হিয়ার টানে পর্ব-০৫

0
301

#হিয়ার_টানে
#৫ম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

আমার কথা শুনে আবির ভাইয়া কিছুটা রেগে গেলেন। তারপর বললেন,

–“তুই নিজেই বলছিস যে, চিঠিটা তুই লিখেছিস! আবার বলছিস তোর জন্য নয়! এটা কি ধরনের মজা হিয়া? আমাকে কি তোর পাগল মনে হয়? এটা কি স্কুলের কোনো আবেদনপত্র যে, বান্ধবীরটা তুই লিখে দিলি? এটা… ”

এটুকু বলেই থেমে গেলেন আবির ভাইয়া। আমি এইবার মাথা নিচু করে বসে আছি। এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না কি করব! আমি আস্তে-আস্তে মাথাটা তুলে আড়চোখে আবির ভাইয়াকে একবার দেখে নিলাম৷ তার চোখেমুখে কেমন একটা মায়া ছড়িয়ে আছে যা উপেক্ষা করে মিথ্যে বলা আমার পক্ষে অসম্ভব! আমি আস্তে করে বললাম,

–“আমি আপনাকে বলতে পারি একটা শর্তে।”

আবির ভাইয়াও আমার মতই আস্তে করে বলল,

–“বলে ফেল কি শর্ত? ”

–“আপনি রাজি আছেন?”

–“শর্ত না শুনলে কীভাবে রাজি হবো! আগে বল।”

–“না, আগে আপনি আমাকে কথা দিন। এইটা নিয়ে কোনো ঝামেলা করবেন না। কাউকে কিছু বলবেন না!”

–“আচ্ছা ঠিক আছে৷ আমি কাউকে কিছুই বলব না। তুই আমাকে বল চিঠিটা কার জন্য লিখেছিলি?”

আমি আবির ভাইয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে মলিন মুখে বললাম,

–“হিমার জন্য!”

আমার কথাটা শুনেই আবির ভাইয়া সাপের মতো ফোঁস করে উঠলো। বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো৷ আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে আমি যেন হিমার নাম নিয়ে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। আবির ভাইয়াকে রাগতে দেখে আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। তারপর আবির ভাইয়ার থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে বললাম,

–“আপনি কিন্তু কথা দিয়েছেন কাউকে কিছু বলবেন না৷ প্লিজ হিমাকে কিছুই বলবেন না। ও আমাকে বারণ করেছিল৷ কিন্তু….”

এটুকু বলার পরেই আবির ভাইয়া আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

–“তুই এখন আমাকে এসব বলছিস? এসব কবে থেকে চলছে? তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন? চিঠিটা কি অভীক ভাইয়াকে দিয়েছিস? অভীক ভাইয়াও কি হিমাকে…”

আমি আবির ভাইয়াকে থামানোর জন্য বললাম,

–“ভাইয়া প্লিজ। আপনি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছেন যে, হিমাকে কিছু বলেন না৷ আর শান্ত হোন এখন৷ কেউ শুনে ফেলবে!”

–“তুই আগে বল যে, কবে থেকে এসব চলছে?”

–“কিছুই চলছে না। অভীক ভাইয়া হিমাকে পছন্দ করে না৷ হিমাই শুধু…”

–“পড়াশোনায় ডাব্বা! আর ও এসব করে বেড়ায়! মাকে আমি কতবার বলেছি ওর দিকে খেয়াল রাখতে! আর আমি কিছু বললেই বলে যে, বাড়াবাড়ি করছি! আজ আসুক ও বাড়িতে!”

বলে আমাকে রেখেই আবির ভাইয়া হনহন করে চলে গেলো। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে।

হঠাৎ আমার হিমার কথা মনে পড়তেই আত্মা শুকিয়ে গেলো৷ আবির ভাইয়া এখন গিয়ে আবার হিমাকে কিছু বলবে নাতো! আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে মুখটা ধুয়েই আবার ফুপুর বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম।

ফুপুর বাড়িতে পৌঁছে হিমাকে হাসিখুশি দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম! যাক বাবা, তারমানে আবির ভাইয়া হিমাকে এখনো কিছু বলেনি৷ এরপর আমি আবির ভাইয়াকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। আমাকে দেখেই মিশি দৌড়ে এলো,

–“আরে হিয়া আপু! তোমার মুখের একি অবস্থা! মুখ ধুয়েছো ? আর চলো নিশি আপু তোমাকে তখন থেকে খুঁজছে! কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিলে?”

আমি ওর সাথে নিশি আপুর কাছে যেতে-যেতে বললাম,

–“তোর এত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ধৈর্য্য আমার নেই। চল, যাচ্ছি!”

–“তুমি নাকি শাহিল ভাইয়ার সাথে ঝামেলা করেছো?”

আমি একটু থেমে শাড়ীটা ঠিক করতে-করতে মিশিকে বললাম,

–“তুই জানলি কি করে? ওই ছেলেটা তোকে বলেছে?”

মিশি আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে-হাসতে বলল,

–“হুম! ভাইয়া বলছিলো যে, আমার এক সুন্দরী আপু নাকি তাকে অনেক অপমান করেছে! পরে জানতে পারলাম যে, সেই সুন্দরী আপুটা আর কেউ নয়! তুমি!”

আমি আমার ডানহাতটা আমার মুখের একপাশে নিয়ে বললাম,

–“দেখতো আমাকে ভালো করে! আমাকে দেখে কি মনে হয় যে, আমি কাউকে অপমান করতে পারি? আর যার মান-সম্মান বলতে কিছু নেই তার আবার অপমান!”

আমার কথা শুনে মিশিও হেসে ফেললো। তারপর বলল,

–“যাই বলো না কেন, শাহিল ভাইয়া তোমার উপরে ভীষণ রেগে আছে। ”

–“উনি রেগে আছে তাতে আমার কি!আমি কি উনার রাগের কামাই খাই নাকি! ”

এতক্ষণে আমি আর মিশি নিশি আপুর ওখানে চলে এসেছি। সবাই আপুকে হলুদ দিয়ে দিচ্ছে। আমিও দিলাম। সবার মুখেই হলুদ শুধু আমি ছাড়া! আমাকে দেখেই সবাই ছুটে আসলো হলুদ লাগাতে! তারপর জোর করে সবাই মিলে আমার মুখটা পুরো হলুদ বানিয়ে দিলো! শাড়ী পড়ে এমনিতেই আমার অবস্থা নাজেহাল! তারপর হলুদ মাখাতে গিয়ে আরো খারাপ অবস্থা হয়ে গেলো!

সবাই মিলে অনেক মজা করলেও আবির ভাইয়ার কথা মনে হতেই আমার সব খুশি যেন উবে গেলো৷ আমি হিমাকে নিয়ে মিশির রুমে চলে গেলাম। কারণ একমাত্র ওই রুমটাই ফাঁকা ছিলো এখন, বাকিসব রুম লোকজনে ভর্তি!

হিমাকে সবার মাঝখান থেকে ওভাবে টেনে আনায় হিমা কিছুটা বিরক্ত আর অবাক হয়ে বলল,

–“কিরে হিয়া, তুই আমাকে এভাবে টেনে আনলি কেন? আর এতক্ষণ তুই কোথায় ছিলি?”

আমি হিমাকে সবটা বলতেই ওর হলুদে মাখা মুখটা যেন মুহুর্তেই কালো হয়ে গেলো। ও আমার হাত ধরে কান্না-কান্না কণ্ঠে বলল,

–“তুই এটা কি করেছিস হিয়া! তোকে না আমি বারণ করেছিলাম কাউকে না জানাতে! আর তুই আমার জমের কাছেই কথাটা বলে দিয়েছিস? তুই এটা কেন করলি? তোর কথা বললে হয়তো আবির ভাইয়া তোকে কিছুই বলতো না! তুই আমার কথা কেন বললি?”

আমি ওর কাঁধে হাত দিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।

–“দেখ হিমা, অভীক ভাইয়াও সত্যিটা জানে! আর আমি না বলে অভীক ভাইয়া যদি কথাটা আবির ভাইয়াকে জানাতো তাহলে কি আমি মিথ্যাবাদী হতাম না? মাঝখান থেকে আমিও আবির ভাইয়ার কাছে খারাপ হয়ে যেতাম! আর সত্যিটাও জেনে যেতো! এতে কি লাভ হতো বল! তার চেয়ে এখনি সত্যিটা জেনে গেছে এটাইতো ভালো হয়েছে!”

হিমা এবার সত্যি-সত্যিই কান্না করে দিলো। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

–“পরে যা হয় হতো! তুই এখন ভাইয়াকে কেন জানালি? ভাইয়া আমাকে খুন করে ফেলবে!”

–“এভাবে কান্না করলে তোর সব সাজ-গোজ নষ্ট হয়ে যাবে কিন্তু! আর শোন,আবির ভাইয়া আমাকে কথা দিয়েছে যে, তোকে কিছু বলবে না! ট্রাস্ট মি!আমার বিশ্বাস, আবির ভাইয়া নিজের কথা রাখবে! ছোটবেলা থেকে চিনি আমি ভাইয়াকে। একবার যখন কথা দিয়েছে তখন তোকে কিছুই বলবে না। আর বললেও আমিতো আছি নাকি!আমাকে তোর ভরসা হয়না?”

তারপর অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে হিমাকে শান্ত করে রুম থেকে বের হলাম। হিমাও কান্নাকাটি করে আমার মতো অবস্থা হয়েছে৷ একেতো মুখে মেকাপ! তার উপরে হলুদ! তার উপরে এখন আবার কান্না করলো! তাই হিমা মুখ ধুতে চলে গেলো৷ তখন আবির ভাইয়ার বান্ধবী নিশি আপু আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,

–“তুমিই তাহলে সেই হিয়া? যার কথা আবির সব সময় বলে! ”

নিশি আপুর মুখে এমন কথা শুনে আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

–“আমার কথা আবির ভাইয়ার মুখে শুনেছেন?”

নিশি আপু স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো,

–“হ্যাঁ, আবিরতো সারাক্ষণ তোমার গল্পই করে। হিয়ার এই পছন্দ! হিয়ার ওই পছন্দ! হিয়া এই খেতে ভালবাসে!…. আরো অনেককিছু! ওর মুখে তোমার গল্প শুনতে-শুনতে এখন আমারও মুখস্ত হয়ে গেছে যে, তোমার পছন্দ-অপছন্দ কি! আর তুমিতো ছবির থেকেও বেশি সুন্দরী! যদিও এখন তোমার মুখ দেখে সহজে চেনার উপায় নেই!”

বলেই হাসতে লাগলো নিশি আপু৷ আপুর সাথে-সাথে আমিও একটু হাসার চেষ্টা করলাম।তবে আমি কথাগুলো শুনে এতটাই অবাক হয়েছিলাম যে,হাসিটা ভেতর থেকে ঠোঁট অব্দি পৌঁছালো না।

–“তা আবির ভাইয়া আমার আর কি কি গল্প করেছে আপনার কাছে?”

–“করেছেতো অনেক গল্প-ই! তবে শুনলাম যে, তুমি নাকি তোমার কাজিন অভীককে পছন্দ করো?”

কথাটা শুনেই আমি আশেপাশে তাকালাম যে, কেউ আবার আমাদের কথা শুনছে নাতো! তারপর দেখলাম যে, নাহ! তেমন কেউ আশেপাশে নেই! তারপর আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,

–“আপু এটা আসলে একটা ভুল বুঝাবুঝি ছিলো! আমি অভীক ভাইয়াকে পছন্দ করিনা! ”

আমার মুখে এই কথাটা শুনতেই নিশি আপুর মুখে এক প্রকার খুশির ঝিলিক দেখতে পেলাম। তিনি খুশিমনে বলে উঠলেন,

–“রিয়্যালি! তুমি অভীককে পছন্দ করো না? আচ্ছা আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে? যদিও সেটা অনেকটা পার্সোনাল হয়ে যায়! তারপরেও তুমি যদি বলতে!”

আমি হাসিমুখে বললাম,

–“আরে আপু বলে ফেলুন! আমিতো আপনার ছোট বোনের মতই।”

আপু একটু ইতস্তত হয়ে বললেন,

–“তুমি কি কাউকে পছন্দ করো? আই মিন, ভালবাসো? তুমি বলতে না চাইলে থাক!আমি তোমাকে ফোর্স করবো না। আসলে কথাটা জানতে ইচ্ছে হলো তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি!”

এমন প্রশ্ন শুনে আমি অনেকটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। অচেনা একটা মানুষকে আমি কি করে বলব যে, আমি একজনকে ভালবাসি! আর সে হচ্ছে আমার প্রাণপ্রিয় আবির ভাইয়া! তারপর এ হচ্ছে আবার আবির ভাইয়ার-ই বেস্ট ফ্রেন্ড!

আমাকে চুপ থাকতে দেখে নিশি আপু আমতা-আমতা করে বলল,

–“সরি আপু! আমি তোমাকে আগেই বলেছি, তোমার ইচ্ছে না হলে বলতে হবে না! আমি এমনিই জানতে চাইলাম। আসলে তুমি এই কথাটা জানালে আমি আবিরের একটা সিক্রেট তোমাকে জানাবো! এইবার তুমি ভেবে দেখো যে, আমাকে বলবে কিনা!”

আবির ভাইয়ার সিক্রেট! শুনেই আমার ভেতরের আমিটা লাফিয়ে উঠলো। আমি হুট করেই মিথ্যে কথাটা বলে দিলাম,

–“না আপু, আমি কাউকে ভালবাসি না! ”

–“আবিরকেও না?”

আমার উত্তর শুনার পর নিশি আপু আবার এমন একটা প্রশ্ন করবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। আমি কি বলব না বলব তা ভাবছি এমন সময় সেখানে হিমা এসে জানালো যে, বাড়ি যাওয়ার জন্য সবাই বের হয়েছে, আমাদের খুঁজছে!

আমি যেন বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম। কিন্তু কষ্ট একটাই যে, আবির ভাইয়ার সিক্রেটটা শুনতে পারলাম না। আচ্ছা পরে কি নিশি আপু আমাকে সিক্রেটটা বলবে ? নাকি আবির ভাইয়ার সিক্রেট আমার কাছে অজানাই রয়ে যাবে?

চলবে…..