#প্রেম_তরঙ্গ
#আলিশা
#পর্ব_৩
এলোমেলো পায়ে অস্থির মন নিয়ে সোজা নিচে চলে এলাম। এদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাবো। বেশ করে পরখ করে নিলাম আশপাশ। সবাই গেটে বর নিয়ে ব্যাস্ত। পুরো গেট সাজানো হলেও একপাশে একটু ছিল ফাঁকা। ঘিরে আছে চারপাশ মানুষে মানুষে। ক্যারেন কে আশপাশে খুঁজলাম। সে নেই। একটু স্বস্তি পেলাম। আমি দ্রুত পায়ে গেটের ভিড় ঠেলে একটু ফাঁকা রাখা জায়গা দিয়ে বাইরে যেতে চাইলাম। গেট পেরোলেই সোজা মেইন রোড। একটা কিছুতে উঠে পরলেই হবে। তারপর আমি কোথায় যাবো? জানি না। হয়তো নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো। যতক্ষণ না বুকের ব্যাথা প্রশমিত হয় ততক্ষণ আমি নিরুদ্দেশ থাকবো। তারপর একদিন আমি আবার ফিরে আসবো। তিতাসকে খুব করে জব্দ করবো। ক্যারেনের সম্মুখে দাড়িয়ে বলবো,
” একটা মেয়েকে এতো অসহায় ভাববেন না। আমি আপনার খেলার পুতুল ছিলাম না। ”
কিন্তু এটুকুতে কি হবে? ওরা তো ঠিকই সুখে থাকবে! শুধু আমিই তো সেই কষ্ট পাবো। ধুঁকে ধুঁকে মরবো। আচ্ছা পরে ঠিক করবো এসব। ভাবনা সব পরে। প্রথমেই আমি এদের ছেড়ে চলে যেতে চাই। আমি তিতাসকে কণার পাশে দেখতে চাই না। এটাই যদি আমার দেখার হয় তবে তার পূর্বে যেন আমার চোখ ঝলসে যায়।
— আরে ভাবি পালাচ্ছেন নাকি! আমায় মিষ্টি মুখ করাবে কে?
মাত্রই একপা ফেলেছিলাম গেটের মাঝে। ঠিক এমন সময় ডাক। আমি চমকে তাকালাম কন্ঠের মালিকের দিকে। চোখ ভিজে উঠতে বাধ্য হলো আমার। বর বেশি নজর কাড়া তিতাস আমায় হাঁক দিলো। সম্বোধনটা কি ছিল? ‘ভাবি’।
— আসেন। এভাবে আমাকে গেটের বাইরে আর কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবেন। আমি তো আমার একমাত্র ভাবির হাতেই মিষ্টি মুখ করতে চাই।
আমার কষ্ট গুলো বেড়ে এবার পাহাড়সম হলো। সেই পাহাড় বুঝি আকাশ ছুঁয়েছে। ভুলে গেলাম মুহূর্তেই এখান থেকে দূরে চলে যাওয়ার কথা। ঘুরে দাড়ালাম। আশপাশে তখন হাসির রোল। ঠাট্টার বহর চলছে। তিতাসের আচরণে আমি অবাক। সকলের অগোচরে পরক্ষ এক খোঁচা সে আমায় দিচ্ছে।
— অফকোর্স টিটাস। টিটিই মিইষ্টি খাওয়াবে।…. হেই টিটি, হোয়্যার ডু ইউ স্টে? কাম হেয়ার। ননদের হাসবেন্ড কে মিইষ্টি খাওয়াও।
ক্যারেনের কন্ঠ। সে উৎফুল্ল চিত্তে বলে উঠলো। আমার জলে টইটম্বুর আঁখি সামলে নিলাম আমি সন্তর্পণে। অজ্ঞাত ঘটনার বিভৎস কাহিনী আর যন্ত্রণা শুধু বুকে চাপা রইলো আমার, তিতাসের আর ক্যারেনের। আমি ধীর পায়ে জেদ সমেত এগিয়ে গেলাম তিতাসের সামনে। তার আর আমার মাঝে ছোট এক টেবিল রাখা। তাতে তিন চার পদের মিষ্টি, শরবত। আমি পোড়া হৃদয় নিয়ে মুচকি হাসলাম তিতাসের দিকে তাকিয়ে। টেবিল থেকে একটা মিষ্টি কাটা চামচে তুলে নিয়ে নীরবে বাড়িয়ে দিলাম তিতাসের দিকে। তিতাস যেন অবাক হলো। ঘাবড়ে গেলো, থতমত খেয়ে গেলো। তার এমন দশা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লাগলো। পাশে তার বন্ধুরা ছিল। যারা আমায় চেনে, পরিস্থিতি জানে তারা সকলেই নীরব। আমি তিতাসের উদ্দেশ্যে বললাম
— অবিশ্বাস কি আপনার রক্তে রক্তে মেশানো নাকি? মিষ্টি খেতে ভয় পাচ্ছেন যে?
— আপনার মুখে একথা মানালো না।
কথাটা বলেই তিতাস মুখ বাড়িয়ে দিলো আমার বাড়িয়ে দেওয়া মিষ্টির দিকে। আধবোজা চোখ তার। আমার ভেতরটা ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। আচমকা হাত কাঁপতে আরম্ভ করলো। এই বুঝি আমার হাত থেকে চামচসহ মিষ্টি হুট করে নিচে পরে যাবে। তিতাস বুঝলো। সে এক হাত বাড়িয়ে দিলো আমার হাতের দিকে। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। একটু পর আমার হাতে অন্য এক হাতের স্পর্শ পেলাম। তনু, মন কেঁপে উঠলো ঝট করে। কানে বেজে উঠলো
— হেই… ব্রো, বউটা আমআর। মিইষ্টি খাওয়ার অযুহাতে টাচ করা অন্যায়।
ক্যারেনের কন্ঠ। আমি ঝট করে চোখ খুলে নিলাম। কান যেমন ঝিনঝিন করে উঠলো ঠিক তেমনই মন অবশ হলো। এতো মানুষের ভীরেও ক্যারেন আমার পিঠ ঘেঁসে। বড্ড কাছে। তিতাসের দিকে তাকিয়ে দেখি সে আহত, বিব্রত। মুখ তার হা। ক্যারেন আমার হাতটা টেনে তিতাসের মুখের কাছে নিয়ে মিষ্টি খাওয়ার জন্য ইশারা করলো। তিতাস প্রায় মিনিট তিনেক আমার দিকে জ্বলে পুড়ে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল। আমি স্থির আছি। যদিও দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার ক্যারেনের ছোঁয়ায়। তবুও দেখতে চাই তিতাস কি করে।
সেদিন আমি আর তিতাস ছাঁদে দাড়িয়ে ছিলাম। না আমি একাই দাড়িয়ে ছিলাম। তিতাস তখন হাঁটু গেড়ে বসা ছিল। হাতে তার লাল রাঙের পরিস্ফুট গোলাপ ছিলো। আমাদের প্রেমের একবছর পূর্ণ হবে সেদিন। দ্বিতীয় বারের মতো তিতাস আমায় অনুভূতি জানিয়ে প্রপোজ করে সেদিন। বলে
” তিথি, ভীষণ ভালোবাসি। কেন ভালোবাসি এটা জানতে চেয়েও না। আমি অনেক খুঁজেছি এই কারণ। বারবার ভেবেছি আমি কেন তোমাকে ভালোবাসি? কারণ খুঁজে পাইনি। কারণ খুঁজতে গিয়ে শুধুই উপলব্ধি করেছি আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। যতোবার কারণ খুঁজতে গিয়েছি ততবার তোমাতে ডুবে গেছি গভীর করে। দেখো আমি গুছিয়ে কিছু বলতে পারি না। শুধু একটা কথাই বলবো, এই মুখোশধারী পৃথিবীতে তুমি আমায় ঠকিও না। আমার জেদের মাত্রা তুমি ভালোভাবেই জানো। তুমি যদি আমার ছাড়া অন্য কারো হও তবে আমি মরবো না, হতাশ হবো না, চিৎকার করে হয়তো কাঁদবোও না। তবে আমি ভালো থাকতে পারবো না তিথি। ধরে নিও ভেতরে ভেতর আমি অসংখ্যবার খুন হয়ে গেছি। আমি ভালো নেই তখন।”
আমার মনে তখন অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়েছিল। তিতাসের কথাগুলো ছিল না ততটা মোহনীয় তবে অবশ্যই হৃদয় কাপিয়া দেওয়ার মতো কিছু ছিল তার কথার মাঝে। আমি জলভরা চোখে তিতাসের হাত থেকে ফুল গুলো নিতে হাত বাড়াই। ঠিক তখনই তিতাস হাত পিছু হটিয়ে আবার বলে
— আগে বলো? আই লাভ হউ! নাহলে ফুল দেবো আমি কি আশায়?
আমি হেঁসে উঠে সেদিন লাজুক মুখে বলেছিলাম
— আই লাভ ইউ বলতে পারবো না। যদি বলি ভালোবাসি? তাহলে হবে?
— হুম হবে.. তবে কাকে ভালোবাসো?
— ঢং! তুমি জনো না বুঝি?
— না বললে আমি জানবো কেমনে শুনি?
— যাহ! বলবো না। বুঝে নাও। তুমি না হবু ডাক্তার। আমি তোমার এতো দিনের পেশেন্ট আর তুমি আমাকে চেনোই না? এই ডাক্তার ভালোই না।
— হাহাহাহা….. তুমি যে আমার পেশেন্ট এটাও তো জানতাম না।
আরো কিছু মিষ্টি মধুর কথা ছিলো সেদিন। সাঁঝ নামতেই নেমে আসা হয় ছাদ হতে। কিন্তু কথায় বলে হাসলে কাঁদতে হয়। কথাটা ব্যাপক ভাবে প্রতীয়মান হয় তারপর দিন। একইসাথে দু’দুটো ঘটনা ঘটে সেদিন। ভোর বেলায় আমি ছাদে হাটাহাটি করতে যাই। সেখানে আমার পূর্বেই দাড়িয়ে ছিল ক্যারেন। তাকে অত্যন্ত বিচলিত দেখাচ্ছিল। ছাদের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত সে পায়চারি করছিলো। আমি স্বাভাবিক ভাবেই তাকে দেখে নেমে আসতে চাই ছাঁদ থেকে। কিন্তু হঠাৎ ডেকে ওঠে আমায় ক্যারেন।
— হেই…লিসেন…
আমি মৃদু কেঁপে উঠে থমকে যাই তার ডাকে। পেছন ঘুরে তার দিকে তাকাতেই আচমকা কাঁপন ধরে আমার দেহে। অপ্রত্যাশিত কিছু হলেই আমার এই কাঁপাকাপি জিনিসটার কবলে পরতে হয়।
— হ্যা বলুন।
বাংলাতেই কথা বলে উঠি তার সাথে। তিতাস ও কণার থেকে শুনেছিলাম ক্যারেন বাংলা ভাষা আয়ত্ত করেছে। অনেক আগে থেকেই তার মা তাকে আমেরিকায় বাংলা ভাষা শিখিয়েছে। যতোই হোক, পিতৃভাষা তাই হয়তো শিখেছিল।
— তুমি টিটি.. রাইট?
— টিটি না, তিথি।
— টিটটিই?
— তিইইইই…থিইইইই
— টিহহহহহট…ঠিইইইই?
আমি সেদিন ভীষণ বিরক্ত হই। স্বভাবতই নিজের নামের দশা রফাদফা দেখলে যে কেউ রেগে অগ্নিমূর্তি হবে। বিরক্তিতে কপাল চাপড়াবে। আমিও তাই করালাম। তবে এবিষয়ে আর কথা বাড়াইনি। পরবর্তী ধাপে চলে যাই। সে এই ধাপে বেশ শক্তপোক্ত মুখ করে বলে আমায়
— টিটাসকে লাভ করো?
চলবে…..
( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন )