#প্রেম_তরঙ্গ
#আলিশা
#শেষ_পর্ব
ভয়ে তটস্থ আমি মিলির হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললাম
— আব্বুর ইলেকশনের আর কতদিন আছে মিলি?
— এবার এমপি পদ নিতে চেয়েছে আব্বু।
মিলির নরম সুরের কন্ঠ। আমি ভয়ে আরো মিইয়ে গেলাম। যেন হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। এরই মাঝে একবার খুব সন্তর্পণে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চাইলাম ক্যারেন কোথায়? কি করছে? এই দেখাতেই যেন আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার দশা। শুধু ক্যারেন নয়। একটা কারের পাশে দাড়িয়ে আছে আরো তিনজন। কণা, কণার মা, বাবা। অন্তরাত্মা যেন কেঁপে উঠলো আমার। সবাইকে নিয়ে এসেছে? ক্যারেন কি আমায় খুঁজতে এসেছে? এতো ধূর্ত সে! পরিবারসহ নিয়ে এসেছে।
— ক্যারেন কোনটা আপু? ব্লু কালার শার্ট পরা লম্বা ছেলেটা?
মিলির কথার জবাবে আমি কাঁপা কন্ঠে বললাম
— হ্যা, গাড়ির কাছে যে দাড়িয়ে আছে। রোদে লাল হয়ে গেছে ওটা।
— এখন কি করবি?
— ওদিকে আর যাবো না। চল সামনে থেকে একটা অটো নিয়ে সোজা বড় আম্মার বাড়িতে যাবো। আমাদের বাড়িতে যাবো না। ওদের সাথে যদি দেখা হয়?
মিলি মেনে নিলো আমার কথা। দু বোন বেশ কিছু পথ হেঁটে গিয়ে উল্টো পথে এক অটো ভাড়া করে বড় আম্মার বাড়ির দিকে গন্তব্য করলাম। শেষ বারের মতো অটোতে উঠে ফিরে চাইলাম তাদের দিকে। এক ধবধবে সাদা কার তখন আমাদের বিপরীতে চলতি দশায়। দেহ মন আমার চিন্তায় কাতর। কি হবে সময়ের গতিতে? কতবড় সর্বনাশ অপেক্ষা করছে আমার জন্য?
.
ভাবনা অনুযায়ী সোজা বড় আম্মার বাড়িতে এসে পৌছালাম। ইচ্ছে ছিল একটা রুম নিজের দখলে নিয়ে বন্দিনী হয়ে যাবো। কিন্তু তাকে ঘোর বিরোধিতা করে বড় আম্মা হুট করে আমায় টেনে নিয়ে গেলেন তার নিজের ঘরে। সাথে আম্মুও এলো। বললেন
— এই শাড়িটা ঝটপট পরে নে। জলদি।
আমি চমকে উঠে বললাম
— কেন?
— আমার ভাই আসছে ঢাকা থেকে। তোকে দেখবে। আর হ্যা সারপ্রাইজ আছে।
আমার থুতনিতে হাত রেখে বড় আম্মা বলে উঠলেন প্রফুল্ল চিত্তে। আমি ধুকপুক করা বুক নিয়ে পাশে থাকা মিলির পানে চাইলাম। মিলি চিন্তিত মুখে বড় আম্মার পানে তাকিয়ে আছে। আম্মু মিলিকে আদেশ দিলেন আমাকে শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার। অতপর বড় আম্মার সাথে কথায় ব্যাস্ত হয়ে বিদায় নিলেন।
— মিলি কি হচ্ছে এসব?
— জানি না। তুই শাড়ি পরে নে। তারপর দেখছি।
— আমার হাত পা ভয়ে জমে যাচ্ছে। একদিকে ক্যারেন, আরেকদিকে এসব।
আমি দিশেহারা হয়ে বিছানায় বসে পরলাম। মিলি অসহায় হয়ে গেলো। চিন্তিত মুখে ও একটা সময় বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। আমার মাথায় হাত। আজ তিতাসের সাথে সব ঠিক থাকলে এমন বেঢপ পরিস্থিতিতে পরতে হতো না আমার।
.
প্রায় ঘন্টা পেরিয়ে গেলো। আজব ব্যাপার হলো মিলি সেই যে বেরিয়ে গেলো আর ফিরছে। আমিও ঘর থেকে বেরোতে পারছি না। হঠাৎ আমার এক ফুফু এসে জাপ্টে ধরেছে আমায় শাড়ি পরিয়ে দিতে। আমার কান্না পাচ্ছে। সব যেন মাথার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বারংবার একে ওকে বলছি আম্মুকে একটু ডেকে দিতে। কেউ দিচ্ছে না। শুধুই বলছে, রান্না ঘরে ব্যাস্ত সে।
— তিথি আপু একটু শোমনো।
আমার ঢিপঢিপ করা হৃদপিণ্ডের মাঝে হঠাৎ সাত বছরের ফুফাতো ভাইয়ের ডাক। আমি তখন দু-হাত হালকা উপরে তুলে দাড়িয়ে আছি। ফুফু শাড়ির কুঁচি ঠিক করছে।
— ফুপি, পলক আমাকে ডাকছে।
— আগে শাড়িটা পর। তারপর ওর কাছে যা।
আমি আর কিছু বললাম না। অপেক্ষায় রইলাম শাড়ি পরার ইতি হওয়ার। প্রায় দশমিনিট পর ফুফু আমায় ছাড়লেন। পলক তখনও দরজার ওপাশে দাড়িয়ে। ফুপি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সে ছোট ছোট কদমে ঘরের ভেতরে ঢুকলো। তারপর আচমকাই আমার হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে বলল
— মিলি আপু দিয়েছে তোমাকে।
এটুকু বলেই সে দৌড়ে চলে গেলো ঘর থেকে। আমি অবাক হলাম। অজান্তেই বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠলো। মিলি দিয়েছে? কেন? কি হয়েছে? মনে হাজার প্রশ্নের বহর নিয়ে ধীর গতিতে কাগজের ভাজ খুলতে লাগলাম। মুহূর্তেই ভেসে উঠলো অচেনা এক হাতের লেখা
” প্রেয়সী আমার,
ভীষণ ভালোবাসি। সেই বুঝ হওয়ার পর থেকে। ক্যাপ্টেন হওয়ার স্বপ্ন বেনার আগ হতে। আমার সকল গানের সুরে আমি কেবল তোমাকেই খুঁজি তিথি। আমার চির নিস্তব্ধ হৃদয় জুড়ে শুধুই তিথি, তিথি আর তিথি। উফ! পাগল বানিয়ে ফেলে এই নামটা আমায়। যেদিন প্রথম কানাডার মাটিতে পা রাখলাম বড্ড কষ্ট হচ্ছিলো। যেদিন প্রথম ফ্লাইং করলাম তখন আমি কানাডার শেষ প্রান্তে ছিলাম প্লেন নিয়ে। কতশত বার যে ইচ্ছে হয়েছিল ওদিন যে হুট করে চলে যাই তিথির কাছে। তাকে উঠিয়ে নিয়ে আসি প্লেনে। তারপর দুজন একসাথে উড়ি। সেদিন বৃষ্টির রাতেও ইচ্ছে হয়েছিল তোমাকে নিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। এক ছাতার নিচে দু’জনে দ্রুত সংসার বেঁধে ফেলি।
তুমি সেদিন বললে না, মাটি দিয়ে চলা ভুলে গেছি আমি? আসলে তা না। তুমি পাশে থাকলে আমি দুনিয়াদারি ভুলে যাই। কেমন যেন একটা ধুকপুক ধুকপুক সুর ওঠে বুকের মাঝে। এই বুঝি আমি হারিয়ে যাচ্ছি। হার্ট বিট করতে ভুলে যায় ক্ষণে ক্ষণে।
আমার গল্প শেষ হবে না তিথি। আরো অনেক অনুভূতি, আরো অনেক কথা আছে। শুনাবো একদিন। তোমাকে পাওয়ার পর। এখন শুধু শুনে রাখো, আমার প্রেমের তরঙ্গ তোমার সাথে। আমার হৃদয় হতে প্রেম তোমার হৃদয়ে বইছে। আমার দশ বছরের ভালোবাসা তুমি। উপেক্ষা করার শক্তি কিন্তু তোমার নেই। কানাডা যাওয়ার আগে আমি কি বলেছিলাম ছোট তিথিকে? মনে আছে?
বলেছিলাম, তিথি, তোমাকে কিন্তু তোমার তীন ভাইয়া অনেক ভালোবাসে। তখন বোধ হয় বোঝোইনি তুমি আমার কথা। আচ্ছা বাদ দাও। বিদায় নিচ্ছি। ”
অনুভূতি পুরোদস্তুর শূন্যের কোঠায় চলে গেলো আমার। মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়ে আবার পড়া শুধু করলাম। ইতি দিয়ে কিছু লেখা নেই। তবে চিঠির শেষাংশে অন্য আরেক হাতের লেখা
” আপু, আমি তীন ভাইয়াকে ভালোবাসি।”
বুঝলাম এটা মিলির লেখা। আমি আরো চমকে উঠলাম। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে নির্লজ্জ লাগছে। মাথা ঝিমঝিম করছে।
সমাপ্ত ( অসমাপ্ত)