হিয়ার টানে পর্ব-০৬

0
292

#হিয়ার_টানে
#৬ষ্ঠ_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

আবির ভাইয়া নিশি আপুকে হিমার কাছে শুতে বললেও নিশি আপু আমার কাছে থাকতে চাইলো। তখন আবির ভাইয়া জোরেশোরে হেসে দিলো। তারপর বলল,

–“ওকে পাহারা দেওয়ার জন্যই একজন লাগে! তুই আবার ওর কাছে কি থাকবি!”

আবির ভাইয়ার মুখে এমন কথা শুনে আমার খুব রাগ হচ্ছিল। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই নিশি আপু বলল,

–“এত সুন্দরী! যদি চুরি যায়! পাহারা না দিলে কি হয়! আজ না হয় আমিই পাহারা দেবো! কি হিয়া তোমার কোনো আপত্তি আছে নাকি? ”

আমি রাগটা থামিয়ে হেসে বললাম,

–“না আপু, আমার কোনো সমস্যা নেই৷ ”

আমারতো আরো ভালো হয়েছে। আবির ভাইয়ার সিক্রেট কথাটা শুনতে পাবো!

সারাদিন শাড়ী পড়ে থাকতে-থাকতে আমার অবস্থা খারাপ! শাড়ীটা চেঞ্জ করে এসে দেখি যে, নিশি আপু শুয়ে আছে৷ আমি আস্তে-আস্তে আপুর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।তখন আপু আস্তে-আস্তে বলে উঠলো,

–“আমার প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু এখনো পাইনি হিয়া! বলবে না?”

–“কিন্তু আপু আমিতো আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছি। এইবার আপনার বলার পালা।…আবির ভাইয়ার সিক্রেট! ”

নিশি আপু একগাল হেসে বললেন,

–“তোমারতো দেখছি তর সইছে না শোনার জন্য! তুমি আবিরকে ভালবাসো,তাইনা?”

আমি আবারও চুপ করে গেলাম৷ এই নিশি আপু কেন বুঝছে না যে, এই প্রশ্নের উত্তরটা আমি উনাকে দিতে চাচ্ছিনা!আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি আবার বললেন,

–“আবির তোমাকে পছন্দ করলেও কি ওকে ফিরিয়ে দিবে?”

আমি চট করে বলে দিলাম,

–“কখনই না!”

–“কি কখনই না? আবির তোমাকে পছন্দ করবে না? নাকি তুমি ফিরিয়ে দিবে না? কোনটা?”

লজ্জায় আমার কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তারপরেও সেগুলোকে যথাসম্ভব গুছিয়ে বললাম,

–“আবির ভাইয়া কি সত্যি আমাকে পছন্দ করবে কখনো? ”

–“তোমার মতো মেয়েকে পছন্দ না করার কিছুতো দেখছি না। আর আবিরতো হিয়া বলতে পাগল!”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

–“মানে? ”

–“মনে হচ্ছে তুমি কিছুই বুঝোনা! আবির তোমাকে অনেক ভালবাসে! প্রতিবার আসার সময় তোমার জন্য কিছু না কিছু কিনবেই! আমাকে জোর করে ওর সাথে নিয়ে যায়! তোমাকে দিলে সবাই কি ভাববে তাই হিমার জন্যও কিনে! এইবারওতো…”

এটুকু বলেই থেমে গেলো নিশি আপু। আমি যেন কথাগুলো শুনে আস্তে-আস্তে বোবা হয়ে যাচ্ছি কথা হারিয়ে। নিশি আপু থেমে যেতেই আমি বললাম,

–“এইবার কি এনেছিলো? কই আমাকেতো কিছু দেয়নি!”

–“এইবার তোমার জন্য একটা গোল্ডেন রিং এনেছিলো তোমাকে প্রপোজ করার জন্য। কিন্তু তুমি অভীক ভাইয়াকে পছন্দ করো মনে করে তাড়াতাড়ি ফিরে গেছে। ”

–“গোল্ডেন রিং? আমার জন্য? ”

–“হুম। আর টাকাটা কীভাবে জমিয়েছে জানো?”

–“কীভাবে?”

–“ওর টিউশনির টাকা! তোমাকে ও ওর নিজের টাকায় কেনা জিনিস দিতে চেয়েছিলো!”

–“সেই রিংটা কোথায়?”

–“ওর কাছেই আছে। ”

তারপর দু’জনে গল্প করতে-করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।

সকালে যতবার আবির ভাইয়াকে দেখছি ততবার আমার শুধু রিংটার কথাই মনে হচ্ছে। কিন্তু আবির ভাইয়া কাল রাতের পর থেকে আমার সাথে একটা কথাও বলেনি৷ হিমাও মুখটা পেঁচার মতো করে রেখেছে৷ হিমা আর আবির ভাইয়া যে কাল থেকে কথা বলেনি তা তাদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে!

আবির ভাইয়া যে, হিমাকে বকা দেয়নি এটাই আমার কাছে অনেক! নিশি আপুর মুখে রাতে আবির ভাইয়ার অনেক গল্প শুনেছি। যদিও নিশি আপুর চেয়ে আবির ভাইয়াকে আমি বেশিদিন ধরে চিনি। কিন্তু তাদের ভার্সিটির গল্প শুনতে ভালই লাগছিলো!

আজ নিশি আপুর বিয়েতে আমি আর হিমা বেগুনি রঙের একটা ড্রেস পড়েছি। আমরা থাকিও জমজের মতো! আবার আমাদের ড্রেসও জমজের মতো। আমার বাবা বা কাকা কেউ আমাদের একজনের জন্য কোনোকিছু কেনে না৷ যা কিনবে দু’জনের জন্যই! ছোটবেলা থেকেই এমন! তাই কোথাও গেলে সাধারণত আমরা একই ড্রেসগুলো পড়েই যাই।

আমি, হিমা আর নিশি আপু সবার সাথে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ সেখানে শাহিল ভাইয়ার উদয় হলো। তারপর তিনি আমাকে আর হিমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো,

–“আপনারা দুইজন জমজ বোন নাকি? যদিও চেহারায় মিল নেই! তবে দেখতে জমজের মতই। সব জমজের চেহারাইতো আর হুবহু হয়না!”

হিমা হয়ত শাহিল ভাইয়াকে এই প্রথম দেখলো৷ তাই আমার মতো হিমাও অবাক চোখে শাহিল ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,

–“দেখ হিয়া! উনি দেখতে কিছুটা অভীক ভাইয়ার মতো না? আমিতো প্রথমে চমকে গিয়েছিলাম!”

আমি হিমার মুখটা আমার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম,

–“অমন হাঁ করে তাকিয়ে থাকিস না! পরে আবার উনার ভাব বেড়ে যাবে! ”

হিমা আমার দিকে তাকালো। ওর পুরো চোখেমুখে বিস্ময়! তারপর বলল,

–“তুই চিনিস নাকি উনাকে? কই আমাকেতো বলিস নি কিছু!”

–“আরে আমি চিনবো কি করে! কাল ফুপা বললো যে, ইনি নাকি উনার কেমন বোনের ছেলে। তাই শুনলাম আর কি!”

–“ওহ আচ্ছা! তাই বল!”

শাহিল ভাইয়া এতক্ষণ আমার আর হিমার কথা শুনছিলো। তারপর কিছুটা আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল,

–“আপনারা কি আমাকে নিয়ে কিছু বলছেন?”

হিমা উনার কথার উত্তর দিতে যাচ্ছিলো। আমি ওকে টেনে ওখান থেকে নিয়ে আসলাম৷ নিশি আপুও আমাদের সাথেই আসলো৷ তারপর হিমাকে বললাম,

–“তুই শুধু-শুধু উনার সাথে ফালতু কথায় জড়াচ্ছিলি! উনি লোকটা মনে হয় সুবিধার নয়!”

বর চলে এসেছে৷ সবাই ওদিকে চলে গেলো৷ মিশিরা সবাই গেলেও আমি আর নিশি আপু যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম ওখানেই রইলাম৷ বেশি লোকজনের মধ্যে যেতে আমার ভালো লাগে না। নিশি আপুরও হয়তো ভালো লাগে না! কিন্তু তা আর জিজ্ঞেস করা হলো না।

আজ রাতে নিশি আপু হিমার কাছেই ছিল। কাল চলে যাবে জন্য হিমা জোরাজোরি করছিলো ওর কাছে থাকার জন্য৷ নিশি আপুর আজও ইচ্ছে ছিল আমার কাছে থাকার৷ হয়তো আরো গল্প করতে চেয়েছিলো! কিন্তু তা আর হলো না!

অনেক চেষ্টা করেও আজ আর আবির ভাইয়ার সাথে কথা বলতে পারলাম না৷ ভাইয়া অনেক ব্যস্ত ছিলো সারাদিন। ফুপুর ছেলে না থাকায় আবির ভাইয়া মিশির অন্যন্য কাজিনদের সাথে অনেক সাহায্য করেছে। তবে শাহিল ভাইয়ার সাথে যে আবির ভাইয়ার সম্পর্ক ভালো হয়নি তা দু’জনকে একসাথে একবার দেখেই বুঝে গিয়েছি!

আবির ভাইয়া আর নিশি আপু চলে যাচ্ছে জন্য আমার আর হিমার মন কিছুটা খারাপ। এই দুইদিনেই অনেকটা আপন হয়ে গিয়েছিলো নিশি আপু। কিন্তু বিদায়তো দিতেই হবে! আবির ভাইয়াকে আমি প্রাণভরে দেখে নিলাম যাওয়ার সময়। কে জানে আবার কবে সামনে থেকে এভাবে দেখতে পাবো!

আবির ভাইয়ার সাথে আগের মতই কথা হলেও আমি সবসময় এই আশায় থাকি যে, হয়ত আজ-ই আবির ভাইয়া আমাকে তার মনের কথাটা জানাবে! কিন্তু না! সেই সময়টা যেন আবির ভাইয়ার আর হয়ে ওঠেনা। কথা বললে শুরুতেই বলবে ‘ভালো করে পড়াশোনা করবি’। আরে ভাই পড়াশোনা ছাড়া কি মানুষের জীবনে আর কিছু থাকতে পারে না! সেই জন্য রাগ করে পরীক্ষার মধ্যে আবির ভাইয়ার সাথে আর কথাই বলিনি! কল করলেও ধরিনি!পড়াশোনার কথা শোনার জন্য আমি তার সাথে কথা বলব!

আজ আমার এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হলো। আজ ভেবে রেখেছি যে, আবির ভাইয়ার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলব৷ কিন্তু আবির ভাইয়াকে কল করার পর কল রিসিভ করেই বলল,

–“আজতো পরীক্ষা শেষ! তোরতো মজা! আমার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা! আমার প্যারা শুরু!তা পরীক্ষা কেমন দিলি?”

আমি হাসিমুখে বললাম,

–“অনেক ভালো হয়েছে। ”

–“ভালো না ছাই! রেজাল্টেই জানা যাবে!হিমাওতো বললো ভালো হয়েছে! তোদের ভালো! কোনো বিশ্বাস নেই!”

এই কথা শুনেই আমার রাগ হচ্ছে৷ আমি কিছুটা রাগী স্বরে বললাম,

–“কেন? শুধু কি আপনারাই ভালো রেজাল্ট করতে পারেন? আমরা পারি না? যত্তসব ঢং!”

–“কথায় চিড়ে ভিজে না! রেজাল্ট দিলেই দেখা যাবে! আচ্ছা এখন রাখি৷ আমি একটু বাইরে আছি৷ পরে কথা হবে!”

বলেই কলটা কেটে দিলো। রাগে আমার গা জ্বালা করছে! একেতো অপমান করলো! তার উপরে আবার মুখের উপরে কল কেটে দিলো! পছন্দ করি বলে কি তার সাত-খুন মাফ করবো নাকি! আমিও আর কল করবো না!

বিকেলে আমি আর হিমা অনেকদিন পর হাটতে বেড়িয়েছি৷ এমন সময় মা কল করে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলল। আমি আর হিমা প্রায় দৌড়ে বাড়ি চলে গেলাম। তারপর মা বলল,

–“পরীক্ষা শেষ হয়েছে আর দু’জনের পাড়া বেড়ানো আবার শুরু হয়ে গেছে! এখন থেকে দুজনে বাড়িতেই থাকবে! দরকার ছাড়া কোথাও যাবে না!”

হিমা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ন্যাকামো সুরে বলল,

–“কি হইছে চাচি? আমাদের পরীক্ষা শেষ! এখনতো শুধু ঘুরেই বেড়াবো!”

মা এইবার কণ্ঠটা একটু নরম করে বলল,

–“তোমার বড় কাকার নির্দেশ! তোমরা এখন বড় হয়েছো৷ কোথাও যাওয়া যাবে না। তিনি নাকি তোমাদের রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে হাসতে দেখেছে।”

বড় কাকার কথা শুনে আমি আর হিমা দুজনেই চুপ হয়ে গেলাম। কারণ বড় কাকাকে শুধু আমি আর হিমা নয়৷ বাড়ির সবাই ভীষণ ভয় পায়। বড় কাকার কথাই এ বাড়ির শেষ কথা! তার মুখের উপরে কথা বলার সাহস কারোর নেই।

আবির ভাইয়ার পরীক্ষা শেষের দিকে। পরীক্ষা শেষ করেই বাড়ি আসবে! আমার কি যে আনন্দ হচ্ছে তা বলে বুঝাতে পারবো না! আমি বসে-বসে ফোন দেখছি৷ হিমা ওর মামার বাড়ি বেড়াতে গেছে৷ এমন সময় বাবা চিন্তিত মুখে আমার ঘরে এসে বললেন,

–“হিয়া মা, তোকে কাল দেখতে আসবে। তৈরি হয়ে থাকিস।”

কথাটা শুনে আমি রেগে গিয়ে বললাম,

–“দেখতে আসবে মানে টা কি বাবা? তোমরা কি আমাকে আর পড়াতে চাওনা? তুমি বলেছিলে রেজাল্ট দেওয়ার পর আমি কোথাও চান্স না পেলে আমার বিয়ে দেবে। আমি সেটা মেনে নিয়েছি৷ কোচিং করতে যেতে দিলে না সেটাও মেনে নিয়েছি! কিন্তু এখন হুট করে দেখতে আসবে! এসবের মানে কি!”

বাবা নিজের মুখটা নিচু করে বললেন,

–“তোর বড় কাকা ছেলে দেখেছে৷ আমিতো মানা করেছিলাম। কিন্তু বড়ভাই বলল যে…”

আমি কথার মাঝখানেই বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

–“আমি এসব কিছুই জানিনা! আমি এখনি বিয়ে করব না ব্যস!”

বাবা আমাকে স্বান্তনা দিয়ে বললেন যে,

–“দেখতে আসলেইতো আর বিয়ে হয়ে যাবে না! এমন করিস না মা! তোর বড় কাকার মান-সম্মান আছে না!”

অবশেষে বাবার অনুরোধে আমি রাজি হয়ে গেলাম।

পরিদন মা আমাকে পুতুলের মতো সাজিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে বসিয়ে দিলো৷ পাত্র-পক্ষ আমাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখলো৷ সে অব্দিও ঠিক আছে। কিন্তু হঠাৎ ছেলের মা বলে উঠল,

–“দেখাদেখিতো অনেক হলো। জানারতো আর কিছু নেই! আমরা আমরাইতো!….. দেখি মা তোমার বাম হাতটা দাওতো।”

শেষের কথাগুলো আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল। আমি উনার কথার কোনো মানে না বুঝতে পেরে সবার সামনে বাধ্য মেয়ের মতো হাতটা বাড়িয়ে দিতেই ছেলেটা আমার হাতের মধ্যে আংটি পড়িয়ে দিলো।

চলবে….