হৃদয়াবেগ পর্ব-১১+১২

0
540

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১১
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

পড়ন্ত, নিম্নগামী অপরাহ্ন। সূর্য নুয়ে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। দিবসের উচ্চ তাপ ধীরে ধীরে শিথিল হচ্ছে। ফুটপাত ধরে ধরে হাঁটছে তাহমিদ আর নাযীফাহ। নাযীফাহ’র এক হাত তাহমিদের হাতের বন্ধনে আবদ্ধ। অপ্রত্যাশিতভাবে থমকে দাঁড়ায় তাহমিদ। পা চলা থেমে যায় নাযীফাহ’রও। কপাল কুঁচকে দৃষ্টিপাত করল তাহমিদের দিকে। তাহমিদ প্রশস্ত হেসে পকেট থেকে টিস্যু বের করে নাযীফাহ’র ললাটে অবক্ষিপ্ত হওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘামের বিন্দু মুছে দিলো পরম ত্তয়াস্তায়, কায়মনোবাক্যে। অধর কোণ প্রসারিত হলো নাযীফাহ’র ও।আজকাল তাহমিদ এমন ছোট বড় সমুদয় বিষয়ে যত্ন, ত্তয়াস্তা, উদ্বিগ্নতায় অন্যরকম সুখানুভূতি হয় নাযীফাহ’র। যা আর কখনো সে অনুভব করেনি সে। তাহমিদ অকস্মাৎ স্পর্শে ধঁক করে উঠে তার অন্তঃস্থল। পুলকিত, বিমুগ্ধ, মোহিত হয় তার হৃদয়। অহর্নিশ তাহমিদের আশেপাশে থাকার আকুলতা, অভিলাষ, স্পৃহা নাযীফাহ’র বক্ষগহ্বরের জাগ্রত হয়। তাই তো তাহমিদ যখন হাঁটতে বের হওয়ার কথা বলে সে তখন বিনাবাক্যে রাজি হয়ে যায় হাজার অসুস্থতা থাকা সত্বেও। তার সুখানুভব হয় তাহমিদের হাতে হাত রেখে হাঁটতে।

‘হাওয়াই মিঠাই খাবো ভাইয়া।’

আশেপাশে নজর বুলালো তাহমিদ হাওয়াই মিঠাই খোঁজার উদ্দেশ্যে। এদিক ওদিক তাকিয়ে রাস্তার অপর পাশে দেখতে পেল একটা বারো তেরো বছর বয়সী ছেলে হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করছে। রাস্তা পাড় হওয়ার জন্য উদ্যত হতেই তাহমিদের কর্ণে এসে। ধাক্কা লাগলো কোনো মেয়েলি কন্ঠস্বর

‘কেমন আছেন স্যার?’

কন্ঠস্বর চিনতে ভুল হলো তাহমিদের।নাযীফাহ’র হাত ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। হাত মুষ্টি বদ্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস চালাচ্ছে সে। ভালো মন্দ কোনো উত্তর না পেয়ে সাবিহা পুনশ্চ বলল,

‘স্যার কি আমার উপর রেগে আছেন? আসলে স্যার আমি ওইদিন ওভাবে মিন করিনি ট্রাস্ট মি।’

যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে তাহমিদ জবাব দিলো,

‘তোমার আর আমার সম্পর্কটা শিক্ষক আর ছাত্রীর। তোমার উপর রেগে থাকার মানেই হয় না।’

হাওয়াই মিঠাই ওয়ালা ছেলেটাকে চলে যেতে দেখেই আকস্মিকভাবে নাযীফাহ তাহমিদের হাত খামঁচে ধরে বলল,

‘ভাইয়া হাওয়াই মিঠাই চলে যাচ্ছে। ও ভাইয়া চলে যাচ্ছে তো।তাড়াতাড়ি চলুন না।’

সাবিহা না চিনার ভান ধরে বলল,

‘আপনার বোন হয় বুঝি, স্যার? কিউট কিন্তু খুব। চোখেমুখে মায়া উপচে পড়ছে।যে কেউ দেখলে মোহাচ্ছন্ন হয়ে যাবে।’

‘আপনার বোন হয় বুঝি, স্যার?’ এতটুকুই ছিলো আগুনে ঘি ঢালার মতো। তাহমিদের চোখেমুখে কাঠিন্য, কঠোরতা দেখে দিলো। রাগে হাত চেপে ধরলো নাযীফাহ’র। নাযীফাহ যন্ত্রনায় মৃদু আর্তনাদ করে বলল,

‘ভাইয়া আমার লাগছে।’

নাযীফাহ’র কথা কর্ণপাত না করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো থেমে রিক্সার গুলো কাছে। তাহমিদের অকস্মাৎ রেগে যাওয়ায় মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেলো নাযীফাহ’র। তিন মাস কোচিং করা অবস্থায় স্যারকে কখনো রাগতে দেখেনি সে। আজ হঠাৎ হলো যে স্যার রেগে গেলো? সে তো স্যারের বোনের প্রশংসাই করেছে খারাপ কিছু তো বলেনি। পিছু ডাকতে গিয়েও থেমে গেলো সে। অতর্কিত যদি তাকেও কিছু বলে বসে। তাহলে সহ্য করতে পারবে না সে। তবে স্যারের হঠাৎ রেগে যাওয়াটা সাবিহার কাছে রহস্যই থেকে গেলো।

____________________________________________

রিক্সাগুলো কাছে এসে হাত ছেড়ে দিলো তাহমিদ। নাযীফাহ হাতটা ধরে বলল,

‘এভাবে কেউ ধরে? দেখুন হাতটা লাল হয়ে গেছে।’

মন খারাপ করে অভিমানী স্বরে পুনশ্চ বলল,

‘আর হাওয়াই মিঠাইও চলে গেলো।’

পরপর কয়েকটা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত, স্থির, নিরূপদ্রব করার প্রয়াস চালাচ্ছে তাহমিদ।

‘খেতে হবে না এসব ছাইপাঁশ। বাসায় যাবি এখন।’

‘মাত্রই তো এলাম।’

‘কথা কানে যায় না? বাসায় যাবি মানে বাসায় যাবি।’

কোনো প্রকার কথা না বলে বাধ্য মেয়ের মতো রিক্সায় চড়ে বসলো সে। তাহমিদও বসলো পাশে।

বাসার নিচে আসতেই কাঠকাঠ গলায় তাহমিদ বলে উঠলো,

‘এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা বাসায় যাবি।’

নাযীফাহ শুকনো ঢুক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

‘আপনি যাবেন না বাসায়?’

তাহমিদের রসকষহীন কাঠখোট্টা, নিরাবেগ জবাব,

‘না, তবে সন্ধ্যার পর তুই কোথাও যাবি না। তোর সাথে আমার বোঝাপড়া আছে।’

কপালে সূক্ষ্ম রেখার ভাঁজ পড়ে নাযীফাহ’র। কি এমন করলো সে যে তার সাথে বোঝাপড়া আছে? এসব ভাবতে ভাবতে চলল বাসার দিকে।

বাসায় এসে ফাহিমের সাথে খুনসুটিতে মত্ত হলো নাযীফাহ। তাহমিদের বলা শেষোক্ত কথা গুলো তার মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে গেলো।

নিজেকে শান্ত, অক্রোধ, অনুত্তেজিত করার অভিসন্ধিতে নিরিবিলি, নির্জন জায়গায় এসে বসে আছে তাহমিদ। সামান্য একটা কথার জন্য সে এতো কেন রাগান্বিত, রুষ্ট, ক্রোধিত হচ্ছে তার জানা নেই। নাকি তার ক্রোধের কারন সাবিহা তার স্ত্রীকে বোন বলেছে বলে? অবশ্য বলারই কথা, মাঝরাস্তায় রাস্তায় ভাই ডাকলে যে কেউই বোন মনে করবে। মনের সাথে যুদ্ধ করে উঠে দাঁড়ালো সে। আজ কয়েকটা কথা মেয়েটাকে বলতেই হবে। বরকে ভাই ডাকার স্বাদ জন্মের মতো ঘুচিয়ে দেবে সে।

____________________________________________

চোখ মুখে কঠিনতা বজায় রেখে কলিং বেল চাপলো তাহমিদ। গুটিগুটি পায়ে এসে দরজা খুললো আমেনা বেগম। তাহমিদ বাসায় প্রবেশ করেই হাতে থাকা হাওয়াই মিঠাই গুলো ছুড়ে মা’রল। রাগত, ক্রোধান্বিত, রুষ্ট স্বরে চেঁচিয়ে ডাকলো নাযীফাহ কে। তাহমিদ এর এমন ক্রুদ্ধ স্বরে চমকিত হয় নাযীফাহ। তার মনে পড়ে যায় তখনকার কথা। ভয়ার্ত চোখে মুখে রুম থেকে বেরিয়ে আসে সে। বেরিয়ে আসে ফাহিমও। নিচে পড়ে থাকা হাওয়াই মিঠাই গুলো দেখে মুখে হাসি ফুটলেও তাহমিদের রক্তিম বর্ণের চোখ দেখে চুপসে গেলো সে। তাহমিদ শার্টের দু’টো বোতাম খুলে ঢিলে করল শার্ট। হাত দিয়ে কপাল স্লাইড করলো,

‘আমি তোর ভাই লাগি?’

নিরুত্তর নাযীফাহ। তাহমিদ হালকা চেঁচিয়ে বলল,

‘কথা বলছিস না কেন? আমি তোর ভাই লাগি?’

তাহমিদের চিৎকারে কেঁপে উঠলো নাযীফাহ’র শরীর। আজ পর্যন্ত তাকে কেউ এভাবে ধমক দেয়নি।নাযীফাহ বিস্মিত, আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে।

‘তোকে নিজের স্ত্রী বলে গ্রহণ করেছি মাঝরাস্তায় সবার সামনে আমাকে ভাই ডাকার জন্য? আর মানুষ তোকে আমার বোন বলে জানার জন্য? তুই এখনো বাচ্চা না যে এসব বুঝবি না। তুই গ্রামে বড় হয়েছিস। তোর সমবয়সী অনেকে বিয়ে করে সংসার করছে।আর তুই এখনো দশ বছরে আঁটকে আছিস। এভাবে দিন পাড় করা যায় না,,,,, ‘

নিজের মতো করে কথা বলে যাচ্ছে তাহমিদ। ফাহিম তাহমিদের অগোচরে সামনে দৃষ্টি স্থির রেখে নাযীফাহ কে ফিসফিস করে বলে,

‘আমি আগেই বলেছি, তাহমিদ ভাই তাহমিদ ভাই করে মাথা না খেয়ে ওগো, হেগো, জানু, কলিজা এসব বলে ডাক শুনলি না তো আমার কথা। গরীবের কথা বাসি হলেও ফলে। এখন আমার ভাইয়ের চোখে রাগ, ক্রোধ আর রোষানল না দেখে ভালোবাসা দেখ তাহলে মন খারাপ হবে না।’

বলেই নাযীফাহ’র দিকে তাকাতেই দেখলো,নাযীফাহ’র চক্ষুদ্বয় নয়নবারিতে টইটম্বুর। নিমেষ ফেললে হবে ভারী বর্ষণ। আর কিছু বলার সাহস করলো না ফাহিম।

যে যার রুমে কিন্তু ড্রয়িং রুমের কোণে অবহেলায়, অবজ্ঞায় পড়ে আছে সেই হাওয়াই মিঠাই গুলো। যা একটু একটু করে চুপসে যাচ্ছে।

____________________________________________

হাই স্পিডে পাখা ছেড়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে নাযীফাহ। যেন সবাই বুঝতে পারে সে ঘুমিয়ে আছে। রাতে খাওয়ার সময় তাহমিদ দেখলো ফাহিম আর আমেনা বেগম থাকলে নাযীফাহ নেই
তাহমিদ বসতেই আমেনা বেগম আর ফাহিম খাওয়া শুরু করলো। তাহমিদের বিপরীতের জায়গাটা খালি দেখে গলা দিয়ে ভাত নামলো না তাহমিদের। ভাত গুলো নড়াচড়া করে পানি ঢেলে উঠে গেলো সে। ফাহিম কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও দীর্ঘশ্বাস ফেলল আমেনা বেগম।

নিগূঢ়, ঘুটঘুটে যামিনী। এলোমেলো হয়ে গভীর তন্দ্রায় নিমগ্ন নাযীফাহ। ধীর, সুস্থির পায়ে হেঁটে নাযীফাহ’র কাছ এসে বসলো তাহমিদ। তন্দ্রাচ্ছন্ন নাযীফাহ’র ফোলা ফোলা আঁখিদ্বয় দেখে অনুশোচনা হতে লাগলো তাহমিদের। খুব সতর্ক ভাবে নাযীফাহ’র মাথায় হাত রাখলো তাহমিদ। জেগে গেলে যাবে। ও কিছু একটা বলে বুঝিয়ে দিবে। নাযীফাহ’র একটা হাত নিজের হাতের মুঠোতে নিলো সে। হাতটা আঁকড়ে ধরে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো ঘুমন্ত, নিদ্রামগ্ন নাযীফাহ’র দিকে।

নাতির উপস্থিতি টের পেয়েও সাড়াশব্দ করলো না আমেনা বেগম। তবে নাতির করুণ অবস্থা দেখে হাসি পেল তার খুব।

____________________________________________

সকালে নাস্তার টেবিলেও নাযীফাহ কে না দেখে তাহমিদের অন্তঃস্থল থেকে নির্গত হয় তপ্ত শ্বাস। নাস্তা করার ইচ্ছে না থাকলেও বসে সে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলো চুপসে যাওয়া হাওয়াই মিঠাই গুলো সোফার উপরে। খারাপ লাগলো তার। হাতের ভাঁজে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে তাহমিদ। আমেনা বেগমের কাঠখোট্টা কথা,

‘মেয়েটাকে এভাবে ধমকে ধামকে না বললেও পারতে দাদুভাই। সে জন্মের পর থেকেই তোমাকে ভাই বলে ডেকে এসেছে। তুমি যে তার বর হবে সেটাতো সে জানতো না। বা বিয়ের পরও তাকে তুমি নিষেধ করোনি ভাই ডাকার জন্য। মেয়েটা রাতেও কিছু খায়নি। এখনো এতো টানাটানি করে এলাম আসলো না।তুমি মাঝে মাঝে এমন বোকার মতো কাজ করো কি বলবো।’

কোনো জবাব দিলো না তাহমিদ। সাবিহা তার স্ত্রীকে বোন বলেছে বলেই তার এতো রাগ। এটা তো এখানে বলতে পারবে না। বিবাহিত জানলে হয়তো আর তাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতো না।

____________________________________________

পরিশ্রান্ত অপরাহ্নে জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে নাযীফাহ। মন মস্তিষ্ক তার বিক্ষিপ্ত। তাহমিদের রণমুর্তি যেন সে এখনো তার চোখ থেকে সরাতে পারছে না। তাহমিদের দিক থেকে তাহমিূ যেমন ঠিক তারও খুব খারাপ লাগছে। এভাবে না বললেও তো হতো।

ফাহিম বাসায় নেই। আমেনা বেগম ছাদে গিয়েছে বাইরে থেকে দরজা আটকে। নাযীফাহ’র কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না বলে জানালা দিয়ে নীল আকাশ দেখছে।

শব্দ করে দরজা আটকানোর আওয়াজে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে নাযীফাহ’র। বাসায় তো কেউ যে রুমের দরজা আটকাবে। তাহলে কি,,,

#চলবে

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১২
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

পশ্চাদভিমুখে আবর্তিত হয়ে তাহমিদ কে দেখে জানে পানি আসলো নাযীফাহ’র। বদ্ধ কামরায় সে আর তাহমিদ অন্তঃস্থলে এক নাম না জানা ঝড় বইতে শুরু করলো। সেই ঝড়ে নেই কোনো ভয়, নেই কোনো আশংকা। আছে শুধু এক রাশ ভালো লাগা, অজানা অনুভূতির সংমিশ্রণ, আসক্তি, অনুরাগ আর অভিরতি। তাহমিদ কে দেখে প্রফুল্লিত, আনন্দিত হলো হৃদয়। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলো না। চেহেরায় এমন অভিব্যক্তি করলো যেন সে খুব বিরক্ত হয়েছে তাহমিদ কে দেখে। কাল এতো বকাবকির পরেও সে এই মুহূর্তে খুব করে তাহমিদের সঙ্গ চাইছিলো। কেন চাইছিলো এই প্রশ্নের উত্তর তার অজানা। তবে তাহমিদ তার আশেপাশে থাকলে মন খারাপেরা কাছে ঘেঁষতে পারে না।

নাযীফাহ’র অভিমানী মুখশ্রী দেখে তপ্ত, উষ্ণ শ্বাস ফেলে তাহমিদ। শ্লথ, মন্থর গতিতে নাযীফাহ’র পিছনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। তাহমিদের প্রশস্ত বুকে এসে ঠেকে নাযীফাহ’র পিঠ।কম্পান্বিত হয় নাযীফাহ’র হৃদয়গহ্বর। বাইরে তা প্রকাশ করলো না সে। চোখমুখ খিঁচে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। নাযীফাহ’র অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করে স্মিত হাসে তাহমিদ। নিজের মুখ নাযীফাহ’র কানের কাছে নিয়ে গেলো সে। চুল থেকে শ্যাম্পুর মাতাল করা সৌরভ আসছে। পরম আবেশে চুলে নাক ডুবাতে ইচ্ছে করছে তার। হাত মুষ্টিমেয় করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো সে। নম্র, মৃদুস্বরে বলল,

‘রেগে আছিস আমার উপর?’

নিশ্চুপ, নিশ্চল নাযীফাহ। শ্রবণগোচর হচ্ছে শুধু শ্বাস প্রশ্বাসের নিনাদ। অভিমানিনীর অভিমান দেখে মৃদুমন্দ, অক্রূর হাসলো সে।

‘রাগ কি খুব বেশি হয়েছে?’

এবারও নীরব, নিসাড়া রইলো সে। তাহমিদের অন্তঃস্থল নির্গত হলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস। অভিমানিনীর অভিমান যে কতটা দুর্ভেদ্য, শঠতাপুর্ন তা তাহমিদের অজানা নয়। নাযীফাহ কে নিজের দিকে ফিরালো তাহমিদ। হাওয়ায় এলোমেলো হওয়া চুলগুলো পরম যত্নে গুঁজে দিলো কানের পিছনে। নাযীফাহ’র নত মস্তক উপরে তুলতেই দেখতে পেল নেত্রজলে টইটম্বুর কনীনিকা। তাহমিদের এমন স্নিগ্ধ শীতল স্পর্শ এবং আহ্লাদীপনায় ম্লান হলো নাযীফাহ’র নয়নবারি। প্রেয়সীর এমন ক্রন্দনরত মুখশ্রী দেখে নিজের সেই বহুদিনের আন্তরিক বাসনা, স্পৃহা আর দমিয়ে রাখতে পারলো না তাহমিদ। অর্ধাঙ্গিনীর ঘর্মাক্ত কপালে অধরের উষ্ণ স্পর্শ দিয়েই দিলো সে। শিরদাঁড়া বেয়ে তরল স্রোত বয়ে গেলো নাযীফাহ’র। পরম আবেশে দুইজন চোখ বন্ধ করে ফেলল।তাহমিদের উষ্ণ, সন্তপ্ত, অত্যষ্ণ মন শীতল হয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ডে। ওষ্ঠে ফুটে উঠলো তৃপ্তি আর সন্তুষ্টির হাসি। তাহমিদের শার্ট খামচে ধরলো নাযীফাহ। অন্তঃস্থল তারও শীতল হয়ে এলো। মিনিট খানিক ওভাবেই থেকে দূরে সরে এলো তাহমিদ। তাহমিদের আকস্মিক কান্ডে লজ্জায় মাথা নত করে রাখলো নাযীফাহ।

‘যদি ভেবে থাকিস তোর অভিমান ভাঙানোর জন্য এমন করেছি তাহলে বলবো এটা আমার অধিকার। তোকে ছোঁয়ার পূর্নাঙ্গ অধিকার আমার আছে। কালকের বকাবকির জন্য কিছুই আমি বলবো না। আর না বলবো আমি ভুল করেছি। একটা সময় তুই আমার বোন ছিলি। তবে এখন আমাদের সম্পর্কের ধরন বদলেছে, মানে বদলেছে। আমরা নতুন একটা সম্পর্কে বাঁধা পড়েছি। এক ঘরে থাকি না বলে যে সম্পর্কের মানে বদলে যাবে এমনটা তো নয়। এখন তোর এই ভাই সম্বোধন এর জন্য তোকে যদি কেউ আমার বোন বলে আমার রাগ হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়? যেদিন আমার মতো যেদিন হবি সেদিন বুঝবি গতকালকের রাগের কারণ।’

এতটুকু বলে থামল তাহমিদ। তারপর পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলালো নত মস্তকে দন্ডায়মান কিশোরীর দিকে। ‘কবুল’ বলে গ্রহণ করার পর অন্যরকম টান অনুভব করে এই মেয়েটার উপর। এটাই হয়তো বিয়ের মমার্থ। নাযীফাহ কে পুনশ্চ লজ্জায় ফেলার জন্য তাহমিদ কুটিল হেঁসে বলে,

‘মনের সাথে যু’দ্ধে পরাস্ত, অভিহত হয়ে যখন তোকে অন্যরকম ভাবে নিজের স্পর্শ দিয়েই ফেলছি তখন এমন হুটহাট স্পর্শের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাক। হয়তো আমর্শ আরো গভীর হবে। একবার যখন তোর কপাল অব্দি আমার ঠোঁট পৌঁছে গেছে তখন আর এমন হুটহাট স্পর্শের জন্য নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে পারবো না। আজ কপাল ছুঁয়েছি কাল হয়তো তোর অধর স্পর্শ,,,।’

এতোক্ষণ যাও একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছিলো নাযীফাহ। তাহমিদের এমন ধারা কথা শুনে লজ্জায় মিইয়ে গেলো সে। নাযীফাহ’র লাজুক, রক্তিমাভ মুখশ্রী দেখে ক্রূর হাসলো তাহমিদ। কিয়ৎকাল পার হলো। নাযীফাহকে স্বাভাবিক করার জন্য বলে উঠলো,

‘আমার অপ্রত্যাশিত রাগ, অমর্ষ হজম করতে গিয়ে তো রাতে খাওয়া দাওয়া করলি না সকালেও না। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি দু’জন একসাথে খাবো।’

নাযীফাহ চট করে বলে ফেলল,

‘আপনি তো ঠিকই খেয়েছেন। আমি সকালে দরজার আড়াল থেকে দেখেছি।’ বলেই জিভে কামড় দিলো সে।

বাগাড়ম্বরপূর্ণ, শব্দবহুল হাসলো তাহমিদ।

‘বসলেই খাওয়া হয়? কেউ একজন আমার জন্য খাওয়া দাওয়া করলো না। আর আমি দিব্যি খেয়ে নিবো? এতোটা পাষাণ, নির্দয় অন্তত আমি না। আমি যাচ্ছি তুই আয়।’ বলেই চলে গেলো তাহমিদ।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে ড্রয়িং রুমে মাত্রই বসল দু’জন। খাওয়ার পুরোটা সময় তাহমিদ নাযীফাহ’র দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলেও নাযীফাহ মাথা নত করে খাওয়া শেষ করে। তাহমিদের চোখে চোখ রাখার সাহস করে উঠতে পারেনি সে। আকস্মিক কলিংবেলের আওয়াজে ঘাবড়ে যায় নাযীফাহ। তড়িঘড়ি করে বুকে থুথু দেয় সে। তাহমিদ বিদ্রূপপূর্ণ দৃষ্টিপাত করে বলে,

‘কলিংবেলই বেজেছে বাঘ ভালুক তো আসে নাই যে এভাবে ঘাবড়ে যেতে হবে। মনে হয় দাদি আসছে তাড়াতাড়ি দরজা খোল।’

তাহমিদের কথায় কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করতে করতে দরজা খুলে নাযীফাহ। দরজা খুলেই দেখতে পায় আমেনা বেগমের সূঁচালো, তীক্ষ্ণধার দৃষ্টি।

‘আমি তো বাইরে থেকে দরজা আঁটকে গিয়েছিলাম। তাহলে বাসায় কে এলো?’ তারপর তাহমিদকে বসে থাকতে দেখেই বিদ্রুপের সুর টানলো,

‘ওওওওওওওওও আপনি? তলে তলে সবাই টেম্পু চালায়।আর আমরা সাধারণ জনগণ হ’রতাল ভেবে মন খারাপ করি।’

তাহমিদ মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,

‘কোনো এক সময় তোমরাও হ’রতাল, অ’বরোধ সবকিছু করেছো। এখন আমরা করলেই দোষ?’

____________________________________________

‘তোমাদের কতদিন হলো দেখি না মা। আমি না হয় না গেলাম গ্রামে তোমরা তো আসতে পারো। মোবাইলে দেখে কি আর বাবা মা দেখার তৃপ্তি মিটে? না আমি তোমার কোলে মাথা রাখতে পারি আর না তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারো। তোমার মমতাময়ী, স্নেহশীতল স্পর্শ পাওয়ার জন্য আমার অন্তর কাঁদে মা।’ মোবাইল স্ক্রিনে মায়ের দিকে তাকিয়ে অসহায়, নিরাধার, বিবশ গলায় বলে উঠলো নাযীফাহ।

এপাশে মেয়ের কথা শুনে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেলো ফাহমিদা বেগমের মুখ। তিনিও মেয়ের দিকে অসহায়, নিরুপায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। মেয়ের জন্য তারও অন্তর কাঁদে। রাতে বেলা মেয়ে ঘুমালে ঘুম থেকে উঠে তিনি কয়েকবার মেয়েকে দেখে যেতেন। কতদিন হলো মেয়েকে সামনা-সামনি দেখেন না। তিনি শুকনো,মলিন হেসে বলেন,

‘এই তো কয়েকদিন পরে ধান কা’টা পড়বে। নতুন ধান ঘরে তুলে তারপর ঢাকা যাবো। সাথে করে নিয়ে যাবো আতপচাল। তোর তো পিঠাপুলি পছন্দ। তোর ফুপু, ফুপাও যাবে। বেশ কয়েকদিন থেকে আসবো।’

____________________________________________

নিজেদের রুমে খুনসুটিতে মত্ত আমেনা বেগম আর নাযীফাহ। আমেনা বেগম উনার ছোট বেলার ঘটনা বলছেন আর নাযীফাহ হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। ঐ সময় রুমে প্রবেশ করে তাহমিদ। নিজেকে সামলে ঠিক হয়ে বসে নাযীফাহ। তাহমিদ কে মাথা নত করে ফেলে সে । তাহমিদ কে দেখলে তার লজ্জারা ভর করে। লোকটার চোখে চোখ রাখার সাহস তার হয় না। তাহমিদ স্বাভাবিক গলায় বলল,

‘তোর কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করেছিলাম। সিলেক্ট ও হয়েছিস। আমি যেই কোচিং-এ ক্লাস নেই সেখান থেকে রিক্সায় গেলে ১৫ মিনিটের দূরত্ব। কলেজ ছুটির পরে সেখানে একাডেমিক কোচিং ক্লাসও হয়। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সেখানেও ক্লাস করবি তুই। তাহলে দু’জন একসাথে বাসায় আসতে পারবো। তোর কথা ভাবতে গিয়ে আলাদা চাপ নিতে হবে না আমার।’

‘তাহলে দু’জন একসাথে বাসায় আসতে পারবো’, এটা শুনে অধর জোড়া প্রসারিত হলো নাযীফাহ’র।

চলে গেলো তাহমিদ।

____________________________________________

পরদিন সকাল বেলা সবাই নাস্তার টেবিলে আসলেও তাহমিদ এলো না। আমেনা বেগম ডাকতেই সে বলল,

‘এখন আমার খিদে নেই দাদি।তোমরা খেয়ে নাও। আজকে কোচিং-এ আমার ক্লাস নেই। আজ বাসায় আছি যেকোনো সময় খেতে পারবো।’

বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো নাযীফাহ। ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো আমেনা বেগমের।

‘তুই দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? তোর কি হলো?’

নিশ্চুপ, নীরব, নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো সে। আমেনা বেগম কিছুটা আন্দাজ করে বলেন,

‘তাহমিদের সাথে খাবি?’ মাথা নাড়ে নাযীফাহ।

ফাহিম খোঁচা দিয়ে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই আমেনা বেগম চোখের ইশারায় না করে। চুপ হয়ে যায় ফাহিম। নিজের রুমে চলে গেলো নাযীফাহ। নাযীফাহ চলে যেতেই আমেনা বেগম ফাহিম কে বলেন,

‘সব সময় ওকে লজ্জা দিস না। বিশেষ করে এই বিষয়গুলোতে। মেয়েটা একটু একটু বুঝতে শিখছে। আমরা মজা নিলে কিন্তু সে লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নিবে। বড় দাদু ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসাটা আর প্রকাশ পাবে না।’

সম্মতিতে মাথা নাড়ে ফাহিম।

____________________________________________

কপালে হাত ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে তাহমিদ। ফাহিম শব্দহীন পায়ে হেঁটে তাহমিদের পায়ের কাছে গিয়ে দিগ্বর্তী হলো। নির্বিরোধ গলায় ডাকল তাহমিদকে। তাহমিদ সেই অবস্থায় থেকে জবাব দিলো, ‘হুম?’

ভাইয়ের সাথে কথা বলতে গলা কাঁপছে ফাহিমের। কান্নাগুলো দলাপাকিয়ে গলায় আটকে আসছে।

‘আমি যে কোনো ভার্সিটিতে চান্স পেলাম না তুমি কি আমার উপর রেগে আছো? তোমার এখানে কোচিং করা কত ছেলে মেয়ে চান্স পেলো। আর আমি তোমার ভাই হয়ে ব্যর্থ। বিশ্বাস করো ভাইয়া আমি অনেক চেষ্টা করেছি।’

কপাল থেকে হাত নামিয়ে ছোট ভাইয়ের দিকে নেত্রপাত করলো তাহমিদ। ভাইয়ের আগুন লাল, রক্তিম বর্ণের চক্ষুদ্বয় দেখে ভীত, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যায় ফাহিম।

#চলবে