হৃদয়াবেগ পর্ব-১৩+১৪

0
525

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১৩ (Bonus)
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

ভাইয়ের গাঁয়ে হাত চমকিত হয় ফাহিম। সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। যার দরুন চক্ষুদ্বয় লাল আকার ধারণ করেছে। ফাহিম উচ্চস্বরে ডাকলো আমেনা বেগম আর নাযীফাহ কে। ফাহিমের আচমকা এমন ডাকে ঘাবড়ে যায় দু’জন। তড়িৎ গতিতে রুমে এসে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তাহমিদ কে দেখে বুঝতে পারে ওর কিছু একটা হয়েছে। আমেনা বেগম তাহমিদের কপালে হাত দিয়ে নাযীফাহ কে বলে একটা বাটিতে পানি আর কাপড়ের টুকরো নিয়ে আসার জন্য। জলপটি দিতে হবে। নাযীফাহ এসব নিয়ে এলে চোখের ইশারায় বলে তাহমিদের কপালে জলপটি দেওয়ার জন্য। ফাহিম নিচে গিয়েছে গলির মোড়ের ফার্মেসীতে বসা ডাক্তার কে নিয়ে আসার জন্য।

নাযীফাহ অনবরত জলপটি দিয়ে যাচ্ছে। শরীরের তাপমাত্রা কমার কোনো লক্ষণ নেই। ডাক্তার জ্বর মাপার পর বলেছে ১০৪° জ্বর। আপাতত জ্বর কমার জন্য ঔষধ দিয়ে গেলেও বলেছে, যদি কালকের ভিতর জ্বর না কমে তাহলে যেন হাসপাতালে নিয়ে যায়। বার কয়েক ভিজা তোয়ালে দিয়ে শরীরও মুছে দেওয়া হয়েছে।

বিকাল তিনটা!

তাহমিদের শরীরের তাপমাত্রা নামতে শুরু করেছে। সে চোখ বন্ধ করে রাখলেও সব শুনতে পাচ্ছে। ভাইয়ের শিয়রের কাছে বসে ফাহিম বলল,

‘ভাইয়ার জ্বরের খবরটা মাকে দেওয়া দরকার।’

তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে তাকায় তাহমিদ। তারপর দূর্বল গলায় বলল,

‘মাকে এসব বলিস না। আমরা দুই ভাই এখানে থাকি বলে এমনিতেই মায়ের টেনশনের শেষ নেই। এসব বললে মা পাগলামি করবে। তাছাড়া এখানে তো দাদি আছে। অযথা মাকে টেনশন দিস না।’

আমেনা বেগমও বললেন,

‘এখন এসব বলার দরকার নাই। যদি সকালের ভিতরে একেবারে জ্বর না ছাড়ে তখন বলা যাবে।’

ফাহিমেরও কথা গুলো যৌক্তিক মনে হলো। আমেনা বেগম নাযীফাহ’র কাছে এসে ওর মাথায় হাত রাখলো।

‘সকালে তো নাস্তা করলি না। এখনও দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো আয় কিছু একটা খেয়ে নিবি।’

বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় তাহমিদ।

‘ও এখনো কিছু খায়নি?’

আমেনা বেগম প্রাণহীন, নির্জীব গলায় বললেন,

‘সকালে তুই পরে খাবি বলাতে ও বলেছিলো তোর সাথে খাবে৷ এরপর তো তোর এই অবস্থা। তোর কপালে জলপটি দিলো।খাওয়ার সুযোগ হলো কই?’

‘তাহলে এক প্লেটে খাবার নিয়ে আয়। তুইও খাবি আমিও খাবো।’

তাহমিদের এমন কথায় চোখ বড় বড় করে তাকায় নাযীফাহ। বিস্মিত গলায় বলে,

‘আপনি আমার হাতে খাবেন?’

শরীরের উষ্ণতার জন্য এমনিতেই চোখ লাল তাহমিদের। নাযীফাহ’র এমন কথায় চোখ গরম করে তাকায় সে। মুখ টিপে হাসলো আমেনা বেগম এবং ফাহিম।

____________________________________________

নাযীফাহ এক লোকমা ভাত তাহমিদের মুখে দিতেই তাহমিদের মনে হলো কেউ তার মুখে নিম পাতার রস ঢেলে দিয়েছে। ভাত মুখে নিয়ে থম মে’রে রইলো তাহমিদ। নাযীফাহ ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই তাহমিদ চোখ মুখ খিঁচে ভাত গলাধঃকরণ করলো তাহমিদ। তারপর ইশারায় নাযীফাহকে খেতে বলল।

তাহমিদের শরীরের তাপমাত্রা এই কমছে এই বাড়ছে। রাতে জ্বর হালকা কমতেই আমেনা বেগম বললেন,

‘নাযীফাহ তো ছোট ও তাহমিদের সাথে থাকতে পারবে না। আর ফাহিম তোরও রাতে না ঘুমালে মাথা ব্যথা করে।আমি বরং দাদু ভাইয়ের কাছে থাকি।’

নাযীফাহ আমতাআমতা করে বলল,

‘দাদি, বলছিলাম কি আমি থাকি? তুমিও অসুস্থ।’

আমেনা বেগম মলিন গলায় বললেন,

‘না রে বোন তুই পারবি না।তার চেয়ে ভালো আমিই থাকি।’

নাযীফাহ আমেনা বেগমের হাত দু’টো ধরে বলল,

‘আমার অন্য জায়গায় বিয়ে হলে তো সব কাজ করতে হতো সবাইকে আগলে রাখতে হতো।সেখানে তোমরা আমাকে একটা বিড়াল ছানার মতো যত্নে রাখছো। আমি না হয় উনার কাছে। যদি রাতে বেশি ছটফট করে তাহলে তোমাদের ডাকবো।’

ফাহিম এগিয়ে এসে নাযীফাহ’র মাথায় হাত রেখে বলল,

‘আমাদের ডানপিটে নাযীফাহ তাহলে একটু একটু করে বড় হচ্ছে।’

____________________________________________

মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাহমিদের মাথার কাছে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে নাযীফাহ। মাঝরাতে গোংরানির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। তাহমিদের কপালে হাত দিয়ে বুঝতে পারে জ্বরের মাত্রা আবারও বেড়েছে। হাতের কাছের বাটি থেকে কাপড়ের টুকরো টা নিয়ে আবারও জলপটি দিতে শুরু করে সে। তাহমিদের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

‘বেশি খারাপ লাগছে আপনার? দাদি কে ডাকবো?’

কোনো সাড়াশব্দ করলো না তাহমিদ। উঠে দাঁড়াতেই নাযীফাহ’র হাত শক্ত করে ধরে সে। চকিত হয় নাযীফাহ। শান্ত, নিস্তরজ স্বরে তাহমিদ বলে উঠলো,

‘তুই আমার পাশে থাক। আমার আর কাউকে লাগবে না। একটু ভালোবেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দে।দেখবি আমার জ্বর কমে গেছে। কোথাও যাস না আমার কাছেই থাক। আমার শুধু তোর সঙ্গ চাই।’

বিড়বিড় করে ঘুমিয়ে গেলো সে। আর উঠে গেলো না নাযীফাহ। তাহমিদ মাথায় জলপটি দিতে লাগলো। তারপর একটা তোয়ালে ভিজিয়ে দুপুরের মতো আবারও বুক, হাত, গলা মুছে দিলো। তোয়ালেটা ওয়াশরুমে মেলে দিয়ে রুমে এসেই দেখলো তাহমিদ খাটে বসে আছে। নাযীফাহ কাছে এসে বসেই কপালে হাত দিয়ে বলল,

‘জ্বর কি ছেড়েছে?’

তাহমিদ তাকালে নাযীফাহ’র দিকে। চোখ দুইটা পূর্বের ন্যায় টকটকে লাল। নাযীফাহ প্রথমে ভয় পেলেও সামলে নিলো নিজেকে। অকস্মাৎ তাহমিদ নাযীফাহ’র বক্ষঃস্থলের দিকে ইশারা করে বলে,

‘ তোর এইখানে আমাকে একটু জায়গা দিবি? আমার অশান্ত মনটাকে একটু শান্ত করবি? তোর,,,’

আর কিছু বলার আগেই নাযীফাহ বলল,

‘আপনি পাগলামি করছেন। আমি দাদিকে ডেকে নিয়ে আসি।’

তাহমিদের সেই আগের উত্তর,

‘তুই কোথাও যাবি না। আমার শুধু তোকে প্রয়োজন। আচ্ছা থাক তোর বুকে আমাকে জড়িয়ে নিতে হবে না। কিন্তু আমার পাশ থেকে কোথাও যাবি না।’

বলেই শুয়ে পড়লো সে। নাযীফাহ বোকার মতো তাকিয়ে আছে আর তাহমিদের পাগলামি দেখছে। সেখানেই থম মে’রে বসে রইলো সে। আকস্মিকভাবে তাহমিদ নাযীফাহ’র কোলে মাথা রেখে পেটে মুখ ডুবিয়ে দিলো। তাহমিদের এহেম কান্ডে হতবিহ্বল হয়ে গেলো নাযীফাহ। সমস্ত কায়া কেঁপে উঠল তার। হৃদপিণ্ডের লব ডবের মাত্রা যেন কয়েকগুন বেড়ে গেলো। তাহমিদের শরীরের উষ্ণতা যেন নাযীফাহ’র শরীরেও ছড়িয়ে পড়ছে। নাযীফাহ কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। তাহলে কি তাহমিদ এই গভীর, প্রগাঢ়, আবেগময় স্পর্শের কথাই বলেছিলো?

তাহমিদ নাযীফাহ’র একটা হাত নিজের মাথায় রেখে বলল,

‘দেখ আমি কিন্তু তোর বুকে মাথা রাখিনি। তোর কোলে মাথা রেখেছি। এখন তোর আলতো হাতে আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে। আর কিচ্ছু লাগবে না।’ বলেই দু’হাতে পেট জড়িয়ে ধরলো।

নাযীফাহ পরপর কয়েকবার শুকনো ঢুক গিলে। তারপর কাঁপতে কাঁপতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো তাহমিদের মাথায়।

____________________________________________

বিছানায় শুয়ে ছটফট করছেন ওয়াহিদা। আজ সকাল থেকেই মনটা অশান্ত তার। একে তো ধান কাটা পড়েছে তারপর কোনো কাজে মন বসাতে পারছে না সে। বুকে শুধু অজানা হাহাকার। রাত প্রায় শেষ হতে চলো কিন্তু উনার চোখে ঘুম নেই। এপাশ ওপাশ কখন থেকে করছেন কিন্তু শান্তি পাচ্ছেন না। সারা শরীর জ্বালাপোড়া করছে। আর থাকতে না পেরে জামান সাহেব কে ডাকলেন উনি। পরপর তিনবার ডাকার পরে পিটপিট করে তাকান জামান সাহেব। স্ত্রীর ফোলা ফোলা আঁখি দেখে ঘুম গায়েব হয়ে যায় উনার। তটস্থ, ভীত গলায় বললেন,

‘শরীর খারাপ লাগছে তোমার? আগে বলবে না।’

‘আমার শরীর ঠিকই আছে। মনে শান্তি পাচ্ছি না। আমার মন বলছে ছেলে দুইটা ভালো নেই। আপনি একটা ফোন দিন না।’ কাতর গলায় বললেন ওয়াহিদা।

জামান সাহেব মোবাইল হাতরে দেখলেন রাত দু’টো বাজে। স্ত্রীর হাত ধরে বললেন,

‘অনেক রাত হয়েছে ওয়াহিদা। কাল সকালে ফোন দেই? এখন যদি আমি ফোন করি তাহলে উল্টো ওরা ভয় পাবে। মনে করবে আমরা বোধহয় বিপদে। তুমি শুয়ে পড়ো আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।’

____________________________________________

খুব সকালে ঘুম ভাঙে নাযীফাহ’র। তারপর নিজের অবস্থান আর তাহমিদের অবস্থান দেখে লজ্জায় মিইয়ে যায় সে।

#চলবে

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১৪
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

তাহমিদের বাহুডোরে আবদ্ধ নাযীফাহ। যাকে বলে একেবারে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে সে। নাযীফাহ চোখ মেলে দেখতে পেলো তাহমিদের প্রশস্ত বুক। নিজের অবস্থান তাহমিদের বুকে দেখে লজ্জায় মিইয়ে গেলো সে। হাসফাস করতে লাগলো। তাহমিদ দেখলে আর সে তাহমিদের সামনে আসতে পারবে না। এক সময় হাসফাস করতে করতে একেবারে চুপ হয়ে গেলো সে। এতো নড়াচড়া করলে নির্ঘাত ঘুম ভেঙে যাবে তাহমিদের। খুব সতর্কতার সাথে তাহমিদের বাঁধন থেকে নিজেকে আলগা করলো। যেন জেগে না যায়। নিজেকে ছাড়ানোর পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো পৌনে ছয়টা বাজে। ওই রুমে গেলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। বসার ঘরে দেখলো ফাহিম শুয়ে আছে।

নাযীফাহ চলে যেতেই চট করে চোখ মেলে তাকায় তাহমিদ। তারপর মুচকি হাসলো সে। তার ঘুম ভেঙেছে অনেক আগেই। নাযীফাহকে নিজের বুকে দেখে চুপচাপ ঘুমের ভান ধরে ছিলো সে। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ঘটা মূহুর্তটাকে অনুভব করছিলো সে। হয়তো এভাবে কাছে আসতে আরো দেরি। তাই ঘুমের ভান ধরে নাযীফাহকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালাতেই ঘুম ভেঙে গেলো নাযীফাহ’র। ভাগ্যিস বুঝতে পারেনি।

____________________________________________

ফ্রেশ হয়ে ঝাল করে নুডলস রান্না করতে রান্নাঘরে এসেছে নাযীফাহ। রান্নার মধ্যে এটাই একটু পারে। তাও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।

রান্না শেষ করে তাহমিদের কাছে গেলো সে। নুডুলসের বাটি টা একপাশে রেখে তাহমিদ কপালে হাত দিলো জ্বর আছে কি দেখার জন্য। জ্বর ছেড়ে শরীর ঘাম দিয়েছে। নাযীফাহ মৃদু,শীতল গলায় ডাকলো,

‘শুনছেন? জ্বর কমেছে উঠে ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি নুডলস রান্না করেছি। কিছু একটা খেয়ে তারপর ঔষধ খাবেন।’

নাযীফাহ’র ডাকে শুয়া থেকে উঠে বসলো তাহমিদ। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই নাযীফাহ বলল,

‘একা একা যেতে পারবেন? নাকি আমি ধরতে হবে?’

তাহমিদ মলিন হেসে জবাব দিলো,

‘এতোটাও অসুস্থ হয়নি আমাকে ধরে নিয়ে যেতে। আমাকে তোর উপর এভাবে নির্ভরশীল করিস না। বিপদে পড়ে যাবি তুই। পরে চব্বিশ ঘণ্টা এই পাঁজি মানুষটার সেবা করতে হবে।

তাহমিদ ফ্রেশ হয়ে আসতেই নাযীফাহ তোয়ালে টা বাড়িয়ে দিলো হাত মুখ মোছার জন্য। তারপর নুডলসের বাটি টা তাহমিদের হাত দিলো খাওয়ার জন্য। তাহমিদ এক চামচ নুডলস মুখে নিয়ে থম মে’রে রইলো। কোনো রকম গিলে বলল,

‘এগুলো রান্না করেছিস?’

নাযীফাহ হাসি মুখে জবাব দিলো,

‘আমি কালকে খেয়াল করেছি আপনি ভাত খাওয়ার সময় কেমন যেন করছিলেন। নিশ্চয়ই মুখের রুচি নষ্ট হয়ে গেছে। তাই ঝাল ঝাল করে নুডলস রান্না করেছি। আপনার ভালো লাগবে।’

‘সেজন্য ঝাল দিয়েছিস বুঝলাম কিন্তু এক গামলা লবন কেন দিয়েছিস আমাকে মে’রে ফেলার জন্য?’

নিজের মাথায় চাটি মে’রে জিভে কামড় দিলো সে।

‘ইশ! বেশি লবন দিয়ে দিয়েছি।দাঁড়ান দাঁড়ান এটা খেতে হবে না। আমি আবার বানিয়ে নিয়ে আসছি।’

‘কোনো দরকার নেই। আমি এটাই খাবো।’

নাযীফাহ অসহায়, বিবশ গলায় বলল,

‘দিন না এটা খেতে হবে না।এমন করছেন কেন? রান্না করতে বেশি সময় লাগবে না তো?

তাহমিদ ধীরস্থির, অব্যাকুল গলায় বলল,

‘তুই তোর আনাড়ি হাতে আমার জন্য সযত্নে রান্না করেছিস।সামান্য লবন বেশি হয়েছে বলে খাবো না? জীবনে করা প্রথম যে কাজ গুলো হয় সেগুলোতে আবেগ একটু বেশি কাজ করে। আর আমার বউ আমার জন্য প্রথমবার রান্না করেছে।যেমনই হউক না কেন এটা আমার জন্য অমৃত। একদিন লবন বেশি খাইলে নিশ্চয়ই আমি ম’রে যাবো না।’

তাহমিদের কথা শুনে শীতলতায় ছেয়ে গেলো নাযীফাহ’র অন্তঃস্থল। পরিতৃপ্ততায় প্রসারিত হলো অধর কোণ।

____________________________________________

সোফায় আঁটসাঁট হয়ে শুয়ে আছে ফাহিম। এপাশে ফিরলেই ফ্লোরে পড়ে যাবে সে। মোবাইল ফোন বেজে উঠতেই নিদ্রা হালকা হয়ে এলো তার। চোখ বুঁজেই হাতরে বালিশের নিচ থেকে মোবাইল ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই তন্দ্রাভাব কে’টে গেলো ফাহিমের। এই সাত সকালে ফোনের ওপাশে মায়ের গলা শুনে পরপর কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলল সে। নিজেকে বড্ড তৃষ্ণার্ত অনুভব করলো। ফোনের ওপাশে ওয়াহিদার ভয়ার্ত, আতংকিত, তটস্থ কন্ঠস্বর,

‘তোরা সবাই সুস্থ আছিস তো বাবারা? তাহমিদের ফোনে কল দিলাম মোবাইল বন্ধ। তোদের চিন্তায় সারারাত ঘুমোতে পারিনি। সারা শরীর আমার জ্বালাপোড়া করেছে।’

কান্না পেয়ে গেলো ফাহিমের। বক্ষঃস্থল কেঁপে উঠলো। এতো মাইল দূরে থাকার পরও কি করে বুঝে গেলো সন্তানের অসুস্থতার কথা। হয়তো এটাই নাড়ীর টান। নয়নবারিতে টলমল করছে চক্ষুদ্বয়। পলক ফেললে নিম্নমুখী হবে নোনতা বারি। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল ফাহিম,

‘কাল থেকে ভাইয়ার জ্বর। সারাদিন শুয়া থেকে উঠতে পারেনি। নাযীফাহ কিছুক্ষণ বাদে বাদে জলপটি দিয়েছে।’

ছোট ছেলের কথা শুনে একেবারে থম মে’রে গেলেন ওয়াহিদা।কি বলবে ভাষা খোঁজে পেলো না। ফাহিম অপরাধী গলায় মাকে ডাকলো,

‘মা?’

ওয়াহিদা অনুভূতিশূন্য, অচৈতন্য গলায় জবাব দিলেন,

‘হুম?’

‘কিছু বলছ না যে?’

ওয়াহিদা মলিন শান্ত গলায় বললেন,

‘আসলে ভাবতেছি, তোদেরকে পড়াশোনার জন্য ঢাকা পাঠিয়েছি বলে কি তোরা আমাকে পর করে দিলি নাকি তোরা খুব বড় হয়ে গেছিস।’

ফাহিম মিনমিনে, নত গলায় বলল,

‘এভাবে কথা বলছো কেন মা?’

ওয়াহিদা বিদ্রুপের সুরে বললেন,

‘তাহলে বাবা আমার কিভাবে কথা বলা উচিৎ। মা হয়ে ছেলের অসুস্থতার কথা আমি জানি না। সারারাত ছটফট করেছি এই ভেবে যে তোদের কোনো বিপদ হলো কিনা। তোর বাবা বলল সকাল হলে ফোন দিবে।রাতের বেলা ফোন দিলে তোরা টেনশন করবি। আমি শুধু সেকেন্ড গুনেছি কখন রাত পোহাবে।আমি যা ভেবেছি তাই হলো।’

‘আমি বলেছিলাম তোমাকে ফোন দেওয়ার জন্য। ভাইয়া নিষেধ করলো বলল তুমি নাকি টেনশন করবে।ভাইয়ার সাথে কথা বলবে?’

‘কারো সাথে কথা বলার দরকার নাই আমার। ফোন রাখ।’

কল কে’টে ওয়াহিদা জামান সাহেব কে বললেন,

‘আপনার ছেলেরা বড় হয়ে গিয়েছে। নিজের অসুস্থতার মায়ের কাছ থেকে লুকিয়ে যায়। মা টেনশন করবে বলে।’
____________________________________________

ফাহিমকে রুমে আসতে দেখেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো নাযীফাহ। ড্রয়িং রুমে পা দিতেই কলিংবেলটা বেজে উঠলো। গুটি গুটি পায়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো বুয়া এসেছে। নাযীফাহ মুচকি হেসে বলে,

‘আজ আপনি রান্নার সময় আমি পাশে থাকবো। দেখবো আপনি কিভাবে রান্না করেন।’

প্রতিত্তোরে বুয়াও মুচকি হেসে জবাব দিলো,

‘আইচ্ছা আফামনি।’

‘মা সকালে ফোন দিয়েছিলো ভাইয়া।’

ফাহিমের মুখ নিঃসৃত বাক্য কর্ণকুহরে পোঁছাতেই চমকিত হয় তাহমিদ। আঁতকে উঠে বলল,

‘তুই কি বলে দিয়েছিস?’

ফাহিম অসহায় গলায় বলল,

‘জানি না ভাইয়া মা কি করে বুঝে গেলো। সত্যিটা না বলে পারেনি। মা রেগে আছে তুমি একটা ফোন দাও।’

তাহমিদের অন্তঃস্থল নির্গত হল দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

‘এখন ফোন দিলে আরো রেগে যাবে। আবহাওয়া একটু ঠান্ডা হউক তারপর।’

কিয়ৎকাল চুপ থেকে পুনরায় তাহমিদ বলল,

‘কাল কি যেন বলছিলি? কোথাও চান্স পাসনি না কি জানি? জানিস কিছু কিছু জিনিস ভাগ্যের উপরও নির্ভরশীল। তুই তো চেষ্টা করেছিস না আসলে তো কিছু করার নেই। পাবলিক ভার্সিটি তে পড়েই যে মানুষ সফল হয় এমন তো না।ভেতরে পুঁজি হিসেবে জ্ঞান থাকলে যেকোনো জায়গায় পড়াশোনা করেই সফল হওয়া যায়। এসব নিয়ে মন খারাপ করবি না। ওটা ভাগ্যে ছিল না। মোনাজাতে আল্লাহর কাছে বার বার চেয়েও যদি না পাস তাহলে ভেবে নিবি ওটা তোর জন্য কল্যানকর ছিলো না। কয়দিন পর সাত কলেজের পরীক্ষা মন দিয়ে পড়। আগের সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।’

ভাইয়ের কথা শুনে বুক থেকে যেন পাথর সরে গেলো।

‘তুমি সবকিছু কত সহজেই বোঝে যাও।’ নাযীফাহ’র রুমে আসার আভাস পেয়ে ফাহিম কুটিল হেঁসে বলল,

‘ভাগ্যিস ওই বাঁদরটার তোমার সাথে বিয়ে হয়েছে। নাহলে গুনে গুনে চার বেলা স্বামীর মা’ই’র খেতো।’

নাযীফাহ দাঁত কটমট করে বলল,

‘ফাহিম্মাআআআআ।’

‘আজইরাল চলে আসছে ভাইয়া।’ বলেই তাড়াতাড়ি চলে গেলো। মৃদু শব্দে হাসলো তাহমিদ।

রুমে ঢুকেই কপাল কুঁচকে এলো নাযীফাহ’র।

‘আপনি সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছেন?’

চুল চিরুনি করতে করতে তাহমিদ বলল,

‘ওমা কোচিং-এ যেতে হবে না। কাল গেলাম না আজও যাবো না?’

নাযীফাহ রেগে বলল,

‘কোথাও যাবেন না আপনি। চাকরি থাকলে থাকবে না থাকলে নাই। আগে নিজের শরীর।’

ভ্রু জোড়া কুটি করে তাহমিদ বলল,

‘গিন্নী হওয়ার চেষ্টা করছিস মনে হচ্ছে? এতো তাড়াতাড়ি গিন্নী হওয়ার কোনো দরকার নাই। আগে মন দিয়ে পড়াশোনা কর।’

‘বেশি কথা বলবেন না আপনি।কাল রাতে যেই পরিমাণে জ্বালিয়েছেন জানেন আপনি? এতো পাগলামি করে মানুষ। জানেন কত ভয় পেয়েছি আমি।’

কপালে ভাঁজ পড়লো তাহমিদের। মস্তিষ্কে চাপ দিলো রাতের কথা মনে করতে। ব্যর্থ হলো সে। নাযীফাহ’র দিকে সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

‘কাল রাতে কি করেছি আমি?’

লজ্জায় লাল হয়ে গেলো নাযীফাহ। লজ্জায় কান গরম হয়ে গেলো তার। তাহমিদ পুনশ্চ বলল,

‘আজব এভাবে লজ্জায় লাল নীল হচ্ছিস কেন? কি করেছি সেটা তো বলবি?’

নাযীফাহ নতমস্তকে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘কে বললো লজ্জায় লাল হচ্ছি। আমার গরম লাগছে।’

‘মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে তারপরও তোর গরম লাগছে?’

নাযীফাহ’র দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। নাযীফাহ’র থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে কিছু একটা ভাবলো সে। নাযীফাহ’র গা ঘেঁষে দাঁড়ালো সে। তারপর বাঁকা, কুটিল হেসে বলে উঠলো,

‘অবচেতন মনে তোকে খুব গভীরভাবে ছুঁয়েছি বুঝি? ইশ! সজ্ঞানে থাকলে তোর লাজুক মুখখানা দেখে তৃপ্তি পেতাম। প্রথমবার বউয়ের এতো কাছাকাছি গেলাম আর বউয়ের তখনকার লজ্জায় মোড়ানো আনন দেখতে পেলাম না। এই আফসোস নিয়ে আমার সারাজীবন বাঁচতে হবে।’

লজ্জায় লাল হয়ে পা বাড়ালো দরজার দিকে। নাযীফাহ কে আরো লজ্জায় ফেলার জন্য তাহমিদ ডেকে বলল,

‘তোর গায়ে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আছে। যা একেবারে মাতা,,,,?

কথা শেষ করতে দিলো না নাযীফাহ। সম্মুখে চাহনি স্থির রেখেই বলল,

‘আপনি একটা যা-তা তাহমিদ ভাই। আমি আর আপনার কাছে আসবো না।’ বলে আর এখানে দাঁড়ালো না সে। দৌড়ে চলে গেলো রান্নাঘরে। নাযীফাহ চলে যেতেই শব্দযোগে হাসলো তাহমিদ। রাতের সব কথা মনে না থাকলেও আবছা আবছা কিছু মনে আছে তার। জ্বরের ঘোরে ছিলো বলে হয়তো এতো পাগলামি করেছে সজ্ঞানে থাকলে কখনো এমন করতো না সে। মনে মনে ভাবলো,

‘আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে কোনো একদিন হয়তো আমরা এক ঘরে ঘুমাবো।তবে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দু’জন এতো কাছাকাছি থাকার মুহূর্তটা কখনো আমি ভুলবো না। আকস্মিক ব্যপার গুলো আসলেই হৃদগহীনে দাগ কে’টে যায়। কাল এবং আজ আমি অন্য রকম এক নাযীফাহ কে দেখেছি।’

____________________________________________

নাস্তার টেবিলে নাস্তা করছে সবাই। তাহমিদ আমেনা বেগম কে বলল,

‘সকালে তুমি একবার আমার কাছে গেলে না দাদি। আমার জ্বর কমার বদলে বাড়তেও তো পারতো?’

কোনো জবাব দিলো না আমেনা বেগম। নিজের মতো খেয়েই যাচ্ছে। তাহমিদও আর কথা বাড়ালো না। খাওয়া শেষ নাযীফাহ এবং ফাহিমের। ফাহিম পা বাড়ালো রুমের দিকে। নাযীফাহ নিজের আর ফাহিমের প্লেট টা নিয়ে কিচেন রুমের দিকে গেলো। এদিক ওদিক তাকালেন আমেনা বেগম। তারপর ভাবলেশহীন ভাবে বললেন,

‘দরজাটা ভেতর থেকে আঁটকে নিলেই পারতে দাদুভাই। আমরা কিছু মনে করতাম না। তোমার বিয়ে করা বউই তো।’

কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো তাহমিদ।

#চলবে