হলদে প্রজাপতি পর্ব-২২+২৩

0
180

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

বাইশ

উনি বোধ হয় আমার এহেন অভিযোগে একটু অবাক হলেন । আমার কাছ থেকে হঠাৎ করে এমন অভিযোগ উনি আশা করেননি ।
বললেন , একচুয়ালি আমার সিডিউলটা তো আপনার ঠিক জানা নেই। আমার পক্ষে সময় বার করা খুবই মুস্কিল বুঝলেন কিনা।
কথাটা বলে ফেলেই আমার মনে হয়েছিল, কথাটা বলা আমার একেবারেই উচিত হলো না । কোথায় আমার তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানানোর কথা। তার জায়গায় আমি কি করলাম? না অভিযোগ করে বসলাম।
কোনরকমে মুখটাকে একটু হাসি হাসি করে বললাম, আসলে হয়তো আমারই আপনার কাছে যাওয়া উচিত ছিল । কৃতজ্ঞতা জানানোটা আমার জন্য এসেন্সিয়াল ছিল বটে ।
— কৃতজ্ঞতা ! কিসের কৃতজ্ঞতা ?
আমি বললাম , এখানে কি বসবেন, নাকি-
উনি এক সেকেন্ড ভাবলেন । তারপর অল্প হেসে বললেন, আজ চলুন বরঞ্চ ছাদে গিয়ে কথা বলা যাক । আপনার বাংলোর ছাদ থেকে আপনার জমিদারীটা কেমন লাগছে দেখাও হবে ।
তাঁর কথার ধরনে হেসে ফেললাম । বললাম , জমিদারিই বটে-
— হ্যাঁ তা জমিদারি বটে তো ! আমরা সবাই আপনার প্রজা ।
— আসুন ।
ছাদের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মুখে তাঁকে একবার বললাম , চেয়ার নিয়ে যাব কি ? টগরকে আনতে বলবো ?
— না না , দরকার নেই । ঘুরতে ঘুরতে, ছাদের কার্নিশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে না হয় গল্প করা যাবে।
— আচ্ছা, সেই ভাল । আসুন –
ছাদে ওঠার আগে তাঁর চোখ পড়ল আমার ঠাকুরঘরের দিকে । তিনি প্রশ্ন করলেন, ঢুকে দেখতে পারি ?
— একদম ।
তিনি ঝুঁকে পড়ে ভালো করে আমার ঠাকুরকে দেখে বললেন, বাঃ, এ যে খুব সুন্দর পূজার আয়োজন আপনার । মা যশোদার কোলে ছোট্ট গোপাল । ভারি সুন্দর তো ।
বললাম , পুজো খুব একটা পান না আমার ঠাকুর। তবে তিনি থাকেন ।
তিনি বললেন , তিনি যে থাকেন, সেটাই বড় কথা । মানসিকভাবে আপনি রাখেন তাঁকে । তাই তিনি থাকেন । ফুল বেলপাতা দিয়ে পুজো সব সময় নাই বা পেলেন।

এই সময়টা আমার ফ্রি থাকলে আমি লনে চেয়ার নিয়ে বসে থাকি , আশেপাশে হয়তো একটু ঘোরাঘুরি করি , কখনো ছাদে উঠি না । আজকে ছাদে উঠে বেশ ভালো লাগলো । পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে সূর্য । প্রায় ডুবু ডুবু । কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুপ করে বিদায় নেবে। দিনের শেষের লাল আলোটুকু ছড়িয়ে দিচ্ছে । সন্ধ্যারাগ পেয়ে বসেছে পশ্চিম আকাশটাকে । হালকা নরম আলোয় ভরে গেছে চারিদিক । কনে দেখা আলো বলে নাকি একে ! কথাটা মনে হতেই মনে মনে হাসি পেল। কনেই হলাম না, তার আবার কনে দেখা ! পশ্চিম দিকটা আমার লন থেকে একদমই দেখা যায় না । এটা আমার বাংলোর পেছন দিক । ছাদে উঠে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখে মন ভরে উঠলো । জারুল গাছটা এদিকে আমার ছাদের ওপর ঝুঁকে পড়ে ঝাঁপিয়ে ফুল দিয়েছে । হালকা বেগুনি রঙের থোকা থোকা ফুলে ভর্তি । সব মিলিয়ে বেশ সুন্দর তো । জারুল গাছের ফুলের থোকাগুলোর ওপরে নরম লাল সূর্যের আলো পড়েছে । ভারী সুন্দর লাগছে। আমি আনমনে একটা জারুলের থোকা হাতে নিয়ে মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম ।
কানে গেল ইন্দ্রাশিষ বাবু বলছেন, বাহ্ ভারী সুন্দর –
আমি ফুলের থোকাটার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললাম, সত্যি ভারী সুন্দর সব মিলিয়ে।
উনি বললেন, আপনি যাকে সুন্দর বলছেন, আমি তাকে সুন্দর বলিনি ।
অবাক হয়ে তাকালাম তাঁর দিকে, মানে ?
— আমি আপনাকে বলেছি , ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে !
আমার কেমন যেন একটা চমক লাগলো। আমি চমকে উঠে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম । সেখানে যে কোনো কৃত্রিমতা নেই , একবারে নিখাদ একটা কনফেশন এর ছবি লেগে রয়েছে তাঁর মুখে । তাঁর মুখ সাক্ষ্য দিচ্ছে তাঁর কথার সত্যতা । আমাকে সুন্দর লাগছে ! তাও আবার ভারী সুন্দর ! এ কিভাবে সম্ভব ? কুৎসিত আমি নই । অসুন্দরও না । তবে সুন্দর কোন ভাবেই নই। সুন্দরী মেয়েদের একটা সম্পূর্ণ অন্য ধাঁচ থাকে । আমি সেই ধাঁচে একেবারে কোনভাবেই পড়ি না । তাই আজ পর্যন্ত জগতে আমায় কেউ কখনো সুন্দরী বলেওনি । আজকে এত বছরেও না । বাবা মাঝে মাঝে বলেছে বটে । পুজোয় বাবার দেওয়া নতুন জামাটা পরে যখন বাবাকে দেখাতে যাই প্রতিবার , বাবা বলে, আমার তরু মা’কে কি সুন্দর লাগছে ! কিন্তু অনাত্মীয় কোন পুরুষ আজ এত বছরেও এত সহজ সুন্দরভাবে কখনো বলেনি। ফ্লার্ট করার প্রয়োজনে দু একজন বলেছে বটে, তবে সেই সুর শুনলে বোঝা যায়। সোনু দা ? না সোনু দা’ও কখনো আমাকে সুন্দর দেখতে বলে নি। বরঞ্চ, এটা এমনটা হলে ভালো হতো, ওটা তেমনটা হলে ভালো হতো – এইসব অভাব অভিযোগ জানিয়েছে । কই কখনো তো সুন্দর বলেনি আমায় ? এই তুলনামূলক চিত্র যখনই আমার মনে ফুটে উঠল, তখনই আমি ভীষণ রকম অবাক হলাম । একী! আমি হঠাৎ করে কোথাও কিছু নেই, সোনু দা’র সঙ্গে ইন্দ্রাশিষ বাবুর তুলনা করছি কিভাবে? সোনু দা আমার ভালোবাসা । কিন্তু এনার সঙ্গে তো আমার তেমন কোনো -? তাহলে হঠাৎ কেন আমার মন এইভাবে তুলনা করে বসলো! এসব তো ভালো না ।
আমি চুপ করে আছি দেখে তিনি বললেন, কি হলো, কিছু ভুল বলে ফেললাম কি?
আমি বললাম , কিসের ভুল ?
— না মানে, চুপ করে রয়েছেন , অফেন্ডেড হলেন কিনা বুঝতে পারছিনা ।
হেসে বললাম , তাই কি হতে পারে? কোন মহিলাকে সুন্দর লাগছে বললে সে কি কখনো অফেন্ডেড হতে পারে ? এই কম্প্লিমেন্টস তো মেয়েদের খুব পছন্দের ।
উনি অল্প হেসে প্যান্টের দুটো পকেটে হাত চালান করে বললেন , একচুয়ালি সত্যিই খুব সুন্দর লাগছে আপনাকে । এই নরম সূর্যের আলো, তার মাঝে আপনি ওই বেগুনি ফুলের গোছাটা হাতে করে দাঁড়িয়ে – সত্যিই খুব সুন্দর । আমার কোন রস-কস নেই তো , ছবি তুলতে পারি না, বুঝলেন কিনা ? যেকোনো ভালো ফটোগ্রাফার হলে আপনার ফটাস্ করে একটা ছবি ঠিক তুলে রাখতো। খুব সুন্দর উঠতো ছবিটা, সেটা কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিতে পারি।
আমি অল্প হেসে বললাম , ছবি তুলতে পারেন, কি পারেন না জানি না । তবে রস-কস একদম নেই, সে কথা কিন্তু ঠিক নয় ।
— বলছেন ?
বলে একটা প্রাণ খোলা হাসি হেসে উঠলেন তিনি।
জারুলের ডাল ছেড়ে ছাদের কার্নিশে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম। একঝলক দেখলাম তাঁর দিকে । তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন হাসি হাসি মুখে । একটা খুব ক্যাজুয়াল টি-শার্ট আর প্যান্ট , চুলটা এলোমেলো , মুখটা হাসি হাসি । এই ভঙ্গিমাতেই প্রায় প্রতিবার আমি তাঁকে দেখি। মানুষটার মধ্যে হয়তো সবচেয়ে বড় আকর্ষণ তাঁর সহজতা। উনি আমার সামনাসামনি কোণের কার্নিশটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাত দুটোকে পিছনের কার্নিশের ওপর রেখে ভর করে দাঁড়ালেন , শরীরটাকে অল্প হেলিয়ে ।
বললেন , তারপর বলুন –
বললাম , আপনার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আছে।
কৌতুক খেলা করে উঠলো তাঁর মুখে। বললেন, তাই নাকি? নিজের অজান্তেই করেছি তবে । তা কিরকম ষড়যন্ত্র শুনি?
— আপনি পাতা’কে আর পাঠাচ্ছেন না আমার কাছে –
— এ তো গুরুতর অভিযোগ দেখছি । আসলে পাঠাইনি আপনি কিরকম মানসিক অবস্থায় রয়েছেন সেটা বুঝতে পারছিলাম না, তাই ।
— বা রে, আপনি বুঝি এতদিনেও জানেন না যে পাতা আমার কাছে এলে পাতার আর আমার দুজনের মনই ভালো হয়ে যায় ?
— পাতার ভালো হয় জানি । আপনারও যে হয় সেটা জানলাম ।
— সে আবার কি ? আপনি কি বলতে চাইছেন, পাতার মণি এতটাই কিপটে যে সে পাতাকে এতদিনে এইটুকু ভালোও বাসেনি ?
আমার এই কথাটা শুনে তিনি যেন কেমন উদাস হয়ে গেলেন । মুখটা নামিয়ে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
তারপর মুখ তুলে বললেন, পাতার ভাগ্য ভালো –
— এমন কথা কেন বলছেন ?
— কারণ আছে বৈকি । একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন বাবা পেয়েছে । সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ায়, মেয়ের দিকে যার কোন খেয়াল নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু ঠাকুমা। সেই ঠাকুমার ইচ্ছা থাকলেও ক্ষমতা নেই । আর মা তো-
কথা বলে চলার বেগে তিনি আরও কিছু যেন বলে ফেলছিলেন, হঠাৎ করে নিজের খেয়াল পড়তে থমকে গেলেন।
আমিও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইলাম। তবে কথা যখন বললাম, তখন নিজেই অবাক হয়ে গেলাম । কারণ, ঠিক সেই প্রসঙ্গেই কথা বলে ফেললাম । এটা কি শুধুই নারীজাতির কৌতুহল ঘটিত, নাকি অন্য কোনো কারণও ছিল কে জানে!
বললাম , আমি টগরের কাছে শুনেছি আপনার স্ত্রী নাকি-
কিন্তু তারপরে আর কি বলবো ভেবে না পেয়ে চুপ করে গেলাম ।
তিনি বললেন, হ্যাঁ যা শুনেছেন ঠিকই শুনেছেন । পাতার মা পাতাকে ছেড়ে চলে গেছে ।
— মানে তিনি কি- ?
— হ্যাঁ, আপনার এত ইতস্তত করার কিছু নেই । অনিতা, আমার এক্স ওয়াইফ, সে আমাকে ছেড়ে অন্য আরেকজনের সঙ্গে ঘর করতে গেছে।
— কিন্তু .. এমন হঠাৎ.. মানে না .. এমনি আর কি.. যাক গে বাদ দিন ..
অল্প হেসে তিনি সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন , না না বাদ দেওয়ার কিছু নেই। আর দেখুন এই প্রশ্নগুলো আমাকে কমবেশি সকলেই করেন । আই নেভার মাইন্ড। একজন মানুষ, তার আমার সাথে ঘর করতে ইচ্ছা হয় নি। অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট । তার অন্য একজনকে পছন্দ হয়েছে । সে তার সাথে চলে গেছে ।
বললাম , তিনি কি.. মানে আপনি .. ইয়ে .. মানে আপনাদের কি..
উনি বললেন, হ্যাঁ ডিভোর্সটা আমাদের হয়ে গেছে । এটাই কি জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলেন আপনি ? সেটা তাকে খুঁজে পেতে বার করে একরকম জোর করেই করতে হয়েছে , বলতে পারেন । তাও আজ বছর তিনেক হয়ে গেল। তবে সে তার মেয়েকে যখন ছেড়ে গিয়েছিল, তখন পাতা মাত্র বছর খানেকের মেয়ে । আমি সরকারি হেল্থ ডিপার্টমেন্টের ডাক্তার তো, বলতে পারেন নিজের গরজেই জোর করে একরকম ডিভোর্সটা করা । কোন লিগাল ঝামেলায় জড়িয়ে গেলে আমার তো প্রবলেম না ? তবে মিউচুয়াল ডিভোর্স পেতে অসুবিধা হয়নি । যেহেতু সে ছেড়ে গিয়েছিল, আর আমি তার আগেন্সটে কোন আ্যলিগেশন আনিনি । তারও কোনো অভিযোগ ছিল না অবশ্য। প্লেন আ্যন্ড সিম্পল ছিল ।
— তাহলে তো অনেক বছর হয়ে গেছে ?
— হ্যাঁ ।
— শুনেছি নাকি পাতার মা খুব সুন্দরী । পাতার মুখ দেখে অবশ্য বোঝা যায় , পানপাতার মতো ওর মুখটা ।
তিনি হেসে বললেন, সকলের চোখে সকলে সুন্দর হয় না । তবে হ্যাঁ, মেয়ে আমার সুন্দরী তো বটেই । একেবারে রাজকন্যা ।
আমিও হেসে উত্তর দিলাম, মেয়েরা তো সব বাবার কাছেই রাজকন্যা । আমি আজকে এই বয়সে এসেও আমার বাবার কাছে রাজকন্যা। তবে আপনার মেয়ে সত্যি করেই রাজকন্যা ।
হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন ঠোঁটের ডগায় চলে এলো আর আমি সেটা করেও ফেললাম । করে ফেলেই অবশ্য নিজে লজ্জিত হলাম মনে মনে । কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই । প্রশ্ন করা হয়ে গেছে ।
বললাম , তারপরে আপনি বিয়ে করেন নি কেন ?
উনি হেসে ফেললেন । বললেন , এ আপনার ভারী অন্যায় । নিজে যে কাজটা একবারও করেননি , সেটা অন্যকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন দু বার তিন বার করে করা হয়নি ?
— তিনবার তো বলিনি । সেকেন্ড টাইম এর কথাই বলেছিলাম । আমার কথা বাদ দিন । আমি তো সেটা করিইনি । কিন্তু , আপনি তো করেছিলেন । আর সেটা করার জন্যই তো পাতা এসেছে পৃথিবীতে । আপনি ওর বাবা, অথচ মেয়েটাকে মনের মতো করে মানুষ করার জন্য সেভাবে সময় দিতে পারেন কি ?
উনি আস্তে আস্তে কেটে কেটে বললেন , অভিযোগটা আপনার সঠিক । আমি মানতে বাধ্য, মেয়েটাকে আমি কিছুই দেখাশোনা করতে পারিনা । রোগী দেখে বেড়ানো আমার একটা নেশা । আমার বাড়ির দরজা সারারাত রোগীর জন্য খোলা থাকে। যে কোন সময় কোন অসুস্থ মানুষ এলে আমি কখনোই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারি না, জানেন তো ? ওই যে বললাম, নেশা ! তবে আমার মেয়েকে আমি ঠিকঠাক দেখাশোনা করতে পারছি না বলে তাকে দেখাশোনা করার জন্য বাড়িতে একজন মানুষকে নিয়ে আসা- এই প্রয়োজনে কি কাউকে বিয়ে করা উচিত ? আপনার কি মনে হয় বলুন –
— শুনেছি নাকি , অমনি ঘর করতে করতে দুজন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা হয়ে যায় ।
— সে ভালোবাসা হবে কি হবে না, সেটা ভবিষ্যতের কথা । কিন্তু প্রয়োজনীয়তাটা তো মন থেকে অনুভব করতে হবে। আর সেই প্রয়োজনীয়তা কি কখনো শুধু পাতাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন মানুষ চাই- এইটা হতে পারে? এইরকম ভাবনা-চিন্তা করে একজন মানুষকে বিয়ে করলে সেটা কি তাকে অশ্রদ্ধা করা হয় না? কি মনে হয় আপনার ?
অল্পক্ষণ চুপ করে থাকে আবার তিনি বললেন , তাছাড়া ডাক্তারদের সব মানিয়ে গুছিয়ে উঠে জীবন শুরু করতেই বেশ অনেকটা টাইম লেগে যায় । আমিও বিয়ে করেছিলাম তিরিশ বেরোনোর পরে । তারপর ক’বছর আর পাতার মা ছিল ? বছর তিনেক হবে । আর আজকে এতগুলো বছর পরে আর এসব ভাবতে ভালো লাগে না ।
আমি একথার সহসা কোনো উত্তর দিতে পারলাম না । বেশ অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকালাম । এই মানুষটা ওপরে ওপরে দেখতে যত সাদাসিধেই হোক না কেন , মনটা বড় গভীর । যেকোনো বিষয়ে বড় গভীর ভাবনা চিন্তা । ফিলোজফি খুব স্ট্রং । জীবন সম্পর্কে যেভাবে তিনি ভাবেন, আমরা হয়তো সচরাচর ভাবতে পারিনা । সত্যি মানুষটার মধ্যে শ্রদ্ধা করার মত অনেক গুণ রয়েছে বটে । চুপ করে রইলাম , তাঁর কথার কোন উত্তর দিলাম না । তিনিও চুপ করে রইলেন । দুজনই চুপ । অস্তাচলগামী সূর্য কিন্তু চুপ করে বসে নেই । শেষ রক্তিমাভাটুকু ছড়িয়ে দিতে দিতে প্রায় বেশিরভাগ অংশটা ডুবে গেছে । যেটুকু জেগে রয়েছে , সেটুকু ডুবে গিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসবে ।
কিছুক্ষণ পরে উনি কথা বললেন ।
বললেন , এই টি এস্টেট এর মালিকদের কাছে খবর গেছে নাকি ? তারা কিছু বলছেন ?
— খবর তো গেছে । তবে ওনারা এটাকে নিয়ে বিশেষ ঘাঁটাঘাঁটি কিছু করেননি । আমার কাছ থেকে ছোট করে ব্যাপারটার কিরকম নিষ্পত্তি হয়েছে শুনে নিয়ে চুপচাপ আছেন । আসলে যে কোন ঝামেলাই তো মিটে যাওয়ার মধ্যে স্বস্তি না ? সেটাকে আবার কে খুঁড়ে খুঁড়ে জিইয়ে রাখতে চায় বলুন ?
— সে কথা ঠিক । তবে ব্যাপারটা সত্যি করেই অনেক দূর গড়াতে পারত । তেমনটা যে হলোনা , সেটা শুধুই আপনার কারণে। সত্যিই সে দিনের সকালটা ভাবলে এখনো আমার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে । আসলে যত যাই বলি, আফটার অল তো একটা প্রাইভেট চাকরি না ? হয়তো ভালো লাগে শুনতে, গালভরা নাম- ম্যানেজারের পোস্ট। আসলে তো সেই ভয়ে জুজু হয়ে থাকা । যদি কিছু বেগড়বাই হয়, এখনই গেল চাকরি। সরকারি চাকরির মত তো আর মজাদার হয়না ।
— সরকারি চাকরি মজাদার হয়তো সবক্ষেত্রে নয় । তবে চাকরি যাওয়া নিয়ে টেনশন করতে হয় না , সেই আর কি।
— কি আর করা যাবে বলুন ? সবার কপালে তো আর সরকারি চাকরি থাকেনা । সে সুখ ভোগও থাকে না ।
উনি হঠাৎ করেই জিজ্ঞাসা করলেন , আচ্ছা আপনি নিশ্চয়ই বেটার অপশন খুঁজবেন ? এখানে এই ধ্যাধ্যারে গোবিন্দপুরে নিশ্চয়ই ভালো লাগছেনা ?
— কে বলেছে ভালো লাগছেনা ? ভালো না লাগলে আমি আসতাম এখানে ? একটাই শুধু চিন্তা হয়, বাবা মাকে নিয়ে আসতে পারিনি । যেকোনো ধরনের ট্রিটমেন্ট এর বিশেষ সুবিধা নেই তো , তাই । ওইটুকুই যা । তবে আমি এখানে খুব ভালো আছি ।
— তবে কি আপনি এই চাকরিতে থাকবেন ভাবছেন?
তাঁর গলার মধ্যে একটা উৎসুক ভাব রয়েছে।
আমি অল্প হেসে বললাম , সবই ভগবানের দয়া বুঝলেন ? এক্ষেত্রে ভগবান তো মালিক পক্ষ , বুঝতেই পারছেন । তাদের দয়া হলে থাকবো।
আবার দুজনে কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম । সূর্য ডুবে গেছে ।
আমি বললাম , আজকে কিন্তু আপনাকে কিছু খাওয়ানো হলো না । নিচে চলুন বরঞ্চ জমিয়ে চা আর স্ন্যাক্স খাওয়া যাবে । টগর খুব সুন্দর পকোড়া ভাজে।
— আজকে না। আজকে প্লিজ না ।
তিনি কব্জিটা উল্টে রিস্টওয়াচ দেখলেন। বললেন, আজকে আমাকে এক্ষুনি বেরোতে হবে । আপনার সাথে কথায় কথায় খেয়াল ছিল না । একটু দেরি হয়ে গেছে ।
— সেকি ? এক কাপ চা’ও না খেয়ে চলে যাবেন ?
— আমি কথা দিচ্ছি, খুব শীগ্রি আসবো আর আপনার সাথে বসে চা খাব । একদম পাক্কা । কিন্তু আজকে আমাকে যেতেই হবে ।
— তাহলে আর কি বলব বলুন? তবে কাল থেকে কিন্তু পাতাকে পাঠিয়ে দিতে হবে । তা না হলে পাতার বাবার কিন্তু এখানে চা’ও জুটবে কিনা গ্যারান্টি দিতে পারছিনা ।
— এ বাবা ! এ তো রীতিমতো ব্ল্যাকমেইলিং –
— হ্যাঁ করছি । পাঠিয়ে দেবেন কিন্তু পাতাকে ।
— সে আর বলতে! সে তো এ কদিন আসতে না পেরে তো একবারে হাঁপিয়ে উঠেছে । আসবে, আসবে । কাল নিশ্চয়ই আসবে ।
— অবশ্য আমারও মাঝের কটা দিন ওকে গিয়ে নিয়ে আসা হয় নি । সে দোষটা অবশ্য আমার । সবটা আপনার ঘাড়ে চাপালে চলবে না।
উনি অল্প হেসে ছাদের সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন । আমি নিচে নেমে গেট পর্যন্ত ওনাকে এগিয়ে দিয়ে এসে আবার ছাদে উঠলাম ।

কি যেন বলছিলেন উনি ? তিরিশের পরে বিয়ে করেছেন ? মানে কি একত্রিশ বত্রিশ এরকম হবে ? আচ্ছা যদি তিরিশই ধরা যায় , তারপরে তিন বছর ওনার স্ত্রী ছিলেন ওনার সাথে । তারমানে তেত্রিশ। পাতার বয়স যখন বছরখানেক, তখন তার মা চলে গেছে। এখন পাতার বয়স দশ বছর হবে । মানে থার্টি থ্রি প্লাস এইট বা নাইন । মানে এখন ওনার এজ কত হতে পারে? ফর্টি ওয়ান ফর্টি টু’ এর কম নয় । তার কম কিছুতেই হবে না । মনে মনে এসমস্ত ক্যালকুলেশন করছিলাম । হঠাৎ করে মনটা সজাগ হয়ে উঠতেই চমকে উঠলাম । একী! আমি এসমস্ত কি ভাবছি । ওনার যতই এজ হোক, আমার কি তাতে ? কেন হচ্ছে এসব ? তবে মনের মধ্যে একটু যেন হালকা আমেজের সৃষ্টি হলো । তবে তো ওনার এজ আমার চেয়ে কম না । এইটুকুনি সন্তুষ্টি আমি মন থেকে বাদ দিতে পারলাম না ।
সূর্যাস্তের পর হালকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আবিরের মতো রাঙা পশ্চিমাকাশ বেশ ভাল লাগল আমার চোখে । সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যখন একেবারে সব অন্ধকার হয়ে গেল , তখন আমার মনের মধ্যে আজকে আবার অনেকদিন পর হঠাৎ করে সেই মুচকি হাসি , সেই তাকানো, সেই স্পর্শ , সেই মুখটা ভেসে উঠলো- সোনু দা । অকারণেই আজ আবার আমার জীবনের সেই হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার কথা ভাবতে ইচ্ছা করছে । নিমেষের মধ্যে অনেকগুলো বছর পিছিয়ে গেলাম । চলে গেলাম আমি সেই .. সেই দিনে.. যেদিন আমি সোনু দার ঘরে গিয়েছিলাম .. সেদিন বাংলোয় ম্যানেজার কাকু ছিলেন না .. সোনু দা একাই ছিল..

ক্রমশ..

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

তেইশ

সেই যেদিন সোনুদার কাছ থেকে প্রথম চুম্বনের স্বাদ পেয়েছিলাম , তবে থেকে ওকে আমি অসম্ভব ভয় পেতে শুরু করেছিলাম। ভয় প্রথম দিন থেকেই পাই, তবে তা যেন সেদিনের পর থেকে দশগুণ বেড়ে গিয়েছিল । অসম্ভব বুক ধড়ফড়ানি নিয়ে দিনের প্রতিটা পল কাটাতাম । সেদিনের পরে তিন দিন বিভিন্ন ছুতো ধরে কলেজেই গেলাম না । বাড়ি থেকে বের হতাম না । একেবারে নিজের ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দী করে ফেললাম । আমার দোতলার যে ঘরটা, সেটার আবার মুশকিল হল , তার উত্তর-পূর্বদিকের বড় জানালাটা খুললে কিছুটা দূরে সোজাসুজি ম্যানেজারের বাংলোটা দেখা যায়। আমি ওই জানলাটা বন্ধ করে রেখে দিতাম । কোনোভাবেই যেন না সোনু দা’কে আমি দেখে ফেলি । চোখাচোখি হওয়া তো একেবারে নিষিদ্ধ ! নিজেই মনটাকে কারারুদ্ধ করে রেখে দিতে চাইতাম । সংযম । ঘোরতর সংযম অভ্যাস করে ফেলতে পারলে যদি এই প্রবল আকর্ষণ উপেক্ষা করা যায় । ও যেন ওর সমস্ত মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রয়োগে আমাকে ওর ভরকেন্দ্রের দিকে টানছে । আমাকে নিয়ে একেবারে ওর মধ্যে বিলীন করে ফেলতে চাইছে । আমার অস্তিত্বটুকুর আর কোন স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকবে না । সম্পূর্ণ অস্তিত্বই ওর মধ্যে যেন লীন হয়ে যাবে । ও যেন একটা আস্ত ব্ল্যাকহোল । যার মধ্যে একবার ঢুকে পড়লে চিরকালের মতো হারিয়ে যেতে হবে। তিন দিন পরে ভীষণ দুরু দুরু বুকে কলেজে যাওয়া আরম্ভ করলাম । তবে গাড়ির পিছনে প্রায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকতাম যতক্ষণ না আমাদের বাংলোর কাছাকাছি অঞ্চলটা পেরিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা । কোনভাবেই যেন না ওর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায় । হয়ে গেলেই আমার সর্বনাশ । চরম সর্বনাশ। কিন্তু আমার মন দ্বৈত অনুভূতিতে দুলছিল। আরেকটা যে অনুভূতি , সেও মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইতো । সে বলতো – ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়’…

আমি ক্রমশ শুকিয়ে যেতে লাগলাম । চোখ মুখ শুকনো । চোখের তলায় কালি । মুখ মলিন হয়ে কালচে হয়ে গেছে । খাবারে রুচি নেই । রাতে ঘুম আসতে চায় না । এলেও কিছুক্ষণ পরে ভেঙে যায়। সারা রাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটে । কখনও কখনও বুকের মধ্যে একটা অসম্ভব চাপা কষ্টের অনুভূতি হয় । চোখ দিয়ে নিজের অজান্তে জল বেরিয়ে আসে । বালিশ ভিজে ওঠে । আমি যে কোন শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছি, সে যুদ্ধে জেতা সম্ভব কিনা, তার শেষ কোথায়, কতদিন কিভাবে এই লড়াই চালিয়ে যেতে পারবো, কিছুই জানিনা । কিন্তু এসবের মধ্যেই আমি কোথাও যেন উপলব্ধি করতে পারতাম, সোনু দা আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য কিছুটা রেস্টলেস হয়ে রয়েছে । এই কদিনের মধ্যে আমি একবারও তাকে চোখের দেখা দেখি নি । জোর করেই দেখি নি। তবুও কি করে যে এই উপলব্ধি আমার মধ্যে হলো আমি জানিনা । তবে তা যে একেবারে সঠিক ছিল, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম দিন দশকের মাথায় ।

সেদিন কলেজ থেকে ফিরে বাংলোর সদর দরজা দিয়ে সবে ঢুকেছি, তখনই একতলার ড্রয়িংরুম থেকে একজনের গলার আওয়াজ পেয়ে আমার হৃদপিণ্ডটা লাফিয়ে প্রায় গলার কাছে উঠে এল । আমি কোন দিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উর্ধ্বশ্বাসে দোতলায় উঠে গিয়ে নিজের ঘরে খিল দিলাম । কিছুক্ষণ লাগলো বুকের ধড়ফড়ানি কমতে। তারপর, বাইরের পোশাক-পরিচ্ছদ চেঞ্জ করে দোতলাতেই আমার জন্য যে টয়লেটটা নির্দিষ্ট আছে, সেখানে গিয়ে হাত পা মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে জোর করে নিজের শরীরটাকে আবার ঘরে টেনে এনে বিছানায় এলিয়ে দিলাম । আমি শুনতে পাচ্ছি একতলা থেকে ক্ষীণ হলেও ড্রইংরুমের আলোচনার শব্দ , মাঝে মাঝে টুকটাক হাসির আওয়াজ আসছে এখনো । সোনু দা রয়েছে, চলে যায়নি।
আমি যাব না ।
কিছুতেই নিচে যাব না ।
কিছুতেই না ..
কিন্তু মানুষ ভাবে এক , হয় আরেক । কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন কাজের মাসি এসে আমার ঘরের দরজায় নক করে আমাকে বলে গেল নিচের ড্রইংরুমে আমাকে ডাকছে । কি করবো ? আমি কি করি? ভামিনী কাকিমার সংসারে এই ধরনের কোন অর্ডার এলে তা পালন না করে ঠ্যাঁটার মতো বসে থাকার কোন উপায় নেই । নাইটি পরেছিলাম । সেটা পরে সোনুদার সামনে যাওয়া যেতে পারে না । সেটা চেঞ্জ করে ঝটপট একটা সালোয়ার কামিজ পরে নিলাম। তারপরে সিঁড়ি বেয়ে একধাপ একধাপ করে নেমে আসতে লাগলাম । এক একটা সিঁড়ির ধাপ নামার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভিতর ঘরের মন যেন বলে উঠলো- এইতো ঠিক হয়েছে, বেশ হয়েছে, এটাই তোর সাথে হওয়া উচিত ছিল..

দুরুদুরু বুকে অবশ পায়ে ঘরে ঢুকে দেখলাম সেখানে অজিত কাকু, বান্টি আর সোনু দা বসে রয়েছে। অজিত কাকু আর বান্টির দিকে সরাসরি তাকালেও সোনুদার দিকে আমি তাকালাম না । কিছুতেই না।
অজিত কাকু আমাকে দেখে বলে উঠলেন, কিরে তরু ? শরীর টরির খারাপ নয় তো ? কটা দিন আর বিশেষ ঘর থেকে বেরোস না যে। চোখ মুখ বসে গেছে দেখছি –
— এত ঘরকুনো হয়ে ঘরে বসে থাকলে হবে না ? এ’তো আমি দেখছি বান্টি যথেষ্ট ফ্রেশ রয়েছে । তার তরু দিদিরই শরীর খারাপ করেছে মনে হচ্ছে । গলাটা ওর । সর্বনাশ ! সেই গলা আবার ! আমার পা দুটো কাঁপছে। মনে হচ্ছে আমি সেখানে পড়ে যেতে পারি। সেদিন আমার ঠোঁটের ওপর ওর সেই উষ্ণ ঠোটের স্পর্শ মনে পড়ছে- আমি সামলে রাখতে পারছিনা নিজেকে । কিন্তু ও কিভাবে এত সহজ, স্বাভাবিক ? ওর গলা শুনে একবারও মনে হচ্ছে না , সেদিনের পরে এই আজকে ও আমাকে প্রথম দেখছে। ও এত স্বাভাবিক থাকে কি করে ? আমি কেন পারিনা ?
ও বললো , বোসো তরু-
আমি বান্টি যে সোফাটায় বসেছিল , তার কোণের দিকে গিয়ে বসলাম ।
ও বলল, এই বিকেল বেলাটা এভাবে ঘাড় গুঁজে ঘরের মধ্যে পড়ে থাকো কেন ? টাইম ওয়েস্ট হয়না ? আমার কাছে তো যেতে পারো । কম্পিউটার শিখতে ইচ্ছে করে না তোমার ? দেখো বান্টি তোমার থেকে ছোট হয়ে কি সুন্দর কম্পিউটার জানে । আমি বিকেলবেলার দিকটা ফ্রি থাকি । তুমি এলে আমি তোমাকে একটু একটু করে কম্পিউটার শিখিয়ে দিতে পারি । কালকে এসো আমার বাংলোয়।
কি সুন্দর সহজভাবে একটা আলোচনা করার ভঙ্গিতে কথা আরম্ভ করে শেষকালে এসে আমাকে অর্ডারটা দিয়ে দিল। কি করবো আমি ? সে ঘরে মূর্তির মতো স্থির হয়ে বসে রইলাম । ওরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল । আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না । শুধু মাথার মধ্যে হাতুড়ির ঘায়ের মত বারবার কথাটা বাজছিল- কালকে এসো আমার বাংলোয় .. কালকে এসো আমার বাংলোয় .. ! এই আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা আমার হবে কি?

হলো না ।
যথারীতি হলো না ।
জানতাম হবে না!
পরের দিন কলেজ থেকে ফিরে এসে আমার সমস্ত সংযমের খোলস ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চললাম ম্যানেজারের বাংলোর দিকে । নিজের সঙ্গে অভিনয়ের এই প্রয়োজন কি? এত বঞ্চনা নিজেকে ! বঞ্চনা বই আর তো কিছু নয় । আমি তো সেই প্রথম দিন যবে থেকে আমার সোনুদাকে দেখেছি , তবে থেকেই জানি- ‘ আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়..
তবুও শরীরে , মনে, অসম্ভব উত্তেজনা । সেদিনের কলেজ থেকে ফেরার সেই শেষবেলায় চুম্বনের কল্পনামাত্রই সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায় । বুকে বারবার আছড়ে পড়ে হাজার সুনামির ঢেউ ।
হাজির হলাম বাংলোর গেটের সামনে । গেট খুলে ঢুকলাম ভেতরে। কলিং বেল টিপলাম । দরজা খুলে বেরিয়ে এল সোনু দা । আমাকে দেখেই ওর মুখটা সেই অদ্ভুত ধরনের অর্থপূর্ণ মুচকি হাসিতে ভরে উঠলো ।
বলল , এসেছো ? জানতাম আসবে ।
ও কি করে এত সহজ স্বাভাবিক থাকলো? সেদিনের পরে ও আমাকে দেখে কই আমার মতো কুঁকড়ে যাচ্ছে না তো ? তাহলে আমার কেন এমন হয় ?
— এস।
বলে ঘরের ভেতরে পা চালাল ও । যেতে যেতে কেমন যেন একটা অস্বস্তি হলো আমার । আড়ষ্ট গলায় প্রশ্ন করে বসলাম , ম্যানেজার কাকু কোথায়?
— উনি তো কালকে থেকেই নেই । এই উইকেন্ডে ফিরবেন না ।
কেমন যেন বুকের ভেতরটা শুকিয়ে এলো । কালকে থেকেই নেই। আজকে ম্যানেজার কাকু থাকবে না জেনেও ও আমাকে বাংলোয় ডাকলো? এটা কি উচিত হলো ? এরকম অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা জীবনে আমার কখনো হয়নি । একটা বাড়িতে একজন পুরুষ, তার জোয়ান বয়েস, আর কেউ কোথাও নেই । সেই বাড়িতে আমি চলে এসেছি । না জেনে এসেছিলাম, সে ঠিক আছে । এখন তো জেনে গেছি । এখন কি আর আমার এখানে থাকা উচিত? কে যেন ভেতর থেকে আমায় বলে উঠলো – এখান থেকে ফিরে চল তরু, কিছু একটা এক্সকিউজ দে ,ফিরে চলে যা, থাকিস না.. । আবার যেন অন্য কেউ বলে উঠলো – কি হবে ? আমি কি অপরিচিত কারোর কাছে এসেছি নাকি? এ তো সোনু দা ।
সোনু দা আমি চুপ করে আছি দেখে বলল, কি হলো ? ম্যানেজার কাকু নেই বলে ভয় পেয়ে গেলে নাকি? ঢুকবে না ভাবছো? ফিরে যাও তাহলে –
হাত দিয়ে দরজার দিকে দেখালো সে ।
— নান্না .. এসব কিছু ভাবি নি । কেন ঢুকব না ?
নিজের ভেতরের দ্বন্দটাকে একটা কথায় সঙ্গে সঙ্গে চাপা দিয়ে দিলাম আমি। সোনুদার পিছন পিছন গিয়ে ঢুকলাম তার স্টাডিরুমে। এর আগের দিনও এই ঘরেই এসেছিলাম । সোনুদা গিয়ে কম্পিউটার ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসলো। বসার আগে সেই চেয়ারটার পাশে আর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমাকে বলল, বস !
আমি বসলাম ।
সোনু দা কম্পিউটারটাকে সুইচ অন করল ।
তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করল, কম্পিউটারের ডিফারেন্ট পার্টস গুলো তুমি জানো কি কি?
এটুকু জানতাম । তবুও দুদিকে বেশ জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে বললাম , না !
কিছু জানি দাবি না করাই ভালো । তাহলেই নিশ্চয়ই সোনুদা আমাকে প্রশ্ন আরম্ভ করে দেবে । কিছুই জানি না শুনে তার মুখে যেন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল।
ঠোঁট টেনে হেসে বলল , মন দিয়ে শোনো। থিওরি পরে একটু একটু করে শেখাবো । এখন প্র্যাকটিক্যালি হাতে হাতে কম্পিউটারটা কিছুটা শেখো। প্রাক্টিক্যাল নলেজই একচুয়ালি কাজে আসে । তার জন্য একদম বেসিক লেভেল এর কিছু থিওরি জেনে রাখা প্রয়োজন । এই দেখো, মেন যেটা টিভির মতো স্ক্রিন দেখতে পাচ্ছো, দ্যাট ইজ কলড্ মনিটর ..
একে একে কম্পিউটারের বিভিন্ন পার্টস এবং তাদের কাজ সম্পর্কে বেসিক থিওরি বলে যেতে লাগল সোনুদা । আমি মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করছিলাম , তবে মন যথেষ্ট বিক্ষিপ্ত । পাঁচটা শব্দ পরপর শুনেই পরবর্তী কুড়িটা মিস করে যাচ্ছিলাম ।
কিছুক্ষণ একনাগাড়ে লেকচার দিয়ে যাওয়ার পর সোনু দা আমায় বলল , তুমি এই চেয়ারটায় বস –
বলে নিজের চেয়ারটা থেকে সে উঠে পড়ল । আমি আড়ষ্টভাবে উঠে সেই চেয়ারটায় বসলাম ।
এরপরে আমার ডান পাশ থেকে ঝুঁকে পড়ে আমার চেয়ারের পেছনে বাঁ হাতটা রেখে কম্পিউটার স্ক্রিনের ওপর চোখ রেখে আমাকে বলল, মাউসটা ধরো –
আমি হেজিটেট করতে লাগলাম । সে সটান আমার হাতের ওপর হাত রেখে আমার হাতটাকে তুলে নিয়ে মাউজের ওপর রাখল । ঠিকভাবে সেট করে দিল , বলল , এবার আমি যেমন যেমন বলছি তেমন তেমন করবে -, এই দ্যাখো , এই যে এইখানটা দেখছো .. এটা .. হ্যাঁ , হ্যাঁ এটাতে এরম ভাবে ক্লিক করলে দেখবে একটা উইন্ডো খুললো, এবার হ্যাঁ . .হ্যাঁ .. এখানে নিয়ে এসে এইভাবে .. এইভাবে এখানে রাখ .. এখানে যে আ্যরো’টা দেখাচ্ছে ,এখানে ক্লিক করে একটা সাব উইন্ডো খুলল দেখছো ?..

আর উইন্ডো ! সাব উইন্ডো ! আমার তখন শরীরের সমস্ত অনুভূতি ডান হাতের ওপর গিয়ে ভর করেছে। আমার হাতের ওপর ও ওর হাতের তালুটা সম্পূর্ণভাবে রেখেছে যে। আঙুলের চাপ দিচ্ছে আমার আঙ্গুলের ওপর । এই এখানে চাপ দিল, আবার পরক্ষণেই ওখানে চাপ দিলো । আঙ্গুলের খাঁজে খাঁজে জড়িয়ে যাচ্ছে ওর আঙুল । আমার কপালে বিন্দু বিন্দু স্বেদ। আমি বুঝতে পারছি আমার নিঃশ্বাস দ্রুত পড়ছে । অ্যাড্রিনালিন কাজ শুরু করে দিয়েছে । হার্টবিট তো নয় যেন , বুকের মধ্যে হাতুড়ির ঘা পড়ছে যেন। ওর নিঃশ্বাস ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমার গাল । ওর কথার বেগে উড়ে যাচ্ছে আমার কানের পাশে দু’চারটে চুল । আমি দেখতে পাচ্ছি আমার হাতের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠছে সব । ঘাড়ের কাছেও তাই । লজ্জা করছে আমার । লজ্জায় মরে যাচ্ছি । ও নিশ্চয়ই সেটা লক্ষ্য করছে । কি ভাবছে ? অথচ এভাবে লোমগুলো খাড়া হয়ে যাওয়া , সে কি আর আমার নিজের হাতে আছে? আমি কি আর ইচ্ছে করে করছি ? আমার সমস্ত শরীর এভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছে যে, আমার কোনো বাধাই মানছে না । নিজের মতো জেগে উঠছে । প্রতিটা লোমকূপ, শিরা উপশিরায়, উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে ।
ও কিছুক্ষণ পর বলল, বুঝলে? সবই তো আমি তোমার হাতে ধরে করিয়ে যাচ্ছি । নিজে কিছু করো ।
এতক্ষণ ও কি বলছিল , কিছুই মাথায় ঢোকে নি । কিন্তু এই শেষ কথাটা মাথায় ঢুকলো । কি করব ? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না । আমার মাথা যে পুরো ইন্যাক্টিভ । এতক্ষণ ধরে কি বুঝিয়েছে , কিছুই মাথায় ঢোকে নি যে। গলা শুকিয়ে এল ।
ও বলল, তুমি শুনেছ আদৌ? শিখলে কিছু ?
আমি ঢোঁক গিলে শুকনো গলাটা একটু ভিজিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করলাম ।
ও এরপর মুখটা আমার দিকে ঘুরিয়ে আমাকে বলল, তাকাও আমার দিকে ।
আমি তাকালাম । ওর চোখের সঙ্গে আমার চোখের দূরত্ব বড়জোর কয়েক ইঞ্চি , গাল গালের কাছে ঘেঁষে রয়েছে, আমার শুকনো ঠোঁট দুটোর থেকে ওর ঠোঁটের দূরত্ব বড়জোর তিন ইঞ্চি । চোখের পাতা দুটো টুপ করে পড়ে যেতে চাইছে। আমি তবুও তাকিয়ে রয়েছি। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছি ওর দিকে। ওর মুখে আবার ফুটে উঠল সেই অর্থপূর্ণ মুচকি হাসিটা । চোখের দৃষ্টিতে কিছুটা পরিবর্তন হলো । কিরকম কে জানে, তবে পরিবর্তন হচ্ছে, হ্যাঁ হচ্ছে। নিশ্চিতভাবেই হচ্ছে । ওর স্পর্শে পরিবর্তন আসছে । আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি ওর আঙুলগুলো জড়িয়ে ধরছে আমার আঙ্গুলের ভাঁজে ভাঁজে । একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে ও আমার দিকে। ওর নাকের দুটো পাটা ফুলে উঠছে। দ্রুত বইছে নিশ্বাস। ওর আঙুলগুলো আমার আঙ্গুলের খাঁজ ছেড়ে দিয়ে এবারে অদ্ভুত সরীসৃপের মতো ভঙ্গিমায় আমার সমস্ত হাতে হিল্লোল তুলতে তুলতে উঠে আসছে ওপরের দিকে । ও ওর গালটা রেখেছে আমার গালের ওপর । ক্লিন শেভড নয় ও । গাল ভর্তি খুব ছোট ছোট খোঁচা খোঁচা দাড়ির রুক্ষতা । সেই রুক্ষতা ও কিছুটা চালান করে দিল আমার গালে। স্থির থাকছে না ও । সেই রুক্ষতাটুকু তুলির টানে বুলিয়ে দিচ্ছে আমার নরম গালের ওপর । ততক্ষণে ওর ডানহাতটা কখন যেন চলে গেছে আমার বাঁ গালে । কানের লতির নিচে ওর মধ্যমার অস্থির আনাগোনা ।

আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম । কিছুক্ষণ পর আমার গালে ওর ঠোটের স্পর্শ পেলাম । তারপর চোখে, কপালে , কানের লতিতে, চিবুকে, ও ওর ডানহাতটা দিয়ে আমার মুখটা সম্পূর্ণ ওর দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে । সমস্ত মুখে ওর স্পর্শ । অবিশ্রাম স্পর্শ। ঠোঁটে , হ্যাঁ ঠোঁটও বাদ গেল না । আমার সমস্ত দেহ অবশ হয়ে পড়েছে । আমি চেয়ারের ওপর মাথাটা এলিয়ে দিয়ে পড়ে রয়েছি। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তো দূর, ঘাড়টাকে সোজা করে উঠে বসার ক্ষমতাও আমার নেই । হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম ও আমার দুটো কাঁধ ধরে আমার শরীরটাকে টেনে তুলছে । আমি চোখ বন্ধ করেই রয়েছি । অনুভূতি যখন সম্পূর্ণ দেহ-মনে ব্যপ্ত হয়ে যায় , তখন চোখ খুললে মনে হয় যেন অনুভূতিটাই হারিয়ে যাবে । ও আমাকে তুলে ধরে সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরল আমায়। আমার উদ্যত বুক তখন পিষ্ট হচ্ছে ওর পুরুষালি বুকের পাঁজরের নিচে । আমার ঠোঁটটাকে যেন শুষে নিল ও ওর মুখের ভেতর । কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানিনা । কিছুক্ষণ পর অবিশ্রান্ত চুমুতে ও আমার সমস্ত মুখ, গলা , ঘাড়ের উন্মুক্ত অংশ ভরিয়ে দিল। তারপর আবার আমার নিচের ঠোঁটটা শুষে নিল নিজের মুখের ভেতরে । কতক্ষণ এমনটা চলেছিল জানিনা। কিছুক্ষণ পর ও আমাকে বসিয়ে দিলো চেয়ারের ওপরে । নিজে পাশের চেয়ারটা কিছুটা দূরে সরিয়ে নিয়ে তার ওপর বসলো । আমি চোখ খুলতে ভরসা পাচ্ছি না । তবু অদ্ভুত এক অনুভূতিতে একবার কেঁপে উঠল সমস্ত শরীর। তারপর নিজের অজান্তেই বুঝলাম বন্ধ চোখের আগল ঠেলে এক ফোঁটা , দু’ফোঁটা করে চোখের জল গাল বেয়ে পড়ছে নিচে। ক্রমশ পড়েই চলেছে। থামতে চায় না । অজস্র ধারায় পড়ছে । আমার বুকের ওড়না ভিজে যাচ্ছে। কেন এত কাঁদছি আমি ? এতো কান্না পাচ্ছে কেন আমার ? জানিনা । একটা সময় দুহাতে মুখটা চেপে ধরে নিঃশব্দে ডুকরে কেঁদে উঠলাম ।

তবে কি আমার সর্বনাশ আজ সম্পূর্ণ হলো ? নাকি আরো কিছু আছে বাকি ? আমি সেদিন আর সেখান থেকে ছুটে পালালাম না । সেদিন হয়তো আমি বুঝতে শিখে গেলাম , সবখান থেকে ছুটে পালানো যায় না..

ক্রমশ..