হিয়ার টানে পর্ব-০২

0
333

#হিয়ার_টানে
#২য়_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

হিমার কথা শুনে আমারও খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো যে, আবির ভাইয়াকে একটা চিঠি লিখবো! রাতে পড়ায় আর মন বসছে না! কি লিখবো না লিখবো তাই ভেবে-ভেবে সাড়া হচ্ছিলাম!

বারবার লিখে আবার কেটে দিচ্ছিলাম। অবশেষে পেন্সিল আর ইরেজার নিয়ে বসলাম! অবশেষে আমার মনের হাজারো কথাগুলোকে কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে সাজালাম! তারপর নিজেই চিঠিটা পড়তে লাগলাম।

“প্রিয় আবির,
আমি আপনাকে ভাইয়া বললেও এই চিঠিতে আর ভাইয়া বলতে চাচ্ছিনা! কারণ আমি যে আর আপনার বোন থাকতে চাইনা! আমার হাজারও অনুভূতির সাথে আপনার অনুভূতিগুলোকে সাজাতে চাই! রোজরাতে আপনার মায়াবী মুখটা দেখে ঘুমাতে চাই! আর প্রতিটা ভোরের আলো আমি আপনার সাথেই দেখতে চাই! আপনি কি আমাকে অনুমতি দিবেন আপনার জীবনের প্রতিটা ঘটনার সাথে আমাকে জড়িয়ে রাখার! আমি শুধু আপনার সাথেই আমার জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে চাই!
প্লিজ না করবেন না! তাহলে আমার এই ক্ষুদ্র হৃদয়টা ভেঙে টুকরো হয়ে যাবে! আর টুকরো হৃদয়ে আপনার থাকতে যে কষ্ট হবে!
এই চিঠিটা কে লিখতে পারে আশা করি বুঝতে ভুল হবে না! আমি যে হিয়া! আবিরের হিয়া!
ইতি লিখে আমি আমার চিঠিটা শেষ করতে চাইনা! আমি যে হাজারো কথা লিখতে চাই আপনাকে নিয়ে! আপনার উত্তরের আশায় রইলাম!”

চিঠিটা দেখছিলাম আর নিজেই লজ্জা পাচ্ছিলাম! আবির ভাইয়া এই চিঠিটা পড়ার সময় কি আমার মতই লজ্জা পাবে! নাকি হাসবে আমার এইসব হাস্যকর লেখা পড়ে!

–“কিরে হিয়া! আজ এত পড়াশোনা করছিস? প্রতিদিন পারলে আমার আগেই ঘুমিয়ে যাস! আর আজ এখনো পড়ছিস?”

পাশ থেকে মায়ের কথা শুনে চিঠিটা বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে ফেললাম৷ তারপর মাকে বললাম,

–“হ্যাঁ মা, এইতো পড়া শেষ! এখন ঘুমাবো৷ তুমি ঘুমাও!”

কথাটা বলেই লাইট অফ করে মায়ের পাশে শুয়ে পড়লাম। আর কাল চিঠিটা আবির ভাইয়ার কাছে কীভাবে পৌঁছাবো তাই ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে কলেজে যাওয়ার সময় হিমা জানালো যে ওর চিঠি লেখা শেষ! ও নাকি পুরো চার পাতার একটা রচনা লিখেছে! আমি শুনেতো অবাক। তারপর হাসি থামাতে না পেরে বললাম,

–“তুই কি প্রেমপত্র নামে কোনো রচনা লিখেছিস? এতবড় চিঠি কেউ লিখে? আর তোর মনে হয় অভীক ভাইয়া ওই চিঠি দেখার পর আর পড়বে?”

আমার কথায় হিমা কিছুটা মন খারাপ করে বলল,

–“আমি কি করব বল! লিখতে-লিখতে বড় হয়ে গেছে। আমিতো ভেবেছি যে, ওইটা দেখে-দেখে তুই আমাকে সুন্দর করে লিখে দিবি! আমার যে হাতের লেখা! অভীক ভাইয়া হাতের লেখা দেখে বমি না করে দেয়! চিঠি পড়াতো দূরের কথা!”

–“আরে ভাই তোর চিঠি আমি কেন লিখবো! ”

–“তুই কিন্তু কথা দিয়েছিস যে, আমাকে হেল্প করবি! এখন পিছু হটলে চলবে না!”

–“আচ্ছা বাবা করবো হেল্প! তার আগে বল যে, এই চিঠিটা তুই অভীক ভাইয়া অব্দি পৌঁছাবি কি করে?”

কথাটা জিজ্ঞেস করার আরেকটা কারণ হচ্ছে আমার চিঠিটাও আবির ভাইয়াকে সেইভাবেই দিবো!

আমার কথাটা শুনে হিমা মুচকি হেসে বলল,

–“ওটা আমার জন্য কোনো ব্যাপার-ই না! অভীক ভাইয়া যখন রুমে থাকবে না তুই চাচির সাথে গল্প জুড়ে দিবি আর আমি সেই সুযোগে চিঠিটা রেখে আসব! ব্যস, মিশন কমপ্লিট! আইডিয়াটা কেমন?”

–“জিনিয়াস! তুইতো দেখছি ভবিষ্যতে লাভগুরু হবি! ”

কলেজে পৌঁছেই আমি হিমার চিঠিটা নিয়ে সবার থেকে লুকিয়ে পড়তে লাগলাম! এত লেখা লিখেছে যে, পুরো ক্লাসের ফাঁকে-ফাঁকে পড়েও আমি সেই চিঠিটা শেষ করতে পারলাম না! অবশেষে চিঠটা আমার কাছেই রেখে দিলাম।

সারাদিন আর আবির ভাইয়াকে দেখতে পেলাম না৷ হয়তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গেছে৷ এতদিন পর গ্রামে এসেছে! তাকে এক পলক দেখার জন্য আমার মনটা ছটফট করছিলো!

বিকেলে আমি আর হিমা আমাদের রুমে বসে হিমার চিঠিটা ঠিক করছিলাম। ঘরের দরজা বন্ধ দেখে মা কয়েকবার বকা দিলেও আমরা তার কথার গুরুত্ব দিলাম না। আজকের মধ্যেই আমাদের চিঠি লেখা শেষ করতে হবে! কাল যে, ফেব্রুয়ারীর ১৩ তারিখ! কালকেই চিঠিগুলো তাদের মালিকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে!

কেটেকুটে অবশেষে হিমার চিঠিটাও ঠিক করলাম।তারপর হিমা চলে গেলো আর আমি সেই চিঠিটা সুন্দর করে আরেকটা পৃষ্ঠায় লিখতে বসলাম।
হিমার চিঠিটা ছিলো এরকম,

“প্রিয় অভীক,
তুমি আমার জীবনের প্রেমের সূর্যোদয়! তোমাকে এক নজর দেখার জন্য আমি সারাটা জীবনও অপেক্ষা করতে পারি! এক তোমার মধ্যেই আল্লাহ এত সৌন্দর্য কেন দিয়েছে? আমাদের মাঝেও তা একটু ভাগ করে দিতো!
লেখারতো অনেক কথাই ছিলো, সব কি আর একদিনে বলা যায়! আজ শুধু এটুকুই বলতে চাই যে, আমি তোমাকে আমার সারাজীবনের সঙ্গী হিসেবে পেতে চাই। তুমি কি পারবে আমার জন্য অপেক্ষা করতে? আমি তোমার পাশে ছিলাম, আছি, আর থাকতেও চাই!
নাম না বললে কি তুমি আমায় চিনে নিবে না? হাসির শুরু, হাওয়ার শুরু, রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তীর শুরু!তাতেই আছে আমার শুর! আরো বলতে হবে বলে মনে হয়না!
আমি এই ভালবাসা দিবসের একটা মুহূর্ত তোমাকে আমার করে দেখতে চাই। যেখানে তুমি আমাকে পুকুর-পাড়ে গিয়ে খুঁজবে! আমি তোমার আশায় থাকবো! আসবেতো আমার অভু?”

চিঠিটা শেষ করতেই আবির ভাইয়া আমার রুমের সামনে এসে হাজির! এই সময় আবির ভাইয়া আমার রুমে? সারাদিন পর আবির ভাইয়াকে দেখে আমার কি যে ভালো লাগছে তা বলে বুঝাতে পারছি না! আমি নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বললাম,

–“ভাইয়া আপনি? ভেতরে আসুন। ”

আবির ভাইয়া ভিতরে এসে আমার বিছানার উপরে বসতে-বসতে বললেন,

–“কেন? আমি কি আসতে পারি না নাকি?”

–“না তা নয়! আসলে এই সন্ধ্যার সময়! তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি!”

–“চাচি বলছিলো তোর পড়াশোনা কেমন চলছে একটু খোঁজ নিতে, তাই চলে আসলাম আর কি! হিমার অবস্থাতো একদম বাজে! তা তোর কি অবস্থা?”

আমি চিঠিটা কোনোমতে একটা বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রেখে পড়ার ব্যাপারে কথা বলতে লাগলাম। বইটা আমি যেন হাতছাড়া করছি না! আবির ভাইয়া তা লক্ষ্য করে বলল,

–“ওই বইটা ওইভাবে লুকাচ্ছিস কেন? কি আছে ওই বইতে?”

আমি বইটা অন্যসব বইয়ের নিচে রেখে বললাম,

–“এটা আমার এক বান্ধবীর বই! এনেছিলাম পড়ার জন্য৷ কিছুই নেই!”

এটুকু বলার পর মা আমাকে ডাকতে লাগলো।আমি আবির ভাইয়াকে রুমে রেখে মায়ের কাছে চলে গেলাম৷ মা আবির ভাইয়ার জন্য চা বানিয়েছে। চা নিয়ে আমার রুমে ঢুকতেই দেখতে পেলাম যে আবির ভাইয়ার মুখটা কেমন পাংশু বর্ণ ধারণ করেছে। আমি চায়ের কাপটা নামাতেই আবির ভাইয়া বলল,

–“আমি এখন চা খাবো না। বাইরে একটু কাজ আছে। তুই পড়! আমি পরে আসবনে।”

আমার উত্তরের আশা না করেই আবির ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলো। আমি হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবির ভাইয়ার জন্য আনা চা’টা নিজেই খেতে শুরু করলাম। আর অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম যে, আবির ভাইয়া এমন হঠাৎ করে চলে কেন গেলো!

আজ কলেজ থেকে এসেই আমি আর হিমা সুযোগ খুঁজছি যে, কখন অভীক ভাইয়া বাড়ি থেকে বের হবে। কিন্তু অভীক ভাইয়া যেন আজ বের-ই হচ্ছে না। আমি আর হিমা ওর রুমে জানালার পাশে বসে আছি। এমন সময় আবির ভাইয়া এসে হিমাকে ডাকতে লাগলো। আমাকে দেখেই আবির ভাইয়া রুম থেকে চলে গেলো।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে যে, আবির ভাইয়া আমাকে এড়িয়ে চলছে! কিন্তু কেন? তা বুঝতে পারছি না। কালকে অভীক ভাইয়ার জন্য লেখা চিঠিটা দেখে ফেলেনিতো? ভাবতেই আমার হাত-পা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসলো! আবির ভাইয়াকে কি জিজ্ঞেস করে দেখবো? কিন্তু হিমার কথা বললে আবার হিমার কপালে শনি নেমে আসবে! আর যদি এটা ভাবে যে আমিই অভীক ভাইয়াকে চিঠি দিবো! তখন! এসব ভাবছিলাম, তখন হিমা রুমে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে-আস্তে বলল,

–“আরে অভীক ভাইয়া বের হয়ে গেছে, চল তাড়াতাড়ি! ”

আমি হিমার সাথে বিনাবাক্যে বের হয়ে গেলাম। আবির ভাইয়া বারান্দায় বসে চাচির সাথে কথা বলছিলো। আমাকে আর হিমাকে যেতে দেখে হিমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–“কিরে হিমু! এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস? ”

হিমা নিজে বাঁচতে আমার নাম নিয়ে বলল,

–“হিয়া নাকি একটু বড় চাচির ওখানে যাবে। তাই…. ”
একথা শুনেই আবির ভাইয়া রেগে গিয়ে বলল,

–“হিয়া যাবে ভালো কথা! তোকে সাথে যেতে হবে কেন? মা না কি যেন করতে বলল তোকে৷ যা কাজ কর!”

আমি জানি হিমার কোনো কাজ নেই। কিন্তু আমার সাথে যেতে দিবে না জন্য এমন করছে৷ আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। হিমাও রাগ করে রুমে চলে গেলো৷ চাচি আমাদের মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরে আবির ভাইয়াকে ধমক দিয়ে বলল,

–“তুই কাল থেকে হিমার পেছনে কেন পড়ছিস বলতো? দু’দিন পর চলে যাবি, একটু ভালভাবে থাকলেই পারিস৷ ”

আবির ভাইয়া এইবার রাগান্বিত হয়ে চাচিকে বলল,

–“তোমার আলতি পেয়েই আজ পড়াশোনার এই অবস্থা! পরীক্ষায় ফেইল করলে তখন বুঝবে আমি কেন ওর পেছনে পড়ি!”

কথাগুলো বলেই আবির ভাইয়া বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো৷

আমি হিমার চিঠিটা নিয়ে পড়লাম বিপাকে৷ আবির ভাইয়া বের হয়ে যেতেই হিমা আবার চুপিচুপি বের হয়ে আসলো। তারপর আমরা দু’জনে গিয়ে অভীক ভাইয়ার রুমে চিঠিটা রেখে আসতে সফল হলাম।

রাতে আমি হিমার কাছে যাবো বলে আবির ভাইয়ার জন্য লেখা চিঠিটা নিয়ে চাচিদের ওখানে গেলাম। এই সময়টা আবির ভাইয়া সাধারণত রুমে থাকেনা৷ তাই ভাবলাম যে, রুমে চিঠিটা রেখে চলে আসবো যেন কেউ বুঝতে না পারে! তাহলে আবির ভাইয়া আমাকে ভুল বুঝলেও চিঠিটা দেখে বুঝে যাবে যে, অভীক ভাইয়ার জন্য লেখা চিঠিটা আমার নয়।

আবির ভাইয়ার রুমের সামনে যেতেই আমি থেমে গেলাম। আবির ভাইয়া হেসে-হেসে কারো সাথে কথা বলছে৷ কিন্তু অন্যকারো কণ্ঠ না শুনতে পেয়ে বুঝে গেলাম যে, আবির ভাইয়া ফোনে কথা বলছে৷ আমি আরেকটু কাছে গিয়ে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করলাম।

–“আরে পাগলী ভ্যালেন্টাইন্স ডে এখনো আসেনিতো। এখনি বলতে হবে? ”

–“ওকে বলছি বাবা, আই লাভ ইউ! হয়েছে এইবার?”

–“দেখ নিশি আমি বলে দিয়েছিতো, এইবার ফোন রাখ৷ আমি বাড়িতে এসেছি! কেউ শুনলে উল্টাপাল্টা ভাববে!”

বলেই হাসতে লাগলো। আবির ভাইয়া কাউকে আই লাভ ইউ বলেছে শুনে আমার পা দু’টো পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলো। চোখ থেকে পানি পড়েই চলেছে৷ চিৎকার করে কান্না করতে মন চাচ্ছে, কিন্তু পারছি না।

হঠাৎ চাচা আমাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

–“কে ওখানে? হিয়া? ভেতরে যা, ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হিমা ভেতরেই আছে দেখ।”

–“না, আমি এখন আর ভেতরে যাবো না। আসি!”

ততক্ষণে আবির ভাইয়া আর হিমা রুম থেকে বাইরে চলে এসেছে। আবির ভাইয়ার চোখে চোখ পড়তেই আমি তাড়াতাড়ি ওখান থেকে চলে আসলাম।অন্ধকারে থাকায় হয়তো কেউ বুঝতে পারেনি যে, আমি কান্না করছি! না বুঝাই ভালো!

চলবে…..