#বুক_পিঞ্জরায় (০৫)+(০৬)
ফাতেমা তুজ জোহরা
পাঁচ.
বিকেলের দিকে জ্ঞান ফিরলো মেহরাবের। চোখ খুলে মেহেরকে পাশে দাঁড়ানো দেখলো। কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেহের তাকালো মেহরাবের দিকে। মেহরাবের জ্ঞান ফিরেছে দেখে গটাগট কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। সবে জ্ঞান ফেরার দরুন চোখদুটো ঘোলাটে হয়ে আছে মেহরাবের। সামনে থাকা মেয়েটাকে ক্লিয়ারলি দেখতে পায়নি। দেখতে পায়নি বলতে, চেহারাটা ঘোলাটে দেখেছে। মাথায় আঘাতের ফলে চোখে সমস্যা হলো নাকি এতক্ষণ পর জ্ঞান ফেরার জন্য ঘোলাটে দেখেছে তা বুঝতে পারছে না মেহরাব।
মিনিটখানেকের মধ্যেই রেদোয়ান আর মাহফুজ কেবিনে প্রবেশ করলো। মেহরাব তাকালো তাদের দিকে। তাদেরও ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না। রেদোয়ানের দৈহিক অবয়ব দেখে আন্দাজ করতে পারছে যে, এই লোকটা তার বাবা হতে পারে। মেহরাব ভাঙা গলায় বলল, “আব্বু।”
রেদোয়ান মেহরাবের মাথার কাছাকাছি টুল টেনে বসে বলল, “এখন কেমন লাগছে ?”
মেহরাব বলল, “খুবই জঘন্য। একদম ভালো নেই।”
রেদোয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “মারাতো আর যাওনি। আল্লাহর শুকরিয়া করতে শিখো। বলো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।”
মেহরাব বলল, “যেখানে আমি ভালো নেই সেখানে আলহামদুলিল্লাহ বলার কী মানে ?”
রেদোয়ান বললেন, “ধরো এক্সিডেন্টে তুমি মারা গেলে। সেই তুলনায় এখন তুমি জীবিত আছো। আল্লাহর করুণায় বেঁচে গিয়েছ। এই রহমতের জন্য কী আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ না ?”
মেহরাব চুপ করে রইলো। তার এখন কথা বলার জন্য কোনো বাক্য নেই। আসলেইতো, সেতো আজকের এই দূর্ঘটনায় মারাও যেতে পারতো। আল্লাহর রহমত ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। ডাক্তার উছিলা মাত্র। তারা কাউকে প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার সামর্থ্য রাখে না। মেহরাবকে চুপ থাকতে দেখে মাহফুজ বলল, “আল্লাহর অশেষ রহমত যে মেহরাবের মারাত্মক কোনো ক্ষতি হয়নি।”
মেহরাব তাকালো সেদিকে, যেদিক হতে কথাগুলো ভেসে এলো। কিন্তু উপস্থিত লোকটা কে তা বুঝতে পারলো না। রেদোয়ানকে প্রশ্ন করলো সে, “আব্বু, উনি কে ?”
এমন প্রশ্ন শুনে মাহফুজ অবাক হলো। তবে রেদোয়ান কিছুটা অবাক হওয়ার সাথে সাথে চিন্তিতও হলো। মেহরাব কি মাহফুজকে চিনতে পারছে না নাকি ? না চেনারতো কোনো কারণ নেই। রেদোয়ান ঝটপট মেহরাবকে প্রশ্ন করলো, “এটা কেমন বেয়াদবি মেহরাব ? তুমি কি তোমার মাহফুজ আঙ্কেলকে চেনো না ?”
মেহরাব বলল, “আব্বু আমি ক্লিয়ার দেখতে পাচ্ছি না। না চেনার কারণে জিজ্ঞেস করেছি।”
রেদোয়ানের চিন্তা বেড়ে কয়েক গুণ হয়ে গেলো। ছেলেটা কী তাহলে দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসলো ? রেদোয়ান বললেন, “কখন থেকে এই অবস্থা ?”
মেহরাব বলল, “এক্সিডেন্ট করার পর থেকে।”
রেদোয়ান পরিষ্কার বুঝতে পারলেন যে, মাথায় আঘাতের ফলেই এই অবস্থা হয়েছে মেহরাবের। রেদোয়ান ছেলের উদ্দেশ্য বললেন, “রাগ কখনো উত্তম কিছু দিতে পারে না। একটা প্রবাদ আছে যে, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। সকালে অমন রাগ করে না বের হয়ে ঠান্ডা মাথায় বসলে হয়তো আজ এমন হতো না।”
মেহরাব কোনো জবাব দিলো না। তার মনে হচ্ছে আসলেই সে এইটা ভুল কাজ করেছে। নিজের মর্জিমাফিক রাগ দেখি না বের হলে হয়তো এই দূর্ঘটনার শিকার হতো না। এখন নিজের অবস্থা করুন। এক প্রকার পঙ্গুর মতো। বেঁচে থেকে অন্যের ভরসায় জীবনযাপন করাটা দূর্বিষহ। এই দূর্বিষহের সীমান্তে মেহরাব পা রেখে ফেলেছে। কপালে দূর্গতি ছাড়া আর কিছু নেই। এমন একজন পুরুষকে এখন আর কে বিয়ে করবে ? যতটুকু বড়াই ছিল নিজেকে নিয়ে, অবশিষ্ট নেই আর কিছু।
রেদোয়ান মাহফুজকে নিয়ে কেবিন হতে বের হয়ে গেলো। ডাক্তারের সাথে কথা বলাটা জরুরি। চোখে ঘোলাটে দেখার বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে হবে। অকালে অন্ধ হবে নাকি ছেলেটা।
রাতের মধ্যেই মেহরাবকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। মেহরাবের অবস্থা দেখে তার মা ও বোন অস্থির হয়ে উঠলো। মাঝেমধ্যে চোখের পানি মুছতেও দেখা গেলো তাদের। মেয়ে জাতিতো, কুসুমের ন্যায় নরম মন। এই নরম মনও আবার পরিস্থিতি ভেদে পাথরের ন্যায় কঠিন হয়ে যায় নিমিষেই। মা-মেয়ে মিলে মেহরাবের যত্নে লেগে পড়লো। কি রেখে কি করবে এসব নিয়েই ছুটাছুটি। সারাটাদিন খাওয়া হয়নি বিকেলে শুধু রুটি-কলা খেয়েছিলো। ক্ষুধা এখন মাত্রাতিরিক্ত, যা মেহরাব বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। সাফিয়াও কম নন, অসুস্থ ছেলের জন্য দেখেশুনে সব ভালো ভালো রান্নাগুলোর করছেন। রাবাব তার মাকে সাহায্য করছে রান্নার কাজে।
রেদোয়ানের সাথে মেহরাবকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে মাহফুজ নিজ বাসায় ফিরে আসেন। রেদোয়ান রাতের খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য অনেকবার অনুরোধ করলেও মাহফুজ চলে আসে। তাকে বলে আসে যে, আগামীকাল পরিবারসহ সে আসবে। আগে পরিবার নিয়ে আসার মানে ছিল শুধু দাওয়াত, আর এখন পরিবার সহ নিয়ে আসা মানে বড় কিছু। সম্পর্ক পরিবর্তনের মতো বড় কিছু। মেহের কেমন রিয়েক্ট করবে তা জানা। তবুও আরেকবার শেষ চেষ্টা। মেহরাব এখন উত্তপ্ত লোহার মতো অবস্থায় আছে। এখন একে আঘাতে সঠিক আকৃতি দিতে না পারলে নয়তো আর সঠিকভাবে গড়া সম্ভব নয়। সব নির্ভর করে এখন মেহেরের উপর। মেয়েটা কি মেহরাবের এমন একটা অবস্থা মেনে নেবে ?
মাহফুজের পরিবার রাতে একসাথে খাবার খেতে বসে। মাহফুজ বেশ চিন্তিত। কি করবে সে বুঝে পাচ্ছে না। মেহেরকে কিভাবে বুঝালে বুঝবে সেটাই ভাবছেন। এটাই শেষবারের মতো প্রস্তাব। এবারের বুঝানোর পর যদি মেহেরের মতামত না বোধক হয় তাহলে মেয়েকে আর জোর দিবেন না বলে ভাবছেন মাহফুজ। মেহের ছাড়া বাসার সবাই ইতোমধ্যে ব্যাপারটা সম্পর্কে অবগত। খাবার খাওয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু মাহফুজ এখনো খাচ্ছেন না। মেহের লক্ষ্য করলো সেদিকে। মেহের আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, “বাবা, খাচ্ছো না যে ? তুমি কি অসুস্থবোধ করছো ?”
মাহফুজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বাবার এমন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখে মেহেরের মনে খচ করে উঠলো। নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে। মেহের আবার জিজ্ঞেস করলো, “বাবা, কি হয়েছে ?”
মাহফুজ বললেন, “আচ্ছা মা, ধরো আমাদের ঘরে একটা লোহা আছে। যেটা বাঁকা। একে সোজা করার প্রয়োজন, কিন্তু কোনোভাবেই পারছো না। একটা সুযোগ পেলে যখন লোহাটা কোনোভাবে উত্তপ্ত অবস্থায় আছে। তখন তুমি কি করবে ?”
মেহের কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর বলল, “বাঁকাটাকে সোজা করার যেহেতু প্রয়োজন সেহেতু লোহার নমনীয় অবস্থায় সোজা করে ফেলবো। কিন্তু এমন প্রশ্নে কী বুঝাতে চাইছো বাবা ?”
মাহফুজ আকুতি ভরা দৃষ্টিতে তার কন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন, “জীবনে যখন যা চেয়েছো তা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি দেওয়ার। যতটা পেরেছি আমার সন্তানদের হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করেছি। বাকীটা আমার রব জানেন যে আমি কতটুকু সার্থক হয়েছি। সবসময় চেয়েছি মানুষের মতো মানুষ হও। তোমার ধারা কারো উপকার না হলেও যেন ক্ষতি না হয়। আহ, সব অগোছালো কথা বলছি। আচ্ছা একটা অনুরোধ রাখবে ?”
মেহের শান্ত কণ্ঠে বলল, “বলো বাবা, নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো।”
মাহফুজ একটু সময় নিয়ে বললেন, “মেহরাবকে বিয়ে করো। তুমি আমার যথেষ্ট বুঝদার কন্যা। আমি অবশ্যই চাইবো তুমি ভালো থাকো। এই বিষয় নিয়ে তোমার মতামতই শেষ মতামত। হ্যা বা না যা বলবে তা-ই হবে। আশা করছি তুমি পারিপার্শ্বিক দিক বিবেচনা করতে সক্ষম। সিদ্ধান্ত ঘুমাতে যাওয়ার আগেই জানাবে। এখন খাবার খেয়ে নাও।”
মেহের মাথা নিচু করে বসে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর খাওয়া শুরু করলো। খেতে খেতে বুঝলো যে লোহার উদাহরণ তাহলে মেহরাবকে বুঝিয়েছে। আয়শা, মাইশা, আসীর কেউই কোনো টু শব্দও করেনি। চুপচাপ নিজেদের খাবার খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। মাইশা মাঝেমধ্যে তাকাচ্ছে সবার দিকে। বুঝার চেষ্টা করছে এই গুমোট পরিস্থিতি। বাবা কেন যে বারবার মেহরাবকে কথা বলছে তা বুঝতে পারছে না মাইশা। বড় আপার কথা অনুযায়ী মেহরাব একজন বদলোক। হাই লেভেলের বাঁদর। সেখানে বাবা কী এমন দেখলো মেহরাবের মাঝে যে বারবার আপুকে ওই লোকটার সাথেই জুড়ে দিতে চাচ্ছে ? সম্পর্কের এই অংকের হিসেব মিলাতে পারছে না মাইশা।
#বক্ষ_পিঞ্জরায় (০৬)
ছয়.
মাহফুজের সামনে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেহের। মাহফুজ বেশ আনন্দিত মেহেরের সিদ্ধান্তে। কোন ভাবনা থেকে বিয়েতে মত দিয়েছে তা বড় বিষয় নয় মাহফুজের কাছে। বড় বিষয় হচ্ছে বিয়েতে রাজি হওয়া। মাহফুজের বিশ্বাস যে মেহরাব ভালো হবে। মেহরাব ও মেহের একসাথে ভালো থাকবে। এখন শুধু সেই ফলাফল চোখে দেখে চোখ জুড়ানোর অপেক্ষা। এরজন্য মেহেরকে একটু খাটতে হবে। তবে মাহফুজ আশাবাদী যে, তার মেয়ে একজন বুদ্ধিমতী। মেহরাবকে ঠিকই সে শিক্ষা দিতে পারবে। হাসপাতালের এমডির সাথে কথা বলে ছুটি নিয়ে নিলো মেহের। ছুটি অতীব জরুরী। আগামীকাল হবে জীবন পালটে যাবার দিন, সম্পর্ক বদলাবার দিন। মেহেরের কাছে এই বিয়ে হলো জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মেহের চলে এলো নিজ কক্ষে। এদিকে মাহফুজের খুশী উপচে পড়ছে। রেদোয়ানকে কল দিয়ে মেহেরের রাজী হওয়ার ব্যাপারে জানিয়ে দিলো।
রেদোয়ান মেহরাবকে বিয়ের কথা জানালে মেহরাব বেশ অবাক হয়। এই মুহুর্তে বিয়ের চিন্তা কল্পনাতেও আসছে না তার। শরীরের এমন অবস্থা নিয়ে বিয়ে কিভাবে সম্ভব ? তাও আবার সেই মেহেরকেই ! এই মেয়েটা রাজী হলো কী করে ? জীবন এক প্রকার জাহান্নামের মতোই হয়ে এসেছে। এই জীবনে সে কেন জড়িত হতে চাচ্ছে ? রেদোয়ান ভালোমন্দ আর কিছু বলল না। শুধু বাবার কথা শুনে গেলো।
_______
প্রতিদিনের মতো ভোর এলো। রাঙিয়ে দিলো আঁধারে ঢাকা আন্তরীক্ষকে। গগণ জুড়ে সূর্যকিরণের হাসি ফুটলেও হাসি ফুটেনি মেহেরের ঠোঁটে। কপাল জুড়ে চিন্তার ভাঁজ। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা। বুকের ধুকপুকানি কমার বদলে বেড়েই যাচ্ছে। নামাজ শেষে জায়নামাজেই বসে রইলো। পরিবারের বাকীরা মেহরাবদের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর মেহেরের দরজায় টোকা পড়লো। মেহের ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে জায়নামাজটা বিছানার কিনারায় রেখে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। খুলে দেখো মা আয়শা দরজায় সাঁড়ানো। হাতে একটা শপিং ব্যাগ। আয়শা ব্যাগটা মেহেরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “মা’ রে, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমরা বের হবো। মাইশাকে কী পাঠাবো তোকে হেল্প করতে ?”
মেহের মাথা ডানে-বামে ঝাঁকিয়ে বলল, “না মা, ওকে পাঠানোর প্রয়োজন নেই। তারও তৈরি হওয়া বাকী। আমি একাই পারবো।”
আয়শা এক কদম এগিয়ে মেহেরের কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। মুখে হাসি থাকলেও সেটা যেন মেকি হাসি। মনের গভীর হতে এ হাসি আসেনি। স্বভাবতই তিনি তার মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত। প্রথম দিকে এত চিন্তা ছিল না। মাহফুজের থেকে তিনিই বেশি চাইতেন মেহরাবের সাথে মেহেরের বিয়ে হোক। কিন্তু মেহরাবের এমন একটা দূর্ঘটনার পর নিজের মেয়েকে আর ওই ছেলের হাতে তুলে দিতে চাইছেন না। এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রী তর্কাতর্কিও করেছেন। তাতে কোনো লাভ হয়নি। এখন হাসি মুখে মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই।
মেহের ব্যাগ খুলে দেখলো তাতে শাড়ি, প্রয়োজনীয় জুয়েলারি ও কসমেটিকস রাখা আছে। নিজের বিয়ের জন্য নিজের হাতেই সাজতে হবে এমন ভাবেনি মেহের। ভাগ্যে নিজের হাতেই সাজগোছ লেখা আছে, অন্য কাউকে পাওয়া তাই সম্ভব নয়। মেহের ধীর হাতে সব বের করে বউ সাজসজ্জার প্রস্তুতি নিলো। সাধারণভাবে সেজে নিলো। বেনারসি শাড়ির উপর পড়ে নিলো বোরকা। নিকাবটা বাঁধতেও ভুলল না। হাত-পায়ে মোজাও পড়ে নিলো। একদম আড়াল করে নিলো নিজেকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো করে দেখে বিরবির করে বলল, “হে আমার রব, আমার উপর রহম করুন। আজ থেকে এই আড়াল যেন চিরস্থায়ী হয়। আমি যেন সব ঠিকঠাক করতে পারি।”
দরজায় টোকা পড়লো। মেহের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। দরজা খুলে দেখলো মাইশা দাঁড়ানো। বেশ ভালোই সেজেছে সে। মেহেরকে দেখে মাইশা অবাক হয়ে বলে, “আপু সবসময় বোরকা বা গাউন টাইপের ড্রেস পড়ো ঠিক আছে। কিন্তু আজকেতো তোমার বিয়ে। আজকে অন্যদিনের তুলনায় আরো বেশি নিজেকে আড়াল করেছো কেন ?”
মেহের বলল, “বিয়ে বলে কী পর্দা করা নিষেধ ? ওরা এখনো আমার কেউ হোন না। একমাত্র বিয়ের কবুল পড়ার পড়েই আত্মীয় হবেন। তখন আমি কিছুটা অনাবৃত হতে পারি। কিন্তু তুমি এত সেজেছো কেন ? তোমার বোরকা কোথায় ?”
মাইশা কিছুটা বিরক্তি আর হতাশার মিশেল কণ্ঠে বলল, “আপু, তোমার বিয়েতে একটু সাজগোছ করবো না ? এই সাজের উপর বোরকা পড়লে সেজে কী লাভ ? কেউতো দেখবে না।”
মেহের বলল, “অন্যকে দেখানোর জন্য সেজে থাকলে আমার বোন বলে পরিচয় দিও না। আমার ত্রিসীমায় যেন তোমাকে না দেখি। তোমাকে এই নিয়ে অনেকবার বুঝিয়েছি। যথেষ্ট বড়ো হয়েছে এখন। সবসময় বাহিরে বোরকা পড়ে বের হও। আমার বিয়ে আমার বিষয়, তাতে নিজেকে কেন প্রদর্শন করবে ?”
মাইশা হতাশ হলো। অন্তত নিজের বোনের বিয়েতে একটু সাজগোছ করে আনন্দ করবে তা আর হলো না। নিজের ঘরে চলে গেলো বোরকা পরিধান করতে। বড়ো বোনের জীবনের এমন একটা অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে যেখানে নিজে উপস্থিত না থাকলে সারাজীবন আফসোস হবে। এদিকে মেহের নিজেই হাজির হলো পরিবারের সবার সাথে। মেহেরকে নিয়ে সবাই গাড়িতে উঠে বসলো। মিনিটখানেক পরেই মাইশা হাজির হলো বোরকা-নিকাব পড়ে। নিকাবের আড়ালে হাসলো মেহের। মাইশা মেহেরের পাশে এসে বসলে মেহের মাইশার হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “গুড গার্ল। নিজেকে কখনো খোলা মিষ্টান্নের মতো প্রদর্শন করবে না। এতে পোকার আক্রমণ হতে পারে। নিজেকে সবসময় প্যাকেটজাত করে রাখবে। সাজগোছ করতে ইচ্ছা হলে ঘরে করবে, এতে সমস্যা নেই।”
মাইশা আরেক হাতে মেহেরের হাত চেপে ধরে বলল, “মনে থাকবে আপু। আজকের ভুলের জন্য মাফ চাইছি। প্লিজ রাগ করো না।”
মেহের হাসলো। মাইশা সেটা ঠিকই বুঝতে পারলো মেহেরের হাসি। দু’বোন হাত জড়াজড়ি করে বসে রইলো। গাড়ি চলল গন্তব্যে। ঘন্টাখানেক পর পৌঁছে গেলো মেহরাবদের বাড়ির সামনে। ওদের আসার অপেক্ষাতেই ছিল রেদোয়ান। গাড়ী থেকে ধান-দূর্বা ইত্যাদি দিয়ে বরণ করে নিলো। ইসলামের বরণ করে নেয়ার এই নিয়ম আছে কী না তা মেহের জানে না। তাই এই নিয়ে কিছু বলল না। রেদোয়ান মাহফুজ আর আসীরকে নিয়ে মেহরাবের ঘরে গেলো। এখানে কাজীও উপস্থিত ছিলেন। এদিকে সাফিয়া আর রাবাব মিলে মেহের, আয়শা ও মায়শাকে নিয়ে ওদের রুমে গেলো। মেহেরের হাত পা কাঁপছে। আজকে প্রথম এলো এই বাড়িতে। এখানে হবে আজ থেকে স্থানী নিবাস। রাবাব বারবার মেহেরের দিকে তাকাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে, এই বিয়ের দিনেও কে এমন পর্দা করে ?
সাফিয়া মেহের ও মেহেরের মা-বোনকে বলল, “এ ঘরেতো আর পুরুষ নেই। অন্তত ঘোমটা খুলে বসো।”
আয়শা ও মাইশা ঘোমটা খুলে বসলো। তারপর মেহের নিকাব খুললো। মেহেরকে সাফিয়া বা রাবাব আগে একবারও দেখেনি। এই প্রথম দেখে ওদের মুখ থেকে বের হয়ে এলো, “মাশাল্লাহ !”
চলবে…