সুখের প্রেমাসুখ পর্ব-০৪

0
404

#সুখের_প্রেমাসুখ(০৪)
#ওয়াসেনাত_আরাবী

“তোমাকে আমি অতি ভদ্র জানতাম।ভেবেছিলাম ঠান্ডা, নরম স্বভাবের। সেই তুমিই কীনা এক বাসররাতে দুবার বউকে সেন্সলেস করে দিলে মাশহুদ? ব্যাড, ভেরি ব্যাড। তোমার থেকে এটা আশা করিনি আমি। ওই একটুখানি কোমলমতি মেয়ে আমাদের। একদিনে এত সহ্য করতে পারে?”

দুলাভাই সায়ন অর্থাৎ রাহার স্বামীর রসিকতা শুনে থম মে’রে বসে রইলো মাশহুদ। মাহা দরজার আড়ালে লুকিয়ে আছে। সায়ন সেটা দেখে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে পড়েই কথাটি বলল। মাহা তাজ্জব বনে গেল। সায়ন ভাইয়া জানলো কী করে এই কথা? নিশ্চই মীরা বলেছে। লজ্জায় মাহার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। রাহার শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলো মনে পড়লো। কী লজ্জা! মাহা এবার বুঝলো রাহা কেন ব্যক্তিগত কথা গোপন রাখতে বলেছে।মাশহুদ চাপাস্বরে বলল,

“কী করবো বলো? তোমার ওইটুকুন শ্যালিকা এত বেশি মিষ্টি যে তর সইলো না।বাসররাত, নিজের বিছানার ওপর নিজের বিয়ে করা বউ দেখে কোন পুরুষ ঠান্ডা থাকে? তুমি ছিলে বুঝি? এজন্যই কী বছর ঘুরতে না ঘুরতে জোড়া ভাগ্নে পেলাম?”

মাহা লজ্জায় নুইয়ে পড়ে। এই লোক তো মহা বদ! ওর মাশহুদ ভাইয়ের এই রূপগুলো কোথায় ছিল এতদিন? মাহা কেন এতগুলো বছর দেখতে পেল না? টেরও পেল না? মাহার হাতের খাবারের ট্রে কাঁপছে। সর্বাঙ্গ কাঁপছে। সায়নের পরের বাক্যটি ছিল,

” আমার ছেলেরা বড় হোক। বুঝতে শিখুক কীভাবে মেয়ে তুলতে হয় তারপর তুমি আমাকে যে প্রশ্ন করেছো তার উত্তর আমি আমার ছেলেদের মাধ্যমে দিবো।যখন তোমার মেয়েদের আমার বাড়ি নিয়ে আসবে,তোমাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। তখন বুঝবে তাদের এত দ্রুত কেন এনেছি।”

“তুমিও রাহা আপুর দলে?আবার খালাতো ভাই-বোনের বিয়ে দিতে নাচছো?”

“না, আমি চাচ্ছি আমার ছেলেরা যাতে সুন্দরী সুশীলা বউ পায়। যারা আমাদের মান্য করে চলবে। তোমাদের মেয়ে একদম পার্ফেক্ট হবে। ঘরের ছেলে ঘরে আটকে রাখার মত বউমা চাই আমাদের। ব্যবস্থা করে ফেলো ভাইরা ভাই।”

“একটা মেয়ে দিয়ে, দুটো মেয়ে চাচ্ছো এটা তোমাদের কোমলমতি মেয়ে জানে? সেই ফুল তো ছুঁয়ে দেওয়ার আগেই ঝরে যায়। সুভাসও নেওয়া যায় না, আর যত্নে গুছিয়েও রাখা যাচ্ছে না। এতটা কোমলমতি বানানো ঠিক হয়নি। হৃদয়ে সব কোমলতা ঢেলে না দিয়ে এর পাশাপাশি কিছুটা বুদ্ধি, মাথায় দিলে সুবিধা হতো।”

“তোমার একার বুদ্ধিই যথেষ্ট! শুধু শুধু ওর মাথাকে প্রেসারে কেন ফেলবে ভাই? তোমার তো একটাই কাজ, ও প্রবলেম ক্রিয়েট করলে তুমি সলভড করবে।”

“বিনিময়ে কী পাবো?”

“সুন্দরী বাধ্য, নম্র,ভদ্র বউয়ের অঢেল ভালোবাসা।”

“তুমি এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা এ ঘরে বসে থাকলে অঢেল ভালোবাসা যার কাছ থেকে পাবো সে তো ঘরে ঢুকতেই পারবে না সায়ন ভাই। ভালোবাসা-বাসি হবে কখন? ”

সায়ন খুকখুক করে কেঁশে ওঠে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মাহার কথা মনে পড়ায়, ভ্রু উঁচু করে মাহাকে ইঙ্গিত দিয়ে প্রশ্ন করে মাশহুদকে। মাশহুদ ইশারায় ইতিবাচক সম্মতি দিল। সায়ন দ্রুত ব্যস্ততার সঙ্গে বলল,

“ওহ! স্যরি, স্যরি ভাই। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি এখুনি বেরিয়ে গিয়ে তোমাদের ভালোবাসা-বাসির একটা সুযোগ তৈরির ব্যবস্থা করে নিজেকে এই শুভ কাজের অংশীদার করছি।”

মাশহুদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই সায়ন বেরিয়ে গেল। দরজার বাইরে মাহাকে দেখেও যেন দেখলো না সে। মাহা দেওয়ালে মুখ আড়াল করে দাড়িয়ে আছে। সায়ন চলে যেতেই মাহা ঘরে ঢুকে রেগে বলল,

“এসব কী বলছিলেন ভাইয়াকে? অসভ্য কথাবার্তা।”

মাশহুদ ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে বলে, “আমি কী বলেছি? দু মিনিট পর পর সেন্সলেস তুই হয়েছিস, সেটা ঘটা করে প্রচারও তুই করেছিস। ভাইয়া এসে এসব সত্য বললে আমি চুপ করে থাকবো? আমি কী পুরুষ না?”

মাহা থতমত খেয়ে বলে, “কিন্তু আপনি তো প্রেমা আপুকে ভালোবাসেন।”

“কে বলেছে?”

“আপনিই তো বলেছেন গতকাল রাতে।”

“তোর কান ঠিক আছে? আমি কী বলেছিলাম মনে কর। মনে করে অ্যাকুরেট শব্দ বল। তার আগে নাশতার প্লেট দে। ক্ষুধা লেগেছে আমার। তুইও বোস। খেতে খেতে মনে করে বলবি। ”

মাহা মাশহুদকে প্লেট দিয়ে অনেকটা সময় ধরে ভাবে। নতুন কিছু মনে পড়ছে না। মাশহুদ প্রেমাকে ভালোবাসে এটাই বলেছিল গতকাল রাতে। মাহা নিশ্চিত এ ব্যাপারে। তাই দৃষ্টির প্রখরতা বৃদ্ধি করে বলল,

“আপনি এটাই বলেছিলেন।”

“নাহ্! তোর শর্ট স্পেসের মেমোরি স্টোরেজ নিয়ে আর পারা গেল না। গতকাল রাতে স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বলেছিলাম ‘বাসি হয়তো’ হয়তো মানে কী? অনিশ্চয়তা। এরপর কী বলেছি? পরকীয়া শব্দটি আমি ঘৃণা করি। তারপর কী বলেছিলাম?আমাদের সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করবো আমি। বলেছিলাম কী না, বল।”

মাহা বোকা বোকা বাক্যে সায় দিল, “বলেছিলেন তো।”

“এরপর বলেছিলাম তোর ইচ্ছে হলে মুক্তি নিতে পারিস আর বাইকে ওঠার সময় বলেছি তোকে আমি ছাড়বো না। বলেছিলাম এটা? মনে পড়ছে?”

মাহা পুনরায় বলে, “হ্যাঁ। এটাও বলেছিলেন।”

“এবার আসি পরের ঘটনায়, রাতে প্রেমার ওখানে কেন গিয়েছিলাম? কারন তুই কেঁদে ভাসাচ্ছিলি। কাঁদছিলি না?”

“হুম। আমার কষ্ট হচ্ছিলো।”

“ওকে। এরপর প্রেমার ওখানে যাওয়ার পর, প্রেমাকে আমি ওর প্রস্তাবের বিপরীতে কী বলি তা নিশ্চই আমার পাশে দাড়িয়ে শুনেছিস? আর ও কী বলেছে তাও তো শুনেছিস। এসব শুনে কী বুঝলি?”

“আপনি একতরফা প্রেম করে, ছ্যাকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে গেছেন। এটা?”

মাশহুদ দাঁতে দাঁত ঘসে বিরবির করে বলে, “এটা তো ঠিকই ফটফট করে বলে দিলি। যত না বোঝার কাহিনি সব মেইন পয়েন্টগুলোতে।”

মাশহুদ হেসে বলে, “এক্জাক্টলি! কিন্তু যেটা জানিস না সেটাও জেনে রাখ,, আমি বাইকে উঠে বলেছিলাম প্রেমার প্রতি একটা আবেগ কাজ করেছিল। এই আবেগ নামক শব্দটা যেকোনো পছন্দের জিনিসের প্রতি কাজ করে। একটা পাখিকে ভালোবাসলেও তার কষ্টে কষ্ট লাগে। তোর ওই ময়না পাখি ম’রলে তুই ষোলোদিন ধরে কেঁদেছিলিস না? তাহলে একটা মানুষের ম’রম’র সময়ে আমার খারাপ লাগাটা দোষের হয়ে গেল? খারাপ লাগলেই এটা ধরে নিতে হবে কেন? যে আমি তাকে প্রেমিকার মত ভালোবাসি? মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে এটা স্বভাবিক! কিন্তু একটা মানুষ সব স্বাভাবিকতা বুঝেও অস্বাভাবিক আচরণ করবে এটা স্বাভাবিক নয়। এটা নিশ্চই জানিস মাহা?”

মাহা চোখ নত করে রাখে। মাশহুদ হেসে বলল, “স্লিপ খেয়ে পড়ে গিয়েছিলি, এতে এত লজ্জা পাওয়ার কী ছিল? যে সেন্সলেসই হয়ে গেলি। তোর এই লজ্জা পেয়ে, ভয় পেয়ে সেন্সলেস হওয়ার গুণটা বিশ্বাস কর পৃথিবীর কোনো মেয়ের নেই। যদি ভুল না হই তাহলে তোকে কোলে নেওয়ার পর তোর রাহা আপুর কথা মনে পড়েছিল। রাহা আপু তোকে কী শিখিয়েছে আমার জানা নেই তবে এটুকু নিশ্চিত থাক, তোর বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু হবে না। সকালে আবার সেন্সলেস হওয়ার নাটক করলি, মায়ের কাছে অভিযোগ করলি, আমাকে শায়েস্তা করতে। তোর ওই টুকু শরীরে এসব বুদ্ধি ঠিক কোন অংশে থাকে? হাটুর নিচ থেকে আসে বুদ্ধি?” কিছুটা থেমে মাশহুদ পুনরায় বলল, “আচ্ছা সবকিছু বাদ দিয়ে আমার ওপর তোর রাগটা আসলে কী নিয়ে সেটা বল।”

মাহা পরোটা ছিড়ে মুখে দিয়ে বলল, “আপনি নিজের মতো যুক্তি দাঁড় করিয়ে নিয়েছেন। আমার আপনার ওপর কোনো রাগ নেই। আপনিই অস্বাভাবিক কথা বলেছেন।”

মাশহুদ দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “যুক্তি তো দাঁড় করিয়েছিই। আর এটাও বের করলাম যে তুই সবাইকে নিয়ে ভাবিস, সবার জন্য তোর কষ্ট হয়। শুধু আমার জন্য বিয়ের পর থেকে কোনো কিছু হয় না। বিয়ের আগে অবশ্য তুই আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসতিস ভাই হিসেবে। আর বিয়ের পর আমি তোর জীবনের একমাত্র শত্রু হয়ে গেছি। তোর মতিগতি দেখলেই বলে দেওয়া যায় তুই নিজে অস্বাভাবিক আচরণ করছিস। এখন সবার সাথে তোর সম্পর্কের একটি বিশেষ পরিবর্তন এসেছে। যখন তখন আমার নামে নালিশ, পার্সোনাল ব্যাপার সবার সামনে বলা যায় না এটা বোঝার মতো বুদ্ধি তোর নেই এটা অসম্ভব! কী বলেছিস সবাইকে?আমি তোকে কীভাবে কষ্ট দিয়েছি?”

“আমি ওটা এভাবে বলিনি। আমার কথা কেউ পুরোটা শুনলো কোথায়? কাউকে তো বলতেই পারলাম না। আপনি রাতে ফিরে আসার পর থেকে উচ্চস্বরে ধমকাচ্ছেন। তেজ দেখাচ্ছেন। বাইরের রাগ বাড়ি আমার ওপর ঝারছেন। সোজা কথা সোজাভাবে বলছেন না। ত্যাড়া ত্যাড়া উত্তর দিচ্ছেন। আপনি বদলে যাচ্ছেন আরও বদলাবেন। বিয়েটা আপনার পছন্দ হয়নি।”

“এজন্য সন্ন্যাসিনী হবি?”

“কেউ আমাকে আগের মতো আর ভালোবাসে না।শুধু আপনাকে ভালোবাসে। আর আপনিও সবার মতো।”

“তোকে রাতে কী বলেছিলাম মাহা? মনে কিছু আসলে সেটা সরাসরি আমাকে বলবি। বলেছিস?”

“বলবো কী করে? রাতে দুম করে কোলে.. সকালে যে বাক্য চোখ মেলে তাকাতেই শুনলাম তাতে এসব বলে আপনার হাতে মা’র খাবো? আপনি গতবার সাইফ ভাইকে একটা ঘু’সি দিয়েছিলেন ওর সেই ব্যাথা কমতে দশদিন লেগেছিল।”

“তুই ভেবেছিস আমি তোকেও ঘু’সি দেবো? আশ্চর্য! মাহা, দিন দিন তুই, তোর বুদ্ধির এত অবনতি হচ্ছে?”

“দিতেও পারেন। ঘু’সি না দিলে চ’ড়-থা’প্প’ড় দেওয়া একদম স্বাভাবিক বিষয় আপনার কাছে।কারন আপনার হাত অনেক বেশি চলে।”

মাশহুদ এর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলতে পারলো না। ওর হাত আসলেই অনেক বেশি চলে। মাহা তো এটার এক প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তবে মাহার ব্যাপারটা আলাদা। এটা এই মেয়ে বুঝবে না। ছোট থেকেই কম বোঝে মেয়েটা।আর আহ্লাদ পেয়ে এখন একেবারেই অবুঝ হয়ে গেছে। শুধু নিজের যা মন চায়, নিজের মাথায় যে বোকা বোকা বুদ্ধি আসে সেগুলোকেই প্রশ্রয় দেয়। ওর ছোট মাথায় বুদ্ধির চাষ করা জরুরি। মাশহুদ চিন্তিত হলো।বুদ্ধির চাষ শুরু করবে কোথা থেকে? একটু জোরে কথা বললেই যে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদে, লজ্জা পেলে দুমদাম সেন্সলেস হওয়ার ক্ষমতা রাখে সেই বিরল মেয়েটাকে স্বাভাবিক করতে বেশ বেগ পেতে হবে। বোঝাতে হবে মাশহুদ ওকে আগের মতই ভালোবাসে, বরং আগের তুলনায় বেশি ভালোবাসবে। তাই এটা নিয়ে অভিযোগ করা বন্ধ করে নিজেকেও এই একই স্রোতে ভাসানোর চেষ্টা করতে হবে। মাশহুদের মনে হলো, বাড়ির সবথেকে ছোট বাচ্চাগুলো বেশি অ্যাডভান্টেজ পায়। এই যেমন মাহা পাচ্ছে। আর ডিসঅ্যাডভান্টেজগুলো বড়দের ভাগ্যে খোদাই করা থাকে। না বুঝে, একটা ভুল শব্দ অন্যভাবে বলে ফেলায় ঘরের বাইরেই পা দেওয়া যাচ্ছে না। এই মাহাকে নিয়ে বহুত ভুগতে হবে। প্রচুর ধৈর্যের প্রয়োজন পড়বে। গতকাল কঠিন গলায় কথা বলাটা উচিত হয়নি। একেবারেই উচিত হয়নি বউয়ের সাথে খুঁনশুটি করার ইচ্ছে পোষণ করা। মেয়েটার বুদ্ধি ঠিক জায়গা বুঝে লোপ পায়। আবার ওকেও দোষ দেওয়া যায় না। ছোট থেকেই খোলা মনের মেয়ে মাহা। সবার সাথে নির্দ্বিধায়, জড়তাহীন কথা বলে। বিশ্বাস করে। যখন মুখ খোলে সত্যটাই বলে। ভণিতা করেনা। এই সবকিছুর সঙ্গে একটু বুঝ থাকলেই মাশহুদ নিশ্চিন্তে থাকতে পারতো।মাশহুদ বলল,

“এই ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে কী হচ্ছে তা যেন ঘরের বাইরে না যায়, মাহা। শুধু এটুকু মেনে চলার চেষ্টা কর। ঠিক আছে?”

“একটা প্রশ্ন করি?”

“হুম।”

“এত সহজে সব স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করছেন কেন? সব তো স্বাভাবিক নয়।”

“সবটাই স্বাভাবিক। শুধু তুই ভুলভাল চিন্তা করে সবটা অস্বাভাবিক করে তুলছিস। আর স্বাভাবিক নয় কেন? এখন আমাদের সম্পর্ক একদম নরমাল। আমি তোকে মন থেকে মেনে নিয়েছি। এবার তোর পালা।”

চলবে..