হলদে প্রজাপতি পর্ব-২০+২১

0
187

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

কুড়ি

সন্ধ্যাবেলা নিকষ কালো অন্ধকার চা-বাগানের বুক চিরে গাড়িতে করে এগিয়ে চলা যে ঠিক কতখানি রোমাঞ্চকর অনুভূতি, তা বলে বোঝানোর নয়। একবার , দুবার দশ বার, শতবার ভ্রমণেও এর মধ্যে নিহিত রোমাঞ্চকর ব্যাপারটা কখনো থিতিয়ে পড়ে না । মনটাও বেশ ফুরফুরে ছিল । সারাদিন ধরে বেশ অন্য রকম কাটলো তো । মনে পড়ছিল পড়ন্ত বিকেলের সেই পালাগানের গ্রাম্য সুর । মাঝে মাঝে গুন গুন করে উঠছিলাম । জগন্নাথ দা’ও গ্রামটা ঘুরেছে নিজের মতো করে । দুপুরবেলায় টগরদের বাড়িতেই ভাত খেয়েছে । পালাগানও দেখেছে । সেসব নিয়ে টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছিল ।
প্রথম দিন থেকেই লক্ষ্য করেছি, জগন্নাথ দা’র বাঁ হাতে বেশ অনেকগুলো সেলাইয়ের দাগ। তাছাড়া হাতটা একটু ব্যাঁকা মত । আঙ্গুলগুলো পুরোপুরি সোজা হয় না । কোন একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল বুঝতে পারি । কিন্তু কোনদিনই জিজ্ঞাসা করা হয়নি ।
আজকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম । বললাম , জগন্নাথ দা , তুমি কি কোনদিন অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে হাতে চোট পেয়েছিলে ?
— ঐ গল্প বুঝি আপনাকে কোনদিন করিনি দিদিমণি?
— না , কই আর করেছ ? আমি অনেকবার ভেবেছি তোমাকে জিজ্ঞাসা করব। তারপরে আর জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি ।
সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে জগন্নাথ দা বলল , সে এক বিশাল বড় কাহিনী !
— কিরকম ? তোমার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল বুঝি?
— না দিদিমণি, দুঃখের কথা আর বলবো কি । আমি এত বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছি , আমার নিজের গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে আমার কিছু হয়নি । হয়েছিল লোকের গাড়িতে ।
— কিরকম ?
— আর বলেন না দিদিমণি । সেবার , তাও বছর চারেক হবে , বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে দিঘা যাচ্ছিলাম। আমাদের ওদিকে পাড়ার অনেকেও যাচ্ছিল । কিছু করে টাকা তুলে আমাদের পাড়ার ওই মন্টুটাই সব ব্যবস্থা করেছিল । এত বড় একটা টুরিস্টদের বাস ভাড়া করা হলো । সেই বাস ছাড়লো দুর্গাপুজোর পরে একাদশীর দিন রাতে । সে তো আমাদের খুবই ভালো লাগছে । মজা করতে করতে গেলাম। দুদিন থাকলাম ওখানে , বুঝলেন তো ? আমাদের খুব বেশি ঘোরা বেড়ানো হয় না বুঝলেন দিদিমণি, বেড়ানোর বড় সাধ হয় । আমি তো গাড়ি চালিয়ে টুরিস্ট নিয়ে গেছি, কিন্তু বৌ-ছেলে-মেয়ের ঘোরা হয় না। ওদের সাথে আমার যাওয়া হয় না কোথাও। আমাদের যেমন-তেমন, বাড়ির সব মেয়ে বৌ’দের হুটোপাটি একদম দেখার মত। তাদের সে কি আনন্দ , সমুদ্দুরের ঢেউতে নেমে ! সে একবার করে নামছে আর নায়িকা মনে করছে নিজেদের। আর যাচ্ছে না পাড়ে, মনে হচ্ছে ওখানে এখন ওই সমুদ্দুরের মধ্যেই বসে থাকবে । সে যাই হোক , মজা তো অনেক হলো । এবারে হয়েছে কি , ফিরে আসার দিন আবার সেই আমরা সবাই রাত্রিবেলা চেপেছি বাসে। বাস স্টার্ট দিয়েছে । ছুটছে , বেদম ছুটছে । এবার, আমরা সব খেয়াল রেখেছিলাম বুঝলেন কিনা, বাসের ড্রাইভার হেল্পার কেউ যাতে সে রকম কিছু খেয়েটেয়ে না নেয়। তা দুদিন ওখানে ছিলি, যা খেয়েছিস খেয়েছিস , আবার না হয় এখানে বাস থেকে সব টুরিস্ট নাবিয়ে দিয়ে, যা করতিস করতিস । তা না, কখন সব একগলা করে গিলেছে । তারপর বুঝলেন কিনা, সে ওখানে একটা রাস্তায় এই রাউন্ড একটা পাক ছিল । সে তো খুব স্পিড তখন তুলে দিয়েছে । আর সামলাতে পারেনি । না কি করেছে কে জানে, সে একেবারে একটা মাঠের ধারে খাদ মত ছিল , তারই পারে বাস একদম উল্টি । চাকাগুলো ওপরে । সেকি দৃশ্য ! না দেখলে আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না । কে যে কোথায় পড়েছে, কার ঘাড়ে যে কি পড়েছে সে একেবারে যা-তা অবস্থা! আমার তো বউ ছেলেমেয়ে তখন কোথায় কে জানে। খানিকটা অজ্ঞান মত হয়ে গিয়েছি । হঠাৎ করে মনে হল কি যেন একটা হিড়হিড় করে টানছে আমায় । সে আমার তখন হাতে কি বেদনা ! মনে হচ্ছে পুরো এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে । কোথায় ঝোপের মধ্যে গিয়ে পড়েছি , কি ঢুকেছে হাতের মধ্যে, ক’খানা কি ব্যাপার, কিছুই বুঝতে পারছিনা। যে আমাকে টানছিল সে আমাকে টেনে বার করে একটা খোলা জায়গায় নিয়ে গিয়ে ফেলল । আমি তাকিয়ে দেখি কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, খোলা ! রাতের অন্ধকারে । তা’ও আবার এই কালো একটা মেয়ে ! আমি তখন ভাবছি কি জানেন দিদিমণি , আমাকে মা কালী বাঁচালো । পেন্নাম করতে যাচ্ছি হাত তুলে। কিন্তু সে পারব কেন ? হাত তো একবারে তখন আমার ভেঙে যাচ্ছে ! সে তার পরে সেখানে কতক্ষণ পড়েছিলাম কে জানে । সেখানকার আশেপাশের সব লোকাল লোকজন আমাদের যাকে যা হয় হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করল । হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সে পুরোপুরি জ্ঞান ফিরতে তখন বুঝতে পারলাম, সেই মেয়েটা ছিল আমাদের পাড়ার নেত্য । আদিবাসী মেয়ে একটা । তার জন্যই বেঁচে গিয়েছিলাম , জানেন ? ওদের গায়ে তো ক্ষমতা খুব । কোথায় পড়েছিলাম , হাতের মধ্যে কি গেঁথেছিল , কে জানে । কোথা থেকে বার করলো আমাকে । এ-এই টেনে বার করেছিল জানেন মেয়েটা ? যাই হোক, সে হাসপাতাল তো বলে হাত বাদ দিতে হবে কনুই থেকে । একবারে কতগুলো জায়গায় রড ঢুকে যখম হয়ে গেছে। হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো । সে তো ভাবছিলাম হাতটা বুঝি গেল । তারপরে কলকাতায় গেলাম । সে যাই হোক , সেখানে সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারবাবু বললেন পাত লাগিয়ে সেট করে দিতে পারবেন। অপারেশনের পরে অনেকদিন হাত নাড়াতে পারিনি । বছরখানেক গাড়ি চালানো বন্ধ ছিল । তারপরে আবার একটু একটু করে চালাতে চালাতে এখন একদম সেট হয়ে গেছে । হাত কোন দিকে কোন ভাবে নাড়াতে ব্যালেন্স করতে আর কোন অসুবিধা হয় না।
— আর তোমার ছেলে-মেয়ে, বৌ? তাদের কারো কিছু হয়নি তো ?
— না ভগবানের দয়ায় শুধু একটু আধটু মুচকে , কেটে-ছড়ে গেছিল । তেমন কিছু হয় নি । তবে আবার বাসের মধ্যে অনেকেই ছিল , তাদের সব সাংঘাতিক সাংঘাতিক কান্ড , অবস্থা ! যাইহোক , মরেনি কেউ, এটাই যা।
— যাক গে, এত বড় অ্যাক্সিডেন্টে যে শুধু হাতের ওপর দিয়ে গেছে, এটা জানবে তোমার খুব ভাগ্য ভালো ।
— এটা আপনি ঠিক বলেছেন দিদিমণি । তবে কি জানেন তো, এত বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছি, নিজের হাতে স্টিয়ারিং ধরে আজ পর্যন্ত কোনো অ্যাক্সিডেন্ট করিনি , জানেন? লোকের গাড়িতে চাপলাম একবার । সে কি অবস্থা হয়ে গেল ।
— সে আর কি করবে ? সবকিছুতেই নিজের দুর্ভাগ্যের কথাটা ভাববে যেমন, ভাগ্যের কথাটাও ভাববে । যেরকম অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল বলছো, তাতে করে কি না কি হতে পারত । সে তুলনায় কিছুই হয়নি ।

গল্পে গল্পে এগিয়ে এসেছি অনেকটা রাস্তা । মাঝে মাঝে রাস্তায় আলো রয়েছে বটে, তবে বেশিরভাগ রাস্তাই অন্ধকার । গাড়ির হেডলাইটের ভরসায় চলেছি। দু’পাশে জমাট কালো অন্ধকারে মাথা দোলাচ্ছে চা বাগান । শিরশিরে একটা ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে গাড়ির জানালা দিয়ে । মনে হচ্ছে যেন হাল্কা একটা চাদর থাকলে ভাল হত ।

টগরদের বাড়ি থেকে বেরোনোর পর পাক্কা এক ঘন্টা কুড়ি পঁচিশ মিনিট হবে, পাতাকে ড্রপ করে দিলাম ওর বাড়িতে । তারপর পৌঁছে গেলাম নিজের বাংলোয়। কিন্তু বাংলোর গেটের কাছে ঢোকার কিছুটা আগে উত্তেজিত ভাবে হাত দেখিয়ে আমাদের গাড়িটা দাঁড়াতে বলল যদু । তার গাড়ি দাঁড় করানোর ধরনে সত্যি কথা বলতে কি একটু অবাকই হলাম। প্রচন্ড উত্তেজিত সে । গাড়ি দাঁড়াতে , তাকে গাড়ির উইন্ডো থেকে হাত বার করে সামনে ডাকলাম । সে সামনে এসে খুব উত্তেজিত হয়ে কি সব যে বলতে লাগল , মাথায় খুব ভালো করে ঢুকলো না।
আমি বললাম, এত কথা না বলে ছোট করে বল কী বলছ ।
সে বাঁ হাতটা তুলে মোটামুটি উত্তর-পশ্চিম কোন করে একটা দিক নির্দেশ করে বলল, ওইখানে -, ওইদিকে কি কান্ড হয়েছে দিদিমণি । আপনি যান । আপনার চা বাগানের মধ্যে পড়ছে যে। আপনাকে যেতে হবে ।
— কিন্তু হয়েছেটা কি ?
— বাঘ পড়েছে , বাঘ !
— বাঘ ! কি বলছ কি!
ধমকে উঠলাম প্রায় যদুকে , বাঘ মানে ?
— আমি যাচ্ছি চলুন দিদিমণি । আপনাকে ওরা যেতে বলে গেছে ।
বলে গাড়ির সামনের দরজা খুলে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে পড়লো সে।
— কিন্তু যাব কোথায় ?
— আমি বলছি দিদিমনি । ওই যেখানে বাঘ পড়েছে –
প্রথমটায় বিশ্বাস হয়নি । কি বলছে কে জানে লোকটা । কিন্তু তারপরে ওর ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে সত্যি করেই বাঘের কোন একটা ব্যাপার ঘটেছে । সে আবার কি ? চা-বাগানে বাঘ! কি বাঘ, কেন , কোত্থেকে এলো , কি বৃত্তান্ত ! সত্যি কথা বলতে কি, এবার যথেষ্ট ঘাবড়ে গেলাম । চা বাগানে মাঝেমধ্যে কোথাও কোথাও বাঘ এসে পড়ে শুনেছি। তবে তা যে একেবারে আমার টি এস্টেটের সীমানার মধ্যে হয়ে যেতে পারে, ভাবতে পারিনি । যদুর কথামতো জগন্নাথদা গাড়ি চালিয়ে নিয়ে চলল । মোটামুটি মিনিট পনেরো থেকে কুড়ি । তারপরে একটা জায়গায় এসে গাড়িটা থামল । দেখলাম সেখানে বেশ জটলা হয়েছে । সত্যি কথা বলতে কি , বুকে কিছুটা কাঁপুনি ধরেছিল । বাঘটা নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও আছে । এভাবে ওপেন জায়গায় বাঘ আর আমি , একসাথে! বাপ্ রে ! এরকম ঘটনা ঘটতে পারে জীবনে কখনো ভাবি নি । গাড়িতে আসতে আসতে যদু যেটুকু বলেছে , তা এই রকম –
আশেপাশের জঙ্গল থেকে একটা চিতাবাঘ নাকি সন্ধ্যার মুখে মুখে ঢুকে পড়ে আমার টি এস্টেটে। তাকে দু-একজন ফিরতি চা শ্রমিক দেখতে পায় । তারপরেই ঢিঢি পড়ে যায় চারদিকে। খবর ছড়িয়ে পড়ে হু হু করে । অনেক লেবার আবার ফিরে এসে সেখানে , জটলা করে । তার সাথে আশেপাশের স্থানীয় কিছু লোকজন যোগ দেয় । তারা সব লাঠিসোঁটা , ড্রাম , এইসব নিয়ে জড়ো হয়ে দূর থেকে বাঘটাকে তাড়ানো চেষ্টা করে । তবে বাঘটা নাকি এখনো যায়নি । ওখানেই কোথায় ঢুকে বসে রয়েছে ।

গাড়ি থেকে নামলাম । টগর তো সেসব শুনে গাড়ি থেকে নামা দূরের কথা, গাড়ির জানালার কাঁচগুলোকেও তুলে দিয়ে ভেতরে বসে রইল। যদু আর জগন্নাথ দা অবশ্য নামল দুজনে । সত্যি কথা বলতে কি, বুক ধুকপুকুনিটা চারগুণ বেড়ে গেল । এই একই মাটির ওপরে খোলা আকাশের নিচে আমি আর এখানেই কোথাও একটা লুকিয়ে রয়েছে চিতাবাঘটা । এইরকম অকল্পনীয় একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে ভাবা যায় ! জটলাটার দিকে এগিয়ে গেলাম । দেখলাম কম করে হলেও জনা পঁচিশ তিরিশ লোক জড়ো হয়েছে । তাদের হাতে বড় বড় বাঁশের লাঠি, দু’চারটে ড্রামও নিয়ে এসেছে, কয়েকজনের হাতে মশাল জাতীয় কিছু , আগুন জ্বলছে । আমাকে দেখেই তারা উত্তেজিত হয়ে সমস্বরে অনেক কিছু বলতে লাগলো । তাকিয়ে দেখলাম আমার টি এস্টেটের লেবার রয়েছে প্রায় দশ বারোজন । তাদের বক্তব্যের সারাংশটুকু আগেই আমার শোনা । এখন তাদের হাতের নির্দেশ লক্ষ্য করে যা বুঝলাম, সেখান থেকে প্রায় তিনশো কি চারশো মিটার দূরে চা গাছের ফাঁকের মধ্যেই একটা পূর্ণাঙ্গ চিতা ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। আরও একটা নতুন তথ্য যা পাওয়া গেল, সেই চিতাবাঘটি একা নয়, সে একটি মা চিতা এবং সঙ্গে তার শাবক রয়েছে। কাছাকাছি ওই নদীর ধারের জঙ্গল থেকে এসে পড়েছে নিশ্চয়ই এখানে । বন্যপ্রাণীদের দেখা পাওয়া গেলেই স্থানীয় মানুষজন এত ভিড় করে ফেলে না? সেটাই মুশকিল । হয়তো এই মা আর শাবক কোন কারনে এখানে এসে পড়েছিল । আবার কাল সকাল হওয়ার আগেই হয়তো খুঁজে খুঁজে নিজেদের ডেরায় বনের মধ্যে ফিরে যেত । কিন্তু এখন চারপাশে লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি, ড্রামের শব্দ, এইসব দেখে শুনে, মা আর তার শাবককে নিয়ে চা বাগানের আড়াল থেকে বেরোনোর ভরসা পায়নি । সন্তানের সুরক্ষার কারণে যে কোন বন্যপ্রাণী সদা সতর্ক থাকে ।

আমাকে আসতে দেখেই জমায়েত করা মানুষগুলোর মধ্যে একটা অস্থিরতা বাড়লো। এতক্ষন তারা দূর থেকে লাঠিসোঁটা, ড্রামের আওয়াজ করে, বাঘটাকে ওখান থেকে তাড়াতে চাইছিল । তবে টি এস্টেটের ম্যানেজারের পারমিশন না নিয়ে খুব একটা কাছাকাছি যেতে পারছিল না । আমাকে আসতে দেখেই চিৎকার-চেঁচামেচি করে ওরা যা বলতে চাইল, তা হল- যেখানে চিতাবাঘটা তার শাবককে নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে, সেখানে তারা লাঠিসোঁটা সাথে যা আছে, তার সাথে দু-একটা বর্শার ফলার মতো অস্ত্রও হাতে রেখেছে দেখলাম , সেগুলো নিয়ে মশালে আগুন জ্বেলে এগিয়ে গিয়ে বনের দিকে চিতাবাঘটাকে তাড়াতে চায় । এখানে এই চা বাগানের মধ্যে বসে থাকলে আশেপাশে যে দু-একটা বসতি আছে, তাদের জন্য ভয়ের। আবার যে চা শ্রমিকরা কাল সকাল থেকে কাজ করতে আসবে, তাদের জন্যও বটে। আমার টি এস্টেটের মধ্যে যেহেতু পড়ছে, সেহেতু আমার পারমিশন না পাওয়া পর্যন্ত ওরা বেশি এগোতে পারেনি । আমি পারমিশন দিলেই ওরা এগিয়ে যাবে। কিন্তু, আমি এমন পারমিশন দিই কি করে ? এই দলটার মধ্যে যেকোন কাউকে বাঘে আক্রমণ করে ফেলতে পারে । আর তা যদি নাও হয় , এদের হাতে প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু অস্ত্র রয়েছে, বাঘটাও জখম হতে পারে , কিংবা তার শাবক। এভাবে বনদপ্তরকে খবর না দিয়ে, নিজেরা কিছু করতে গেলে উভয়পক্ষের যেকোনো ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা । আমি তাদের যথাসম্ভব বোঝাতে লাগলাম, তারা নিজেরা কিছু না করে যেন বনদপ্তরকে খবর দেয়। প্রথমটায় তারা মানছিল না আমার কথা । কিন্তু তারপরে অনেক করে বোঝাতে তারা রাজি হল । আমি ব্যাপারটা বনদপ্তরকে ফোন করে জানালাম । তারা আসার আশ্বাস দিল ।

তারপর প্রায় মিনিট দশেক সময় কেটে গেছে। আমি তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম তাদের ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা তাদের নিজেদের জন্য খুবই রিস্কি। তারা যে যার বাড়িতে ফিরে গিয়ে জায়গাটা ফাঁকা করে দিলে আমি সেখানে গাড়ির মধ্যে বসে থেকে বনদপ্তরের লোকজনের এখানে আসার জন্য অপেক্ষা করবো । তারপর তারা এসে যা করার করবে। কেউ কেউ বুঝলো, তবে বেশির ভাগই বুঝলো না । তারা দেখে যেতে চায় কি হলো বাঘটার । মানুষের এই অহেতুক কৌতুহল ব্যাপারটাই বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষার জন্য হানিকর সবচেয়ে বেশি । কথা কাটাকাটি হতে লাগল তাদের সঙ্গে । ইতিমধ্যে যখন সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলায় ব্যস্ত, তখন আর বাঘের দিকে নজর করা হয়নি । হঠাৎ করে কে একজন চিৎকার করে বলে উঠলো, বাঘটা নাকি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে এসেছে । ওখানে গাছগুলোর মধ্যে সে তাকে দেখেছে । কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ । একেবারে সমস্ত শোরগোল যেন নিমেষে বন্ধ হয়ে গেল । তারপরেই ওই দলটার মধ্যে পাঁচ-ছ’ জন অহেতুক কৌতূহলে কিছুটা এগিয়ে গেল । মুখ থেকে বিভিন্ন বিচিত্র শব্দ বার করছে তারা । আমি বারণ করাতে কোন কাজ হলোনা । সেই ক’জনের দেখাদেখি বাকি দলটাও যে যার মত এগোতে লাগল তাদের সঙ্গে ।

কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার । তিরিশ কি চল্লিশ সেকেন্ড হবে । তারা হয়তো হাত দশেক এগিয়েছে । ওই সমস্ত বিচিত্র শব্দের মধ্যে বাঘের নড়াচড়ার কোন শব্দ আর পাওয়া যাচ্ছে না । সে যে ঠিক কোথায় রয়েছে, তা কিছু বুঝতেও পারছিনা ।
এমন সময় ! এমন সময় এক হাড় হিম করা দৃশ্য ! মুহুর্তের মধ্যে আমার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত গায়ের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে উঠল । হিমশীতল একটা তড়িৎ স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে । দেখলাম , উল্কার বেগে একটা হলুদ রঙের মাংসপিণ্ড ঠিক যেন উড়ে এসে পড়ল দলটার মধ্যে । সাথে বুকের অন্তস্থল পর্যন্ত কাঁপিয়ে তোলা এক ভয়ানক গর্জন!

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

একুশ

কয়েকটা মুহূর্তের জন্য আর নিজের হার্টবিট ছাড়া জগতে কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে বলে মনে হলো না। চতুর্দিকে যেন চাপ চাপ অন্ধকার! পায়ের নিচে কোন মাটি নেই । শুধু ঢিপ ঢিপ ঢিপ ঢিপ শব্দটা । তারপরে যখন জ্ঞানবুদ্ধি , পঞ্চইন্দ্রিয় সব ফেরত পেলাম, তখন দেখি ওই দলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পেরেছে ছুটেছে । আর বাঘটা আবার তার স্বস্থানে নিজের শাবকের কাছে ফিরে গিয়ে চা বাগানের আবডাল খুঁজে নিয়েছে । কিছুক্ষণ সব নিস্তব্ধ । চা গাছের পাতাগুলোও যেন নড়াচড়া করতে ভুলে গেছে । প্রত্যেকেই ছিটকে বেশ অনেকটা করে পালিয়েছিল। নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছানোর পর বেশিরভাগ মানুষই আবার ছোটা বন্ধ করে ইতিউতি ফিরে তাকিয়ে বাঘটার গতিবিধি লক্ষ্য করার চেষ্টা করছে । শুধু আমিই বোধহয় এই গোটা পর্বটার মাঝখানে নিশ্চল একেবারে কাঠের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছি । যেন শ্বাস নিতেও ভুলে গেছি। জগন্নাথ দা আর যদু , তারা দুজনে আমার থেকে বেশ কিছুটা পেছনে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়েছে এবং একেবারে গাড়িটার কাছে দাঁড়িয়ে আমাকে চিৎকার করে ডাকছে , সেখানে গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ার জন্য ।
প্রায় গোটা একটা মিনিট এইভাবেই কাটলো । তারপরে হঠাৎ করে মনে হল কোথা থেকে যেন গোঙানির মত একটা শব্দ আসছে । শব্দটা ক্রমশ বাড়তে লাগলো । ধীরে ধীরে আর্তনাদে পরিণত হলো। লক্ষ্য করে দেখলাম যে কজন ছোটা থামিয়ে বাঘের গতিবিধি লক্ষ্য করার চেষ্টা করছে তাদের মধ্যেও বেশ সচকিত একটা ভাব । দূরের একটা ল্যাম্পপোস্টের প্রতিফলিত ক্ষীণ আলোয় মনে হলো তারা যেন অন্ধকারের মধ্যে এক পা এক পা করে সেই গোঙানির শব্দ লক্ষ্য করে এগোচ্ছে। তবে কাছে যাওয়ার ভরসা পাচ্ছে না। তারা চলেও যাচ্ছে না , নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে । এইরকম ভাবে ঠিক কতক্ষণ কাটলো বলতে পারব না । হয়তো মিনিট দশেক হবে । কিন্তু সেটা কয়েকযুগ বলেই মনে হচ্ছিল। আমিও তার মধ্যে পায়ে-পায়ে কিছুটা পিছিয়ে এসে এগিয়ে গেছি গাড়ির কাছে । আবার যদি ওই হলুদ উল্কার আচমকা আগমন ঘটে, তাহলে যেন গাড়ির দরজাটা চট করে খুলে একটা নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে বসতে পারি।

বনদপ্তরের গাড়ি এল । তারপরের ঘটনা আশাব্যঞ্জক এবং মর্মান্তিক দু’রকমই। আশাব্যঞ্জক এই কারণে যে, চিতাবাঘটি এবং তার শাবককে বনদপ্তরের কর্মীরা খাঁচায় বন্দী করতে সক্ষম হলো । আর কোন চিন্তা নেই । তারা এবার তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে অরণ্যে ফিরে যেতে পারবে । কিন্তু মর্মান্তিক বিষয়টি হলো, ওই জটলাটার মধ্যে লাফ দিয়ে পড়ে সে একটি মানুষকে বেশ ভালোরকম জখম করেছে । ঘাড়ের কাছে এবং ডান হাতের বাহুর ওপরের দিকে বেশ কিছুটা করে মাংস উধাও ! চরম সংকটজনক অবস্থায় তাকে সঙ্গে সঙ্গে শিলিগুড়ির হাসপাতলে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেছি । তবে আমার দায়িত্বটা এখানে সম্পূর্ণভাবে চলে এলো । কারণ, জখম হওয়া মানুষটির নাম রবি বর্মন, সে আমার টি এস্টেটের একজন শ্রমিক । তাকে নিয়ে গিয়ে ভর্তির সমস্ত ব্যবস্থা করে সেদিন নিজের বাংলায় ফিরে আসতে আসতে রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজলো ।

ভীষণরকম বিধ্বস্ত লাগছিল । কি সুন্দর একটা পাঁচালীর সুরের মতো দিনটা শুরু হয়েছিল, আর শেষ হল যেন বেসুরো ফাটা ড্রামের শব্দে। মাথা তখন আমার দপদপ্ করছে, যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। টগরদের গ্রামের মানুষজনদের গ্রাম্য জীবন যাত্রা, তাদের আপ্যায়ন , বিকেলের পালাগান সমস্ত স্মৃতি তখন আমার মধ্যে লোপ পেয়েছে । শুধুমাত্র চোখ বন্ধ করলেই সেই হলুদ রঙের উল্কাটা দেখতে পাচ্ছি । আর তারপর মানুষটার ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহটা । প্রায় সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারলাম না । আর একটা টেনশন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল । সেটা হল রবি যেহেতু আমার টি এস্টেটের একজন শ্রমিক, সে কারণে আমি আবার নতুন কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বো না তো ? দুঃস্বপ্নের মত কাটলো রাতটা। ভোরের দিকে মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তির কারণে চোখের পাতা লেগে এসেছিল ।

ঘুম ভাঙলো যখন বেলা হয়ে গেছে । সাড়ে আটটা বাজে । আমার ঘুম থেকে উঠতে কোনদিন এত দেরি হয় না । তাও ঘুম ভাঙলো টগরের উত্তেজিত চেঁচামেচির শব্দে,
— দিদি, দিদি ওঠো গো ! দেখবা চলো, বাইরে কি শোরগোল !
তড়াক করে উঠে বসলাম । কোনরকমে মুখে হাতে একটু জল দিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়েই গেলাম বাইরে । ও বাবা ! এতো প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক জড়ো হয়েছে । বিক্ষুব্ধ তারা । আমার বাংলোর গেটের সামনে বসেই বিক্ষোভ জানাচ্ছে। সর্বনাশ ! যে ভয় পেয়েছিলাম সেটাই হয়েছে। চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে যে একজন গুরুতর আহত হয়েছে, সে কারণে বেশ কিছু শ্রমিক এবং তাদের বাড়ির লোকজনেরা এখানে আমার বাংলোর সামনে বিক্ষোভ জানাতে এসেছে। কিছুক্ষণ তাদের উত্তেজিত কথাবার্তা , যা কিনা আমাকে দেখার পর চারগুণ হয়ে গেল , শুনে বুঝতে পারলাম ওরা সম্পূর্ণ ঘটনার জন্য আমাকে দায়ী করছে । এই ধরণের ঘটনা ঘটে এক, লোক মুখে ফেরে আরেক । দিন রাত হয়ে যায় , তিল তাল হয়ে যায়। ওদের বক্তব্য হল , আমি যদি ওই সময়টা ওদের অপেক্ষা করতে না বলতাম , বনদপ্তরের লোকজন আসার জন্য, তাহলে ওরা সবাই মিলে গিয়ে চিতাবাঘটাকে তাড়িয়ে দিত সেখান থেকে। যেহেতু আমি সেটা করতে দিইনি, বনদপ্তরের লোকজন আসার জন্য অপেক্ষা করেছি, সেইজন্যেই এই অঘটন । ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম । এই ঘটনার দায় কোনভাবে আমার ওপর যদি এসে পড়ে ! সেটাই ঘটলো। ওরা আমার পদত্যাগের দাবি করছিল। আমি শত চেষ্টা করেও ওদের বোঝাতে পারছিলাম না এই ঘটনায় আমার কিছু করার নেই । অতর্কিত হামলার ঘটনা ঘটেছে। কয়েকজন ওইভাবে বাঘটার দিকে তখন এগিয়ে না গেলে এই ঘটনা ঘটত না । যেহেতু বাঘের সাথে শাবক ছিল, সেইজন্য সে তার সুরক্ষার ব্যাপারে অধিক সতর্ক ছিল । কিন্তু উত্তেজিত জনতার মাঝে তত্ত্বের কথা খাটে না । সকাল গড়ানোর সাথে সাথেই উত্তেজনার পারদ চড়তে লাগলো । কি করবো ? ভীষণ দিশাহারা লাগছিল । জানিনা মালিক পক্ষের কাছে অলরেডি কী ধরনের খবর গেছে। খবর তো নিশ্চয়ই নিউজপেপারে বেরোবে । কিন্তু এখন এই উত্তেজিত শ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে পড়ে আমি মালিকপক্ষকে কিছু জানাতে ভরসা পেলাম না । কি থেকে কি হয়ে যাবে । এই বিক্ষোভের যদি একটা সহজ সমাধান থাকে, আমাকে সরিয়ে দিলে যদি তার সমাধান পাওয়া যায়, তাহলে নিশ্চয়ই সহজ সমাধানটাই মালিকপক্ষ খুঁজে নেবে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল ! বাবা ! বাবাকে ফোন করে জানালে কি এর কোন সমাধান সূত্র পাওয়া যেতে পারে? কিন্তু আমি এখানে একা রয়েছি , আসতেও পারবে না, পরিস্থিতি নিজে চোখে দেখতে পাবে না , কি ভেবে বসবে । মারাত্মক টেনশনে পড়ে যাবে হয়তো । না না , তা করা যাবে না । সাধের চাকরিটা কি তবে আমায় খোয়াতেই হবে ?
টগরের অবস্থাও তথৈবচ । সেও রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে।
আর আমাকে বলছে, কি হবে দিদি , উরা যদি ঘরের ভিতর ঢুকা ভাঙা ফুটা করে? কি করবা তখন !

আর কি করবা ! আমি মরছি নিজের জ্বালায় ।

ঠিক এই সময়, সেখানে একজনের আগমন ঘটলো । দেখলাম, বাংলোর গেট পেরিয়ে তিনি ঢুকে আসছেন । মাথাটা এতটাই গুলিয়ে ছিল যে, সামনাসামনি দেখেও যেন ঠিক চিনতে পারছিলাম না। একেবারে সামনে এসে পড়তে দেখলাম- ইন্দ্রাশিষ বাবু ।
উনি এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি একটা ঝামেলায় খবর পেয়ে এলাম । ছোট্ট করে আমাকে বলে দিন তো, ওদের বক্তব্য কি ।
কয়েকটা ঢোঁক গিলে শুকনো গলায় বললাম যাহোক দু’ চার লাইনে কি হয়েছে ।
উনি বললেন, আপনি একটু ঠান্ডা হয় বারান্দায় এখানে বসুন । বাইরে আসতে হবে না । আমি দেখছি, ওদের সাথে কথা বলছি।
বলে উনি বেরিয়ে গেলেন । সরাসরি বিক্ষুব্ধ জনতার মাঝে গিয়ে দাঁড়ালেন । আমি শংকিত দুরুদুরু বুকে সেদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। কোন আশার আলো কি দেখার আছে? বিশেষ ভরসা পেলাম না। বেশ কিছুক্ষণ কথা চলল ওনার সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতার । আমি কিছু বিশেষ শুনতে পাচ্ছিলাম না । শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম । ধীরে ধীরে যেন উত্তেজনা কমতে লাগল তাদের মধ্যে । তারপর চিৎকার-চেঁচামেচি বন্ধ হয়ে গিয়ে দলটির মধ্যে বিশেষ কয়েকজনের সঙ্গে ওনার আলোচনা চলতে লাগলো । তাও প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট হবে । তারপর ধীরে ধীরে এক এক করে তারা সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো । মিনিট সাত আট পরে মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গেল । সেখানে শুধু বিক্ষিপ্তভাবে দু একটা দল করে তিন-চারজন মিলে আলোচনা করছিল, তারাও মিনিট দশেকের মধ্যে চলে গেল।
তিনি ফিরে এলেন আমার কাছে । বললেন , ওরা চলে গেছে। আমি ওদের যা বলার বলেছি । আপনি চিন্তা করবেন না । আজকের দিনটা রিল্যাক্সড থাকুন । ছোটাছুটি করার, অফিশিয়াল কোন কাজ করার দরকার নেই । একটা ছুটি নিয়ে নিন । আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি ভীষণ ঘাবড়ে গেছেন । ঘুমটাও রাতে তেমন জুতসই হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
আমি জড়ানো গলায় বললাম, ওদের .. ওদের কি বললেন?
— সে যা বলার বলেছি। তবে আপনার চিন্তার কোন কারণ নেই। এবেলা আর কোথাও বেরোবেন না । প্রয়োজন হলে বিকেলে না হয় একবার গিয়ে হাসপাতালে দেখে আসবেন রবিকে । তবে চিন্তার কোন কারণ নেই, তার যা কন্ডিশন, তাতে করে মারা সে যাবে না । এটুকু আপনাকে বলতে পারি ।
আরো দু-চারটে কথা বলে স্ট্রিক্টলি আমাকে বাড়িতে থেকে সেই বেলাটা রেস্ট নিতে বলে তিনি চলে গেলেন । আমারও সত্যি কথা বলতে কি , শারীরিক-মানসিক কোন জোরই ছিল না সেদিন অফিসে বেরোনোর মতন বা ফিল্ড ওয়ার্ক করার মতন। শিশিরকে ডেকে পাঠিয়ে মোটামুটি সবটা বুঝিয়ে দিয়ে এসে নিজের দক্ষিণ খোলা বেডরুমটার বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম । বিশ্বজোড়া সমস্ত ক্লান্তি যেন চেপে ধরেছে আমায়। হাই উঠছে তবু ঘুম আসছে না । সময় যেন কাটতে চায় না । এইরকম একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটে যাবে আর তাতে আমি এভাবে জড়িয়ে যাব দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি । মাথা যেন অবশ হয়ে যেতে চাইছে । তবু তারই মধ্যে অস্থির ভাবে বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে বেলা গড়িয়ে চলে । আর মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে ইন্দ্রাশিষ বাবুর মুখটা । তিনি এ অঞ্চলের একজন সত্যি করে মানবিক ডাক্তার । মানবিক না হলে পাঁচ টাকা করে ফিজ নিয়ে রোগী দেখা সম্ভব নয়, এক কথায় বলতে গেলে তিনি ফ্রিতে সেবা করে থাকেন মানুষের । মানুষটা যেমন একটি নোবেল প্রফেশনে রয়েছেন, সেই প্রফেশন এর মাধ্যমে সত্যি করে মানুষের কাছে গেছেন । তাদের দুঃখ-যন্ত্রণায় সামিল হয়েছেন। ভালোবেসেছেন, অনুভব করেছেন , বলেই এভাবে মানুষগুলোর সেবা করে চলেছেন । এইরকম ছন্নছাড়া কিছু চরিত্র মাঝে মাঝে দেখা যায় । আজকে আমি প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম , এখানকার মানুষগুলোর কাছে তিনি সত্যি করেই দেবতা । তাঁর পক্ষেই একমাত্র সম্ভব হলো এভাবে বিক্ষুব্ধ জনতাকে শুধু কিছুক্ষণের আলোচনার পর ফেরত পাঠানো । সত্যিই আমি আজকে নতুন ভাবে তাঁকে আবিস্কার করলাম । মানুষটা এত সাদাসিদে, অথচ ঠিক আমার চরম সংকটের মুহূর্তে কোথা থেকে খবর পেয়ে এলেন কে জানে ! যেন ঠিক দেবদূতের মত ! কৃতজ্ঞতা । হ্যাঁ, পরম কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল আমার দেহ মন । তার সাথে অদ্ভুত একটা অনুভুতি হল আমার । মনে হল যেন, এখানে আমার সত্যিকারে নির্ভর করার মত একজন মানুষ আমার কাছাকাছি রয়েছেন । আমি যে কোন বিপদে আপদে , যেকোনো প্রয়োজনে একবার তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারলে হয়তো কিছু না কিছু একটা উপায় ঠিক হবে । তাঁর এই যে কয়েকটা কথায় কিছু মানুষকে বশ করার ক্ষমতা, এ কিন্তু তাঁর একদিনে হুট করে অর্জিত ক্ষমতা নয় । এর জন্য তাঁর বিপুল শ্রম রয়েছে । ভালোবাসা রয়েছে । যত্ন রয়েছে । বছরের পর বছর ধরে তিনি এই মানুষগুলোর মন জয় করেছেন । তারা আর সকলের কথা ফেলতে পারে, অবিশ্বাস করতে পারে , ডাক্তারবাবুর কথা কখনো নয় । তাছাড়া তাঁর সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা আমার মনে প্রথমদিন থেকেই তৈরি হয়েছিল । হতে পারে তিনি মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন , তবে তাঁর দায়িত্ববোধ বলে কিছু নেই । না হলে , তাঁর নিজের মেয়ে ওইভাবে ক্ষ্যাপার মতো সন্ধ্যেবেলা বাড়ি থেকে দূরে চা-বাগানে অন্ধকারের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় না । কিন্তু সে ধারনাও আমার যেন কিছুটা টলে গেল । দায়িত্ববোধ তাঁর রয়েছে । প্রয়োজনের চেয়ে বরঞ্চ বেশি রয়েছে । এই পরিস্থিতিতে তাঁকে যে আমার কাছে আসতে হবে, এ কথাটা কিন্তু কেউই আর তাঁকে বলে দেয়নি । তবু তিনি এসেছেন । সাংসারিক বুদ্ধি-বিবেচনা প্রত্যেকের সমান থাকে না । ওনার হয়তো সেইটি অনুপস্থিত । তবে দায়িত্ববোধ নেই , এই কথাটা বোধহয় ঠিক নয়।

বিকেলবেলা গেলাম হাসপাতালে । রবির সাথে দেখা হল । সে আমার সঙ্গে দু-একটা কথাও বলল । সেখানে ডাক্তারদের সাথে কথা বলতে, ওনারা যা বললেন সেটা ইন্দ্রাশিষ বাবুর কথার সঙ্গে মিলেই গেল দেখলাম । প্রাণ সংশয় নেই যে, এ কথাটা বললেন তাঁরা । একটু হলেও নিশ্চিন্ত হলাম । যদিও চাপা টেনশনটা রয়েই গেল ।

তারপর দিন ছয়েক কেটে গেছে। রবি এখন কিছুটা সুস্থ । যদিও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। আগামী আরো কয়েকটা দিন থাকবে । যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, খুবই একটা ম্যাজিকাল প্রসেসে যেনো সেটা সেরকম কোন এফেক্ট ফেলতে পারল না । আমি রবিদের বাড়ি গিয়েছিলাম । তাদের ছোট বসতিটি আমার বাংলো থেকে মিনিট পঞ্চাশেক গাড়িতে করে যেতে হয়। বাড়িতে তার ছোট ছোট দুটো ছেলে-মেয়ে , বউ , বাবা-মা , এক বিধবা বোন । এ ক’দিনে আমি প্রায় প্রতিদিন গেছি তাদের বাড়ি। না ভোট চাওয়ার মত করে মেকি নমস্কার করে দাঁড়ানোর জন্য নয়, আর ঝঞ্ঝাটে পড়ে যাওয়ার কারনেও নয় । আমি আন্তরিকভাবে গেছি । ভালোবেসে গেছি । তাদের অসহায়তায় সহমর্মিতা অনুভব করেই গেছি । হয়তো প্রথমটায় যেতে হয়েছিল বাধ্য হয়েই। কিন্তু, তারপরে একটা সহজ আন্তরিকতা আমাকে নিয়ে গেছে। ভবিষ্যতেও যাবে , আমি জানি । আশেপাশের বাড়ির মানুষগুলোর সাথেও আলাপ পরিচয় হয়েছে। এই বসতিটির মধ্যে পাঁচ-ছ’টা বাড়ি থেকে আমার টি এস্টেটে এরা কাজ করতে যায় । অতর্কিত বাঘের আক্রমণ এবং তারপরে তাদের প্রতিবেশীর এইভাবে গুরুতর জখম হওয়ায় তারা খুবই বিহ্বল হয়ে পড়েছিল এবং বিক্ষোভে শামিল হয়েছিল । তবে কেন জানি না, আমি প্রতিদিন তাদের কাছে আসার জন্যই বা হয়তো আমার মধ্যে আন্তরিকতা কিছু বুঝে থাকলেও এরা থাকতে পারে। আমাকে সামনাসামনি এত কাছাকাছি দেখার পর, আমার সাথে কথা বলার পর, তাদের মনোভাব অল্প অল্প করে পরিবর্তন হতে লাগলো । তাদের আর্থিক সাহায্য বা চিকিৎসার দায় দায়িত্ব নেওয়া , সেটা বড় কথা নয় । সেটা তো এই পরিস্থিতিতে যে কেউ করতে বাধ্য তবে । তাদের জীবনযাত্রার এই প্রত্যক্ষ দলিলপত্র আমাকে সহজ করে তুলছিল তাদের কাছে । আমার কাছেও তারা অনেক সহজ হয়ে উঠেছিল । চা পাতার ঝুড়ি কাঁধে নিরন্তর বয়ে চলা জীবনের অংশটুকুর পরেও তাদের যে সাংসারিক জীবন , সেই জীবনের চিত্রপট আমাকে কোথাও নাড়া দিয়েছিল । এই কয়েক মাসে জোর করে নিজের ওপর যে কঠিন একটা আবরণ তৈরি করে আমি এই মানুষগুলোর সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি করেছিলাম ,কাজের সম্পর্কটাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল যেখানে, সেখান থেকে বেরিয়ে নতুন করে আবার একটা সহজ সম্পর্কের সূত্র খুলে গেল।

তবে এই সমস্ত কিছুর ফাঁকে ফাঁকেই এই কটা দিন যেন আমি কোথাও একজন মানুষের আসার অপেক্ষা করেছি । মানুষটি আর কেউ নন, ইন্দ্রাশিষ গাঙ্গুলী । কেন করেছি জানিনা । তবে করেছি । আরো অদ্ভুতের কান্ড , মনে কিছুটা অভিমান জমা হয়েছে। মানুষটা সেই যে সেই সংকটের সময় এলো , তারপরে আর একবারও আমার বাংলোর দিকে পা বাড়ানোর সময় হলো না ? এইরকম একটা অবস্থায় তিনি আমাকে শেষ দেখে গেছেন, অথচ এ ক’দিনে একবারও মনে হলো না আমার কাছে এসে একবার আমার সঙ্গে দেখা করে যাওয়াটা প্রয়োজন । আবার এটা ভেবে সত্যিই অবাক হয়েছি, অভিমান ব্যাপারটা খুব সূক্ষ্ম এটা অনুভূতি, সেটা কি এতোখানি স্বল্প পরিচিত একজন মানুষের প্রতি আসে ? আসা কি উচিত বা কোনোভাবেই কি আসার জায়গাটা তৈরি হয়েছে ? তবুও কেন জানি না, ওই সূক্ষ্ম অভিমানটুকু রয়েই গেল আমার এ কটা দিন ।

সেদিন অফিস থেকে ফিরে এসেছিলাম একটু তাড়াতাড়ি । ফিরে এসে বাংলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় জায়গা যেটা আমার, সেই লনে একটা আরামকেদারা গোছের বেতের চেয়ার নিয়ে অলস ভঙ্গিতে বসেছিলাম । কিছুই করছিলাম না । আকাশের দিকে চোখ তুলে কি ভাবছিলাম জানিনা । ফড়িংগুলো ঝাঁক বেঁধে ওড়াউড়ি করছিল । কখনো আবার চোখ নামিয়ে সেই চিরাচরিত চা বাগান দেখছিলাম। গত একটা দুটো দিন মনটা কিছুটা ক্লান্ত হয়ে উঠেছে । অশান্ত ঝড় বয়ে যাওয়ার পরে চারিদিকে যেমন শান্ত হয়ে যায় , তেমনই আর কি ।

হঠাৎ করে পরিচিত একটা গলার আওয়াজ পেলাম, কি ভাবছেন ? এই তো দেখছি আজকে বেশ ফ্রেশ লাগছে ।

আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে দেখলাম , গেট পেরিয়ে লনের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার দিকে আসছেন ইন্দ্রাশিষ বাবু ।
উনি আমার কাছে এসে হাসি হাসি মুখে তাকালেন । কয়েক মুহূর্ত আমি ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ।
তারপরেই কেমন ভাবে জানিনা আমার ভেতরের সেই সূক্ষ্ম অভিমান বোধ কথা বলে উঠলো ।
বললাম , এতদিনে বুঝি আমাকে ফ্রেশ লাগছে , কি কেমন লাগছে, দেখতে আসার সময় হল আপনার?

ক্রমশ..