হৃদয়াবেগ পর্ব-১৫+১৬

0
521

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১৫
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছে তাহমিদের।এই জীবনে এতোবড় লজ্জা সে আর কখনো পায়নি। কেন যে যেচে কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল আল্লাহকে মালুম। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মা’র’ল সে। দাদি নিশ্চয়ই ওই অবস্থায় দেখেছেন। ইশ! কি লজ্জা কি লজ্জা। লজ্জায় দিক বেদিক দিশা না পেয়ে একের পর এক রুটি টুকরো টুকরো করে অনবরত মুখে দিতেই লাগলো তাহমিদ। নত মস্তক উপরে তোলার সাহস আর হচ্ছে না তাহমিদের। নাতির এমন দিশেহারা অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে আমেনা বেগম। অন্ধকারে ঢিল ছুড়ছেন তিনি। তা যে একেবারে নিশানায় লাগবে বুঝতে পারেনি। মূলত উনি দু’জনকে কোনোরকম আপত্তিকর অবস্থায় দেখেননি। রাতে ঘুমানোর আগে ফাহিমকেও বলেছিলেন নাযীফাহ ডাকা না অব্দি যেন ওই রুমের ধারে কাছে না যায়। একে তো ওরা স্বামী স্ত্রী। তার উপর ঘুমের ঘোরে মানুষ কত কিছুই করে। ওরা যে লজ্জায় দরজা বন্ধ করবে না এটা উনার অজানা নয়।

মাথা নত করে একের এক রুটির টুকরো মুখে দেওয়াতে এক পর্যায়ে কাশতে কাশতে চোখমুখ লাল হয়ে গেলো তাহমিদের। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন আমেনা বেগম। কাশির শব্দে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসলো নাযীফাহ। দ্রুত পায়ে তাহমিদের কাছে এসে পিঠ মালিশ করতে লাগলো। নাযীফাহ কে নিজের কাছে দেখে ছিটকে দূরে সরে গেলো তাহমিদ। বিস্ময়ে মুখ আপনা-আপনি হা গেলো তার। সে কাশছিল বলেই তো নাযীফাহ পিঠ মালিশ করতে এলো। তাহমিদ কাশতে কাশতে বলল,

‘দূরে যা৷ আমার কাছে আসবি না একদম।’

তাহমিদের কথা শুনে নাযীফাহ’র কপালে সূক্ষ্ম রেখার ভাঁজ পড়লো। যে মানুষ কাছে ঘেঁষার বাহানা খুঁজে আজ বলছে দূরে যেতে। চিন্তা করে কোনো কূলকিনারা করতে পারলো না সে। ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘আরে আপনি কাশি দিচ্ছেন বলেই তো পিঠ মালিশ করছি। কাশতে কাশতে চোখমুখের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।’

মিটিমিটি হাসছেন আমেনা বেগম। নাতির নাজেহাল অবস্থার মজা নিচ্ছেন তিনি। তার গম্ভীর নাতি যে মেয়েদের মতো লজ্জাও পায় উনার জানা ছিলো না। তাহমিদ নাযীফাহ’র দিকে না তাকিয়ে পুনশ্চ বলল,

‘লাগবে তোর পিঠ মালিশ। কাশি এমনে চলে যাবে। আপাতত তুই এখান থেকে যা।’

অভিমান হানা দিলো নাযীফাহ’র হৃদগহীনে। রাতের আধাঁরের ন্যায় তমসাচ্ছন্ন হয়ে গেলো মুখ। তাহমিদ নাযীফাহ কে দূরে যেতে বলায় কান্না পেয়ে গেলো তার। বিমর্ষ, বিষাদগ্রস্ত গলায় বলল,

‘ঠিক আছে আমি আর আপনার আশেপাশে আসবো না।’

আর দাঁড়ালো না নাযীফাহ। খুব দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো সেখান থেকে। নাযীফাহ’র অভিমানী কন্ঠস্বর শুনে আপনা-আপনি কাশি বন্ধ হয়ে গেলো তাহমিদের। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো নাযীফাহ’র যাওয়ার পানে। তার দোষ কি? দাদির লজ্জার হাত থেকে বাঁচতেই তো নাযীফাহ কে দূরে যেতে বলল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল সে। এক বিপদ থেকে বাঁচতে আরেক বিপদ কাঁধে নিলো। আমেনা বেগম ব্যঙ্গ করে বললেন,

‘আহারে দাদু ভাই বউ রাগ করে চলে গেলো? এখন কি করবে? এক কাজ করো আবার জ্বরের বাহানায় বিছানায় শুয়ে থাকো। আবারও বউকে কাছ পাবে রাতে।’ তাহমিদের অসহায় চাহনি দেখে হাসি বন্ধ হচ্ছে না আমেনা বেগমের।

অনাকাঙ্খিত ভাবে কাছে আসায় দাদির দেওয়া লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে দুই কথা বলেছে বলে বউ গাল ফুলিয়ে চলে গেছে। আরেক রাত বউয়ের কাছাকাছি থাকলে বউ পাশের বিল্ডিংয়ে গিয়ে বাসা ভাড়া নিবে। টেবিলের উপর থেকে পানি পূর্ণ গ্লাসটা কয়েক ঢুকে শেষ করে ফেলল সে। দাদির দেওয়া লজ্জার জবাব দিতে বলল,

‘আমি তো আমার বউকে কিছুই করলাম না। তোমাকে তো দাদা আরো গভীর ভাবে ছুঁয়েছে। আরো কাছাকাছি ছিলে তোমরা। আমার দাদু বংশ এগিয়ে নিয়েছে, তাহলে? আমাকেও আমার বংশ এগিয়ে নিতে দাও। নিজের টা ষোলো আনা তাই না।’

তাহমিদের দেওয়া লজ্জা যেন বয়োজ্যেষ্ঠ আমেনা বেগমকে স্পর্শ করতে পারলো না। পাত্তাই দিলো না তাহমিদের কথাকে। ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলো,

‘আমরা তো আরো কতকিছুই করেছি। তবে বদ্ধ কামরায়।’

তাহমিদ দাদিকে জব্দ করতে না পেরে, ‘ধ্যাৎ’ বলেই রুমে চলে গেলো। এবার শব্দযোগে হাসতে লাগলেন আমেনা বেগম। তাহমিদের দাদার মৃত্যুর পরে নিজেকে একা একা লাগলেও এখন আর তেমন একা একা লাগে না। নাতি নাতনিদের সাথে বেশ চলে যাচ্ছে দিন। ড্রয়িং রুমে পা দিয়ে দাদিকে একা একা এমন হাসতে দেখে ফাহিম দাদিকে বলল,

‘তুমি এমন একা একা হাসছো কেন?’

‘ওসব তুই বুঝবি না।’

ফাহিম বেক্কলের মতো দাদির দিকে তাকিয়ে রইলো।

____________________________________________

মায়ের নাম্বারে ডায়াল করে তাহমিদ দোয়া পড়তে লাগলো। একবার, দুইবার রিং হওয়ার পর মোবাইল রিসিভ করলেন ওয়াহিদা। কোনো কথা বলছেন না উনি। তাহমিদ নিরাধার, বিবশ গলায় বলল,

‘কথা বলছো না কেন মা?’

ওয়াহিদার অভিমানী গলা,

‘আমি কারো মা না। আমি যদি মাই হতাম তাহলে সন্তানের অসুস্থতার খবর আমার কানে আসতো। মা না বলেই তো কেউ কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেনি।’

মায়ের অভিমানী গলা শুনে হাসলো তাহমিদ। সন্তানের জন্য মায়ের কত উচাটন। সামান্য জ্বরের খবর না দেওয়াতে বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে বসে আছে।

‘সামান্য জ্বরের খবর দিয়ে সন্তান যে তার মাকে টেনশনে রাখতে চায়নি। সামান্য জ্বর কি পুরুষ মানুষকে কাবু করতে পারে নাকি।’

কাঁদতে লাগলেন ওয়াহিদা।কান্নার প্রকোপে কেঁপে কেঁপে উঠছে ওয়াহিদার শরীর।

‘কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবি না। আমি তোর মা।আমি জানি তোর জ্বর উঠলে তুই জ্বরের ঘোরে কতটা পাগলামি করিস। তুই যখন একা ছিলি তখন অসুস্থ হলে এভাবেই বিছানায় পড়ে থাকতি, তাই না রে? ছোট বাঁদরটা ছিলো বলে জানতে পারলাম। না হলে তো জানতেও পারতাম না।’

পাগলামির কথা বলতেই গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে তাহমিদের। সকালের নাযীফাহ’র লাজুক মুখ চোখে ভাসতেই হেসে ফেলল সে। হাসির নিনাদ শুনে ভ্রু কুঞ্চিত হলো ওয়াহিদার।

‘তুই হাসছিস?’

‘ভালোবাসি মা। খুব ভালোবাসি।’

ওয়াহিদা বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে বললেন,

‘এই একটাই অস্ত্রই তো জানিস। এই কথা শুনলে যে মায়ের রাগ মাটি হয়ে যায় ভালো করেই জানা আছে, হুম?’

‘মাকে ভালোবাসি তো বলবো না? কতদিন তোমাকে দেখি না।ঢাকা আসবে কবে তোমরা?’

ছেলের সাথে কথা বলে রাগ কমে গেলো ওয়াহিদার। উৎফুল্ল, প্রসন্ন, আনন্দদায়ক গলায় বললেন,

‘এই তো ধানের কাজ শেষ হলো বলে। সপ্তাহ খানেক পরে আমরা সবাই যাবো। কতদিন হলো তোর দাদিকে দেখি না। উনি ঠিকমতো ঔষধ খায় তো?’

‘তোমার যেই ডানপিটে ভাইঝি দাদি ঔষধ না খাওয়া অব্দি সামনে সরে না।’

ওয়াহিদা হাসতে হাসতে বললেন,

‘তাহলে তোর দাদির সাথে নাযীফাহই ঠিক আছে।’

____________________________________________

গোমড়া মুখে বাইরে দিকে তাকিয়ে আছে নাযীফাহ। সকাল গড়িয়ে ভরদুপুর এখন। রুম থেকে আর বের হয়নি সে। আমেনা বেগম নাযীফাহ বিরস, বিষাদভারাতুর মুখশ্রী দেখে মৃদু হাসলেন উনি। প্রণয়ের আগেই অনুমতি প্রাপ্ত প্রেমিকের সামান্য কথায় এতো অভিমান।পরবর্তীতে মনে হয় চোখ গরম করে তাকালেও প্রলয় বয়ে যাবে।

আমেনা ধীরস্থির পায়ে ছুটলেন তাহমিদের রুমের দিকে। তাহমিদ দাদি দেখে লাজুক হাসলো। আমেনা বেগম নাতির কাছে গিয়ে নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তাহমিদ আলতো হেসে দাদির ভাঁজ পড়া হাতে চুম্বন করলো।

‘দাদি তুমি যে গ্রাম ছেড়ে, স্বামীর ভিটা ছেড়ে আমাদের সুবিধার জন্য এই কোলাহলপূর্ণ, যানজটের ঢাকা শহরে পড়ে আছো,তোমার গ্রামের জন্য মায়া লাগে না?’

নাতির কথায় মলিন হাসলেন উনি,

‘আগে মানুষের কাছে শুনতাম, নাতি নাতনি হলে নাকি সন্তানের মায়া টা নাতি নাতনির উপর চলে যায়। আসলেও কথাটা সত্যি। পড়াশোনার জন্য যখন তুই ঢাকা চলে এলি? আমার বুকের একপাশ কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। তারপর চলে এলো তোর গুনধর ভাই। তোদের শূন্যতায় বাড়িটা কেমন খাঁ খাঁ করতো।তাই তো শূন্যতা ঘুঁচাতে একা একা চলে যেতাম তোর মামুর বাড়ি। গিয়ে তোর বউয়ের সাথে নানা বাহানায় ঝগড়া করতাম। আমি আমার নাতি নাতনিদের মাঝে ভালো আছি। গ্রামের জন্য তো মন কেমন করবেই, তাই না। সেখানে কিন্তু কেউ আমাকে আদর করে দাদি বলে ডাকে না।আমার ভাঁজ পড়া দু’টো হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয় না।’

চুপ হয়ে গেলেন উনি। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে পুনরায় বললেন,

‘দাদু ভাই সকালের কথায় মেয়েটা ভালোই অভিমান করেছে। যাও অভিমান ভাঙাও। প্রণয়ে অভিমান, অনুরাগ থাকবে না তা হয় নাকি। অভিমানে ভালোবাসা আরো গাঢ় হয়।’

দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে তাহমিদ নাযীফাহ কে শান্ত, ঘোর লাগা কন্ঠে ডাকলো।নীরব, নিঃশব্দ, নিসাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নাযীফাহ। কোনো প্রকার উত্তর দিলো না। জবাব না পেয়ে তাহমিদ কুটিল হেসে বলল,

‘সেদিনের মতো করবো কি? তাহলে আমার জন্য ভালো হবে। বউকে ছুঁইলে শরীর চাঙা হয়। দরজার ছিটকিনি দিলাম কিন্তু?’

চমকিত, বিস্মিত হয়ে পশ্চাতে ফিরে তাকায় নাযীফাহ। নাযীফাহ’র ভয়ার্ত, আতংকিত চেহেরা সশব্দে হাসলো তাহমিদ। নাযীফাহ বিষন্ন, গোমড়া মুখে উত্তর দিলো,

‘আপনিই তো আপনার কাছে যেতে নিষেধ করেছেন।এখন আবার আমার কাছে এসেছেন কেন?’

নাযীফাহ’র দিকে এগোতে এগোতে তাহমিদ বলে উঠলো,

‘সেজন্য খুব অভিমান হয়েছে বুঝি? তা এই অধম তার অর্ধাঙ্গিনীর অভিমান ভাঙাবে? ওই ঘর্মাক্ত কপালে আমার অধরের উষ্ম স্পর্শ দিয়ে নাকি অধরে অধরে মিলিয়ে? নাকি অন্য,,,,’

লজ্জায় তাহমিদের দিকে তাকাতে পারছেনা নাযীফাহ। নত মস্তকে বলল,

‘আপনি খুব অসভ্য তাহমিদ ভাই।’

বলেই জিভে কামড় দিলো সে। ঝোঁকের একি বলে ফেলল সে? উচ্চশব্দে হাসতে লাগলো তাহমিদ।

‘বউয়ের কাছে সভ্য হয়ে থাকা যায় নাকি বর সব সময় বউয়ের কাছ অসভ্যই থাকে। খাওয়ার সময় হয়েছে তাড়াতাড়ি খেতে আয়।খুব খিদে পেয়েছে। আর সকালে বিশেষ কারনে ওই কথা গুলো বলেছি।’

____________________________________________

সবকিছু টেবিলে এনে মাত্রই খেতে বসল সবাই। সেই মুহূর্তে কলিং বেল বেজে উঠলো। নাযীফাহ এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। দরজা খুলেই দেখল নিতুর মাকে। উনি নাযীফাহকে দেখেই মৃদু হাসলেন।

‘ সবাই খেতে বসেছো বুঝি?’

মাথা নাড়ে নাযীফাহ। নিতুর মা মুখে হাসি বজায় রেখে বলল,

‘তাহলে ঠিক টাইমে এসেছি।’

একটা বাটি এগিয়ে দিয়ে পুনশ্চ বললেন,

‘নিতুর বাবা সকালে একটা কাতল মাছ এনেছিল। মাথাটা দিয়ে মুড়িঘন্ট করেছি।ভাবলাম তোমাদেরও দিয়ে যাই।’

‘ভেতরে আসেন না।’

‘আজকে না অন্য কোনোদিন আসবো।আগে এটা নাও।’

চলে গেলো নিতুর মা। নাযীফাহ দরজা আঁটকে বাটি হাতে টেবিলের কাছে আসতেই তাহমিদ বলল,

‘কে এসেছিলো?’

‘নিতুর মা।’

‘ভেতরে আসতে বললি না?’

‘বলেছিলাম, কিন্তু আসেনি।মুড়িঘণ্টর বাটিটা আমার হাতে দিয়ে চলে গেলো।’

তাহমিদ লোভাতুর মুখে বলল,

‘ওয়াও মুড়িঘণ্ট। আমার প্রিয়। অনেকদিন হলো খাওয়া হয় না।’

তাহমিদের ভ্রূদ্বয় কুঁচকে তাকালো নাযীফাহ।

‘আপনার মুড়িঘণ্ট প্রিয়?’

আমেনা বেগম ফোঁড়ন কে’টে বললেন,

‘কেন তুই জানিস না? দাদু ভাইয়ের তো এগুলো হলে আর কিছু না লাগে না।’

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নাযীফাহ বলল, ‘না।’

____________________________________________

ফুটপাত ধরে হাঁটছে দু’জন। তাহমিদ ফোনে কথা বলতে বলতে বড় বড় কদম ফেলে সামনে চলে গেলো। জুতোর বেল্ট খুলে যাওয়ায় সেখানে বসেই বেল্ট আটকাচ্ছিলো নাযীফাহ। বেল্ট আঁটকে মাথা তুলে দেখতে পেলো বেপরোয়া গতিতে একটা বাস তার দিকে ধেঁয়ে আসছে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেলো সে। ত্রাস, ভয়, আতংক গ্রাস করলো তাকে।চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখলো সে

#চলবে

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১৬
#রূপন্তি_রাহমান

চুপচাপ, নীরব থেকে সবাই খাওয়া শেষ করলো।একেবারে শেষ মূহুর্তে তাহমিদ নাযীফাহ কে বলল,

‘কাল সকালে রেডি হয়ে থাকিস কলেজে ভর্তি করতে নিয়ে যাবো।’

সম্মতিতে মাথা নাড়ে নাযীফাহ। খাওয়া শেষ হতেই আমেনা বেগম বলেন,

‘খাওয়া শেষ হলে নাযীফাহ আর ফাহিম নিঃশব্দে রুমে চলে যা। আমার বড় দাদু ভাইয়ের সাথে কিছু দরকারি কথা আছে।’

কুঁজিত হলো তাহমিদের কপাল। দাদির অভিমুখে দৃষ্টিপাত করে দাদির মতিগতি অর্থোদ্ধার করার প্রয়াস চালালো সে। কিন্তু দাদির গুরুগম্ভীর, রাশভারি মুখ দেখে কোনো কিছু ঠাহর করতে পারলো না সে। খাওয়া শেষে ফাহিম চলে গেলো। নাযীফাহ আহ্লাদী গলায় বলল,

‘ও দাদি আমি থাকি? আমি শুনবো তোমরা কি বলো।’

হাসি পেলো আমেনা বেগমের। তারপরও চেহেরার গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলেন,

‘যা বলবো তা সহ্য করতে পারবি তো? নাকি লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাবি? শুনলে সব কথা শুনতে হবে এবং উত্তর দিতে হবে। কথার মাঝখানে যাওয়া যাবে না।’

এসব শুনে আর এখানে থাকার সাহস হয়নি নাযীফাহ’র।এক ছুটে রুমে চলে গেছে। সবটা না বুঝলেও দাদির কথা শুনে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো কি বলবে। নীরবে, শব্দহীন হাসলো সে।

‘দাদু ভাই?’

‘হুম দাদি?’

‘কয়েকটা কথা বলি তোমাকে। নাযীফাহ তোমার বিয়ে করা বউ। তোমার কিন্তু হক আছে ওর উপর। তাকে কাছে পেতে তোমার ইচ্ছে করতেই পারে। নাযীফাহ এসব পাপ পূণ্য না বুঝলেও আমরা তো বুঝি। আমরা কিন্তু গুনাহের ভাগিদার হবো। তুমি যদি বলো এভাবে থাকবে না। তোমরা একসাথে থাকবে তাহলে আমি অনুষ্ঠানের কথা বলতে পারি তোমাদের মা বাবার সাথে।’

দাদির কথা শুনে অট্টহাস্য সে।

‘মনে মনে যা ভেবেছিলাম তাই বলেছো তুমি। আচ্ছা আমি কি কখনো কোনো ইঙ্গিত দিয়েছি যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না? আজ বিয়ে না করলে আমি একা একা থাকতাম না বলো? আমি এখন ওই বাঁদরটার সাথে সংসার শুরু করলে ওর পড়াশোনা লাটে উঠবে। যদি কখনো মনে হয় নিজেকে আর সংযত করতে পারছি না। নিজের দৃষ্টি হেফাজত করতে কষ্টসাধ্য হচ্ছে বা আমি অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছি তখন তোমাকে আমি নিজে বলবো যে, দাদি আমার নাযীফাহ কে প্রয়োজন। নাযীফাহ’র এইচএসসি শেষ করার আগে অন্তত এসব বলো না। আপাতত না হয় পারিবারিক ভাবে অনুমোদন দেওয়া প্রেম করি। যাকে বলে সার্টিফিকেট প্রাপ্ত হালাল প্রেম।’

____________________________________________

সকালে রেডি হয়ে নাযীফাহ আর তাহমিদ মাত্রই বাসা থেকে বের হলো। সিঁড়ির কাছে এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে ডাকল নিতুর মা। এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করলো,

‘কোথাও যাচ্ছো বুঝি?’

তাহমিদ ব্যস্ত গলায় বলল,

‘নাযীফাহ কলেজে ভর্তি করাবো তাই বের হচ্ছি, ভাবি।’

নিতুর মা পুনশ্চ বলল,

‘তাহলে তো তাড়া বেশি। আর দেরি না করাই তোমাদের। আজকে আমার নিতুর জন্মদিন। সন্ধ্যায় তোমাদের দাওয়াত। ছোটখাটো পার্টি হবে।আসতেই হবে কিন্তু।’

তাহমিদ মৃদুস্বরে হেসে বলল,

‘আচ্ছা ভাবি আসবো।’

দু’সিঁড়ি নামতেই নিতুর মা নাযীফাহ কে শান্ত গলায় ডাকতেই পিছু ফিরে তাকালো সে। নিতুর মা মুচকি হেসে বলে উঠলো,

‘ মিয়া পাঞ্জাবি আর বিবি শাড়ি পড়ে আসতে হবে।’

নাযীফাহ অসহায়, মলিন গলায় বলল,

‘আমি শাড়ি সামলাতে পারি না।’

নাযীফাহ’র কথাকে পাত্তা না দিয়ে নিতুর মা বলল,

‘কয়েক ঘন্টার জন্যে শাড়ি গায়ে জড়ালে কিছু হবে না।’

নাযীফাহ নিরাধার চক্ষে তাকালো তাহমিদের দিকে।তাহমিদ সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল,

‘আমার দিকে এভাবে তাকাবি না।এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’

____________________________________________

ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে মাত্রই কলেজ থেকে বের হলো দু’জন। নাযীফাহ কে উদ্দেশ্য করে তাহমিদ বলল,

‘এখান থেকে কোচিং সেন্টার মাত্র পনেরো মিনিটের রাস্তা। চল হেঁটে যাই তাহলে আশপাশ টা দেখতে পারবি।’

নাযীফাহ ও এক গাল হেসে সম্মতি জানালো। পথিমধ্যে তাহমিদের কল আসায় কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে গেলো সে। হোঁচট খেয়ে জুতোর ফিতা খুলে গেলো তার।বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করে ফুটপাতে বসেই জুতার ফিতা লাগাতে লাগলো। মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো একটা বাস বেপরোয়া গতিতে তার দিকে ধেয়ে আসছে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেলো সে। হাত পা অসাড় হয়ে গেলো তার। ভয়ে, আতংকে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে রইলো সে।

একটানে নাযীফাহ কে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো তাহমিদ। সারা শরীর কাঁপছে তার। শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখলো। এই তো এখনই সব শেষ হয়ে যেতো আর একটু হলে।

তাহমিদের পিঠ খাঁমচে ধরলো নাযীফাহ। কয়েক সেকেন্ড আগেও সে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছে সে। তাহমিদের বুকে মাথা রেখে হার্টবিট শুনতে লাগলো নাযীফাহ ।যা খুব দ্রুত গতিতে উঠানামা করছে। ভয়ে, আতংকে এক পর্যায়ে নাযীফাহ কেঁদে দিলো।

মোটামুটি ভিড় জমে গেছে জায়গাটায়। লোকজন বলাবলি করছে, ‘মেয়ের দোষ নাই। প্রতিযোগিতা করে এসব চালকরা গাড়ি চালায় আর রাস্তার সাধারণ মানুষ প্রাণ দে’য়। আর একটু হলেই মেয়ের গায়ের উপর দিয়ে চালিয়ে নিতো। ভাগ্যিস ছেলেটা দৌড়ে এলো।’

কান্নার আধ্বান তাহমিদের কানে বাজতেই লোকজনকে তোয়াক্কা না করে নাযীফাহ’র মুখটা তুলেই এলোপাতাড়ি অধর ছোঁয়াতে লাগলো প্রেয়সীর চোখে মুখে। তাহমিদের এমন আদর মাখা স্পর্শ পেতেই ফুঁপিয়ে উঠলো নাযীফাহ। তাহমিদ কোনোদিক না তাকিয়ে নাযীফাহ’র হাতটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। তার চোখে শুধু ভাসছে বাসটা কিভাবে ধেয়ে যাচ্ছিলো নাযীফাহ’র দিকে। কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই তাহমিদের বয়সী একটা ছেলে পিছু ডাকল ওদের।

‘এক্সকিউজ মি! একটু শুনবেন আপনারা?

তাহমিদ পিছনে ফিরে তাকাতেই ছেলেটা দৌড়ে এসে হাঁপাতে লাগলো। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। কিয়ৎকাল পরে ছেলেটা প্রফুল্লচিত্তে, অম্লান কন্ঠে বলল,

‘আপনার গার্লফ্রেন্ড হয় বুঝি?’

কপাল কুঁজিত করে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। ছেলেটা পুনশ্চ উৎসাহ নিয়ে বলে,

‘বলেন না ভাইয়া আপনার গার্লফ্রেন্ড হয়।’

না বোধক মাথা নাড়ে তাহমিদ। ছেলেটার কপালে ভাঁজ পড়লো। গোমড়া মুখে বলে,

‘তাহলে?’

তাহমিদ অম্লান হেসে বলে,

‘শুধু প্রেমিকা না। একেবারে সরকারি অনুমোদন গৃহীত প্রেমিকা।’

নাযীফাহ’র একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

‘সার্টিফিকেট প্রাপ্ত হালাল প্রেমিকা আমার।’

ছেলেটা মুচকি হেসে বলে,

‘বউ?’

প্রশ্নের জবাবে তাহমিদও মুচকি হেসে বলে,

‘বউ ঠিক আছে। তবে আগে সে প্রেমিকা হিসেবে উত্তীর্ণ হবে। তারপর বউ হবে।’

‘খুব ভালোবাসেন বুঝি?’

প্রশ্ন শুনে তাহমিদ নাযীফাহ’র দিকে তাকালো। লজ্জায় মাথা নত করে রেখে সে। ছেলেটা তাহমিদের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলে,

‘তখন আপনার পাগলামি দেখে ভেবেছিলাম আপনার প্রেমিকা হয় বুঝি। তাই নিজেকে দমিয়ে না রেখে জিজ্ঞেস করলাম। কিছু মনে করেননি তো?’

তাহমিদ মৃদু হেসে বলে,

‘মনে প্রশ্ন জেগেছে তাই জিজ্ঞেস করেছেন। এখানে কিছু মনে করার কি আছে।’

কোচিং সেন্টারের দিকে আর যাওয়া হলো না ওদের। সোজা বাসায় চলে গেলো ওরা।

____________________________________________

বিকেলের দিকে নাযীফাহ’র হাতে একটা শাড়ি তুলে দেয় তাহমিদ। শাড়ি দেখে কাঁদো কাঁদো হয়ে তাকালো সে তাহমিদের দিকে। তাহমিদ সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

‘কয়েক ঘন্টার ব্যপারই তো কষ্ট করে হয় একটু সামলে নিস।তাছাড়া আমি আছি তো।’

আমেনা বেগমের সাহায্যে প্রায় এক ঘন্টা সময় নিয়ে শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে নাযীফাহ। এখানে সেখানে এবং যেখানে যেভাবে পারে সেভাবেই সেফটিপিন দিয়ে আঁটকেছে সে। কিছুক্ষন আগেই আমেনা বেগম আর ফাহিম নিতুদের বাসায় গেলো। তাহমিদ নাযীফাহ কে ডাকতে এসেই যেন পলক ফেলতে ভুলে গেলো। হার্টবিট থেমে গেলো তার।সারা শরীরের র’ক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম। নিষ্পলক, নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে রইলো নাযীফাহ’র দিকে। খোলা চুল, দুই ভ্রুর মাঝে এক রত্তি টিপ, অধর জোড়ায় লাল লিপস্টিক। তাহমিদের এক হাত চলে গেলো বুকের বা পাশে। আচমকা তাহমিদ কে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুকে থুথু দেয় নাযীফাহ। তারপর তাহমিদের পাঞ্জাবি নজরে আসতেই বলল,

‘ওমা আপনার পাঞ্জাবির সাথে তো আমার শাড়ি একেবারে মিলে গেলো।’

তাহমিদ নিজেকে সামলে দৃষ্টি নত করে বলল,

‘কিনেছিলাম কাপল সেট আরো আগে। তাই মিলে গেছে।’

____________________________________________

জন্মদিনের অনুষ্ঠান প্রায় শেষের পথে। রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার অর্ডার করায় এতো ঝামেলা হয়নি। হালকা পাতলা যা গেস্ট এসেছিলো প্রায় সকলেই চলে গেছে। নিতুর মা তাহমিদ এবং নাযীফাহকে থাকতে বলেছে দরকারী কথা আছে বলে। নাযীফাহ নিতুর সাথে খেলছে। কেক কা’টা’র পরপরই আমেনা বেগম এবং ফাহিম বাসায় চলে গেছে। মেহমান যখন সব চলে গেলো তখন নিতুর মা তাহমিদ কে একপাশে ডেকে এনে বলল,

‘কি ব্যপার মিয়া বিবির কাছাকাছি না থেকে দূরে দূরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেন? ঝগড়া হলো নাকি?’

মৃদুস্বরে হেসে বলে তাহমিদ,

‘তাহলে আপনার চোখে ধরা পড়ে গেছি।’

নিতুর মা বাঁকা হেসে বলে,

‘জহুরির চোখ ভাই ধরা তো পড়তেই হতো। এখন বলো সমস্যা কি?’

তাহমিদ পরপর কয়েকটা শুকনো ঢুক গিলে বলল,

‘শাড়িতে নারীর সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বিয়ের দিন এতোটা খেয়াল না করলেও আজ আমি ওর থেকে দৃষ্টি ফিরাতে পারছি না। ওর কাছে পাশে থাকলে যেকোনো একটা ভুল হয়ে যাবে। আর আমি নাযীফাহ’র এইচএসসি কমপ্লিটের আগে কোনো ভুল করতে ইচ্ছুক না। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে কোনো একদিন ওকে শাড়ি পড়িয়ে আমার সামনে সারাদিন বসিয়ে রাখবো।’

তাহমিদের কথা শুনে কিছু একটা ভাবলো নিতুর মা। তারপর চোখেমুখে হাসির রেখা টেনে বলে,

‘ছোটখাটো ভুল করাই যায় বলো।আবার সেই ভুলকে ফ্রেমবন্দীও করা যায় তাই না? তুমি কর্নারের রুমে যাও আমি এক্ষুনি নাযীফাহকে নিয়ে আসছি। তাহমিদ নিতুর মায়ের কোনো কথা না বুঝে হ্যাবলাকান্তের মতো কর্নারের রুমে যেতে লাগলো। মিনিট পাঁচেক বাদেই নিতুর মা এক হাতে ক্যামেরা আর আরেক হাতে নাযীফাহ কে টানতে টানতে এই রুমে নিয়ে এলো। নাযীফাহকে তাহমিদের পাশে দাঁড় করিয়ে বলল,

‘একেবারে মেইড ফর ইচ আদার। এখন তাহমিদ চটপট করে নাযীফাহ’র কপালে চুমু দাও। আমি এই পবিত্র মুহূর্তটাকে ফ্রেমবন্দী করবো।’

মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও মনে মনে হাসলো তাহমিদ। আর নাযীফাহ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে নিতুর মায়ের দিকে। নিতুর মা নাযীফাহ’র মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল,

‘কয়েক সেকেন্ডের ব্যপারই তো। দু’জনের ম্যাচিং ড্রেস তাই ভাবলাম একটা বিশেষ মুহূর্তের স্মৃতি হিসেবে ছবি তুলে রাখি।’

তাহমিদ কয়েক পা এগিয়ে এসে নাযীফাহ’র মুখোমুখি দাঁড়ালো। লজ্জায় মিইয়ে গেলো নাযীফাহ।

তাহমিদ নিজের ওষ্ঠের উষ্ণ স্পর্শ দিলো নাযীফাহ’র ললাটে। পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। ঘনঘন শ্বাস ফেলতে লাগলো নাযীফাহ। মুচকি হাসছে নিতুর মা। কয়েক সেকেন্ড পরে নাযীফাহ তার গণ্ডদেশে পানির অস্তিত্ব অনুভব করতেই চট করে চোখ মেলে তাকালো। তাহমিদ এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। নিতুর মা আতঙ্কগ্রস্ত গলায় বলল,

‘কি হলো তাহমিদ তুমি কাঁদছো কেন?’

নিতুর মায়ের গলা যেন তাহমিদের কর্ণকুহর অব্দি পৌঁছালো না।আচমকা তাহমিদ,,,,

#চলবে