হৃদয় দহন পর্ব-০৫

0
330

#হৃদয়_দহন
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:০৫
🍁🍁
বাড়ির থেকে কিছুটা কাছে একটা লেকের ধারের বেঞ্চিতে বসে আছে রোদ্রিক আর ঐশানি। অচেনা নাম্বারের মেসেজ দেখে কৌতূহলী হয়ে ঠিকানা এবং সময় অনুযায়ী এসেছিল ঐশানি কিন্তু এসেই বড়সর একটা ধাক্কা খেল সে। তাকে মেসেজ করা ব্যক্তিটি হচ্ছে রোদ্রিক। নিরবতা ভেঙ্গে রোদ্রিক বলা শুরু করলো,

– তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে ভেবেছিলাম সঠিক সময়ে বলবো কিন্তু মন আর সায় দিচ্ছে না দু’দিন তোমায় না দেখে এক যুগ না দেখার সমপরিমাণ কষ্ট হচ্ছে।

রোদ্রিক লোকটাকে প্রথম থেকেই কেমন একটা অদ্ভুত লাগছিল ঐশানির। লোকটির শান্ত গলায় বলা কথাগুলোয় তার মনে উতাল পাতাল ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। খুব মনোযোগ সহকারে রোদ্রিকের মুখপানে তাকিয়ে আছে ঐশানি।

রোদ্রিকের দৃষ্টি এতোক্ষণ নিচে ছিল কিন্তু এবার সে সরাসরি ঐশানির দিকে স্থির দৃষ্টি রেখেছে। ঐশানির হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেছে এমন মোহনীয় দৃষ্টি দেখে। নিরবতা ভেঙ্গে ঐশানি প্রশ্ন করলো,

– স্যার আপনি! কি এমন কথা বলবেন যে এইভাবে ডেকে আনলেন?

রোদ্রিক উওর দিলো,
– অনেক কথা আছে কিন্তু তার আগে বলো যাই হয়ে যাক তুমি চাকরিটা ছাড়বে না।

– চাকরি কেন ছাড়বো? অনেক কষ্ট করে চাকরিটা পেয়েছি, আপনি বলুন আপনার কথা।

– আই লাভ ইউ ঐশানি আই রিয়েলি লাভ ইউ।

ঐশানি আরো অবাক হয়ে গেছে, রোদ্রিকের দিকে বিষ্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
– এসব কি বলছেন!

– আমি সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসি তোমাকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে চাই।

– মাত্র দু’দিনের পরিচয়ে এতোটা আবেগ প্রবণ হয়ে গেলেন?

– কে বলেছে দু’দিনের পরিচয়? আমি তোমাকে অনেক আগে থেকেই চিনতাম।

– আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না, যা বলার সোজাসুজি বলুন।

রোদ্রিক দম ছেড়ে বলতে লাগলো,
– মায়া আমার খালাতো বোন ওর সঙ্গেই তোমাকে একদিন দেখেছিলাম আর সেদিন থেকেই তোমাকে আমার ভালো লেগে গেছে, তোমাকে বলতে পারিনি কিন্তু মায়াকে সবটা বলেছিলাম।

ঐশানি বিষ্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
– তাহলে এই চাকরিটা..

– তোমার চাকরির প্রয়োজন ছিল আর তখন মায়া বুদ্ধি করে আমার অফিসের ঠিকানা দেয়।

– এই জন্যই আমার সিভি না দেখেই চাকরি দিয়েছিলেন আর এই জন্যই আমার প্রতি এতোটা উদারতা।

– ভুল বুঝছো আমি শুধু চেয়েছিলাম তুমি আমার কাছাকাছি থাকো আর মায়া চেয়েছিল তোমার উপকার করতে।

ঐশানির কোনো জবাব না পেয়ে ভিতু কন্ঠে,
– দেখো ঐশানি তুমি কিন্তু চাকরিটা ছাড়বে না।

ঐশানি হেসে,
– চাকরি কেন ছাড়তে যাবো, নিশ্চিন্তে থাকুন চাকরি আমি ছাড়ছি না।

রোদ্রিক আশ্বস্ত এবং খুশি হয়ে ঐশানির হাত ধরে,
– তাহলে কি তুমি আমার ভালোবাসা গ্ৰহণ করলে?

ঐশানি নিজের হাত রোদ্রিকের কাছ থেকে ছাড়িয়ে,
– আমি চাই না আমার এই ছোট্ট জীবনের সঙ্গে আর কাউকে জড়াতে দয়া করে এই ভালোবাসা নিয়ে আমার সামনে আসবেন না।

– ঐশানি!

আর কিছু বলা হলো না হুট করে ওদের সামনে সাদিক এসে দাঁড়ালো। ঐশানি কিছুটা ভয় পেয়ে গেছে বিচলিত কন্ঠে,

– সাদ ভাইয়া!

সাদিকের চোখজোড়া লাল বর্ণ ধারণ করেছে রাগে। ঐশানিকে এক টানে দাঁড় করিয়ে,

– কেন আশা করিসনি? এই তোর ইম্পর্ট্যান্ট কাজ এই জন্যই মা’কে মিথ্যে বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিস।

– ভুল বুঝছো তুমি।

সাদিক ধমক দিয়ে,
– যা বুঝার ঠিক বুঝেছি আমি।

রোদ্রিক এতোক্ষণ তাদের কথাগুলো শুনছিল এবার দাঁড়িয়ে সাদিকের উদ্দেশ্য করে,
– আপনি এইভাবে ওর হাত ধরেছেন কেন?

সাদিকের রাগটা আরও বেড়ে গেল,
– তোর হাত ধরার জন্য এখন অন্য কারো অনুমতির প্রয়োজন হবে নাকি?

ঐশানির চোখ ভিজে গেছে সাদিক তাকে ভুল বুঝলো বলে। সাদিক তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু রোদ্রিক আবারো তাদের সামনে এসে,

– সমস্যা কি আপনি জোর করে কোথায়‌ নিয়ে যাচ্ছেন ওকে?

– সে কৈফিয়ত কি আপনাকে দিতে হবে? ওকে যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যাবো।

রোদ্রিক কিছু বলতে যাবে ঐশানি ইশারায় নিষেধ করলো কিছু বলতে। কারণ সে জানে সাদিকের রাগটা, সাদিক রাগলে তার মাথা ঠিক থাকে না যা ইচ্ছে করে ফেলে। রোদ্রিক ঐশানির জন্য চুপ হয়ে সরে গেল। সাদিক ঐশানিকে টানতে টানতে গাড়িতে উঠিয়ে জোরে গাড়ি চালাচ্ছে।

সকালে ঐশানি সাবিনা আহসানকে বলে বাড়ি থেকে বের হয় যা সাদিকের চোখ এড়ায়নি তাই সেও ঐশানির পিছু নিয়ে এখানে এসেছে আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখছিল কিন্তু রোদ্রিক ঐশানির হাত ধরায় সাদিকের রাগ যেন বেড়ে গেল।

এতো জোরে গাড়ি চলছে যে ঐশানির মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে ভিতু কন্ঠে,

– সাদ ভাইয়া আস্তে চালাও এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে তো।

সাদ চুপ করে আগের ন্যায় গাড়ি চালাচ্ছে, মুখটা এখনো রাগে লাল হয়ে গেছে। একসময় গাড়িটা থেমে যায় তাদের বাড়ির সামনে, গাড়ি থেকে নেমেই টানতে টানতে ঐশানিকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে সাদিক। ড্রয়িং রুমে বসা সকলে এমন ঘটনায় অবাক হয়ে যায় কিন্তু সাদিকের কোনো দিকে খেয়াল নেই নিজের মতো করে ঐশানিকে নিয়ে উপরে উঠতে লাগলো।

ওয়াহিদ আহসান জোর গলায়,
– সাদ এসব কি হচ্ছে ঐশি কাঁদছে কেন? দাঁড়াও বলছি।

কারো কথা সাদিকের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি রাগে সে উম্মাদ হয়ে গেছে। ঐশানিকে নিজের ঘরে নিয়ে দরজা আটকে দিলো। এবার ঐশানির ভয়টা বেড়ে গেছে গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না অতি কষ্টে বললো,

– এখানে কেন আনলে?দরজা আটকালে কেন সবাই কি বলবে?

সাদিক ঐশানির গাল দুটো জোরে চেপে ধরে,
– কে কি বললো তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো ঐশানি চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে কিন্তু সাদিকের যেন এতে কোনো নজর নেই সে চেঁচিয়ে,

– তুই আমাকে উওর দে কে ওই ছেলেটা কিসের বস হয় সেদিন গাড়িতে করে দিয়ে গেল কিন্তু তুই অনেক যুক্তি দিলি কিন্তু আজ হাত কেন ধরলো? এখন কি বলবি বল?

– কে আমার হাত ধরেছে তাতে তোমার কি? তুমিও তো রাইশার হাত ধরে ঘুরে বেড়াও আমি কিছু বলেছি তাহলে কেন আমার সাথে এমন ব্যবহার করছো।

মূহুর্তেই ঐশানির গালে আঘাত হলো। সাদিক সর্ব শক্তি দিয়ে ঐশানিকে থাপ্পর মারতেই ঐশানি তাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে গেল ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেঁধেছে। সাদিক হাঁটু গেড়ে বসে,

– এখানে রাইশা কেন আসলো? জেলাস হয় খুব? এতোই যখন জেলাস তাহলে সবার সামনে গিয়ে বিয়েটা ভেঙ্গে কেন দিলিনা?

ঐশানি ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে,
– আমি কেন বিয়ে ভাঙ্গবো তুমি নিজেই তাকে বিয়ে করতে চেয়েছো, আর আমায় ঠকিয়েছ আমার হৃদয় দহন করেছো তারপরও কোন মুখে আমার সামনে আসো তোমাকে কখনো ক্ষমা করবো না আমি।

সাদিকের রাগ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে, টেবিলে রাখা সো পিছটা জোরে ফেলে দিয়ে দরজা খুলতেই বাড়ির সবাই ভেতরে প্রবেশ করলো দেখেই বুঝা যাচ্ছে সবাই এতোক্ষণ ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল ঐশানির ঠোঁটের কোণে রক্ত দেখে ওয়াহিদ আহসান চেঁচিয়ে,

– রক্ত এলো কি করে তুই ওর গায়ে হাত তুলেছিস?

সাদিক ক্ষাপ ছাড়া জবাব দিলো,
– হ্যা।

সঙ্গে সঙ্গে ওয়াহিদ আহসান সাদিককে থাপ্পর মেরে,
– তোর সাহস হয় কিভাবে ওর গায়ে হাত তুলার? আজ সন্ধ্যায় না তোর গায়ে হলুদ তাহলে ওর পিছনে লেগেছিস কেন?

উপস্থিত সকলে স্তব্ধ হয়ে গেছে, সাদিকের রাগ আরো বেড়ে গেছে এই প্রথম কেউ তার গায়ে হাত তুললো। রাগে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল সাদিক।

সাবিনা আহসান ঐশানির রক্ত মুছে দিলো ওয়াহিদ আহসান এগিয়ে ঐশানির মাথায় হাত রেখে,

– অনেক ব্যথা করছে মা? ক্ষমা করে দে আমায় বুঝতে পারছি না তোর সাথে কি হচ্ছে সবাই কেন এমন করছে তবে এর শাস্তি সাদকে পেতে হবে বাড়িতে আসুক।

ঐশানি ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে,
– কিছু বলতে হবে না আঙ্কেল এমনিতেই এই প্রথম আমার জন্য সাদ ভাইয়ার উপর হাত তুললে তুমি।

– আর ও যে তোর উপর হাত তুললো মনে এতো দয়া রাখতে নেই মা।

ঐশানি কিছু বললো না ওয়াহিদ আহসান কিছুক্ষণ বসে চলে গেলেন। সাবিনা আহসান ঐশানিকে তার ঘরে নিয়ে খাইয়ে নিজের কোলে মাথা রেখে মাথায় হাত বুলাচ্ছেন।
________________
সাদিক বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়। রোদ্রিকের সঙ্গে ঐশানিকে দেখেই তার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ঐশানির গালে আঘাত করার কথা মনে পড়তেই ‌নিজের হাতটা গাড়ির কাঁচে জোরে ঘুসি মারে সাথে সাথে কাঁচ ভেঙ্গে হাত কেটে রক্ত বের হওয়া শুরু করলো।

অনেক রাতে বাড়ি ফিরলো সাদিক বাড়ির ড্রয়িং রুমে এখনো আলো জ্বলছে তাকে দেখে ওয়াহিদ আহসান ক্ষিপ্ত হয়ে এগিয়ে,

– কি সমস্যা তোর ঐশানির গায়ে হাত তুললি তার পর সেই যে বের হলি এখন ফিরলি জানতি না আজ তোর গায়ে হলুদ তারপরেও আসলি না কতগুলো মানুষের কথা শুনতে হয়েছে বিয়ে তোর ইচ্ছেতে হচ্ছে আমাদের কেন সম্মান যাবে।

সাদিক এসবে গুরুত্ব না দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে,
– ঐশি কোথায়?

ওয়াহিদ আহসান রেগে,
– একদম ওর নাম মুখে আনবি না যা এখান থেকে কাল তোর বিয়ে আর হ্যা ঐশির ধারের কাছে যাতে তোকে না দেখি আর দেখলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।

সাদিক মাথা নিচু করে উপরে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু সাবিনা আহসান তার কাছে এসে হাত ধরে,
– কিরে তোর হাতে কি হয়েছে ব্যান্ডেজ কেন?

– তেমন কিছু না।

ওয়াহিদ আহসান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে,
– যা ইচ্ছে হোক তোমার দেখতে হবে না এই হাত দিয়েই ঐশির গায়ে হাত তুলেছে।

সাদিক দ্রুত পায়ে চলে গেল।

চলবে……….