হিয়ার টানে পর্ব-০১

0
540

#হিয়ার_টানে
#সূচনা_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

–“তুইও অভীক ভাইয়াকে পছন্দ করিস তাই না হিয়া?”

আমি আবির ভাইয়ার পাশে দাঁড়াতেই কথাটা বলে উঠলো আবির ভাইয়া। আমি উনার সাথে দেখা করতে আসলাম আর উনি এসব কথা বলছে! আজব! আমি বেঞ্চিতে বসে বললাম,

–“নাতো। আমি অভীক ভাইয়াকে কেন পছন্দ করবো? ”

–“না, এই এলাকার সব মেয়েইতো অভীক ভাইয়া বলতে পাগল! তাই তোকে জিজ্ঞেস করলাম আর কি! তুইও নিশ্চয়ই আর সবার মতই অভীক ভাইয়াকে পছন্দ করিস!”

–“সবাই পছন্দ করে বলে কি আমাকেও পছন্দ করতে হবে? এমনটা কোথায় লেখা আছে শুনি?”

–“না, আসলে আমিতো এমনিই জিজ্ঞেস করলাম!তুই কি রাগ করলি?”

–“না, আমি আসি আবির ভাইয়া! ক্ষুধা লেগেছে। কলেজ থেকে এসে কিছুই খাইনি!”

কথাগুলো বলেই আমি পুকুর পাড়ের বসার বেঞ্চিটা থেকে উঠে পড়লাম৷ সামনেই পুকুরে অভীক ভাইয়া গোসল করছে৷ আর তাকে দেখেই আবির ভাইয়া আমাকে কথাটা জিজ্ঞেস করেছে বুঝতে পারলাম।

আবির ভাইয়াকে আরেক নজর দেখেই আমি ওখান থেকে প্রায় ছুটে চলে আসলাম!

আমি হিয়া। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আর এতক্ষণ যার সাথে কথা বলছিলাম সে হচ্ছে আমার চাচাতো ভাই আবির৷ এইবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে।প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করেই বাড়িতে এসেছে৷ বেশ কিছুদিন থাকবে।

আর অভীক হচ্ছে আমার আরেক চাচার ছেলে। দেখতে যেমন সুন্দর! তেমনি অহংকারী! ছাত্র হিসেবেও গ্রামের সেরা!ঢাকা মেডিকেলে পড়াশোনা করে । এইবার ফাইনাল ইয়ারে। গ্রামের প্রায় সব মেয়েই অভীক ভাইয়া বলতে পাগল! যে কেউ একবার দেখলে আর চোখ ফেরাতে পারবে না।

কিন্তু আমার কেন জানি অভীক ভাইয়াকে পছন্দ নয়! আমার কাছে আবির ভাইয়াই সেরা! অভীক ভাইয়ার মতো অতো ফর্সা নয়, আবার লম্বাও নয়, পড়াশোনাতেও আমার মতই এভারেজ! শ্যমবর্ণের আবির ভাইয়া আমার কাছে সবার সেরা! যাকে দেখার জন্য আমি মাসের পর মাস অপেক্ষা করে থাকি! কখন বাড়ি আসবে! আর কখন তাকে দুচোখ ভরে একবার দেখবো! এই অনুভূতিটা তবে থেকে হয়েছে যবে থেকে আবির ভাইয়া ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। আগে হয়ত সবসময় চোখের সামনেই থাকতো বলে এই অনুভূতিটা বুঝতে পারতাম না। অথবা তখন এই অনুভূতিটা বোঝার মতো বয়স আমার ছিলো না!

আমি যাকে পছন্দ করি সে যদি আমার সামনে অন্যকোনো ছেলেকে পছন্দ করি কিনা তা জিজ্ঞেস করে তাহলেতো রাগ হওয়ারই কথা!তাই আমি খাবার খাওয়ার অজুহাত দিয়ে ওখান থেকে চলে আসলাম।
আচ্ছা আবির ভাইয়া কি বুঝতে পারে না যে আমি তাকে কতটা পছন্দ করি! নাকি বুঝতে চায়না আমার না বলা অনুভূতিগুলো! নাকি আমাকে মুখ ফুটে বলতে হবে তাকে যে, আমি তাকে ভালবাসি! একটা মেয়ে হয়ে আমি তাকে কি করে বলব যে, আমি তাকে ভালেবাসি! আর আবির ভাইয়া যদি আমাকে পছন্দ না করে! আমাকে ফিরিয়ে দেয়! তখন কি আমি সহ্য করতে পারবো! আবার আবির ভাইয়া যদি অন্যকোন মেয়েকে পছন্দ করে ফেলে তাহলেওতো আমি সেটা সহ্য করতে পারবো না! আজ একটা বছর আমি আমার অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রেখেছি! আর যেন পারছি না! যতই দিন যাচ্ছে ততই মনে হচ্ছে আমি আমার ভালবাসার মানুষটা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি! হারিয়ে ফেলছি সেই আবির ভাইয়াকে যাকে আমি মনে-প্রাণে চাই!

আবির ভাইয়া এসেছে শুনেই আমি কলেজ থেকে এসেই তাকে খুঁজতে পুকুর পাড়ে চলে গিয়েছিলাম! অথচ সে ভেবেছে যে আমি হয়তো অভীক ভাইয়াকে দেখতে পুকুর পাড়ে গিয়েছি! এইজন্যই হয়ত আমাকে কথাটা জিজ্ঞেস করলো! তারমানে আবির ভাইয়া আমাকে ভুল বুঝেছে! কথাটা ভাবতেই আমার নিজেরই লজ্জা লাগলো! অভীক ভাইয়াওতো তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে! সেও কি ভেবেছে যে, আমি তার গোসল করা দেখতে গিয়েছি! ছি! ব্যাপারটা এতক্ষণ আমার মাথাতেই আসেনি। আমার মনে হচ্ছে যে, আবার ছুটে গিয়ে আবির ভাইয়াকে বলে আসি যে, আমি উনাকে দেখতে ওখানে গিয়েছিলাম! অভীক ভাইয়াকে নয়।

যেই ভাবা সেই কাজ! আমি আবার একছুটে পুকুর পাড়ে চলে গেলাম৷ কিন্তু আবির ভাইয়াকে সেখানে না দেখতে পেয়ে এদিক-সেদিক খুঁজতে লাগলাম৷ কিন্তু কোথাও তাকে না দেখতে পেয়ে চলেই আসছিলাম তখন পেছন থেকে কারো মুখে আমার নাম শুনতে পেলাম। মিষ্টি একটা কণ্ঠস্বরে সে আমার নাম ধরে ডাকছে৷ আমি পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি যে, অভীক ভাইয়া একটা লুঙ্গী আর হাতা-কাটা গেঞ্জি পড়ে গামছা দিয়ে চুলটা মুছতে-মুছতে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে! আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ তারপর বললাম,

–“ভাইয়া কেমন আছেন? ”

–“আমিতো ভালই আছি। তুমি কেমন আছো? কালকে এসেছি অথচ তোমাকে আজ দেখতে পেলাম। কোথায় ছিলে?”

–“আমিও ভালই আছি৷ আসলে কলেজে গিয়েছিলামতো। মাত্রই আসলাম। তাই হয়ত দেখতে পাননি!”

–“কলেজে না হয় আজ গিয়েছিলে। কাল সারাদিনও তো দেখলাম না! ”

–“না, আসলে রাতে পড়ছিলাম!”

–“অজুহাত! তা পড়াশোনা কেমন চলছে? ”

–“এই ঠেলে-ঠুলে চলছে আর কি! আমিতো আর আপনার মতো নাম্বার ওয়ান স্টুডেন্ট না! আমার যেমন চলার কথা তেমনি চলছে! ”

–“খোটা দিচ্ছো কেন! ভালই কথা শিখেছো দেখছি!”

অভীক ভাইয়া আমাদের কাজিনদের সাথে তুমি করেই বেশি কথা বলে৷ আর আমি অভীক ভাইয়ার থেকে আগে থেকেই দশ হাত দূরে থাকার চেষ্টা করতাম।

আমি অভীক ভাইয়াকে কিছু বলতে যাবো ঠিক তখনি সেখানে আবির ভাইয়া এসে হাজির! আবির ভাইয়াকে দেখে আমি আরও চুপ হয়ে গেলাম। আবির ভাইয়া অভীক ভাইয়াকে লক্ষ্য করে বলল,

–“কেমন আছেন ভাইয়া?”

–“এইতো ভালো। তুমি? কখন আসলে? ”

–“এইতো কিছুক্ষণ আগেই। আপনিতো কাল এসেছেন। তাই না?”

–“হুম৷ থাকবে নাকি কয়দিন?”

–“না, বেশিদিন ছুটি নেই৷ আর দুইটা টিউশনি আছে, ছুটি দিয়ে এসেছি৷ বেশিদিন থাকতে পারবো না। ”

–“টিউশনি করাও তোমার পড়াশোনার ক্ষতি হয়না?”

আবির একগাল হেসে বলল,

–“আমিতো আর সারাক্ষণ পড়ি না! আর দুইটা টিউশনি থাকলে হাত-খরচাটা হয়ে যায় আর কি!”

তাদের গল্পের মাঝে আমার নিজেকে অসহায় লাগছিলো। তাই আমি চুপিচুপি ওখান থেকে কেটে পড়লাম।

আমি ঘরে ঢুকতেই মা চেঁচাতে লাগলো,

–“সেই তখনি বললি যে, ক্ষুধা লেগেছে! আমি তখন ভাত বেড়ে রেখেছি! অথচ তোর আসার নাম নেই! কোথায় গিয়েছিলি এই ভরদুপুরে? ”

–“এইখানেই। আবির ভাইয়া এসেছে। তাই…”

আমার কথা শেষ না হতেই মা ভাতের থালাটা তুলে আমার দিকে এগিয়ে দিতে-দিতে বলল,

–“ওদের দেখে কিছু শেখ! সারাক্ষণ টো-টো করে ঘুরে বেড়ালে ওদের মতো আর ভার্সিটিতে পড়তে হবে না! তোর বাবা বলে দিয়েছে, কোনো ভার্সিটিতে চান্স না পেলে সোজা বিয়ে দিয়ে দেবে! আসিফ এখন বাবা-মায়ের সম্মান রাখলে তবেই বাঁচা! ”

কথাগুলো বলেই মা হন-হন করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। এই অভীক ভাইয়া আর আবির ভাইয়া কেন যে, ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছিলো কে জানে! আমাকে আর আমার চাচাতো বোন হিমাকে সারাক্ষণ তাদের গুণগান শুনে কাটাতে হয়। মাঝেমধ্যে ওদের দুজনের উপর প্রচুর রাগ হয়! আর আমার ছোট ভাই আসিফ! ভাইদের মান রাখতে সেও ক্লাস টপার!ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে, এইটে বৃত্তি পেয়েছে, এইবার নাইনে পড়ে! বোঝাই যাচ্ছে যে, ভাইদের পথ অনুসরণ করেই এগুচ্ছে! আর আমি আর আবির ভাইয়ার ছোট-বোন হিমা জমজের মতো! এক ক্লাসেই পড়ি! আবার রেজাল্ট ও একই ধাঁচের। কোনোমতে টেনেটুনে পাশ!

বিকেলে আমি আর হিমা হাটতে বের হয়েছি। তখনি হিমা লাজুক হেসে আমাকে বলল,

–“জানিস হিয়া, আমি না অভীক ভাইয়াকে পছন্দ করি! অভীক ভাইয়াকে দেখলেই না আমার কেমন জানি লাগে! মনে হয় সারাক্ষণ উনাকেই দেখি! ইশ! উনার যদি একটা ছোট ভাই বা বোন থাকতো তাহলে তার উসিলায় হলেও সারাক্ষণ আমি উনাদের বাড়ির আশেপাশেই ঘুরঘুর করতাম! আর বড় চাচাও দেখ! নিজের বাড়ি রেখে অন্য জায়গায় গিয়ে বাড়ি বানাতে হবে! আমাদের সাথে থাকলে কি হতো! যখন-তখন অভীক ভাইয়াকে দেখতে পারতাম! ”

হিমার কথা শুনে প্রথমেই আমার আবির ভাইয়ার কথা মনে পড়লো! আমারোতো আবির ভাইয়াকে দেখার জন্য মন আকুলিবিকুলি করে! তারপর আমি মনের কথা মনে রেখে হিমাকে বললাম,

–“তুই এমনভাবে বলছিস যেন, অভীক ভাইয়াদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে কতই না দূরে! শুধুমাত্র রাস্তার এপাড়-ওপাড়! আর তুই যে অভীক ভাইয়াকে পছন্দ করিস এটাতো অনেক পুরাতন কথা! নতুন কিছু বল!”

আমার কথা শুনে হিমা মুখে ভেঙচি কেটে বলল,

–“একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ! তুই কিন্তু অভীক ভাইয়ার দিকে একদম নজর দিবি না! অভীক ভাইয়া শুধু আমার!”

কথাটা বলেই আশেপাশে তাকালো হিমা। তারপর যখন দেখলো যে, আমাদের আশেপাশে কেউ নেই তখন আবার বলতে লাগলো,

–“আচ্ছা হিয়া, অভীক ভাইয়ার কেমন মেয়ে পছন্দ হতে পারে বলতো?”

–“তুই এমনভাবে বলছিস! যেন অভীক ভাইয়া আমাকে বলে রেখেছে যে, হিয়া! আমার না এমন টাইপের মেয়ে পছন্দ! তুমি একটু খুঁজে দেবে!”

আমার কথা শুনে হিমা কিছুটা রেগে গিয়ে বলল,

–“তুই মজা নিচ্ছিস তাইনা! তুই নিজে যখন কাউকে পছন্দ করবি তখন বুঝবি যে, ভালবাসার মানুষটি সম্পর্কে জানার জন্য মন কেমন করে! তখন আমাকে বললে আমিও এভাবেই মজা করব!”

–“আরে বইন তুই রাগ করছিস কেন! আমিতো এমনিই বললাম! তুই হঠাৎ অভীক ভাই নিয়ে পড়লি কেন বলতো? কাহিনী কি?”

হিমা লাজুক হেসে আমতা-আমতা করে বলল,

–“সামনেইতো ১৪-ই ফেব্রুয়ারী আসছে! আমি একটা প্ল্যান করেছি! তোকে ছাড়া আর কাউকেতো বলা যাবে না! তার আগে বল তুই আমাকে হেল্প করবি?”

আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

–“কি এমন প্ল্যান করেছিস যে, আমার হেল্প ছাড়া হবে না? বলে ফেল, শুনি!”

–“আমি না এইবার ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে অভীক ভাইয়াকে একটা চিঠি দিবো! ”

–“তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? কেউ জানতে পারলে কি লঙ্কা কান্ড হবে তা ভেবে দেখেছিস? আর অভীক ভাইয়ার রিয়াকশন কি হবে বুঝতে পারছিস? তা কল্পনা করেইতো আমার হাড় হিম হয়ে আসছে! ”

–“আরে ভাই আমি নাম-ধাম লিখে দেবো নাকি! আমি অতোটাও বোকা নই! তুই আমাকে হেল্প করবি! ব্যস! বাকিটা আমি তোকে পরে জানাবো! যদি রাজি হয়ে যায়!”

–“তুই কি পাগল? চিঠিতে কি এমন দিবি যে তোর নাম না জেনেই তোকে পছন্দ করবে? তোকে না চিনলে তোকে উত্তরই বা দিবে কি করে! আর তুই-ই চিঠিটা কীভাবে দিবি? ”

–“এতকিছু তোকে ভাবতে হবে না। তুই আমার সাথে থাকবি! হেল্প করবি! ব্যস! আর কিচ্ছু জানিনা! এবার বাড়ি চল! সন্ধ্যা হয়ে আসছে৷ আরেকটু দেরি করলে তোর মা আর আমার মা মিলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিবে!”

–“আচ্ছা চল। ”

বলেই আমরা বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। হিমা যে কি প্ল্যান করছে তা ভেবে এখনি আমার মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেছে! কে জানে এই মেয়েটা আবার কি ফন্দি এটেছে!

চলবে…..