচ্ছা , ডোন্ট ইউ থিংক , এভরি পার্সনস্ হার্ট শুড বি অলওয়েজ এভারগ্রীন ?
আবার অসহায় ভাবে তাকালাম ওর দিকে। এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই আমার কাছে ।
ও আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, কিন্তু আমাদের ম্যাডাম তো কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়াকালীনই একেবারে জেঠিমা । এভারগ্রীন-এর তো কোন বালাই নেই ।
বলে মুখটা একটু ফুলিয়ে একরকম মুখ ভঙ্গি করে বলল , ‘আমার কালকে ক্লাস টেস্ট রয়েছে, তাই জন্য আমি কলেজে যাইনি, আজকে ঘরে বসে পড়ছিলাম’ ; জেঠিমা না তো ? কি বলবো? কলেজে তো লোকে যায় প্রেম করতে। দু’চারটে বয়ফ্রেন্ড থাকবে । তাদের সাথে দেখা না হলে কি আর ভালো লাগে?
আমি মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠলাম । বললাম , সবাই কলেজে প্রেম করতে যায় না।
ও অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই বুঝি ? তুমি কলেজে কি করতে যাও শুনি ?
গম্ভীর হয়ে বললাম , পড়াশোনা।
ও ফিফ করে হেসে বলল , তাই বুঝি ? কই দেখি তোমার হাত দেখি ।
— মানে ?
— দেখাও না হাতটা , দেখি । তোমায় বলে দিচ্ছি।
— কি বলবেন ?
— বলে দেব কলেজে কারো সঙ্গে তোমার প্রেম হবে কিনা।
— ওসব আমার হাত দেখে বলতে হবেনা । আমিই আপনাকে বলে দিচ্ছি , আমার ওসব কিচ্ছু হবে না ।
— এসব কি আর কিছু বলা যায় ? হতেই পারে। দেখি না, তোমার হাতটা-
বলে নিজের ডানহাতটা বাড়িয়ে আমার বাঁহাতটা টেনে নিল । তারপর আমার হাতের পাতাটা নিজে চোখের তলায় মেলে ধরে যেন খুব বিজ্ঞের মত কিছু দেখল । আমি বুঝতে পারলাম আমার বুকের মধ্যে উথাল পাথাল হচ্ছে , যেন সমুদ্রের ঢেউ। এমনটাও হয় ? একজন শুধু হাত ধরলে এমনটা হয় বুঝি ? কি হয় ? কেন হয় ? কিভাবে হয়? এমন কেন হয় ?
আমি উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলাম । যদি বুকের উত্তাল ঢেউয়ের প্রতিচ্ছবি মুখে ভেসে ওঠে? ওর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম ও মিটিমিটি হাসছে।
কিছুক্ষণ পর আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, শুনবেনা কি দেখলাম ?
সে যে সত্যিই আমার হাত দেখেছে , সেটা ঠিক বিশ্বাস না করলেও বা সে যে আদৌ হাত দেখতে পারে বা হাত দেখা বস্তুটা কী , সে সমস্ত সম্পর্কে ঠিক বিশ্বাস বা অবিশ্বাস’ কোনটাই আমার না থাকলেও, সে যে কিছু একটা দেখেছে, সেটা অস্বীকার করতে পারলাম না।
মুখ নিচু করে এক হাতে করে অন্য হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে বললাম , কি দেখলেন শুনি ?
— দেখলাম তোমার এক্ষুনি একটা প্রেম হবে । এক্কেবারে জবরদস্ত প্রেম !
আমি কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি নিয়ে ওর দিকে তাকালাম । হাত দেখতে পারে কি না পারে, আমার বয়েই গেল । কিন্তু আজকে যে সে আমার হাত ধরেছে ! কেমন যেন একটা হল আমার হাতের মধ্যে , শরীরের মধ্যে , বুকের মধ্যে । ও আমার হাতটা ধরার সঙ্গে সঙ্গে হল । এই অনুভুতির নাম কি?

ক্রমশ..