হৃদয়াবেগ পর্ব-১৯+২০

0
469

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১৯
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

রান্নাঘরে এসে আর ভাত খেতে ইচ্ছে করলো না নাযীফাহ’র। মা আর ফুপিকে বিরক্ত না করে নিজেই নুডলস রান্না করতে এলো। যেহেতু নুডলস রান্না করতে সে পারে সেহেতু তাদের বিরক্ত করার আর মানেই হয় না। সেদ্ধ নুডলস এর পাতিল চুলা থেকে নামাতে গিয়ে হাত ফসকে বাম পায়ের উপর পড়ে যায়। গরম পানি পায়ে পড়ার সাথে সাথেই নাযীফাহ, ‘ওমাগো ‘ বলে চিৎকার করে ওঠে। মাত্রই চোখ লেগে এসেছিলো তাহমিদের। নাযীফাহ’র চিৎকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে সে। দিক বেদিক দিশা না পেয়ে একছুটে রান্নাঘরে আসে। তার পিছু পিছু বাকি সবাইও এলো। রান্নাঘরের চিত্র দেখে তার মুখে কাঠিন্যভাব দেখা দিলো। পাতিল একপাশে, নুডলস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঝেতে। অন্যপাশে নাযীফাহ পা ধরে বসে কান্না করছে। তাহমিদ সাবধানে নাযীফাহ’র কাছে গিয়ে এক প্রকার টেনেই তুলল তাকে। ওয়াশরুমে এনে পায়ে পানি দিতেই তাহমিদের শার্ট খামচে ধরলো সে।প্রচুর জ্বালাপোড়া করছে পা। বাকি সবাই নিঃশব্দে প্রস্থান করলো সেখান থেকে। ড্রয়িং রুমে নাযীফাহ কে বসিয়ে তাহমিদ ফাস্টএইড বক্স থেকে অয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসলো। চোখ মুখ তার আগুন লাল হলেও সে সযত্নে নাযীফাহ’র পায়ে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিচ্ছে। দেওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালো সে।রক্তিমবর্ণ চোখে নাযীফাহ’র দিকে তাকিয়ে বলে,

‘বড্ড রান্নার শখ না তোর? ভবিষ্যতে আমি তোকে হেঁসেলে রেখেই মা’র’বো। কোনো কাজ করতে হলে আগে দেখতে হয় বড়রা কিভাবে করে। সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। তোর নুডলস খেতে ইচ্ছে করছে এটা বললে কেউ তোকে রান্না করে দিতো না?’

মাথা নত করে ফেলে নাযীফাহ।

____________________________________________

একের পর এক দিনের সমাপ্তি ঘটিয়ে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টায়। কোনো কোনো দিন কাটে আনন্দমুখর আবার কোনো কোনো দিন কাটে বিষন্নতায়। হেমন্তকাল শেষে শীতের আগমন ঘটেছে। প্রকৃতি হয়েছে রুক্ষ।এক এক করে গাছের সব পাতা ঝরে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে শীতের প্রকোপ থাকলেও শহরের শীত ওই কুয়াশা আবৃত ভোর পর্যন্তই। শহরে ঋতু পরিবর্তনের তেমন একটা প্রভাব দেখা যায় না।বারোমাসই ফ্যান চালু দিয়ে ঘুমোতে হয়। নাযীফাহ’র কলেজ, কোচিং বাসা আর তাহমিদের কোচিং-এ ক্লাস নেওয়া, নিজের পড়াশোনা চালিয়ে দিনগুলো বেশ যাচ্ছে। ফাহিম ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছে ইংরেজি বিভাগে। এখান থেকে যাতায়াতের সমস্যা বলে কলেজের কাছেই একটা মেসে উঠেছে। বৃহস্পতিবার রাতে আসে আবার শুক্রবার বিকেলে চলে যায়। তাহমিদ আর নাযীফাহ’র বাবা মা দিন দশেক থাকার পরে আবার গ্রামে ফিরে গিয়েছিল। সেইদিন নাযীফাহ মায়ের শাড়ির আঁচল টেনে ছোট বাচ্চাদের ন্যায় কেঁদে ছিলো। ফাহমিদা বেগম মেয়েকে সান্ত্বনা দিলেও আড়ালে তিনিও চোখের পানি বিসর্জন দিয়েছেন। নাযীফাহ’র মনের সেই বিষন্নতার পাহাড়কে দূর করার জন্য সেইদিন দ্বিতীয়বারে ন্যায় মাঝরাত অব্দি দু’জন ছাদে বসে ছিলো। পার্থক্য হলো সেদিন পূর্ণিমা ছিলো না। ঘোর অমাবস্যা ছিলো। চারদিকে ঘুটঘুটে আঁধারের মাঝে একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে বসেছিলো ছাদের কিনারায়। নাযীফাহ বিষন্ন আর বেদনার্ত মন শান্ত করার জন্য আকঁড়ে ধরেছিল তাহমিদের বুক। আর তাহমিদ ভালোবেসে আগলে নিয়েছিল নাযীফাহকে। বাসায় কেউ না থাকলে আমেনা বেগমের সময় কাটে নিতুর মায়ের সাথে গল্প করে। নাযীফাহ যখন কলেজ থেকে ফিরে তখন নাযীফাহ গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসে। কাকে কিভাবে বোকা বানালো, কার সাথে কি করলো এসব বলে আর হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায়। দুষ্টুমির জন্য কলেজে মোটামুটি পরিচিত সে।

নিজের ক্লাস শেষ করে ভার্সিটি থেকে মাত্রই অফিস রুমে এসে বসেছে তাহমিদ। একটা শীট চেক করার জন্য হাতে নিতেই মোবাইল বেজে উঠলো তার।মোবাইল স্ক্রিনে ফারুক স্যারের নাম্বার দেখে কপালে সূক্ষ্ণ রেখার ভাঁজ পড়ে। মনে মনে দোয়া পড়ে কল রিসিভ করলো যেন নাযীফাহ’র নামে কোনো বিচার না হয়। কল রিসিভ করে সালাম দিতে দিতেই ওপাশ থেকে বলল,

‘তাহমিদ এ কাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেলে? আমি ভেবেছিলাম গ্রামের মেয়ে শান্ত প্রকৃতির হবে। এ তো সারা কলেজ মাথায় তুলে রাখে। আজ কোনো কারণে আমার মেজাজ খুব খারাপ ছিলো। মনে করেছি ক্লাসে গেলে হয়তো ছাত্রছাত্রীরা আস্তো থাকবে না । সে আমার রাগত চেহারা দেখে বলল, ‘স্যার রাগলে আপনাকে বেশি সুন্দর লাগে। আপনি এখন থেকে রেগে থাকবেন। আমি সিউর ম্যাম আপনার রাগ দেখেই পাগল হয়েছিলো। শত চেষ্টা করেও নিজের মুখের গাম্ভীর্যতা ধরে রাখতে পারিনি।ফিক করে হেসে দিয়েছিলাম।’

‘মা’ই’র দিবেন স্যার তাহলে পরবর্তীতে এমন দুষ্টুমি আর করবে। মা’ই’রে’র উপর আর ঔষধ নাই।’

তাহমিদের কথায় মলিন হাসলেন উনি।

‘তাহমিদ তুমি নিজেও টিচিং প্রফেশনে আছো।তুমি বুঝবে। কিছু কিছু স্টুডেন্ট থাকে যারা হাজার দুষ্টুমি করলেও তাদের উপর রাগ করা যায় না। নাযীফাহ তাদের কাতারেই পড়ে। তুমি জানো কি না জানি। কয়েকদিন আগে ওর ফ্রেন্ড জান্নাত প্রেশার ফল করে সেন্সলেস হয়ে যায়। কোনো মা’ও হয়তো এভাবে কান্না করতো না সে যেভাবে বান্ধবীর জন্য কান্না করেছে। যতই দুষ্টুমি করুক না কেন সে কিন্তু একেবারে সরল।’

মৃদুস্বরে হাসলো তাহমিদ। প্রিয় মানুষের প্রশংসা সবারই শুনতে ভালো লাগে। হুট করে ইচ্ছে হলো প্রেয়সীর ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, ঘর্মাক্ত আনন দেখার জন্য। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালো সে।নাযীফাহ’র কলেজ ছুটি হতে আরো পনেরো মিনিট। কেউ একজনকে ডাকল তাহমিদ।

‘শাওন ভাই আমার ক্লাসটাইমে আপনি ক্লাসটা নেন।আমি আপনার ক্লাসটা আমি করবো।’

ব্যস্ত পায়ে ছুটলো বাইরে। কলেজ গেইটে পা দিতেই ছুটির ঘন্টা বাজলো। প্রায় মিনিট দশেক পরে নাযীফাহ কলেজের বাইরে পা দিলো। জান্নাতের সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ তাহমিদকে দেখে কপাল কুঁজিত হলো তার। জান্নাতকে সাথে নিয়ে তাহমিদের মুখোমুখি হলো সে।ভ্রু যুগল কুঁচকে প্রশ্ন করলো,

‘আপনার তো কোচিং সেন্টারে থাকার কথা এখানে যে?’

জান্নাতের দিকে তাকিয়ে কোনো উত্তর দিলো না তাহমিদ। নাযীফাহ’র প্রশ্নের জবাবে শুধু শব্দহীন হাসলো। হাসি দেখে যা বুঝার বুঝে নিলো নাযীফাহ। তার মনের দ্বারেও আজকাল অনুভূতিরা কড়া নাড়ে। তাহমিদের প্রকাশিত অপ্রকাশিত সকল আবেগ, অনুরাগ, গভীর প্রণয় যেন তার হৃদগহীনেও অনুভূতির অন্বেষণ ঘটাচ্ছে। মাঝে মাঝে তাহমিদের নিক্ষেপ করা শান্ত চাহনি,হুটহাট গভীর স্পর্শ তার বক্ষঃপঞ্জর শীতল থেকে শীতল করে তুলে। জান্নাত ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,

‘নাযু তুই তাহলে ভাইয়ার সাথে যা। আমার টেইলর্সের দোকানে গিয়ে লেইট হবে।’

নাযীফাহ বলল,

‘তাহলে আমিও যাই তোর সাথে।’

‘ভাইয়া যেহেতু এসেছে তাহলে তোর আর উল্টো পথে যাওয়ার দরকার নেই। তুই ভাইয়ার সাথে যা। আমি আসছি। আমার জন্য বসার জায়গা রাখবি কিন্তু।’

রিক্সায় চড়ে বসতেই নাযীফাহ পুনশ্চ প্রশ্ন করলো,

‘তখন কিন্তু বলেনি হঠাৎ কেন এসেছেন।’

তাহমিদ তার অধর জোড়া প্রসারিত করে নাযীফাহ’র একটা হাত মুঠোবন্দি করলো।

‘কেউ একজনের এলোমেলো কেশ, ক্লান্ত চাহনি একটা নজর দেখার জন্য হৃদগহ্বরে স্পৃহা জেগেছিল। তাই এক মুহূর্ত দেরি না ছুটে এলাম। কারো ক্লান্তি মাখা আনন দর্শন করে নিজের মানসিক ক্লান্তি দূর করার জন্য।’

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো নাযীফাহ। তাহমিদ নাযীফাহ’র সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বলল,

‘বেশি ক্লান্ত লাগলে আমার কাঁধে মাথা রেখে ক্লান্তি নিবারন করতে পারিস আমি মাইন্ড করবো না।’

নাযীফাহ উষ্ণ শ্বাস ফেলে বলল,

‘আপনিও ক্লান্ত আমিও ক্লান্ত। থাক দু’জনের ক্লান্তি, নিস্তেজ ভাব আর অবসন্নতা আপনার কাঁধে রেখে আপনার বোঝা আর না বাড়াই।’

তাহমিদ ভ্রু নাচিয়ে বলল,

‘কেউ একজন মনে হচ্ছে খুব দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছে? সে কি অতি দ্রুত পুরোপুরি মিসেস তাহমিদ হওয়ার জন্য আপ্রান প্রয়াস চালাচ্ছে নাকি? তাহলে কিন্তু আগেভাগে তাহমিদ বলে দিচ্ছে একশো তে দেড়শো পেলেও তাহমিদের কথার নড়চড় হবে না। আগে এইচএসসি পাশ করতে হবে। তারপর অন্যকিছু।’

তাহমিদের কথা শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকালো নাযীফাহ। তাহমিদ বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলল,

‘তার আগে এই রাক্ষসের মতো নখ গুলো কাটতে হবে। বিকজ সেফটি ফার্স্ট। আমার অক্ষত দেহটাকে কেউ সুযোগ পেয়ে ক্ষ’ত বি’ক্ষ’ত করবে সচেতন নাগরিক হয়ে এটা আমি অন্তত চাই না।’

চোখ পাকিয়ে তাহমিদের বাহুতে চিমটি কাটে নাযীফাহ

____________________________________________

ইংরেজি ক্লাস নিচ্ছে তাহমিদ। বোর্ডে টেন্সের এর স্ট্রাকচার লিখছে সে। নাযীফাহ’র পানির পিপাসা পাওয়ায় সে ফিসফিস করে জান্নাতের কাছে পানি চাইতেই সামনে থেকে আরেকটা মেয়ে বলে উঠলো,

‘স্যার নাযীফাহ কথা বলছে। তার বিশৃঙ্খলার জন্য আপনি কি বলছেন কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।’

মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তাহমিদের। ক্লাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা তার মোটেও পছন্দ না। আর নাযীফাহ’র নাম নেওয়ায় রাগের মাত্রা যেন বাড়ল। মার্কার পেনের মুখ আঁটকে পিছনে ফিরে ক্রোধান্বিত গলায় বলল,

‘স্ট্যান্ড আপ নাযীফাহ।’

আকস্মিক কান্ডে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো নাযীফাহ। সবটাই যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কথাই বললো কখন আর বিশৃঙ্খলাই করলো কখন? পিপাসা পাওয়ায় ফিসফিস করে তো শুধু পানিই চাইলো। আর কিছু তো না।

তাহমিদ পুনশ্চ গর্জে উঠে বলল,

‘আই সে স্ট্যান্ড আপ।’

ধমকের শব্দে কেঁপে উঠলো নাযীফাহ সহ বাকিরাও। উঠে দাঁড়ালো সে। তাহমিদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘বলেছি না ক্লাসে বিশৃঙ্খলা আমার পছন্দ না। ক্লাস ভালো না লাগলে চলে যাবেন। অন্যকে বিরক্ত করার মানে কি?’

অভিমানেরা ভিড় জমাতে লাগলো মনের আনাচে-কানাচে। আর সেই অভিমান গুলো অশ্রু হয়ে জমতে শুরু করলো কনীনিকার কোণে। যেন পলক ফেললে বৃষ্টি হয়ে ঝরবে অভিমানের অশ্রু। রাগে, অভিমানে ব্যাগটা নিয়েই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো সে। নাযীফাহ’র যাওয়ার পানে তীক্ষ্ণধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। পরপর কয়েকটা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালালো সে। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেলো পুরো ক্লাসরুম। এর আগে তাহমিদকে এতো রাগতে কেউ দেখিনি। জান্নাত সামনের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসছে। ক্লাসে ঘুরে ঘুরে টপিক বুঝাচ্ছে তাহমিদ। বোর্ডে গিয়ে আরেকটা স্ট্রাকচার লিখতেই আচমকা দু’কদম পিছিয়ে এলো সে। সম্মুখের আপতিত দৃষ্টিগোচর হতেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো তার। ক্রোধে হাতের মার্কার পেনটা চেপে ধরলো সে।

#চলবে

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ২০
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

প্রেয়সীর ক্রন্দনরত অভিমানি আনন আঁখিপটে ভাসতেই বিষন্নতায় আচ্ছাদিত হয়ে গেলো তাহমিদের অন্তর। পরক্ষণে মনকে সান্ত্বনা দিলো এই বলে যে, পড়াশোনার সাথে নো কম্প্রোমাইজ। এখন সে প্রেয়সী না সে এখন ছাত্রী।’

স্ট্রাকচার বোঝানো শেষে সবাইকে এক্সারসাইজ করতে দিলো তাহমিদ। ক্লাসের এই মাথা থেকে ওই মাথা রাউন্ড দিয়ে দেখতে লাগলো সবার এক্সারসাইজ। জান্নাত তাহমিদকে ডাকল,

‘স্যার এক্সারসাইজের চার নাম্বারটা বুঝতে পারছি না। একটু যদি বুঝিয়ে দিতেন?’

তাহমিদ কাছে এসে কলমটা হাতে নিয়ে বুঝাতেই জান্নাত সবার অগোচরে ধীর, মৃদু স্বরে বলল,

‘নাযীফাহ কোনো বিশৃঙ্খলা করেনি। পিপাসা পেয়েছিলো বলে জাস্ট জিজ্ঞেস করেছে আমার কাছে পানি আছে কিনা। আজ আমরা টিফিন পিরিয়ডেও কিছু খাইনি। প্ল্যান ছিলো কিছু খেয়ে তারপর কোচিং-এ আসবো। কিন্তু তার আগেই আপনি কলেজে চলে এসেছেন।’

হাতের কলমটা ফেলে তাহমিদ বিস্মিত হয়ে গেলো। চোখ বড় বড় করে জান্নাতের দিকে তাকাতেই জান্নাত মলিন হেসে বলল,

‘আর বোঝাতে হবে না স্যার বুঝে গেছি।’

তিমিরাচ্ছন্ন হয়ে গেলো তাহমিদের মুখ।মন খারাপ নামক মেঘেরা জমতে শুরু করলো মনের আকাশে।জীবনের প্রথমবার মেয়েটার সাথে এমন কঠোর, অত্যুগ্র,রূঢ় ব্যবহার করলো তাও বিনা কারণে। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো তার। থমথমে, বিষন্ন মুখ নিয়ে বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হটকারিতায় করা কার্যকলাপের জন্য আফসোস হতে লাগলো তার। বিষন্নতা কে এক পাশে রেখে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,

‘সবার এক্সারসাইজ শেষ? আর কারো কোনো প্রবলেম আছে?’

সকলেই না বোধক মাথা নাড়ে। আরেকটা টপিক নিয়ে আলোচনা করার জন্য বোর্ডে লিখতেই শ্রেণিকক্ষের জানালা দিয়ে মনে হলো কিছু একটা দেখলো সে। দু’কদম পিছিয়ে এসে দাঁড়ালো জানালা বরাবর। জানালা বরাবর থাকা ফুচকা স্টলের দিকে দৃষ্টিপাত করেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো তার। নাযীফাহ আর একটি ছেলে হাসতে হাসতে ফুচকা খাচ্ছে। কথার মাঝে ছেলেটা টিস্যু এগিয়ে দিলো নাযীফাহ’র অভিমুখে। হাসিমুখে তা গ্রহণ করলো নাযীফাহ। দৃশ্যটি দৃষ্টিগোচর হতেই রাগে, ক্ষোভে, ক্রোধে হাতে থাকা মার্কার পেনটা চেপে ধরলো সে। তার হৃদগহ্বরে জ্বলন শুরু হলো। ঈর্ষান্বিত হলো সে। একজন প্রেমিক পুরুষ হিসেবে সে তার বক্ষঃস্থলে জেলাসির আনাগোনা টের পেলো। বোর্ডের কাছে এসে মিনিট দুয়েক চোখ বন্ধ করে রাখলো । যাও ব্যবহারের জন্য খারাপ লাগা শুরু করেছিলো এখন রাগ আর ক্রোধের মাত্রাটা তরতর করে বাড়ছে। টপিকটা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো তাহমিদ। ক্লাস থেকে বেরিয়ে সে সোজা ওয়াশরুমে গেলো। ট্যাপ চালু করে মাথায় পানি দিতে লাগলো।

____________________________________________

‘বুঝলি আজ আমার কলিজা ঠান্ডা হয়েছে। আমার না নাযীফাহকে একদম পছন্দ না। এতোদিন এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। ইশ! নাযীফাহ’র মুখটা দেখার মতো ছিলো।’

পাশে থাকা মেয়েটি স্বাভাবিকভাবে বলল,

‘আজকে তোর কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি।তুই কি ভেবেছিস নাযীফাহ তোকে ছেড়ে দিবে? মোটেও না।’

ওয়াশরুম থেকে মাত্রই তাহমিদ বের হয়েছিলো আকস্মিক কথা গুলো কর্ণগোচর হতেই পা থেমে গেলো তার। অতঃপর মেয়ে দুটিকে পাশ কাটিয়ে যেতেই তাদের চোখে মুখে আতংক ভর করলো।

রাস্তায় বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নাযীফাহকে খোঁজার চেষ্টা করলো তাহমিদ। আশেপাশে কোথাও নেই। অগত্যা একা একা রিক্সায় চড়ে বসলো বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

কলিংবেল চাপতেই আমেনা বেগম দরজা খুললেন। রাগত স্বরে বললেন,

‘তুই আজকে বিনাকারণে মেয়েটাকে সবার সামনে ধমক দিয়েছিস?’

আচমকা দাদির কথায় ভরকালো তাহমিদ। তারপর দাদির দিকে সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘যখন ধমকেছি তখন সে আমার না ছিলো মামাতো বোন আর না বউ। একজন ছাত্রী হিসেবে বকেছি। বউ হিসেবে তার সকল বাচ্চামু আমি সাদরে গ্রহণ করে নিবো।তার পাগলামি আমি সহ্য করবো কিন্তু ছাত্রী হিসেবে তার কোনো ফাঁকিবাজি আমি মেনে নিবো না।’

আমেনা বেগম রুঢ় গলায় বলল,

‘হাতে কি তোর?’

‘কিছু না। তবে তুমি আগামী এক ঘন্টা ওই রুমের আশেপাশে যাবে না।’

আমেনা বেগম মুখ ভেঙচিয়ে বললেন,

‘আমার এতো ঠেকা পড়েনি।’

তাহমিদ দ্বারে পা দিয়ে দেখলো নাযীফাহ কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। শব্দ করে দ্বারের দু’কপাট বন্ধ করলো। মাথা থেকে কাঁথা সরিয়ে ফোলা ফোলা আঁখি পল্লব মেলে তাকালো নাযীফাহ। প্রেয়সীর এলোমেলো আনন দেখে অন্তর্দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হলো তাহমিদের। কয়েকটা শুকনো ঢুক গিলে সে। চেহেরায় গম্ভীর ভাব এনে রাশভারী গলায় বলল,

‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলের সাথে এক প্লেটে ফুচকা খেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছেন বুঝি? তাই কলেজ ড্রেস না পাল্টে সোজা শুয়ে পড়েছেন ক্লান্তি দূর করার জন্য?’

তাহমিদের কথা শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই রাগে ফুঁসতে লাগলো নাযীফাহ। নাযীফাহ’র রাগকে গ্রাহ্য করলো না তাহমিদ। হাতে থাকা প্যাকেট টা নিয়ে নাযীফাহ’র বরাবর বসলো। তারপর নাযীফাহ কে ইশারায় সেগুলো দেখিয়ে বলল,

‘এখানে চল্লিশ পিস ফুচকা আছে। একেবারে ঝাল দিয়ে বানানো। আমার সামনে এখন এগুলো শেষ করবি। তোর খুব ফুচকা খাওয়ার শখ না? আজ দেখবো তুই কত ফুচকা খেতে পারিস।’

নাযীফাহ অ’গ্নি দৃষ্টিতে একবার তাহমিদের দিকে আরেকবার ফুচকা গুলোর দিকে তাকালো। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

‘সবগুলো ফুচকা আমি এখানে আপনার সামনে বসে শেষ করবো। তবে আমার একটা শর্ত আছে।’

শর্তের কথা শুনে ললাটে সূক্ষ্ম রেখার ভাঁজ পড়ে তাহমিদের। কুঁজিত কপালে তাহমিদ নাযীফাহ’র দিকে তাকালো।

‘ফুচকা খাওয়ার সময় আমি যদি ঝালে কাতরাই তাহলে আপনি আমাকে পানি দিতে পারবেন না। আর না আমাকে খাওয়ার জন্য নিষেধ করতে পারবেন।’

তাহমিদ কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঝালটকে ডুবিয়ে একের পর এক ফুচকা মুখে দিতে লাগলো নাযীফাহ। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। পাঁচটা ফুচকা মুখে দেওয়ার নাযীফাহ সত্যিকার অর্থে ঝালের অস্তিত্ব অনুভব করলো। ঝালে কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে তার। ঝালে ঠোঁট আর নাক টকটকে লাল হয়ে গেছে। ঝালের প্রকোপে আঁখি পল্লবে অশ্রু ভর করেছে । সাত নাম্বার ফুচকা মুখে দেওয়ার পর আট নাম্বারে ফুচকায় হাত দিতেই তাহমিদ সেই হাত ধরে ফেলে। শান্ত, নিস্তেজ গলায় বলল,

‘আর খেতে হবে না।’

নাযীফাহ নাক টেনে জবাব দিলো,

‘এটা কিন্তু আমার শর্তে ছিলো না।’

‘আমি তো বলিনি আমি তোর শর্ত মানবো। তাহলে? আর খেতে হবে না।’

‘আমি তো খাবোই।’

বলতে দেরি আর একটানে নাযীফাহ কে বুকের মিশিয়ে নিতে দেরি করলো না তাহমিদ।

‘আমি তোকে অবিশ্বাস করি না। কিন্তু হুট করে কোনো ছেলের সাথে তোকে দেখার পরে যেখানে মাথা রেখেছিস সেখানে জ্বলন শুরু হলো। আমি তো হিংসাপরায়ণ ছিলাম না নাযীফাহ। কিন্তু তোর ক্ষেত্রে কেন নিজেকে হিংসুক মনে হয়? আমি জেলাস নাযীফাহ প্রচুর পরিমাণে জেলাস।’

বেলা নামতে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে গোধূলির আকাশে রক্তিম আভা। তাহমিদ ঠোঁট ছুঁয়ালো নাযীফাহ’র এলোমেলো চুলে।

‘তখনকার ওই ধমকের জন্য তাহমিদ সরি। তুই তো জানিস পড়াশোনার সময় বিরক্ত করলে আমার মেজাজ ঠিক থাকে না। জান্নাত আমাকে সব বলেছে।’

নাযীফাহ লেপ্টে রইলো তাহমিদের বুকে। এইখানে মাথা রাখলে নিজেকে বড্ড সুখী মনে করে সে। প্রশান্তির স্থান এটা। কখনো কখনো তার মনে হয় ঘড়ির কাঁটা থেমে যাক আর সে মিশে থাকুক তাহমিদের বুকের বা পাশে। নাযীফাহ ধীর গলায় বলল,

‘উনি জান্নাতের ছোট ভাই। আপনার সাথে কখনো দেখা হয়নি। চট্টগ্রামে থাকে। আমাকেও ছোট বোনের মতো মনে করে। জান্নাত কে নিতে এসেছিল। সবচেয়ে বড় কথা ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আছে।’

নাযীফাহ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তাহমিদ।

‘ড্রেস পাল্টে ফ্রেশ হয়ে আয়।

অবশিষ্ট ফুচকা গুলো হাতে নিয়ে অগ্রসর হলো দরজার দিকে। ছিটকিনি খুলে পুনশ্চ নাযীফাহকে বলল,

‘লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি, কখনো আমার দূর্বল জায়গায় হাত দিবি না। আজ পার পেয়ে গেলি।পরে কিন্তু আমি ছেড়ে দিবো না।’

তাহমিদ চলে যেতেই অধর প্রসারিত করে হাসলো নাযীফাহ।

____________________________________________

তাহমিদ অবশিষ্ট ফুচকা গুলোর কিছু রাখলো আমেনা বেগমের জন্য বাকি গুলো নিতুদের বাসায় গিয়ে দিয়ে এলো। রাতে আর খাওয়া হলো নাযীফাহ’র। আমেনা বেগম আর তাহমিদ খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার মতো শুয়ে পড়লো। প্রভাতের কিরন চোখে পড়তেই পিটপিট করে তাকালো নাযীফাহ। গুটিগুটি পায়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে গেলো ড্রয়িং রুমের দিকে।সেখান থেকে উঁকি দিলো তাহমিদের রুমে। কোলবালিশ জড়িয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে সে। নাযীফাহ পা বাড়ালো রান্নাঘরে দিকে। একটা চুলোয় চায়ের পাতিল বসালো। চা বানানো শেষে এক কাপ চা নিয়ে ছুটলো তাহমিদের কক্ষে । দূর থেকে মৃদু স্বরে ডাকতে লাগলো তাহমিদকে। নিদ্রামগ্ন তাহমিদের কর্ণে নাযীফাহ’র স্নিগ্ধশীতল কন্ঠস্বর পোঁছাতেই আঁখি পল্লব পিটপিট করতে লাগলো। কাপ হাতে দন্ডায়মান নাযীফাহ কে দেখে অধর কোণে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। এই যে তার মনের ঘরের ঘরোনি। উঠে বসলো সে।হামি দেওয়ার পর নাযীফাহ’র হাত থেকে কাপটা নিলো। চুমুক দিতেই চোখ বন্ধ করে নিলো সে। কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে নিজে যেচে নাযীফাহ জিজ্ঞেস করলো,

‘কেমন হয়েছে চা?’

নাযীফাহ’র কথায় চোখ মেলে তাকায় সে।মৃদু শব্দে জবাব দেয়,

‘গরম গরম চা পাতা ফ্লেভারের শরবত। গরম গরম শরবতের টেস্ট খারাপ না।’

নাযীফাহ কাঁদো কাঁদো হয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,

‘চিনি বেশি হয়ে গেছে?’

তাহমিদ প্রশস্ত হেসে বলে উঠলো,

‘এতো হাইপার হওয়ার কিছুই নেই। একেবারেই কেউ পারফেক্ট কিছু বানাতে পারে না। ভুল হয়, ভুল থেকে শিক্ষা নেয়। পায়ে যে চা ফেলিসনি এটাই কপাল। আর আজকে কলেজ যাওয়ার দরকার নেই।’

____________________________________________

নাস্তার টেবিলে বসে আছে দু’জন। আমেনা বেগম নাস্তা শেষ করে স্থান ত্যাগ করেছে আরো আগে।

‘ষোড়শী কিশোরীর মনে ভয়ে কে’টে অন্তর্দেশে সাহসেরা বাসা বাঁধছে? আজকাল আর তাকে লজ্জা পেতে দেখা যায় না। এখন সে অর্ধাঙ্গের চোখে চোখ রেখে কথা বলে। শর্ত দেয় আবার মাঝে মাঝে চোখ রাঙানিও দেয়। ব্যপারটা মোটেও সুবিধার ঠেকছে না।তাগড়া যুবক ভবিষ্যত পরাধীনতার আভাস পাচ্ছে এখনই।’

তাহমিদের মুখ নিঃসৃত উক্তি শুনে কপাল কুঁচকে উক্তির অর্থোদ্ধার করতে লাগলো সে। নাযীফাহ’র মস্তিষ্ক এর তাৎপর্য ধরতে পেরে প্রশস্ত হেসে সে বলল,

‘কারণ মাকড়সা অনুভূতির জাল এপাশেও বুনতে শুরু করেছে। এখন আর তাকে দেখলে লজ্জা ভয় ভিড় করে না। অনুভূতিরা কড়া নাড়ে মনের দোরগোড়ায়।’

নাযীফাহ’র কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকাল তাহমিদ। নাযীফাহ’র বলা কথা গুলো যেন সে হজম করতে পারছে না। ষোড়শী কিশোরীর মনেও যে তার নামের আবেগ আর অনুরাগের ছড়াছড়ি তা যে তার বিশ্বাসই হচ্ছে না।

‘মনে হচ্ছে কেউ একজন হুট করে বড় হয়ে গেছে।’

লজ্জায় নাযীফাহ নত মস্তকে বসে রইলো। তাহমিদের কথার পিঠে মুখ ফসকে মুখে যা এসেছে তাই বলে দিয়েছে সে। এখন মাথা উপরে তোলার সাহস হচ্ছে না। লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেলো। এজন্যই বলে, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। নিশ্চয়ই তাহমিদ ভাই তাকে খারাপ ভাববে?

সম্মুখে বসা লজ্জায় মোড়ানো কিশোরীকে দেখে শব্দহীন হাসলো তাহমিদ। পুলকিত হলো অন্তঃস্থল।

‘আমার যে ষোড়শী কিশোরীর লজ্জায় লাল হওয়া আনন বেশি ভালো লাগে। তার মিইয়ে যাওয়া মুখ দেখলে আমার হৃদগহ্বরে প্রশান্তিরা ডানা ঝাপটায়।’

কথা গুলো কর্ণগোচর হতেই চমকিত হলো নাযীফাহ। তাহমিদের ভারী শ্বাস আছরে পড়ছে নাযীফাহ’র কাঁধে।মানুষটা তো সমানে বসে ছিলো তার পিছনে এলো কখন? নাযীফাহ ঘাড় ঘুরাতেই তার ওষ্ঠ স্পর্শ করলো,,,,,

#চলবে