#আলোকবর্ষ_পেরিয়ে ( দশম পর্ব )
কিন্তু ঐশী এই কথার উত্তরে সেই কঠিনভাবেই বললো,
—-” আমি কাউকে কোন শাস্তি দিচ্ছি না বাবা! আর ওর ওপর আমার রাগ অভিমান কোন কিছুই নেই, আর থাকবেও না কখনো; কারণ আমার কাছে এই সম্পর্ক টা শেষ। অনেকদিন আগেই শেষ। এরপর আমার অভীকের সাথে কোন কথা নেই বলার! আমি শুধু একটাই জিনিস চাই, লিগ্যালি এই বিয়েটা থেকে বেরিয়ে আসতে।”
কথাগুলো ঐশী সেদিন অভীক কে শুনিয়েই বলেছিল আসলে। অভীকের এটা জানা দরকার, একটা সরি তে সব কিছু ঠিক হয় না। পুরনো খারাপ লাগাগুলো অতো সহজে মোছে না।
তবে অভীক সেই মুহূর্তে ভেঙে পড়েছিল হঠাৎ। ঐশী যে আর ওর সাথে থাকতে চায় না, এটা যেন আজ খুব বেশি করে বুঝেছিল অভীক। তাই নিজেই আস্তে গলায় বলেছিল,
—-” তুমি যেটা চাও সেটাই হবে। আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেব ঐশী। আর আসবো না এখানে। তুমি ভালো থেকো।”
কথাগুলো একসাথে বলেই অভীক চলে যেতে যাচ্ছিল, কিন্তু থমকে গেল ঐশীর বাবার ডাকে। ঐশীর বাবা আজ বেশ দৃঢ়ভাবেই বললো,
—–” দাঁড়াও অভীক। আমার কিছু কথা আছে।”
কথাটা বলেই উনি ঐশীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
—- ” এত সহজে সব কিছু শেষ হয় না ঐশী! মানছি, অভীক তোকে ভুল বুঝেছিল। ও খুব খারাপ ব্যাবহার করেছে তোর সাথে। কিন্তু তার জন্য আজ ও প্রচন্ডভাবে রিপেন্ট করছে। ছেলেটার চেহারাটা একবার দেখেছিস! অভীক কে দেখে যে কেউ বলবে, যে ও ভালো নেই! আর একটা সুযোগ তো সবাই ডিসার্ভ করে!”
কথাগুলো শুনে ঐশী এবার সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেছিল ওর বাবাকে,
—–” তুমি ঠিক কি চাও বাবা? আমি আবার আগের মতন সংসার করি অভীকের সঙ্গে? সরি, এটা আর কোনদিন সম্ভব না আমার পক্ষে।”
এই কথাটা শুনে ঐশীর বাবা খুব ঠাণ্ডা মাথায় বলেছিল,
——” না, আমি সেটা বলছি না। আমি শুধু তোর কাছ থেকে একটা মাস চাই, ব্যাস। তুই অভীকের সাথে এক মাস কাটিয়ে দ্যাখ। আর যদি তারপরও তোর একই ডিশিশন থাকে, তাহলে আমি এই ডিভোর্সটা আর আটকাবো না । কিন্তু এই একটা মাস তুই অভীক কে এই সুযোগটা দে। ওর পুরনো ভুল গুলোকে ঠিক করার সুযোগ। ধরে নে এটাই আমার জন্মদিনের গিফ্ট!”
কথাগুলো শুনে ঐশীর আর কিছু বলার ছিল না ঠিক। আসলে এই একটা মানুষের মুখের ওপর ও সত্যি কিছু বলতে পারে না কখনো! তাই নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়েও রাজি হতে হলো, এক মাস এমন একটা মানুষের সাথে থাকার জন্য, যে আর ওর মনের কোথাও নেই।
<২১>
সেদিনের পর ঐশী শুধুমাত্র বাবার কথা রাখার জন্য আরো একবার ফিরেছিল অভীকের সাথে ঐ বাড়িতে। কিন্তু এই ফেরাটাই শেষ ফেরা। ঐশী এই একটা মাস কোনভাবে কাটিয়ে পুরোপুরি বেরিয়ে আসবে এই রিলেশন টা থেকে। আর তখন আর কারোর কিছু বলারও থাকবে না। কথাগুলো খুব স্পষ্টভাবে ভেবে রেখেছিল ঐশী মনে।
কিন্তু সেদিন বাড়ি আসার পর ঐশী হঠাৎ কেমন নিঃস্তব্ধতা খেয়াল করেছিল এই বাড়িটায়, যেটা আগে ছিল না! মেঘাকে এসে থেকে ও দেখেনি কোথাও! আজ তো রবিবার। কলেজ ছুটি। আজ তো মেঘার বাড়ি থাকার কথা। আর মেঘার সাথে ঐশীর যেরকম সম্পর্ক ছিল, সেখানে ঐশী বাড়িতে এলে মেঘা অন্তত একবার আসতো ওর সাথে দেখা করতে। যদিও এই কমাসে মেঘার সাথে ঐশীর সেরকম কোন কথা হয়নি ফোনে। আসলে অভীকের কথাগুলো আজও কানে বাজে ওর। মেঘা আর অভীকের জীবনে ঐশী তো একজন বাইরের লোক ছিল; যার আসাতেই মেঘার অতো বড় ক্ষতি হয়েছে। এইসব শোনার পর ঐশী ঠিকই করে নিয়েছিল, এই বাড়ি থেকে বেরোনোর পর ও আর মেঘার সাথেও কোন রকম যোগাযোগ রাখবে না। আর কোন ব্যাপারে থাকবে না ওদের। কিন্তু মেঘা প্রথম প্রথম ফোন করতো ওকে। ফিরে আসতে বলতো বার বার। নিজের দাদার হয়ে সরিও বলতো ওকে পুরনো সব কিছুর জন্য। কিন্তু ঐশী প্রত্যেকবারই একটাই উত্তর দিত মেঘাকে, যে ওর পক্ষে আর কোনদিন অভীকের সাথে থাকা সম্ভব না। এরপর ধীরে ধীরে মেঘার ফোন আসা কমতে থাকে। আর ঐশীও নতুন চাকরি, কাজের চাপের মধ্যে মেঘাকে কল করা, খোঁজ খবর নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল নিজে থেকে।
কথাগুলো আজ ঘরে বসে ভাবছিল ঐশী একা একা। যেই ঘরে একটা সময় অভীকের সঙ্গে থাকতো ও, আজ এতগুলো মাস বাদে এই ঘরটাকেই কেমন অচেনা লাগছিল যেন। এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই অভীক এসেছিল সেদিন ঘরে। একটু থমকে ও ডেকেছিল তারপর ঐশীকে। ঐশী এবার ভাবনার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে তাকিয়েছিল ওর দিকে, অভীক তখন নিজের এতদিনের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে বলেছিল ঐশীকে স্থির গলায়,
——” থ্যাঙ্কস.. এখানে আসার জন্য। আমাকে আর একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমি জানি, একটা সরি তে কোন কিছু ঠিক হয় না; কিন্তু আমি!”
না, কথাটাকে আর শেষ করতে না দিয়েই ঐশী এবার বলে উঠলো অভীক কে,
—–” আমি এখানে কোন কিছু ঠিক করার জন্য আসিনি কিন্তু। আমি এখানে এসেছি শুধুমাত্র আমার বাবার কথা রাখতে; কারণ ওই মানুষটার মুখের ওপর আমি কোনভাবেই না বলতে পারি না! আর এই এক মাস আমরা একই ঘরে হয়ত থাকবো, কিন্তু একসাথে থাকবো না। আর খুব দরকার ছাড়া আমাদের মধ্যে কোন কথা না হওয়াই ভালো।”
কথাটা বলে ঐশী আর অভীকের উত্তরের কোন অপেক্ষা করেনি সেইদিন। চুপচাপ নিজের জিনিসপত্র গোছানো তে মন দিয়েছিল। আর অভীক ও সেই সময় কিছু বলার মতন খুঁজে পায়নি ঠিক! শুধু মনে হচ্ছিল একটা অদেখা কাঁচের ভীষণ মোটা দেয়াল আছে দুজনের মাঝে। আর অভীক একই ঘরে, ঐশীর এতটা কাছে থাকলেও এই দেয়ালটাকে ভাঙতে পারবে না কখনো।
সেদিনের পর একই বাড়িতে, একই ঘরে দুজন অচেনা মানুষ থাকতে শুরু করেছিল আবার। তবে প্রথম রাতে ঐশী যখন সোফায় শুতে যাচ্ছিল, অভীক আটকেছিল ওকে। খুব নরম গলায় বলেছিল,
—–” তুমি প্লিজ খাটে ঘুমোয়। এইভাবে সোফায় শোয়ার কোন দরকার নেই।”
ঐশী সেই কথায় একটা লাইনেই উত্তর দিয়েছিল,
—–” সরি, আমি তোমার সাথে বেড শেয়ার করতে পারবো না।”
কথাটা শুনে অভীক থমকে হেসেছিল হঠাৎ। তারপর আস্তে গলায় বলেছিল,
—–” জানি। কিন্তু সোফায় আমি শোবো, তুমি না।”
কথাটা বলে ঐশীর কোন উত্তর আসার আগেই ও খাট থেকে নিজের বালিশটা নিয়ে শুয়ে পরেছিল সোফায়। ঐশী সেই মুহূর্তে এক সেকেন্ডের জন্য স্থির হয়ে গেছিল যেন! তবে এরপর আর ও কোন কথা বাড়ায়নি অভীকের সঙ্গে। কিন্তু এরপর প্রত্যেকটা রাতই অভীক সোফায় ঘুমোত, কিছু না বলে। তবে ঐশী মাঝে মাঝে খেয়াল করতো এই রাতগুলোতে অভীকের উসখুস ভাবে এদিক ওদিক ফেরা, ঠিকভাবে ঘুমোতে না পারা গুলোকে। অভীক যে মাঝে মাঝেই ঘাড়ে হাত দিয়ে বসে পড়তো মাঝ রাতে, বা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো একা একা, এইসবও খেয়াল করতো আনমনে। ওর যে সোফায় ঘুমিয়ে ঘাড়ে ব্যাথা হচ্ছে, আনকমফর্টেবেল ফিল করছে রোজ, এটা বুঝতে পারতো ঐশী। কিন্তু ঠিক কিছু বলতে পারতো ওকে নিজে থেকে। আসলে মনের দূরত্ব বোঝানোর জন্য চুপ করে থাকাটা খুব দরকার যে! নইলে ভুল ধারণা তৈরি হয়ে যেতে পারে অভীকের। মনে হতেই পারে যে ঐশী এখনও ওর ভালো খারাপ থাকা নিয়ে চিন্তা করে! তাই চুপচাপ সব কিছু অদেখা করে যেত ঐশী রাতগুলোতে। কিন্তু একদিন আর পারলো না এইভাবে। সেদিনও অভীক মাঝরাতে উঠে বসে ছিল ঘাড়ের যন্ত্রণায়। অন্ধকার ঘরে ঐশী তখন দূরে ঘুমিয়ে ছিল। অভীক সেই মুহূর্তে এক মনে দেখছিল কালো রাতে আবছা হয়ে যাওয়া ঐশীকে। মনে পড়ে যাচ্ছিল পুরনো সময়ে ও এই মেয়েটাকে কিরকম শক্ত করে আঁকরে ধরে ঘুমতো রোজ! ভয়ের স্বপ্ন দেখলে ও ঘুমের ঘোরেই জরিয়ে ধরত ঐশীকে। অথবা অনেক কাজের চাপ থাকতো যেই দিনগুলোতে, তখন রাতে ঐশীর বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তো বেখেঁয়ালে। আর আজ, আজ এই মেয়েটা কত দূরে ওর থেকে! কেমন আবছা কোন ছবির মতন; যাকে কখনো ছোঁয়া যাবে না! কথাগুলো এক মনে ভাবছিল অভীক, তখনই ঐশীর জল তেষ্টায় ঘুম ভেঙেছিল হঠাৎ ; আর চোখ খুলেই খেয়াল করেছিল সোফায় বসে থাকা অভীককে। সেদিন এরপর আর ও কিছু না বলে থাকতে পারেনি। ঘরের আলো জ্বালিয়ে ও সোজাসুজি ভাবেই বলেছিল,
—–” তোমার সোফায় ঘুমোতে প্রবলেম হয় রোজ? আমি তাহলে কিন্তু অন্য ঘরে ঘুমোতে পারি। এই বাড়িতে তো আর ঘরের অভাব নেই! তুমি এই খাটে কম্ফর্টেবলি ঘুমাও।”
কথাগুলো বেশ জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছিল ঐশী। কিন্তু অভীক ওকে থামিয়ে কিছুটা অসহায়ভাবেই বলেছিল যেন থেমে থেমে,
—-” প্লিজ ঐশী, অন্য ঘরে যাওয়ার কথা বোল না আর! অলরেডি অনেক ডিসটেন্স আছে। আর দরকার নেই। জানি, এই এক মাস বাদে আমি হয়ত চাইলেও কখনো দেখতেও পাবো না তোমাকে। কিন্তু এট লিস্ট এই একটা মাসের জন্য, আমার এই টুকু কাছে থাকো, আই রিকুয়েস্ট দিজ..”
কথাটা বলে অভীক দু এক মিনিট চুপ ছিল কেমন নিজের মনে। ঐশীও এই মুহূর্তে ঠিক কি বলবে যেন বুঝতে পারছিল না নিজে। হঠাৎ এই আলো আঁধারে রাতে ছেলেটাকে যেন ভীষণ ফ্যাকাসে, ছন্নছাড়া লাগছিল ওর। চোখের কোণের কালিটাও খুব স্পষ্টভাবে ধরা দিচ্ছিল অভীকের ঐশীর সামনে। ‘ তাহলে কি অভীক ভালো নেই!’ কথাটা যেন আনমনেই মনে এসে ভিড় করছিল ওর। কিন্তু তখনই অভীক ঘরের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে আবার বলে উঠেছিল শান্ত গলায়,
—–” আলো নিভিয়ে দাও। ঘুমিয়ে পরো তুমি। অনেক রাত হয়েছে।”
সেদিন কথাটা বলে অভীক নিজেই উঠে আলোটা নিভিয়ে দিয়েছিল ঘরের, আর আবার সেই পুরনো কালো অন্ধকারে ঢেকে ফেলেছিল নিজেকে। কিন্তু ঐশী এই রাতে প্রথম যেন খেয়াল করেছিল এই বদলে যাওয়া অভীক কে। পুরনো ছেলেটার সাথে এর তো কোন মিলই নেই আর! কেমন নিস্তেজ, চুপ করে যাওয়া একটা মানুষ হয়ে গেছে অভীক! এত শান্ত, এত থমকে থাকা চেহারা তো ওর আগে ছিল না! এর কারণ কি মেঘার না থাকাটাও! ঐশীর চলে যাওয়া, তারপর মেঘারও বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া কি অনেক বড় ধাক্কা দিয়েছে অভীক কে! কথাটা ভাবতে ভাবতেই রাতটা কাটিয়েছিল ঐশী এরপর।
চলবে।