হিয়ার টানে পর্ব-০৭

0
279

#হিয়ার_টানে
#৭ম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

আমার আঙুলে আংটি পড়তেই আমি রাগী চোখে বাবার দিকে তাকালাম। বাবা চোখ নামিয়ে নিলো। আমি ওখান থেকে চলে আসার জন্য পা বাড়িয়েছি তখন বড় কাকা বলে উঠলেন,

–“হিয়া ওখানে বসো। ”

আমি উনাদের সামনে সোফার উপর বসে পড়লাম।আমার মাথাটা যেন ঝিম-ঝিম করছে। পুরো পৃথিবীটা মনে হচ্ছে ঘুরছে । নিজের অনিচ্ছা সত্বেও আমি ওখানে বসে রইলাম।

উনারা চলে যেতেই আমি রাগে চেঁচিয়ে উঠলাম,

–“বাবা! তুমি এখনো চুপ করে আছো? কি বলেছিলে তুমি? আর এখন কি হলো?”

আমি আংটিটা হাত থেকে খুলতে যাচ্ছিলাম৷ মা আমাকে বাধা দিয়ে বলল,

–“এসব কি ধরনের ছেলেমানুষী! এই আংটি হাত থেকে একদম খুলবি না। এত ভালো ছেলে সারা গ্রাম খুঁজেও একটা পাবি? তোর বাবা যা করেছে তোর ভালোর জন্যই করেছে। ”

–“মা, আমি এ বিয়ে করতে পারবো না। ”

মা বাবার সামনে থেকে আমাকে নিয়ে এলো। তারপর বলল,

–“পাগল হয়ে গেছিস? তোর বড় কাকা শুনলে কি বলবে! মেয়ে মুখে-মুখে তর্ক করছে!”

–“আমি এ বিয়ে করতে পারবো না৷ ব্যস! ”

–“কেন? বিয়ে করতে সমস্যা কি? আজ হোক আর কাল হোক বিয়েতো করতেই হবে। আর একটা কথাও বলবি না৷”

আমি লাজ-লজ্জার মাথে খেয়ে বলে দিলাম,

–“আমি একজনকে পছন্দ করি। আমি এ ছেলে কেন, অন্যকাউকেই বিয়ে করতে পারবো না তাকে ছাড়া! ”

আমার কথাটা শেষ হতে না হতেই বাবা আমার রুমে এসে আমাকে একটা থাপ্পড় দিলেন। আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে, বাবা আমার গায়ে হাত তুলতে পারে। আমি হাঁ করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখের পানিগুলো কোনো বাধা মানছে না। বাবা রেগে গিয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–“তোমার মেয়েকে বোঝাও একটু! উনারা আংটি পড়িয়ে দিয়েছে! এখন এসব বলে লাভ নেই! আমি উনাদের কথা দিয়ে দিয়েছি। দুই’দিন পর বিয়ে। ছেলে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসেছে৷ এখন কোনো অনুষ্ঠান হবে না। শুধু রেজিস্ট্রি করে রাখা হবে৷ ওরা আজকেই করতে চেয়েছিলো, কিন্তু আমি দুইদিনের সময় নিয়েছি। আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে! একটু এরেঞ্জমেন্ট না করলে হয়!”

বাবার মুখে কথাগুলো শুনে আমি ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়লাম। কোনোকিছু বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছি! বাবা এভাবে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি!

–“বেশি বাড়াবাড়ি করলে কালকেই আমি বিয়ের ব্যবস্থা করছি! ”

কথাগুলো বলেই বাবা আমার রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।মা আমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে চলে গেলো। আমি পাথরের মতো অনড় হয়ে ওখানেই বসে রইলাম।

রাতে খাওয়া-দাওয়া না করেই শুয়ে পড়লাম। মা কয়েকবার খাওয়ার জন্য ডাকলেও বাবা একটা কথাও বললেন না। নিজে খেয়ে-দেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। বাবাতো কখনো এমন করে না আমার সাথে! তাহলে আজ কেন এমন করছে!হিমাও নেই যে, ওর সাথে একটু গল্প করবো! আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে কালকেই চলে আসবে বললো।

আমি আংটিটা খুলে টেবিলের উপরে রেখে আবির ভাইয়াকে কল করে সবটা বলতেই আবির ভাইয়া বলল,

–“ছোটকাকা এমনটা করতে পারেনা! এভাবে তোর বিয়ে দিতে পারেনা৷ আমার পরশু সেন্ট্রাল ভাইভা আছে৷ ওটা শেষ হলেই আমি বাড়ি চলে আসছি। তুই চিন্তা করিস না৷ সব ঠিক হয়ে যাবে!”

আমি কান্না করতে-করতে বললাম,

–“কিছুই ঠিক হবে না! পরশু এসে আমার বিয়ে দেখতে চান? আবির ভাইয়া আজ একটা কথা সত্যি করে বলুনতো? আপনি কি সত্যি চান যে, আমার বিয়ে হয়ে যাক অন্যকারো সাথে?”

–“এসব তুই কি বলছিস হিয়া! আর আমার চাওয়া না চাওয়ার কি কোনো মূল্য আছে তোর কাছে? তুইতো বলছিস এখন বিয়ে করবি না!”

–“কেন বলছি সেটা মনে হয় জানেন না?”

–“কেন?”

–“এখনো চুপ করে থাকবেন? আমি সব জানি ভাইয়া! আপনি যদি এখনো চুপ করে থাকেন তাহলে আমি সত্যিই বিয়ে করে নিবো। একবার শুধু বলুন!”

–“হ্যাঁ হিয়া, আমি মানছি আমি তোকে ভালবাসি৷ কিন্তু…”

আবির ভাইয়ার মুখে এই কথাটা শোনার জন্য আমি কতদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম! আজ তার অবসান ঘটলো। তবে এমন একটা পরিস্থিতিতে এমন কথা শুনতে হবে তা ভাবতে পারিনি! আমি এইবার আনন্দে কান্না করে দিলাম। তারপর বললাম,

–“আমি আপনাকে ভালবাসি ভাইয়া! আর আপনিও আমাকে ভালবাসেন৷ পৃথিবীর আর কোনো শক্তি নেই যে, আমাকে অন্যকারো সাথে বিয়ে দিতে পারে! আমি আপনাকে ছাড়া অন্যকাউকে বিয়ে করতে পারবো না। আপনিতো আমাকে গ্রহণ করবেন আপনার জীবনে?”

–“হিয়া এখন এসব বলার সময় নয়! আগে কাকাকে বুঝাতে হবে! বিয়েটা যে করেই হোক আটকাতে হবে! কাকা এভাবে তোর বিয়ে দিতে পারে না! ”

–“সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না! আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আমি কিছুতেই এই বিয়ে করবো না।”

–“হিয়া! তুই আমার সাথে মজা করছিস নাতো? দেখ মজা করা আমার একদম পছন্দ নয়! তুই যদি মজা করে থাকিস আমার থেকে সত্যিটা জানার জন্য তাহলে কিন্তু ভালো হবে না!”

–“আপনার মনে হচ্ছে এমন একটা ব্যাপার নিয়ে আমি মজা করছি? আপনি হিমা বা চাচিকে জিজ্ঞেস করে দেখুন!”

–“আচ্ছা, আমি শুনছি! যদি এটা মজা হয় তাহলেতো বুঝতেই পারছিস!”

–“আচ্ছা!”

আমি আমার মনের কথাগুলো কাউকে জানাতে পারিনি এখনো। এমনকি হিমাকে জানাতেও ভয় লাগছে! ও যদি সবাইকে বলে দেয়! কিন্তু বিয়েটাতো আমি এখনো ভাংতে পারিনি! বাবা বলেছে যে, ছেলেরা নাকি বিয়ে পিছিয়ে দিয়েছে। ওদেরও বাজার-সদাই করতে হবে! আর এবারের ছুটিতো কেটেই গেলো! আবার ছুটি নিয়ে এসে একেবারে অনুষ্ঠান করে নিয়ে যাবে!কথাটা শুনে আমি যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম৷ আবির ভাইয়া চলে আসলে কোনো একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করবে!আবির ভাইয়াও বাবার সাথে কথা বলেছে৷ বাবা কারো কথাই শুনছে না! সে আমাকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে! আমি আবির ভাইয়ার ভরসায় আছি এখন! জানিনা আমাদের ভালবাসার জোর কতটুকু!

রাতে আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি মা পাশে নেই।আমার কেমন যেন ভয় লাগছিলো। রাত প্রায় ৩টা বাজে! আমি মাকে ডাকার জন্য বাবার ঘরের দিকে যেতেই শুনতে পেলাম যে বাবা বলছে,

–“ওতো বুঝতে পারেনি যে, কালকেই বিয়ে? ওকে কিন্তু কিছুতেই জানানো যাবে না। তাহলে কি করবে না করবে কে জানে! ওকে দিয়ে কোনো বিশ্বাস নেই এখন আমার! এখনো রাজি হয়নি বিয়েতে তাইনা?”

মা “না” বলতেই বাবা আবার বলল,

–“রাজি হতে হবে না। ভেবোনা তুমি! এই বয়সে এমন পাগলামি একটু-আধটু করেই থাকে! তুমি শুধু ওকে একটু চোখে-চোখে রেখো! ছেলেটা অনেক ভালো। বিয়ে হয়ে গেলেই দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

–“আমার কিন্তু ভয় লাগছে৷ মেয়েকে এভাবে জোর করে বিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক? যদি বিয়ের পর সমস্যা করে? তখনতো আরো সমস্যা হবে!”

–“তুমি বেশি ভেবো নাতো। কত বিয়ে দেখলাম এমন! সব ঠিক হয়ে যাবে! আচ্ছা তুমি এবার যাও! ও আবার চলে জেগে যেতে পারে!”

কথাগুলো শুনেই আমি কান্না করতে লাগলাম। আমার বাবা-মা আমার সাথে এমন শত্রুতা কেন শুরু করে দিয়েছে? আমি বুঝতে পারছি না! তারমানে কালকেই আমার বিয়ে দিবে? আমি যেন উল্টাপাল্টা কিছু না করি তাই আমাকে শান্ত করে রেখেছে!কেন?

মা এসে আমার পাশে শুয়ে পড়লো৷ তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না! এখনতো আবির ভাইয়াকেও জানানো যাবে না! কিন্তু আবির ভাইয়া ছাড়া আর কাউকে আমি বিয়ে করতে পারবো না!

সকালের আলো ফুটার আগেই আমি মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে বসে-বসে খুব সাবধানে একটা ছোট্ট চিরকুট লিখলাম।

“প্রিয় মা-বাবা,
আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি এই বিয়ে করতে পারবো না৷ আনি একজনকে ভালবাসি৷ তোমরা আমার সাথে এমন কেন করছো জানিনা! তবে আমি তোমাদের অনুরোধ রাখতে পারলাম না। সরি বাবা, সরি মা! আমাকে খুঁজতে হবেনা! আমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছি!
ভালো থেকো, আর আমার জন্য দোয়া করো।
তোমাদের হিয়া…”

বললামতো চলে যাবো। কিন্তু কোথায় যাবো? আবির ভাইয়াকে কল করলাম অনেকবার৷ কিন্তু এত সকালে আবির ভাইয়া কল রিসিভ করলো না৷ আমার একমাত্র গন্তব্য এখন আবির ভাইয়ার ভার্সিটি!

আমি চুপিচুপি মায়ের বোরকাটা পড়ে একটা ছোট হ্যান্ডব্যাগে এক বোতল পানি আর মোবাইলটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। তারপর বাবার মানিব্যাগ থেকে ১০ হাজার খানেক টাকা পেলাম৷ পুরোটাই রেখে দিলাম৷ তারপর অন্ধকারের মধ্যেই বেড়িয়ে পড়লাম। যে মানুষ সকালের আযান হওয়ার পরেও একা রুমের বাইরে যেতে ভয় পাই! সে মানুষ আজ আজানের সময় বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে পড়লাম!

প্রায় আধা-ঘন্টার মতো হেঁটে-হেঁটে আমি বাস স্টেশনে পৌঁছালাম। সকালের বাসটা পেয়েও গেলাম। শহর আমাদের গ্রাম থেকে ততটাও দূরে নয়। দুই ঘন্টার মতো সময় লাগে। আমি বাসে উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। তারমানে এতক্ষণেও চিঠিটা মনে হয় কারোর হাতে পড়েনি! নইলে এতক্ষণে এখানে লোক চলে আসতো! আমি অবশ্য বোরকা পড়ে থাকায় কেউ দেখলেও চিনতে পারছে না। এই যা বাঁচা!

বাস চলতে শুরু করলো। আমি আরো কয়েকবার আবির ভাইয়াকে কল করলাম৷ কিন্তু রিসিভ করলো না। আমার পাশে একটা বয়স্ক মহিলা বসেছিলো। উনি নিজের ফোনটা বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে বলল,

–“কোথায় যাবি মা? আমার মেয়েকে একটু কল দিয়ে দিবি? দেখ রিতা লেখা আছে।”

আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ ফোনটা নিয়ে উনার মেয়েকে কল করে দিলাম।

কিছুক্ষণ পর উনি নিজের ব্যাগ থেকে পাউরুটি আর কলা বের করে খেতে লাগলেন৷ তারপর আমার দিকে একটা রুটি এগিয়ে দিয়ে বলল,

–“নে মা, এই রুটিটা খেয়ে নে। আমার ছেলে কিনে দিয়েছে৷ আমি কি আর এত খেতে পারি!”

আমি না করা সত্বেও জোর করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

–“বুড়ি বলে আমার হাতের জিনিস পছন্দ হচ্ছেনা! বয়স হয়ে গেলে সবাই ঘৃণা করে!”

বলেই অভিমানে উনি রুটিটা আমার হাত থেকে নিয়ে আবার ব্যাগে রাখতে যাচ্ছিলেন৷ আমি উনাকে খুশি করার জন্য রুটিটা উনার হাত থেকে নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। এতটা রাস্তা হেঁটে ক্ষুধাও পেয়েছিলো৷ রুটিটা খাওয়ার সাথে-সাথেই আমার কেমন যেন ঘুম পেতে লাগলো৷ আমি চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললাম। এত সকালে উঠায় হয়তো ক্লান্তিতে এমনটা হচ্ছে!তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।

আমি চোখ খুলে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করে অবাক হয়ে গেলাম! আমার ফোন! ব্যাগ! সব কোথায়? আর আমি হাসপাতালেই বা কি করে আসলাম!

চলবে….