হৃদয়াবেগ পর্ব-২১+২২

0
485

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ২১
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

নাযীফাহ ঘাড় ঘুরাতেই তার ওষ্ঠ স্পর্শ করলো তাহমিদের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আবৃত গাল। আকস্মিক স্পর্শে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো নাযীফাহ। হুট করে কি ঘটে গেলো বোধগম্য হলো না তার। স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ সে। তার সমপূর্ণ কায়া অসাড়,নিশ্চল, অনুভূতিহীন জড় বস্তুতে পরিণত হলো। নড়তে ভুলে গেলো সে কিংবা নড়ার জন্য বিন্দু পরিমাণ শক্তি সে পেলো না। গাত্রে জড়ানো ওড়নার একপাশ খসে পড়লো কাঁধ থেকে।

অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত ভাবে নাযীফাহ’র উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়ে অনড়, স্থির হয়ে গেলো তাহমিদ। আকস্মিক কি ঘটে গেলো অনুভবয়োগ্য হলো না তারও। হতবিহ্বল হয়ে গেলো সে। আপনা-আপনি তার হাত স্পর্শ করলো তার গাল। নিজে নাযীফাহ কে উষ্ণ স্পর্শ দিলেও কখনো নাযীফাহ তাকে সেভাবে স্পর্শ করেনি। ঠোঁটে ফুটে উঠলো পরিতৃপ্তির হাসি। অপ্রত্যাশিত হলেও বউ থেকে পাওয়া প্রথম পরশ। তাহমিদ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘পঁচিশে নভেম্বর সকাল আটট পয়ত্রিশ। সেকেন্ডের কাঁটা হেরফের হবে তবে এই তারিখের এই সময়টা আমার স্মৃতির মানসপটে স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরদিন, অনভিলষিত ভাবে কিছু পাওয়ার খুশিতে। অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটনা কখনো কালজীর্ন হয় না। অভূতপূর্ব থাকে সর্বদা, সব সময়।’

কপাল কুঁজিত হয় নাযীফাহ’র। ঘাড় উঁচু করে তাহমিদের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দু’জনের। তাহমিদ ক্রূর হেসে বলে,

‘বউয়ের ঠোঁটে কি ভিটামিন আছে? ঠোঁট জোড়া গাল স্পর্শ করতেই গাত্রে কেমন বল পাচ্ছি। সকাল থেকে শরীর টা ম্যাজম্যাজ করছিলো।এখন শক্তি পাচ্ছি। তাহলে এই ভিটামিনের অভাবে আমার শরীর দূর্বল লাগে। আর আমি শুধু শুধু সবুজ শাক সবজি দিয়ে ভাত খাচ্ছি। আহারে অতীতের দিনগুলোর জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে। আগে জানলে নিয়ম করে তিনবেলা এই ভিটামিন গ্রহণ করতাম।’

দাঁতে দাঁত চেপে একের পর এক তাহমিদের লজ্জাজনক কথা হজম করছে নাযীফাহ। এখন কিছু বলতে গেলে আরো লজ্জা দিবে তাহমিদ। তাই চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করছে সে। নাযীফাহ’র গা থেকে খসে পড়া ওড়নার পাশটা পুনশ্চ গায়ে জড়িয়ে দিলো তাহমিদ। নিরূদ্ধে সে নাযীফাহ’র কানে মৃদু কন্ঠে বলল,

‘তিনবেলা নিয়ম করে পাবো কি? থাক তিনবেলা না দুইবেলা দিলেই হবে।তুই রাজি থাকলে ঠোঁট অব্দি পৌঁছানোর দায়িত্ব আমি নিবো।তুই রাজি তো?’

প্রগাঢ় ত্রপায় মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না নাযীফাহ’র।শ্বাস পর্যন্ত আঁটকে আসছে তার। লোকটা এমন কেন? বুঝতে পারছে নাযীফাহ মনের অবস্থা। এসব কথা তার শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই সমস্ত কায়া অসাড় হয়ে আসছে।

দু’হাত দূরে গেলো তাহমিদ। হাত ভাঁজ করে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো আপাদমস্তক লজ্জায় মোড়ানো অর্ধাঙ্গীর দিকে। আচমকা বুয়ার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো তাহমিদ। নাযীফাহ ও নড়েচড়ে বসলো। বুয়া আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলল,

‘ভাইজান কাপড়চোপড় ধুয়া শেষ। দুপুর আর রাইতের জন্যি কি রানমু এট্টু কন।’

তাহমিদ কিছু না বলে রুমে গেলো। তারপর ম্যানিব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে বুয়ার হাতে দিয়ে বলল,

‘তিনদিনের জন্য তোমার ছুটি। পাঁচশো টাকা নাও। ভালো মন্দ কিছু কিনে নিও।’

বুয়া বিস্মিত গলায় বলল,

‘ভাইজান হঠাৎ কইরা কি অইছে?’

তাহমিদ অধর জোড়া প্রসারিত করে বলে উঠলো,

‘কিছু হয়নি তবে আজ তোমার ভাইজান খুব খুশি। সেই খুশিতে তোমায় ছুটি দিলাম।’

কথার ফাঁকে এক প্রকার পালিয়ে গেলো নাযীফাহ। না হলে দেখা যাবে আবার উল্টো পাল্টা কথায় পুনরায় লজ্জা পাবে।

____________________________________________

পৌনে এগারোটা বাজে। তাহমিদ ল্যাপটপে কিছু একটা করছে। তার ভার্সিটি অফ। দরজা থেকে নাযীফাহ ডাকল,

‘তাহমিদ ভাই?’

তাহমিদ ল্যাপটপে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল,

‘কি আশ্চর্য বুঝে গেছিস আমি কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সেজন্য বুঝি ভিটামিন সাপ্লাই দিতে এসেছিস? তা কোন গালে দিবি, বাম গালে নাকি ডান গালে?’

নাযীফাহ মৃদু শব্দে চিৎকার করে বলল,

‘আপনি সকাল থেকে কিসব শুরু করেছেন? শুধু আজেবাজে কথা। দাদি শুনলে কি বলবে? আপনার মুখে কিছু আটকায় না?’

তাহমিদের দৃষ্টি এখনো ল্যাপটপের স্ক্রিনে স্থির।

‘সরি টু সে যতদিন বউ ভাই বলে সম্বোধন করবে ততদিন নিজেকে এসব বলা থেকে সংযত করতে পারবো না। বউ ভাই বলার সাথে সাথে কনফিউজড হয়ে যাই সে বউ নাকি বোন। তাই ভালোবাসার কথা বলে মনে রাখি সে বোন না বউ।’

নাযীফাহ ভ্রুকুটি করে মিনমিনিয়ে রিনরিনে গলায় বলল,

‘অসভ্য লোক কোথাকার।’

নাযীফাহ’র রিনরিনে গলার স্বর কর্ণকুহর অব্দি পৌঁছালো তাহমিদের। সে অধর প্রসারিত করে বলল,

‘ইতিহাস সাক্ষী পুরুষরা সবার কাছে সভ্য হলেও একমাত্র বউয়ের কাছে অসভ্য। কারন বাবা হওয়ারও একটা ব্যপার আছে।’

নাযীফাহ ‘ধ্যাৎ’ বলেই চলে গেলো। নাযীফাহ চলে যেতেই শব্দযোগে হাসলো তাহমিদ। মেয়েটাকে রাগাতে তার বেশ লাগে।বিশেষ করে লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া আনন। মিনিট পাঁচেকর মাথায় নাযীফাহ আবারও ফিরে এলো। এবার কোনো ভণিতা ছাড়াই বলল,

‘বুয়া তো চলে গেলো। দুপুরের রান্না কি হবে?’

তাহমিদ ঘাড় ঘুরিয়ে নাযীফাহ’র দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।

‘দুপুরের রান্না,,,, ‘

তাহমিদ কে কথা শেষ করতে না দিয়ে নাযীফাহ বলল,

‘রান্না আমি করি?’

কপালে ভাঁজ পড়ে তাহমিদের।

‘নুডলস রান্না করতে গিয়ে পায়ে গরম পানি ফেলেছিস। রান্না করতে গিয়ে কি গা পু’ড়াবি? দরকার নাই।’

নাযীফাহ আদুরে স্বরে বলল,

‘এমন করছেন কেন করি না রান্না। ফুপি আমাকে রান্না শিখিয়েছে তো।’

‘অন্য একদিন করিস। এখন না হয় তোর বরের হাতের রান্না খেয়ে দেখ। খারাপ রাঁধে না তোর বর। মুখে তুলতে পারবি।’

____________________________________________

কোচিং সেন্টারে বসে জান্নাতের জন্য অপেক্ষা করছে নাযীফাহ। এখনো আসেনি সে। এর মধ্যে সেইদিনের সেই মেয়েটা কক্ষে প্রবেশ করলো। নাযীফাহ কে দেখে বাঁকা হাসলো সে। নাযীফাহ পাত্তা দিলো না। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেই জান্নাত আসলো। ব্যাগটা রেখে জিজ্ঞেস করলো,

‘কলেজ যাসনি কেন?’

নাযীফাহ মন খারাপ করে বলল,

‘যেতে দেয়নি।’

জান্নাত উৎফুল্ল হয়ে বলল,

‘জানিস আজ না ফারুক স্যার ক্লাসে গান গেয়েছেন। স্যারের গানের গলা কিন্তু সেই।’

নাযীফাহ আবারও মন খারাপ করে বলল,

‘আজ আমি যাইনি তো তাই।শাহরুখ খানও এসেছে নিশ্চয়ই?’

নাযীফাহ’র কথা শুনে উচ্চ শব্দে হাসলো জান্নাত। তারপর সামনের মেয়েটার দিকে নজর যেতেই ফিসফিস করে বলল কিছু একটা। জান্নাতের কথা শুনে নাযীফাহ ক্রূর হেসে জোরে জোরে বলল,

‘একজন বলল, কেউ যদি কোনো অন্যায় করে তা যেন ভুল করেছে ভেবে ক্ষমা করে দেই। তাই চুপচাপ আছি।না হলে তো আমায় চিনিসই। কিন্তু দ্বিতীয় বার এমন করলে ছেড়ে দিবো না।’

এক এক সবাই আসার পর ক্লাসে আসলো তাহমিদ। কালকের টপিক থেকে পড়া জিজ্ঞেস করতে লাগলো। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করার পর দাঁড় করালো সেই মেয়েটিকে।

‘থার্ড বেঞ্চের লাস্ট ওয়ান স্ট্যান্ড আপ প্লিজ। আপনি বলবেন, পাস্ট পারফেক্ট কনটিনিউয়াস টেন্সের স্ট্রাকচারটা। এবং অন্য ফর্ম থেকে এই ফর্মে নিতে হলে কি কি পরিবর্তন করা লাগবে।’

মেয়েটি আমতা আমতা করে বলল,

‘সাবজেক্ট প্লাস ভারবের সাথের ইডি প্লাস,,,’

ভ্রু কুঁচকে তাকালো তাহমিদ।

‘আমি কাল এগুলো পড়িয়েছিলাম? কাল তো বললে ক্লাসে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে বুঝতে পারছো না। তার পরও আমি আরো কয়েকবার বুঝিয়ে দিয়েছি, তাহলে? ক্লাসের শেষে জিজ্ঞেসও করেছি কারো কোনো প্রবলেম আছে কিনা। যদি না বুঝতে বলতে পারতে। শুনো, বাবা র’ক্ত পানি করে ইনকাম করে টাকা দেয় পড়াশোনায় ফাঁকি বাজি করার জন্য। টাকা ইনকাম করতে অনেক কষ্ট। শুধু তুমি না এখানের সবার বাবাই কারো কারো মাও জব করে। ভালো করে পড়াশোনা করো। ভবিষ্যতে কিছু একটা করতে পারবে। বাবা মায়ের কষ্টের দাম দাও।’

পড়া বলতে না পারার কারনে পরপর তিনজন টিচার সেই মেয়েটিকে বকাঝকা করলো।আর সব রাগ গিয়ে জমলো নাযীফাহ’র উপর। ক্লাস বেরিয়ে জান্নাত আর নাযীফাহ অপেক্ষা করতে লাগলো তাহমিদের।

জান্নাত আর নাযীফাহ কথা বলার মাঝেই মেয়েটি এসে ফোঁড়ন কাটে।

‘নিজেকে চালাক মনে করো তাই না? ভেবেছো আমরা কিছু বুঝি না। তাহমিদ স্যারের সাথে তোমার এতো কিসের ঢলাঢলি?সব জায়গায় স্যারের তোমাকে দেখা যায় কেন? আমাদের বাচ্চা মনে করেছো।গ্রাম থেকে উঠে আসা মেয়েরা নিজেদের সাধু বানায় সবার কাছে। আসলে এদের চরিত্রের ঠিক থাকে না। শহরে এসে সুন্দর সুন্দর ছেলে দেখলে মাথা ঘুরে যায়। কি দিয়ে স্যার কে পাগল করেছো? নিজের রূপ গুন নাকি?’

কর্ণকুহরে কথা গুলো পৌঁছানো মাত্রই কলিজা ফেটে কান্না আসছে তার। কেউ তার চরিত্র নিয়ে কথা বলছে? আঙ্গুল তুলছে চরিত্রের উপর। গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না তার। এক পর্যায়ে ফুঁপানো শুরু করলো সে।

জান্নাতের কাছে অল্প কিছু শুনেই দৌড়ে অফিস রুম থেকে বেরিয়ে এলো তাহমিদ। নাযীফাহ কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই নাযীফাহ কাউকে পাত্তা না দিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাহমিদকে। বাঁধ ভেঙেছে কান্নার।অঝোর ধারায় ঝরছে চোখের পানি।হেঁচকির জন্য কম্পিত হচ্ছে সমস্ত কায়া। মোটামুটি সব স্টুডেন্ট জড়ো হয়ে গেলো। মেয়েটিও আতংকিত হয়ে গেলো। চোখেমুখে ভর করলো এক রাশ ভয়।

নাযীফাহ কে এক হাতে জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি বলেছে তোকে?’

কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছে না নাযীফাহ। বার বার হেঁচকি দিয়েই চলেছে সে। তাহমিদ পুনশ্চ জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হলো? আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তো। কি বলেছে তোকে?’

নাযীফাহ কাঁপা কাঁপা গলায় থেমে থেমে বলল,

‘আমার নাকি চরিত্রে সমস্যা
সেজন্য আপনার সাথে এতো ঢলাঢলি করি
এক রিক্সায় যাই।’ বলেই খামচে ধরলো তাহমিদের শার্ট।

কথা গুলো কর্ণগোচর হতেই রাগে চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে গেলো তাহমিদের। চোখেমুখে কাঠিন্য দেখা দিলে। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল,

#চলবে

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ২২
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

‘ যার চরিত্র নিয়ে কথাটা বললে তার পরিচয় তুমি জানো? কোনো আইডিয়া আছে সে আমার কি হয়?কারো সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করলে তার সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখতে হয়। আমার বউ সে। আমার অর্ধাঙ্গী সে। যাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।’

বিস্ময়ে মেয়েটি সহ সবার মুখ হা হয়ে গেলো। প্রেমিক যুগল ভাবলেও স্বামী স্ত্রী ভাবেনি কেউ।

‘যাকে কবুল বলে আমি বিয়ে করেছি। জন্মলগ্ন থেকে সে আমার মামাতো বোন। বছর হতে চলল তাকে আমি বিয়ে করেছি। তোমার মনে প্রশ্ন জাগলে আমাদের জিজ্ঞেস করতে পারতে। তাই বলে মাঝ রাস্তায় তুমি তার চরিত্র নিয়ে কথা বলবে? তার সাথে তোমার কিসের এতো শত্রুতা? সে তো কখনো তোমার সাথে মিসবিহেভ করেনি, তাহলে? তোমাদের মতো বয়সের ছেলেমেয়েদের একটাই সমস্যা, কাউকে ভালো না লাগলে তাকে শত্রু মনে করো।তাকে পার্সোনাললি এ্যাটাক করো। কাল তোমার কথায় আমি তাকে ধমক দিয়েছি, বকেছিও। আজ পর্যন্ত আমি ধমক তো দূরের কথা চোখ রাঙানিও দেইনি কখনো। আমার জন্য তার চোখের পানি ঝরেছে। বাসায় সে হাজার পাগলামি করলেও আমি তাকে মুখের কথা অব্দি বলি না। আমি কেন আমার পরিবারের কেউ কিছু বলে না। তার পাগলামি আমার পরিতৃপ্তি, প্রশান্তি দেয়। সে ন্যূনতম অসুখবোধ করলেও আমার হৃদপিণ্ডে জ্বলন শুরু হয়। তার মনে মন খারাপ নামক মেঘেরা যেন জড়ো না হয় সেজন্য রোজ বিকেলে হাঁটতে বের হই। আমার দুইটা টিউশন অব্দি ছেড়ে দিয়েছি। আর তুমি তাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপমান করছো? এতো সাহস দিয়েছে তোমাকে? আজ তুমি ছেলে হলে বুঝতে এই তাহমিদ কি। দেখে নিতাম তোমার কতটুকু সাহস। তোমার বাবা মায়ের নাম্বার দাও।’

চমকে উঠে মেয়েটি। এতোক্ষণ যাবৎ নত মস্তকে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। বাবা মায়ের নাম্বার দেওয়ার কথা বলায় আতংক গ্রাস করলো তাকে। করজোড়ে তাহমিদ কে বলল,

‘স্যার মাফ চাই। আমার বাবাকে কিছু বলবেন না।আমার বাবা এসব শুনলে আমাকে মে’রে’ই ফেলবে।ভুল হয়ে গেছে আমার।’

মেয়েটির কথা পাত্তা না দিয়ে তাহমিদ পুনশ্চ এক প্রকার চিৎকার করেই বলল,

‘তোমার বাবা মায়ের নাম্বার দাও। আমি জিজ্ঞেস করতে চাই এসব করার জন্য এতো কষ্ট করে টাকা ইনকাম করে তোমাকে বড় করছে কিনা।’

মেয়েটি তাহমিদ পায়ে ধরার জন্য উদ্যত হতেই দু’কদম পিছিয়ে গেলো তাহমিদ।

‘শুনো, জিহ্বা মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদ আবার সবচেয়ে নিকৃষ্ট সম্পদও। এই জিহ্বার কারণে মানুষ জান্নাতে যাবে আবার জাহান্নামেও যাবে। কাউকে কথার আঘাত দিও না। এই যে কথা গুলো বললে আমার কলিজায় আ’ঘা’ত করেছো। সরাসরি আমাকেও যদি কয়েকটা কথা বলতে আমার এতো খারাপ লাগতো না। যতটা না তুমি তাকে বলায় লেগেছে।’

‘তাহমিদ এতো হাইপার হইয়ো না,শান্ত হও। না বুঝে বলে ফেলেছে। আশেপাশে মানুষ দেখছে।’

‘না শাওন ভাই আমাকে বলতে দিন। আজ আমার কারনে আমার স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে কথা উঠেছে। আমি বর্তমান থাকা অবস্থায় কেউ একজন মাঝ রাস্তায় তার চরিত্রে কালিমা লেপন করছে। স্বামী হিসেবে আমি ব্যর্থ। আপনি নাযীফাহ’র ছেলেমানুষীর কথা শুনে এখানে ভর্তি করতে বললেন। আমি নিষেধ করেছিলাম শাওন ভাই। কারন কেউ যখন জানতে পারবে সে আমার বউ তাহলে সবাই মনে করবে আমি তাকে এক্সট্রা কেয়ার করতেছি। আপনি বললেন কি? সে তোমার বউ এটা বলার দরকার কি? এখানে এলে তুমি টিচার আর সে স্টুডেন্ট। আজ কি হলো দেখলেন? নিজের প্রতি নিজের রাগ হচ্ছে।’

তাহমিদ কে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে এক নাগালে ফুঁপিয়ে চলেছে নাযীফাহ। একহাতে প্রেয়সী কে সযত্নে নিজের সাথে মিশিয়ে রেখেছে তাহমিদ। অন্যহাতে দিয়ে চোখের পানি মুছে দিলো।

‘সরি! আমার আরো আগে বলে দেওয়া উচিৎ ছিলো। তাহলে আর আজ এসব হতো না।’

নিস্তব্ধতায় আচ্ছাদিত হয়ে গেলো চারপাশ। মনে হচ্ছে এতোক্ষণ প্রলয় বয়ে যাওয়া পরে প্রকৃতি ঠান্ডা হয়েছে। উপস্থিত সবাই যেন নির্বাক। মেয়েটি নিঃশব্দে কাঁদছে। তাহমিদ পুনশ্চ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘তোমরা সবাই তো একসাথে ক্লাস করো। কখনো বলতে পারবে আমি নাযীফাহ কে আলাদা ট্রিট করেছি বা তোমাদের কম বুঝিয়েছি বা তাকে বেশি বুঝিয়েছি? আমাদের সম্পর্কের কথা কখনো তোমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। কারন আমিও প্রয়োজন মনে করেনি। আমরা স্বামী স্ত্রী বাসায় কিন্তু কোচিং সেন্টারের এরিয়ায় পা দিলে সে স্টুডেন্ট আর আমি টিচার। তাছাড়া এখানে আমি পড়াতে আসি পার্সোনাল লাইফ নিয়ে আলোচনা করতে আসি না। প্রিয়জন সম্পর্কে কেউ কটু কথা বললে এটা ঠিক কতটা পীড়াদায়ক বুঝবে না। বিয়ের মাস দুয়েক পরে নাযীফাহ দুইদিন নিখোঁজ ছিলো। আমি রাত দুইটায় আমার ভাইকে নিয়ে গ্রামে রওনা দিয়েছি। পুরোটা রাস্তা শুধু দোয়া করেছি ওর যেন কিছু না হয়। সেই দুইদিন আমি কিভাবে কাটিয়েছি শুধু আমি জানি আর আল্লাহ জানে। বলতে পারো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে সে।’

অতীতের সেই বি’ষাক্ত, তিক্ত, কণ্টকাকীর্ণ দিনগুলোর কথা মনে পড়তেই শিউরে উঠলো নাযীফাহ’র শরীর। সেই দু’টো দিন তার কাছে মনে হয়েছে সে জাহান্নামে আছে। তৃষ্ণায় এক ফোঁটা পানির জন্য কাতরেছে সে। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নাযীফাহ তাহমিদ কে। দিন গুলোর ভাবতেই গলা শুকিয়ে এলো তার। তাহমিদ আবারও বলতে লাগলো,

‘হারিয়ে ফেলার ভয় থেকে নিজের কাছে এনে রেখেছি। নিজের বাবা মা থেকে দূরে আছে সে। তোমাকে জব্দ করা নাযীফাহ’র কয়েক সেকেন্ডের ব্যপার। শুধু আমি বলেছি বলে সে এখনো চুপ করে আছে। কারণ এখানে আমার একটা সম্মান আছে।’

চুপ করে রইলো তাহমিদ। কিছু ভালো লাগছে না তার। অসহ্য লাগছে আশপাশের পরিবেশ। মনে হচ্ছে বি’ষাক্ত হয়ে গেছে সেই পরিবেশের হাওয়া । হাওয়ায় যেন বি’ষ মিশে আছে। শাওন সাহেব তাহমিদের কাঁধে হাত রাখলেন।

‘এসব নিয়ে মন খারাপ করো না তাহমিদ। তোমাদের তো পবিত্র সম্পর্ক। কেউ কিছু বললে তো আর অপবিত্র হয়ে যাবে না। নাযীফাহ কে নিয়ে বাসায় যাও। মেয়েটা অসুস্থ হয়ে যাবে।’

তাহমিদ মলিন হাসলো।

‘ব্যপারটা তা না। আসলে আমি আমার স্ত্রীকে সেভাবে প্রটেক্ট করতে পারিনি। এখানেই আমার ব্যর্থতা।’

মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আজ পড়ার জন্য তোমাকে বকেছি বলে কি সেই রাগটা ওর উপর দেখালে? বলতে পারবে কোনটা ভুল বলেছি? নিজের বিবেককে প্রশ্ন করো না বাবা মা এতো কষ্ট কার জন্য করে, কিসের জন্য করে? পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার জন্য? জীবন এতো সোজা না। সফলতা এভাবে আসে না। কাল তোমাদের দু’জনের কথোপকথনও শুনেছি। কিছু বলেছি বলো? আজ ইচ্ছে করলেই আমি তোমার বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিতে পারতাম। কিন্তু নিবো না। নিজেকে শুধরাও।এখনো সময় আছে। এতো নেগেটিভিটি নিয়ে বাঁচা যায় না । পজিটিভলি সবকিছু ভাবতে শুরু করো জীবন সুন্দর হবে। সবার সাথে মিশার চেষ্টা করো দেখবে ভেতরের হিংসাত্মকতা কমে যাবে।’

নিজের বক্ষ থেকে নাযীফাহ কে আলগা করলো তাহমিদ। মুখোমুখি নাযীফাহ কে দাঁড় করিয়ে তার আনন নিজের হাতের আঁজলায় নিলো। নিস্তেজ হেসে, শান্ত, ধীরস্থির গলায় বলল,

‘কখনো ভাবিনি নিজের অনুভূতি গুলো মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে জনসম্মুখে ব্যক্ত করতে হবে। আমি আমার হৃদয়ের সকল আবেগ আর অনুরাগ আমার আর তোর মাঝে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলাম। সেটা হয়তো আল্লাহ চায় না।’

অতঃপর নাযীফাহ’র কপাল থেকে এলোমেলো ছোট ছোট চুল গুলো সরিয়ে সেখানে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ালো।

‘ভালোবাসি তোকে আমি। নিজের থেকেও বেশি। ঠিক যতটা ভালোবাসলে নিজের মৃত্যুর থেকেও বেশি প্রিয় মানুষ কে হারানোর ভয় হয় ঠিক ততটাই ভালোবাসি। ভালোবাসা এক অদৃশ্য অস্পর্শনীয় অনুভূতি যা বলে কয়ে হয় না। হুট করেই হয়ে যায়। অনুভূতিরা হঠাৎ করে কড়া নারে মনের দ্বারে।’

কয়েকটা ছেলে শিস দেয়া শুরু করলো। হাত তালিও দিলো অনেকে।নাযীফাহ চারপাশে চোখ বুলালো একবার। সবার চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় মুখ লুকালো তাহমিদের বুকে। ভাগ্যিস ব্যপারটা কোচিং সেন্টারের সাথে ফাঁকা জায়গাটায় ঘটেছে। যদি মেইন রোডের পাশে হতো তো কি হতো? তাহমিদ সকলকে উদ্দেশ্য করে পুনরায় বলল,

‘আরো একটা ব্যপার তোমাদের এনসিউর করতে চাই। তোমরা ভাবতে পারো হয়তো আমাদের আগে প্রণয় তারপর পরিনতি। আসলে না আগে আমাদের পরিনতি ঘটেছে তারপর প্রণয়। আমরা হলাম সরকারি সনদ প্রাপ্ত হালাল প্রেমিক যুগল। তাই না নাযীফাহ?’

কথাটা কর্ণগোচর হতেই সবার অলক্ষ্যে নাযীফাহ খামচি দিলো তাহমিদের পিঠে।

‘এই যে তোমাকে বলছি।’

মেয়েটি তাকালো তাহমিদের দিকে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখের নাজেহাল অবস্থা। ফুঁপাচ্ছে সে। এতোগুলা মানুষের সামনে আজ নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। তাহমিদ বলল,

‘একজন বড় ভাই হিসেবে বলছি। কখনো কারো চরিত্র, সম্ভ্রম নিয়ে কথা বলো না। আঙুল তুলো না। নারী বলো আর পুরুষ উভয়ের কাছে তার চরিত্র সবকিছুর উর্ধ্বে। আমি ছেড়ে দিয়েছি বলেই যে অন্য কেউ ছেড়ে এমন কিন্তু নয়।’

নাযীফাহ রিনরিনে গলায় বলল,

‘আমি বাসায় যাবো। এখানে আর ভালো লাগছে না।’

বেলা নামতে শুরু করেছে। পশ্চিমাকাশে দেখা যাচ্ছে গোধূলির রক্তিম আভা। পক্ষিরা নীড়ে ফিরতে শুরু করেছে। নাযীফাহ’র আঙুলের ভাঁজে আঙুল রেখে হাঁটতে শুরু করলো তাহমিদ। পিছু ডাকল জান্নাত। দাঁড়িয়ে পড়লো দু’জন। জান্নাত ওদের কাছে গিয়ে দুজনের কনিষ্ঠা আঙ্গুলে কামড় দিলো।

‘নজর না লাগুক আমার দেখা বেস্ট কাপলের উপর।’

প্রতিত্তোরে হাসলো দু’জন।

____________________________________________

ওরা চলে যেতেই শাওন সাহেব মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘তোমার নাম নূর রাইট? তুমি আজ আমার ক্লাসেও পড়া দিতে পারোনি।তাহলে আমার রাগটা কার উপর দেখালে? ওই মেয়েটার উপর? নিজের বিকৃত চিন্তাভাবনার জন্য মা বাবার শিক্ষার দিকে আঙুল তুলতে কাউকে বাধ্য করো না। কোনো বাবা মা চায় না তার সন্তান খারাপ হউক। ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করতে হয়। এখনো সুযোগ আছে। তাহমিদ কিন্তু তোমার শিক্ষক। শিক্ষকের মনে আ’ঘাত দিয়ে কেউ কখনো সফল হয়নি। নত স্বীকার করে মাফ চেয়ে নিও। আবার লোক দেখানো মাফ চাইতে হবে না। যদি ভেতর থেকে অনুতপ্ত হও তবে। এখন সন্ধ্যা হতে চলেছে।সবাই বাসায় যাও।’

অনবরত কেঁদে চলেছে সে। হয়তো উপলব্ধি করতে পারছে নিজের ভুল গুলো। ভিড় থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,

‘প্রথম প্রথম তো তুমি আমার পিছনেও লাগতে। তোমার সমস্যা একটাই কেউ রেগুলার ক্লাসে পড়া বলতে পারলে তোমার তা সহ্য হয় না। শুধু তোমার কারনে আমি পড়া শিখলেও বলি না। আমার মাঝে কতটুকু জ্ঞান শুধু আমি জানি। এখানে পড়াশোনা করতে এসেছি ক্রোধানলে রেষারেষি করতে না।’

ওর সাথে থাকা সেদিনের মেয়েটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘তোকে সেদিনই নিষেধ করেছিলাম, শুনিসনি। আজ তো আমাকে কিছু না বলেই নিজের রাগ ক্রোধ মিটাতে এলি। কি হলো? নিজের ফাঁদে নিজে পা দিলি। হয়তো আমার পিছনেও লাগতি। তোর সাথে চলি বলে লাগিস না। নিজের ভেতরে হিংসা নামক বস্তুটাকে আর পুষিস না। বাসায় যা এখনি মাগরিবের আযান দিবে।’

____________________________________________

‘রিক্সায় যাবি নাকি হেঁটে যাবি?’

তাহমিদের প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না নাযীফাহ। অনুভূতিহীন হয়ে দৃষ্টি স্থির রেখে হাঁটতে লাগলো সে।

তাহমিদ পুনশ্চ প্রশ্ন করলো,

‘আইসক্রিম খাবি নাকি ফুচকা খাবি?’

এবারও নিশ্চুপ, নিরোত্তর নাযীফাহ। মুখে কুলুপ এঁটেছে সে। নাযীফাহ’র নির্জীবতা দেখে বক্ষঃস্থল থেকে নির্গত হলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস। আশপাশটা একবার চোখ বুলালো সে। মোটামুটি নীরব আর কোলাহল মুক্ত। মাঝে কয়েকটা রিক্সা যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে পড়লো সে। তাহমিদ দাঁড়িয়ে যেতেই পা থেমে গেলো নাযীফাহ’র। প্রাণহীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তাহমিদের পানে। তাহমিদ এক পা এক পা করে তার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। দু’জনের মাঝে কয়েক ইঞ্চির দূরত্ব। তাহমিদের গরম শ্বাস আছরে পড়ছে নাযীফাহ’র কায়ায়। এতোটা কাছাকাছি আসায় হৃদপিণ্ড তড়িৎ গতিতে লাফাতে শুরু করলো। কিছুক্ষন আগেও তো তাদের মধ্যে কোনো দূরত্ব ছিলো না। নাযীফাহ তো একেবারে মিশে ছিলো তাহমিদের সাথে তখন তো এমন অনুভব হয়নি। তাহমিদ এই অতর্কিত কাছে আসায় নাযীফাহ’র মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। তাহমিদ যখন আরো একটু দূরত্ব ঘুচালো লজ্জায় মিইয়ে গেলো সে। অধর কোণে লাজুক হাসি। তাহমিদ তার অধর জোড়া নাযীফাহ’র গাল বরাবর নামাতেই পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো সে। অনেক্ক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর যখন তাহমিদের আবেগ মিশ্রিত কোনো ছোঁয়া পেলো না চট করে চোখ মেলে তাকালো সে। সাথে সাথে,,

#চলবে