অপেক্ষিত প্রহর পর্ব-০৩

0
439

#অপেক্ষিত_প্রহর
#আফসানা_মিমি
|৩য় পর্ব|

– তুকি কি ভেবেছিলে, আমাকে কষ্ট দিবে আর আমি তা মনে গেঁথে দুর্বল হয়ে যাবো? কখনও না ইফু! দশ দশটা বছর তোমার অপেক্ষার প্রহর গুনছি। আর না! আজ যখন তোমার সবকিছু মিথ্যা ছিলো, তাহলে ঠিক আছে। আমি তোমার জন্য এভাবে প্রতিটা প্রভাতে অপেক্ষার প্রহন গুনবো। তুমি একদিন হলেও তো আসবে আমার কাছে সেই প্রহরের অপেক্ষায় রইবো।

উদ্রেকময় এক রজনী পাড় করে আলোকিত প্রভাতের আগমন ঘটেছে আজ। সূর্য উদিত হবার পর থেকে এখানে অপেক্ষা করছি প্রিয় মানুষটার জন্য। কিছুক্ষণ পর পর হাতের কদম ফুলের দিকে দৃষ্টিপাত করছি আর হাসছি। আজই আমার অপেক্ষার অবসান ঘটবে। সেকেন্ড পেরিয়ে মিনিট, মিনিট পেরিয়ে ঘন্টা প্রিয় মানুষটির আসার কোন লক্ষণ দেখছি না। হাতের কদমফুলও ততক্ষণে নষ্ট হয়ে গিয়েছে হাতের ঘষাঘষিতে। মনটা আবারো বিষিয়ে উঠেল। মনে মনে পন করলাম, প্রতিদিন আসবো এখানে। প্রতিদিন অপেক্ষা করব তোমার জন্য প্রিয়।

———

কলেজে পা দিবো আজ আমি। আগের মত চটপটে হতে হবে আমাকে। যেন কোন দুঃখ কষ্ট ছুঁয়ে দিতে না পারে আমাকে।

– কিরে আহিবা, এতদিনে আসার সময় হলো তোর? তুই জানিস কলেজে কত কান্ড হয়ে গিয়েছে!

কলেজে ঢুকতেই হেনা কোথা থেকে দৌঁড়ে এসে বকবক করতে শুরু করল। হেনার কথায় অতিষ্ঠ হয়ে দিলাম এক ধমক,

– এই চিকার ছানা, দম নে এবার। এত বকবক করছিস কেন? আমি কে হই তোর?

আমার কথা শুনে হেনা অপরাধীর ন্যায় বলল,

– ও আমার আহুবেবী, রাগ করিস না। তুই তো জানিস-ই রাজের সাথে আমার ইয়ে চলছে। এই রাজটা না! আমাকে কোথাও যেতে দেয় না। সবসময় কড়া শাষণের উপর রাখে। আর রইলো ফোনের কথা, সেটা তোকে হাজারবার করেছি। কিন্তু ফোন বন্ধ ছিলো তোর। আর এমন হবে না আহুবেবী। রাগ করিস না।

– হেনার বাচ্চা হেনা। তুই ঐ রাজের বাচ্চার জন্য আমার খবর নেস নি তাই না! তোকে মানা করেছিলাম না ঐ রাজের সাথে মিশবি না! দাঁড়া আজ তোর একদিন তো আমার একদিন।

রাজ ছেলেটা হেনার জন্য একটু ও ভালো না। রাজ একটু বেপরোয়া স্বভাবের। আমাকে সহ্য করতে পারে না উচিত কথা বলি যে আমি তাই। এজন্য আমার প্রাণের প্রিয় বান্ধবীকে নিষেধ করে আমার সাথে মিশতে। কিন্তু হেনা তো হেনাই আমাকে ছাড়া অচল।

হেনাকে পুরো কলেজ দৌঁড়াচ্ছি আমি। আমার বিপদের সময় এই মেয়ে কোন না কোন কান্ড করে বসে। আজ এই মেয়ের নিস্তার নেই।

– হেনার বাচ্চা হেনা, এখন যদি তুই না থামিস তাহলে তোর শরীরে বিলাই চিমটি লাগিয়ে দিবো। সারারাত পুকুরে চুবিয়ে রাখবো। থাম বলছি।

আমার একটা কথাও হেনার কর্নকুহরে প্রবেশ করেছে কি না সন্দেহ। হেনা নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দৌঁড়াচ্ছে। হেনা দৌঁড়ে কলেজের পিছনে দিকটায় চলে গেল সাথে আমিও। হেনার সাথে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হাপিয়ে গিয়েছি। কলেজের এই দিকে সচরাচর কেউ আসে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবারও হেনাকে ধরতে যাবো এমনিই কারোর সাথে ধাক্কা লাগে।

– এই ধাক্কা-ধাক্কিই আমার জীবন নরক বানিয়ে ফেলেছে। আজ আমি ধাক্কা দেয়া মানুষটিকে মেরে ফেলবো একদম মেরে ফেলবো।

জামার নিচের অংশ ঝাড়তে ঝাড়তে বকে যাচ্ছিলাম ধাক্কা দেয়ার মানুষটিকে।
– সেদিন তো খুব করে বলেছিলে আমি নাকি ইচ্ছে করে তোমাকে ধাক্কা দিয়েছি, তোমার জীবন নরক বানিয়ে ফেলেছি। যা হয়েছে তোমার আমার সাথে সব নিজের ইচ্ছায় করেছি। আজকে কি বলবে মিস ধাক্কাওয়ালি?

নিচের দিকে তাকিয়ে-ই বুঝতে পারলাম আমার চির শত্রু উরফে আমার আমার শিল্পী বর ফারদিন ইফাজ কথা বলছে। মুহূর্তেই ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল আমার। কলেজের পিছনের দিকটা কেউ থাকে না এখানে। আর সেদিনের করা কাণ্ডের জন্য যদি এ লোকটা আমার থেকে প্রতিশোধ নেয়। এমনিতেই শুনেছি শহরের শিল্পীরা নাকি অনেক খারাপ হয়। এই শিল্পীও যদি খারাপ হয়! আমাকে একা পেয়ে যদি কিছু করে ফেলে! শুকনো ঢুক গিলে গলা ভিজিয়ে পিটপিট চোখ করে পেছনে তাকালাম। আমার কথিত বর থুক্কু শিল্পী সাহেব দুইহাত বুকে গুঁজে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার পানে।

ইফাজের চাহনি দেখে এখন বলতে ইচ্ছে করছে,

– ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি,
তুমি আলু ভর্তা! আমি আলু ভাজি।

কিন্তু তা আর বললাম না। এখন সিরিয়াস সময়। এ সময় হচ্ছে ঝগড়া করার সময়। এখন যদি এভাবে উল্টা পাল্টা কিছু বলি তাহলে আমারই ক্ষতি হবে। এখন যা বলতে হবে বুদ্ধি খাটিয়ে বলতে হবে।

– তো মিস ধাক্কাওয়ালী, বদমেজাজি,বিবাহিত নারী, উত্তর নেই মুখে তাইতো!
একটা কথা কি, আমিও কিন্তু এখন তোমার উপর মিথ্যা অপবাদ দিতে পারি। আমিও বলতে পারি যে, তুমি সেদিন ইচ্ছে করে এমন কাণ্ড করেছ যেন আমার মত রকস্টারকে বিয়ে করতে পারো। কি এই কথা বলতে পারি?

শিল্পী সাহেবের কথা শুনে লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেললাম। আসলেই, সেদিন আমার এভাবে বলা ঠিক হয়নি। যা হয়েছিল তা আমাদের পরিস্থিতির চাপে পড়ে হয়েছিল। আমার চুপ হয়ে থাকা দেখে শিল্পী সাহেব হেসে বললেন,
– যে এই কাজ করেছে তাকে ধরা উচিত তোমার। কেন করেছে তার জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত। আর পেলো তো পেলো তোমার সাথে আমাকে কেন জড়িয়ে নিলো তা জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত।

শিল্পী সাহেবের কথা শুনে চিন্তা করতে লাগলাম যে, আসলেই তো ফরিদা খালা কেন এমন করলেন আমার সাথে? ফরিদা খালাকে তো আজ কোথাও দেখতে পেলাম না। তবে কি খালা ইচ্ছে করে এমন কিছু করেছে?
ইফাজ মুচকি হেসে এক কদম আমার সামনে এগিয়ে আসলো। ইফাজের আগানো দেখে আমি আরও এক কদম পিছিয়ে গেলাম। বলা তো যায় না একা মেয়ে মানুষ আমি, কখন যে কি করে বসে এই লোকটা আমার সাথে! আমার পিছিয়ে দেওয়া দেখে দেখলাম ইফাজ ভ্রু কুঁচকাল।আমার অবস্থান দেখে ইফাজ আরও এক কদম আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। এবার আর সহ্য হচ্ছে না ইফাজের কাণ্ডকারখানা। ঝাঁঝ মাখা কন্ঠস্বরে ইফাজের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলাম,
_আর এক কদম সামনে আগাবেন না শিল্পী সাহেব। ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। কি পেয়েছেন কি আপনি! আমাকে কথার জালে ফাঁসিয়ে বশ করে ফেলবেন? কখনোই না। এই আহিবা কখনো আপনার ফাঁদে পা দেবে না। এখন বলুন আপনি এখানে কি করছেন? এখন শহরে যান নি কেন? আপনার না এতদিন শহরে চলে যাওয়ার কথা ছিল? আর তাড়াতাড়ি শহরের যান, আমাদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করেন। আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।
ডিভোর্সের কথা শুনে ইফাজ দাঁড়িয়ে গেল। কিছু একটা ভেবে আমার উদ্দেশ্যে বলল,

_ডিভোর্স তো তুমি পাবে কিন্তু এখন না। যা করেছো আমার সাথে তার ডবলের ডবল শাস্তি পেয়ে তার পর ডিভোর্স পাবে।
ইফাজের কথা শুনে ভ্রু কুচকালাম। সন্দেহের বহির্ভুত হয়ে জিজ্ঞেস করালাম,

_ কিসের শাস্তি দিবেন? আমি কোন অপরাধ করিনি যার জন্য আপনি শাস্তি দিবেন। আর শুনে রাখুন আমি আপনাকে ভয় পাই না। যতই আপনি গণ্যমান্য শিল্পী হোন না কেন।

_ কে কাকে ভয় পাবে আর কাকে আদর করবে তা একটু পরে-ই দেখা যাবে ম্যাডাম! এখন ক্লাসে যান।

ইফাজ আর এক মিনিটও দাঁড়ালো না। হাঁটা শুরু করল সামনের দিকে। এর মাঝে কোথা থেকে যেন হেনা দৌঁড়ে এসে আমার কাঁধে হাতের ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
_ কিরে আহিবা, কি বলে গেল শিল্পীটা? আহা ফারদিন ইফাজ তোর সাথে কথা বলেছে। কি সৌভাগ্যবতী তুই। আমার তো বিশ্বাস-ই হচ্ছে না ফারদিন ইফাজ তোর সাথে কথা বলেছেন তাও এতক্ষণ দাঁড়িয়ে। আমিতো দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সেই জঙ্গলের ভিতরে চলে গিয়েছিলাম। তারপর এক গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম। যেই না দূর থেকে তোকে দেখলাম ফারদিন ইফাজের সাথে কথা বলছিস অমনি দৌঁড়ে আবার চলে এসেছি। তা কি কথা হয়েছে তোদের?

হেনার কথা শুনে রাগান্বিত চোখ হেনার পানে তাকালাম। হেনা বুঝতে পারলো আমার রাগ এখনো কমেনি। তাই বোকার মত কিছুটা হেসে আবারও দৌঁড় দিল কলেজের ভিতরে।

প্রিন্সিপাল স্যারের অফিস কক্ষে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর শিল্পী সাহেব। বদ শিল্পীটা আমার পানে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। আর আমি অসহায় চোখে তাকিয়ে আছি প্রিন্সিপাল স্যারের পানে। প্রিন্সিপাল স্যার খানিকটা কেশে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,

– আমি খুবই দুঃখিত মা! আমার একটি করা ভুলের জন্য তোমার জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আসলে সেদিন ফরিদা খালা তোমার আর ইফাজের কথা এমন ভাবে আমার সামনে পেশ করেছিলেন যে আমার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়ে গিয়েছিল। আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে তোমার মত মেয়ে এমন কোন কাজ করতে পারে না। আজ ফরিদা খালার অনুপুস্থিতিতে সব আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। আর ইফাজ আজ সকালে আমাকে বোঝালো যে আসলে সেদিন যা করেছিলাম ভুল করেছিলাম।

প্রিন্সিপাল স্যারের কথা শুনে তপ্তশ্বাস ফেললাম। আমার সাথে যা হয়েছে না এখন আর তা খন্ডানো যাবে আর না সেটা ঠিক করা যাবে।

প্রিন্সিপাল স্যারের কক্ষ থেকে বের হয়ে আনমনে করিডোরে হাঁটছি। আমার ভবিষ্যত কি হবে তা চিন্তা করছি। আদৌও কি শিল্পী সাহেব আমাকে ডিভোর্স দিবে? নাকি আমার বাবা মাকে অবগত করবে আমাদের বিয়ের কথা!

– আমার কথা ভাবা হচ্ছে বুঝি বউ?

কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কথাটা বলল বদ শিল্পীটা। ইফাজকে আমার এতটা কাছে কাছে আসতে দেখে ছিটকে দূরে সরে গেলাম। রাগান্বিত স্বরে বললাম,

আমার কাছ থেকে একশত হাত দূরে থাকবেন। নয়তো একদম মেরে ফেলবো আপনাকে। আমি গ্রামের মেয়ে মেয়ে বলে ভাববেন না দুর্বল। আমার সাথে পাঙ্গা নিলে আপনার চৌদ্দ গুষ্টিকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুড়াবো আমি।

কথাগুলো বলে শিল্পীটার সামনে আর এক মিনিটও দাঁড়ালাম না। এক দৌঁড়ে চলে আসলাম নিজের ক্লাস রুমে। বিয়ে করেছে বলে যখন তখন আমাকে কথা শোনাবে এটা আমি মানবো না। আমি তো ডিভোর্স নিয়ে ছাড়বো এর কাছ থেকে যে ভাবেই হোক।

এদিকে আহিবা চলে যেতেই ইফাজ বুকে হাত দিয়ে মুচকি হেসে বলতে লাগল,

– আহ আমার হিবারাণী তো ঠিক আগের মতই রয়ে গিয়েছো। আমার ছিদকাঁদুনে হিবারাণী। শুধু একটা জিনিসের পরিবর্তন হয়েছে তোমার মধ্যে। আগের থেকে অনেকটা শক্ত হয়ে গিয়েছো তুমি। হয়তো আমার অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে তুমি এতটা শক্ত হয়ে গিয়েছো যার জন্য তোমার ইফু এত কাছে থাকা সত্বেও চিনতে পারছো না! কিন্তু তুমি চিন্তা করিও না, দুনিয়ার যত জ্বালানো, পুরানো আছে সব আমি জ্বালাবো পুরাবো তোমাকে। অন্য কেউ তোমাকে ফুলের টোকা পর্যন্ত দিতে পারবে না। আর এখন তো বৈধ টিকিট পেয়েই গেলাম সুতরাং চব্বিশ ঘন্টা তোমার আশপাশে কিভাবে থাকবো সে ব্যবস্থা করব আমি।
আর কয়েকঘন্টার অপেক্ষা। তারপর তোমার কাছে থাকবো আমি। এতটা কাছে থাকবো যেন আমার অন্তরের গভীরতা তুমি অনুভব করতে পারো।

“তোমারে দেখিয়া এই হৃদয় প্রেমের স্রোত যাচ্ছে বহিয়া!
ডুবে যাচ্ছি যে আমি তোমার প্রেমের অতলে।
পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি তোমার নেশায় বুঁদ হয়ে।
হে প্রিয়তমা! অপেক্ষার অবসান শেষ হবে কবে! জড়িয়ে নিবো তোমায় আদরে নিরবে।

চলবে……