হৃদয়াবেগ পর্ব-১৭+১৮

0
502

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১৭
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

আচমকা তাহমিদ নাযীফাহ কে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। তাহমিদের বলিষ্ঠ হাতের বাহুডোরে আবদ্ধ নাযীফাহ। তাহমিদের আকস্মিক কান্ডে চমকিত, হতবিহ্বল সে। তাহমিদের সমস্ত গতিবিধি, কার্মকান্ড সবই যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে তার। নাযীফাহ’র মন মস্তিষ্ক কোনো কিছুই যেন অর্থোদ্ধার করতে পারছে না। তাহমিদের ফুঁপানোর ফলে সমস্ত কায়া কম্পিত হচ্ছে।

নিতুর মা যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। কোনোকিছুই বোধগম্য হচ্ছে না উনার।ইন্দ্রিয় যেন বুঝেও বুঝতে পারছে না কিছু। হাতের ক্যামেরাটা একপাশে রেখে দ্রুত কদম ফেলে অগ্রসর হলো তাহমিদের অভিমুখে। তাহমিদের কাঁধে হাত রাখলেন উনি। নিসাড়া তাহমিদ। নিতুর মায়ের স্পর্শ যেন ষষ্ঠইন্দ্রিয় ধারণ করতে অক্ষম। একটু ধাক্কা দিতেই চেতনা ফিরে পেলো সে। নিতুর মা বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

‘কি হয়েছে তাহমিদ? এভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদছো কেন? কিছুক্ষণ আগেও তো ভালো ছিলে। হঠাৎ কি হলো?’

অকস্মাৎ তাহমিদ নাযীফাহ’র সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো পড়লো। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে নিতুর মা। তাহমিদ নাযীফাহ’র হাত দু’টো নিজের আজঁলায় নিয়ে ললাট ঠেকালো। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,

‘ আজ আর একটু হলে সবকিছুর পরিসমাপ্তি এখানেই ঘটতো। সকল মনের টান, অপ্রকাশিত অনুভূতি, আবেগ, অনুরক্তির ইতি এখানেই টানতে হতো আমার । ভাবি, এই মেয়েটা কেন বুঝে না ওর কিছু হলে আমার পুরো পৃথিবীটাই উলোটপালোট হয়ে যায়। অন্তঃস্থলে বয়ে যায় ভয়ঙ্কর প্রলয়। কেন একটু সবদিক নজর রাখে না? একটু আধটু নিজের খেয়াল রাখলে কি অনর্থ হয়ে যাবে? হারিয়ে ফেলবো মনে করে নিজের কাছে এনেছি এখানে এসেও এমন হলো। সেসময় নিজেকে বড্ড ব্যর্থ মনে হচ্ছিল।’

সকালের সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়তেই সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো নাযীফাহ’র। গলা শুকিয়ে গেলো তার। আজ হয়তো তার জীবনের শেষ দিন হতে পারতো। নিঃশ্বাস নেওয়ার অবসান ঘটলেও ঘটতে পারতো। নাযীফাহ’র কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল এটাই হয়তো তার তাহমিদের সাথে কাটানো শেষ মুহূর্ত।

‘সকালে কি হয়েছে একটু খোলাখুলি বলবে?’ নিতুর মায়ের আতংকিত, চিন্তিত কন্ঠস্বর।

ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে নিশ্চুপ বসে রইলো তাহমিদ। তাহমিদের কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে নিতুর মা নাযীফাহ’র দিকে তাকালো। নাযীফাহ সকালে ঘটনা থেমে থেমে বলতেই আঁতকে উঠলেন তিনি। ভয়ার্ত গলায় বললেন,

‘আজ অনেক বড় ফাঁড়া গেছে তোমার উপর দিয়ে। আজ অনেক কিছুই হতো পারতো। হয়তো হায়াত ছিলো বলেই রক্ষা পেয়েছো। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও তাহমিদ হয়তো ট্রমা থেকে বের হতে পারছে না।’

চুপ হয়ে গেলো নিতুর মা। চোখের ইশারায় বললো তাহমিদ বসা থেকে উঠানোর জন্য। ইশারা বুঝতে পেরে তাহমিদ কে টেনে দাঁড় করালো। নত মস্তকে, বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। নিতুর মা পুনশ্চ নাযীফাহ কে ইশারা করলো তাহমিদ কে জড়িয়ে ধরার জন্য। এবার আর লজ্জা গ্রাস করতে পারলো না নাযীফাহ কে। কারণ তাহমিদ এমন নিস্তব্ধতা, বিমূঢ়তা দেখে তার বক্ষঃপিঞ্জরে আকস্মিক ঝড়ে উলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। সম্মুখে দন্ডায়মান যুবকের এমন বিষাদভারাতুর, নির্জীবতা মানায় না। অপ্রত্যাশিতভাবে তাহমিদের বক্ষের ঠিক বা পাশে আলতো করে মাথা রাখলো নাযীফাহ। তাহমিদ দু’হাতে আগলে নিলো নাযীফাহ কে। মৃদুস্বরে হাসলো নাযীফাহ। এই লোকটাকে চক্ষের সামনে দেখলে শান্তি অনুভব হয়। আর যখন বিড়াল ছানার মতো বুকে আগলে নেয় তখন এই প্রশস্ত, চওড়া বুকটাকে নিরাপদ স্থান মনে হয়।

‘নাযীফাহ হয়তো ভাগ্যবতী নারীদের মধ্যে একজন। তোমাকে হারানোর ভয়ে, শংকায় কোনো এক পুরুষ বাচ্চাদের ন্যায় কাঁদছে। এর থেকে বড় পাওয়া কি হতে পারে। তোমাকে যেমন আগলে রাখে তুমিও আগলে রেখো। ভালোবাসার মানুষকে আগলে রাখা জন্য বয়স না হৃদয়গহ্বরে ভালোবাসা থাকা লাগে। কি না হওয়া দেবদাস? একটুতে এভাবে ভেঙে পড়লে চলে? বিপদ আপদ যে কোনো সময় আসতে পারে। পুরুষ কে মানসিকভাবে শক্ত থাকতে হয়।’

তাহমিদ প্রাণহীন, নিস্তেজ হাসলো। অক্লিষ্ট গলায় বলল,

‘ভাবি, পুরুষ মানুষ নিজের আসন্ন বিপদে ডরায় না। যতটা কাছের মানুষের বিপদ, ঝুঁকির কথা চিন্তা করে ডরায়।’

‘আমি জানি তাহমিদ, পুরুষ মানুষ পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করতে পারলেও এরা নারীর কাছে এসে দূর্বল হয়ে যায়।হউক সে মা, বোন, মেয়ে কিংবা বউ। নিতুর জন্মের সময় আমার কিছু কমপ্লিকেশন ছিলো। সেই ভয় থেকে লোকটা আজ পর্যন্ত আমাকে দ্বিতীয় বার মা হওয়ার জন্য কিছু বলে না। আমার শ্বাশুড়ি মা-রা যাওয়ার পর থেকে লোকটা সম্পূর্ণ আমার উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। আমি বাচ্চার কথা বললে লোকটা মাঝে মাঝে কি বলো জানো? ‘ তুমি আছো, নিতু আছে আমার আর কিছু চাই না। মা মা-রা যাওয়ার পরে তুমি আমাকে সামলে নিয়েছো। তোমাকে হারালে আমি থাকতে পারবো না। আমার এক সন্তানই যথেষ্ট। আর লাগবে না।’ আলহামদুলিল্লাহ তাহমিদ নিজেকে মাঝে মাঝে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। তবে আজ আমি অন্য এক তাহমিদ কে দেখলাম। যার আগের রূপ আর আজকের রূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আকাশ পাতাল তফাৎ।’

আর দাঁড়ালো এখানে। দ্রুত প্রস্থান করলো কক্ষ থেকে। এরা একটু সময় কাটাক। নাযীফাহ তাহমিদের দিকে তাকিয়ে মৃদু শব্দে বলল,

‘ছাদে যাবেন? সুবিশাল আকাশের মধ্যিখানে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। চাঁদ দেখবেন?’

তাহমিদ প্রশস্ত হেসে বলে উঠলো,

‘আয় তবে। এক চাঁদ কে সাথে নিয়ে আরেকটা চাঁদ দেখবো।’

লাজুক হাসলো নাযীফাহ। নিতুর মাকে দরজা বন্ধ করার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে দু’জন।

____________________________________________

ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। তমসাচ্ছন্ন, কৃষ্ণাভ এই রজনীতে আলো ছড়াচ্ছে চন্দ্রমা। চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। শুধু দু’জনের শ্বাস প্রশ্বাসের মৃদু শব্দ শ্রবণগোচর হচ্ছে।
তাহমিদ নাযীফাহ’র আঙুলের ভাঁজে আঙুল রেখে বলে,

‘চল ওখানে বসে চাঁদ দেখি। তুই দেখ অন্তরীক্ষের চাঁদ আর আমি দেখি মা বাবার আমার জীবনে এনে দেওয়া চাঁদকে।’

তাহমিদের কথা কর্ণগোচর হতেই লজ্জায় মিইয়ে গেলো নাযীফাহ।

দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চন্দ্রসুধা গায়ে মাখছে দু’জন। একটা সময় পর তাহমিদ খেয়াল করলো তার কাঁধে মাথা রেখে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেছে নাযীফাহ। নিদ্রামগ্ন নাযীফাহ’র ভারী নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে চারপাশে। তপ্ত শ্বাস ফেলল সে। তন্দ্রা রাণী তার আঁখি পল্লবেও ভর করেছে। নাযীফাহ’র ঘুমন্ত দেহকে একহাতে আগলে নিয়ে মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ালো তাহমিদ। তারপর নাযীফাহ’র মাথাটা কাঁধ হতে ছাড়িয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে কিছু সময়।

‘কিছু কিছু অসম্ভব সুন্দর মুহূর্ত তোর অচেতন অবস্থায় কেন তৈরি হয়? একা একা আমিই কেন শুধু সেসব সন্ধিক্ষণ অনুভব করি? কবে দু’জন একসাথে এইসব ছোট ছোট মুহূর্তকে হৃদয়ঙ্গম করবো?’ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে দ্বিতীয় বারের মতো কোলে তুলে নিলো নাযীফাহ কে।

ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিংবেল চাপতেই প্রায় মিনিট দশেক পরে ঘুম ঘুম চক্ষু নিয়ে দ্বার খুলে আমেনা বেগম। তাহমিদের কোলে ঘুমন্ত কিশোরীকে দেখে কুটিল হেঁসে ব্যঙ্গ করে বলেন,

‘আহারে বউ প্রেম করতে করতে ঘুমিয়ে গেলো? তা প্রেমালাপ শুরু করেছিলি নাকি এর আগেই?’

‘তুমি আসলেই দাদি,,,,’

____________________________________________

নাস্তার টেবিলে বসে আছে সবাই। রুটির টুকরোটা মুখে দিয়ে ফাহিম তাহমিদ কে বলল,

‘ভাইয়া তুমি না চাকরির জন্য এপ্লাই করেছিলে কি হলো?’

ভাইয়ের কথার জবাবে তাহমিদ বলে,

‘এমবিএ কমপ্লিট করার পরে চাকরি নিবো। ছয়মাস পরে এমবিএ পরীক্ষা। এডমিশনের কোচিং তো শেষ। কয়েকদিন পরে একাডেমি কোচিং শুরু হবে। এখানেই আছি এখানেই থাকি। নিজের পড়াশোনাও চলছে পার্ট টাইম জবও হচ্ছে।’

কথা মাঝে ফোঁড়ন কাটে নাযীফাহ।

‘আমার ক্লাস শুরু হবে কবে থেকে?’

তাহমিদ নাযীফাহ’র দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘ভূতের মুখে রামনাম। দ্যা গ্রেট নারীফাহ জিজ্ঞেস করছে পড়াশোনার কথা?

নাযীফাহ চোখ মুখ কালো করে তাকিয়ে রইলো তাহমিদের দিকে। নাযীফাহ’র মুখের ভাবভঙ্গি দেখে শব্দযোগে হাসল তাহমিদ। ফাহিম বিদ্রুপ করে বলে,

‘তোকে পুরো হূলো বিড়ালের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ তোর সামনে মাছের কাঁটা নিয়ে গেছে।’

ফাহিমের কথায় রাগে ফোঁসছে নাযীফাহ। নাযীফাহ’র রাগ দেখে মুচকি মুচকি হাসছে তাহমিদ।

‘সপ্তাহ খানেক পরে তোর ক্লাস শুরু হবে। তার আগে কলেজ ড্রেস বানাতে হবে। আজ বিকেলে হাঁটতে বের হলে টেইলর্সের দোকানে যাবো।’

তাহমিদ আর ফাহিম বাসা থেকে বেরিয়ে যেতেই নাযীফাহ আমেনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী গলায় আবদারের স্বরে বলল,

‘ও দাদি আমাকে রান্না করা শিখাবে? ফুপি বলেছে তোমার হাতের রান্না নাকি খুব মজা।’

আমেনা বেগম বিস্ফোরিত চোখ নাযীফাহ’র দিকে তাকিয়ে রইলেন।

‘ও দাদি না বলবে না কিন্তু।’

আমেনা বেগম মুচকি হেসে বলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

____________________________________________

রাত পোহালে নতুন সপ্তাহ। আজ শুক্রবার বিধেয় সবাই বাসায়। তাহমিদ দুপুরে খাবার খেয়ে ঘুমিয়েছে এখনো ওঠেনি। ফাহিম মাত্রই বাসা থেকে তড়িঘড়ি করে বের হলো। মনে হয় খুব তাড়া তার। ফাহিমের যাওয়ার পানে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো নাযীফাহ। ঠিক বিশ মিনিটের মাথায় কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে সামনে তাকিয়ে আঁতকে উঠল সে।

#চলবে

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১৮
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

সম্মুখে দন্ডায়মান কালো বোরকায় আপাদমস্তক আবৃত এক নারী। শুধু চক্ষুদ্বয় উন্মুক্ত। নিজের মাকে দেখে চিনতে এক মুহূর্ত দেরি হলো নাযীফাহ’র। অসাড় হয়ে গেলো তার কায়া।আচমকা ফুঁপিয়ে উঠে এলোমেলো পায়ে হেঁটে গিয়ে মাকে ঝাপটে ধরলো সে। মায়ের বুকে মাথা রেখে নীরবে নেত্রজল পরিত্যাগ করছে । ফাহমিদা বেগম মেয়ের মাথায় পরম মমতায়, স্নেহশীতল স্পর্শ দিতে লাগলেন। মায়ের আদুরে ছোঁয়া পেয়ে নাযীফাহ’র ক্রন্দনের অনুভূমিকত্ব যেন আরো প্রগাঢ় হলো। আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো সবাই। ফাহমিদা বেগম ঠোঁট ছুঁয়ালেন আত্মজার ললাটে।

‘নিজেকে ঢেকে রাখার পরও চিনে ফেললি?’

অনবরত কেঁদেই চলেছে নাযীফাহ। কনীনিকার বর্ষন যেন সময়ের সাথে সাথে ভারী হচ্ছে। কোনো রকম নাক টেনে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

‘কালো কাপড় দিয়ে যদি তোমার চক্ষুদ্বয় ঢেকে রাখতে তাও চিনে নিতাম। তোমার গায়ের মিষ্টি গন্ধটা আমি এক মাইল দূর থেকে পাই।’

‘শুধু মা না বাবাও যে এসেছে সেদিকে কি কারো খেয়াল আছে?’ খালেদ মোশাররফের শান্ত, শীতল স্বর।

মেয়েরা স্বভাবতই বাবার আদুরে হয়। বাবার সংস্পর্শে আহ্লাদী হয়ে উঠে মুহূর্তেই। দুনিয়া একদিকে তো বাবা আরেকদিকে। বাবার স্নিগ্ধশীতল গলার স্বর নাযীফাহ শ্রবণগোচর হতেই এইবার ঠোঁট উল্টে শব্দ করে কেঁদে দিলো সে। খালেদ মোশাররফ কয়েক পা এগিয়ে এসে পরম মমতায়, স্নেহার্দ্রতায় মেয়েকে বুকে আগলে নিলেন। বাবার বুকে মাথা রেখে একাধারে হেঁচকি দিয়েই কেঁদেই চলেছে নাযীফাহ।

‘এসব কান্নাকাটি বন্ধ করে যদি এই অধমের ছোট্ট বাসায় পায়ের ধূলো দিতেন তো আমি ধন্য হয়ে যেতাম। যেভাবে কান্নাকাটি শুরু হয়েছে বিল্ডিং না ভেসে যায়।’

দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল কথাগুলো বলল তাহমিদ।

ওয়াহিদা বেগম বিষন্ন, মেঘমেদুর কন্ঠে বললেন,

‘এতো খানি পথ ফাঁড়ি দিয়ে আমরাও এসেছিলাম। না ছেলে দু’টো কাছে এলো আর ছেলের বউ।’

মায়ের কথা শুনে আহাম্মক হয়ে গেলো ফাহিম। মায়ের দিকে ক্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে বলে,

‘ইয়া বড় বড় দু’টো লাগেজ হাতে নিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরবো?’

ফাহিমের কথা কে পাত্তা না দিয়ে ওয়াহিদা বলেন,

‘শুন বাপ ইচ্ছে থাকলে অনেক কিছু করা সম্ভব।’

বাবাকে ছেড়ে ফুপিকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো নাযীফাহ। টুপ করে গালে একটা চুমু দিয়ে বলে,

‘তুমি তো আমার আরেকটা মা, ফুপি। তোমাকে ভুলবো কেমন করে?’

ওয়াহিদা নাযীফাহ’র কপালে চুমু দিয়ে বলেন,

‘আর তুই তো আমার ঘরের লক্ষি।’

মায়ের কাছে এগিয়ে এলো তাহমিদও।জামান সাহেব চক্ষের সামনে এমন আবেগঘন ঘটনা অবলোকন করার পরে আক্ষেপের স্বরে বলেন,

‘আমি তো বরাবরই অবহেলিত পুরুষ। আমি সব সময় সবার দৃষ্টি সীমার বাইরে থাকি।’

‘ তা তুমি বাবা, মায়ের কথা জিজ্ঞেস করেছো কয়বার?’ ভ্রু যুগল কুঁচকে কথাগুলো বললেন আমেনা বেগম। শ্বাশুড়িকে দেখামাত্রই নাযীফাহ কে ছেড়ে শ্বাশুড়ির কাছে এলেন ওয়াহিদা। পায়ে ছুঁয়ে সালাম করতেই আমেনা বেগম বিরক্তির স্বরে বললেন,

‘আহ! তাহমিদের মা তোমাকে না বলেছি পা ছুঁয়ে সালাম করা আমাদের ধর্মে নিষেধ করেছে।মুখে সালাম দেও।’ তারপর একহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,

‘কেমন আছো তোমরা?’ ওয়াহিদা বিষন্ন স্বরে বললেন,

‘ছেলে দু’টো কে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে বয়স্ক এক বাচ্চাও বাড়িতে নেই। ভালো থাকি কি করে?’

মাকে দেখে কয়েক পা এগিয়ে এসে মায়ের কপালে চুম্বন করলো জামান সাহেব।

____________________________________________

বাসায় প্রবেশ করে ফ্রেশ হয়ে নিলো সবাই। ড্রয়িং রুমে সবাই জড়ো হতেই ফাহমিদা বেগম আর ওয়াহিদা ব্যাগ থেকে একে একে সব জিনিসপত্র নামাতে লাগলেন। ফাহমিদা বেগম আতপচাল আর হরেক রকমের শুকনো পিঠা বের করে বলেন,

‘তোর পছন্দের সব রকমের পিঠা শুকিয়ে নিয়ে এসেছি। মাঝে মাঝে ভেজে খেতে পারবি।’

ওয়াহিদা ফ্রোজেন একটা মাছ বের করে বললেন,

‘ পুকুরে জাল ফেলেছিলো। তাহমিদ তোর তো মুড়িঘন্ট পছন্দ তাই আমি বড় কাতল মাছটা রেখে দিয়েছিলাম।’

ওয়াহিদা একে একে তাহমিদের পছন্দের আরো অনেক কিছু বের করলেন। ফাহিম তীক্ষ্ণধার দৃষ্টিতে দাঁত কটমট করতে লাগলো। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতেই রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে নাক ফুলিয়ে বলে,

‘ বড় ছেলের পছন্দের সবকিছু এনেছে। আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছে বলে আমার দিকে কারো নজর নেই। লোকে ঠিক বলে, চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হয়ে যায়। আমার পছন্দ অপছন্দের কথা কাউকে মনে রাখতে হবে না।’

রাগ দেখিয়ে ধপাধপ পা ফেলে রুমে চলে গেলো ফাহিম। ফাহিম চলে যেতেই সকলে শব্দযোগে হাসতে লাগলো।

ফাহিম রুমে গিয়ে ধপ করে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে খাটে শুয়ে পড়লো। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে ওয়াহিদা এসে ছেলের মাথায় হাত রাখলো। মায়ের স্পর্শ বুঝতে পেরে কপট রাগ দেখিয়ে ফাহিম বলল,

‘আদর দেখাতে আসবে না একদম।যাও নিজের বড় ছেলের কাছে যাও। আমি কে? আমি তোমার ছেলে না। আমাকে তো কুড়িয়ে পেয়েছো।’

ছেলের রাগ দেখে মৃদু হাসলেন ওয়াহিদা। পরম মমতায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন ছেলের মাথায়। ধীর, মন্থর গলায় ফাহিমের কানের গিয়ে বললেন,

‘তোর পছন্দের মাংসের শুঁটকি এনেছি। রাতে ঝাল ঝাল করে রান্না করে দিবো।’

মায়ের কথা শ্রবনেন্দ্রিয় হতেই চট করে উঠে বসলো ফাহিম। উৎফুল্লিত কন্ঠে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘সত্যিই মাংসের শুঁটকি এনেছো? কতদিন হলো তোমার হাতের ঝাল ঝাল মাংসের শুঁটকি রান্না খাইনা।’

____________________________________________

রাতে ফাহমিদা বেগম আর ওয়াহিদা রান্নার আয়োজন করতেই নাযীফাহ তাদের সামনে গিয়ে নত মস্তকে আবদারের স্বরে বলল,

‘ফুপি আমি তোমার কাছ থেকে মুড়িঘণ্ট রান্না শিখবো। ঠিক তুমি যেভাবে রাঁধো সেভাবে।’

মেয়ের মুখে রান্না শেখার কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে মেয়ের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রয় ফাহমিদা বেগম। ওয়াহিদারও নাযীফাহ’র কথা ঠিক হজম হচ্ছে না। কপাল কুঁজিত করে ওয়াহিদা বললেন,

‘হঠাৎ রান্না শেখার শখ হলো, ব্যপার কি? তাও মু,,,ড়ি,,,ঘ,,,ন্ ‘

কথা অর্ধ সমাপ্ত রেখেই চুপ হয়ে গেলেন ওয়াহিদা। কিছু একটা ভাবতেই তার চোখ দু’টো চকচক, অত্যুজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অতঃপর উৎসাহিত গলায় বললেন,

‘শুধু মুড়িঘণ্ট আরো অনেক রান্না তোকে শিখাবো। যেসব রান্নার ঘ্রান কেউ একজন পেলে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যায়।’

নত মস্তকে লাজুক হাসে নাযীফাহ। ফাহমিদা বেগমের সমস্ত ব্যপার যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ওয়াহিদার দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিপাত করতেই সে চোখের ইশারায় কিছু একটা বললো। অধর জোড়া প্রসারিত হলো ফাহমিদা বেগমেরও। উনি প্রফুল্লচিত্তে চোখ বড় বড় করে তাকালেন ওয়াহিদার অভিমুখে। তার চাহনির অর্থ, সত্যি? ওয়াহিদা উপর নিচ মাথা নাড়ে। ফাহমিদা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যাক এবার তাহলে তার মেয়ে একটু একটু করে সবকিছু বুঝতে পারছে। তাহমিদের পছন্দ অপছন্দের দিকে নজর পড়েছে তার।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করার পরে বিপত্তি সৃষ্টি হয় শুয়া নিয়ে। বেডরুম দুইটা কিন্তু মানুষ অনেকজন। অনেক চিন্তাভাবনা করার পর ঠিক হয়, এক রুমে খাটের উপরে থাকবেন আমেনা বেগম আর নাযীফাহ। নিচে বিছানা করে থাকবেন ওয়াহিদা আর ফাহমিদা বেগম। আর অন্যরুমের খাটে থাকবেন জামান সাহেব আর খালেদ মোশাররফ। আর নিচে বিছানা করে থাকবে তাহমিদ আর ফাহিম।

মাঝরাতে হাঁসফাঁস করতে লাগলো তাহমিদ। কিছুতেই তার ঘুম আসছে না। কারণ এই সময়টায় সে ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় দু’চোখ ভরে দেখতো ঘুমন্ত নাযীফাহ কে। চক্ষের তৃষ্ণা মিটাতো সে। আজ সেখানে যাওয়াটা বেমানান। মা শ্বাশুড়ি সবাই আছে। আকস্মিক কারো কাছে ধরা পড়ে গেলে ব্যপারটা দৃষ্টিকটু। তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠে বসলো সে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে জানালার একপাশ খুলে অন্তরীক্ষের জ্বলজ্বল করতে থাকা নক্ষত্র দেখতে লাগলো। কয়েকদিন তাকে এসব দেখেই চোখের তৃষ্ণা মিটাতে হবে।

____________________________________________

আজ কলেজে নাযীফাহ’র প্রথম দিন।তাহমিদ সাথে করে কলেজে নিয়ে এসেছে। শ্রেণিকক্ষ দেখানোর পরে তাহমিদ শান্ত, অঘোর কন্ঠে নাযীফাহকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘এই পরিবেশটা তোর জন্য একেবারে নতুন। তুই গ্রামে বড় হয়েছিস।আর এটা শহর। হয়তো প্রথম প্রথম কারো সাথে তোর মিশতে খুব কষ্ট হবে। একবার এই পরিবেশের সাথে খাপখাওয়াতে পারলে আর সমস্যা হবে না। রেগুলার কয়েকদিন ক্লাস করলে বন্ধুবান্ধবও হয়ে যাবে। তোর ক্লাস টিচার ফারুক স্যার আমার ফ্রেন্ডের বড় ভাই। কলেজে কোনো সমস্যা হলে বা কেউ কিছু বললে স্যারকে বললে হবে।বাকিটা উনি সামলে নিবে। আর একটা কথা, তোকে আগেও বলেছি তোর হাতে কিন্তু শুধু বাবার সম্মান না আমার সম্মান এবং আমার পরিবারের সম্মান জড়িত। এটা ঢাকা শহর মুখোশের আড়ালে অনেক অমানুষও থাকে। নিজেকে হেফাজতও করবি।সব সময় তো আর আমি পাশে থাকবো না। হুট করে কেউ ভাব করতে আসলে পাত্তা দিবি না।’ এতটুকু বলে এদিক ওদিক তাকালো তাহমিদ। আশেপাশে ছাত্রছাত্রীর অভাব নেই। তাহমিদের খুব ইচ্ছে করছিলো নাযীফাহ’র কপালে উষ্ণ স্পর্শ দিতে। কিন্তু তা আর হবে না এখন। মৃদু হেসে বলে,

‘যা এখন ক্লাসে যা। ছুটির পর কোথাও যাবি না। আমি এসে নিয়ে যাবো।’

ক্লাসে গিয়ে চুপচাপ হয়ে বসে আছে নাযীফাহ। ক্লাসে সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। নিজেকে খুব একা লাগছে তাঁর। হুট করে একটা মেয়ে তার পাশে এসে বসলো। কোনোরকম কথা বললো না সে। মেয়েটা নাযীফাহ’র বাহুতে খোঁচা দিয়ে বলল,

‘আমি তোমার সাথে বসেছি কথা বলছো না কেন?’

ঠোঁট উল্টে চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো নাযীফাহ। মেয়েটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,

‘আমার সব ফ্রেন্ডরা অন্য কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে। আমি এই কলেজে একা। তুমি আমার ফ্রেন্ড হবে?’

নাযীফাহ খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল,

‘সত্যি? সেই কখন থেকে একা একা বসে আছি।’

মেয়েটা হেসে বলল,

‘আমার নাম জান্নাত। তোমার নাম কি?’

নাযীফাহ মুচকি হেসে বলে,

‘নাযীফাহ।’

____________________________________________

ছুটি হওয়ার আগেই কলেজ গেইটে এসে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। নাযীফাহ’র বের হওয়ার অপেক্ষায় আছে সে। হঠাৎ নাযীফাহকে কোনো মেয়ের সাথে হাসতে হাসতে আসতে দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে তার। গেইট থেকে বের হয়েই জান্নাত নাযীফাহ’র থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। তাহমিদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে নাযীফাহ’র দিকে। নাযীফাহ তাহমিদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

‘তাড়াতাড়ি বাসায় চলেন। খুব খিদে পেয়েছে।’

‘বাব্বাহ্! একদিনে বান্ধবীও বানিয়ে ফেলেছিস? আমি তো ভেবেছিলাম আমি কলেজ এসে দেখবো তুই কান্না করছিস।’ ঠাট্টা করে বলল তাহমিদ। নাযীফাহ কিছু না বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ দিকে।

রিক্সায় উঠার পর তাহমিদ নাযীফাহ’র একটা হাত খুব শক্ত করে ধরে রাখলো। কোলাহলপূর্ণ রাস্তা ছেড়ে রিক্সা একটু নিরিবিলি রাস্তায় উঠতেই তাহমিদ রিক্সার হুড তুলে দিলো। নিজের মুঠোয় রাখা নাযীফাহ’র হাতটায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ালো। কেঁপে উঠলো নাযীফাহ’র সর্বাঙ্গ। তাহমিদ যে এমন কান্ড করবে হয়তো এটা তার ধারণার বাইরে ছিলো। মাথা তুলে চোখ বড় বড় করে তাহমিদের অভিমুখে নেত্রপাত করতেই তাহমিদ মৃদু হেসে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো একহাতে। রিকসাওয়ালার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় নেতিয়ে গেলো নাযীফাহ। রিক্সাওয়ালা একমনে রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছে। পিছনে কি হচ্ছে এসব তার ধারণার বাইরে। বাসার কাছাকাছি আসতেই ঠিক হয় বসে তাহমিদ।

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে যায় নাযীফাহ। মা আর ফুপি খোশগল্পে মেতে আছে বলে আর বিরক্ত করলো না সে। তাহমিদ বিছানায় পিঠ লাগাতেই নিদ্রা ভর করলো চোখে। আচমকা রান্নাঘর থেকে নাযীফাহ চিৎকারের শব্দ পেয়ে দিক বেদিক দিশা না পেয়ে হুড়মুড়িয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে। তাহমিদের পিছু পিছু বাকি সবাইও গেলো। রান্নাঘরের দৃশ্য অবলোকন হওয়া মাত্রই চোখেমুখে কাঠিন্যভাব দেখা দিলো তাহমিদের।

#চলবে