অপেক্ষিত প্রহর পর্ব-০৫

0
371

#অপেক্ষিত_প্রহর
#আফসানা_মিমি
|৫ম পর্ব |

ভোর ছয়টা বাজে চল্লিশ মিনিট। নির্ঘুম আরো একটি রাত পেরিয়ে নতুন ভোরের আগমন ঘটেছে আমার জীবনে। কাঠের সদর দরজা খুলে চুপি চুপি বের হয়ে আসলাম বাড়ি থেকে। সারারাত হাজারো চিন্তায় এবর জ্বালানোতে আমার আঁখিদ্বয়ে ঘুম আসেনি। তাই সিগ্ধ সকালে নিজেকে স্নিগ্ধতার চাদরে মুড়িয়ে নিতে চাচ্ছি। আমিদের বাড়ির দালান থেকে কিছুটা দূরেই মেইন গেইট। ঐ যে গোপাল ভাঁড়ের বাড়িতে যেমন মাটির দালান দিয়ে মাঝখানে কাঠের দরজা লাগানো ঠিক তেমনটা আমাদের বাড়ির মেইন গেইট।

মাথায় লম্বা করে ঘোমটা টেনে গেইট পাড় করলাম। আসার আগে দু’তলার দিকে তাকাতে ভুলিনি। বলা নেই, যদি বদ শিল্পীটা কোনভাবে দেখে ফেলে! পর্দা টাঙানো দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। বদ শিল্পীটা সারারাত দো’তারা বাজিয়েছে আমাকে জ্বালাতন করার জন্য। এখন হয়তো ঘুমোচ্ছে তাই আমি এখন স্বাধীন।
গ্রামের এঁকে বেঁকে রাস্তায় হাঁটছি। সকালের সতেজ হাওয়া গায়ে লাগা মাত্রই মন ফুরফুরে হয়ে গিয়েছে। নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পা বিছিয়ে বসে পড়লাম। আঁখিদ্বয় বন্ধ করে ইফুর কথা ভাবতে শুরু করলাম,

– এই ইফু, তুমি এত জোড়ে হাঁটো কেন? আমিতো ছোট তুমি জানো না? তোমার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে পারি না। রীতিমত দৌঁড়াতে হয় আমার। এই ইফু, তুমি জানো না! ছোটদের কষ্ট দেওয়া পাপ!

– খুব পাকা পাকা কথা বলতে শিখেছো তুমি তাই না হিবারাণী! তুমি যেমন ছোট আমিও তো তেমন ছোট। পাপের কথা বলছো তুমি! আমি বড়ো থাকলে তোমাকে কাঁধে করে নিয়ে ঘুরতাম। কিন্তু আমিতো এখন তোমাকে কোলে নিয়ে ঘুরতে পারব না, কোলেও তুলতে পারব না আলমগীরের মত। ঐ যে সাবানা আলমগীরের ছবি আছে না! সেখানে আমি দেখেছি আলমগীর শাবানাকে কোলে করে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু আমি তো এখন ছোট তোমাকে কোলে নিতে গেলে আমি পড়ে যাবো ঠাস করে। বড়ো হই, জমিনেই পা ফেলতে দিবো না তোমার।

– আচ্ছা থাক কোলে নিতে হবে না। তুমি আস্তে আস্তে হাঁটো আমি তোমার পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটবো।

– ঠিক আছে আসো আমার সাথে।

ইফুর সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে সেদিন খুবই খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু এক জায়গায় এসে আমার খুশিতে বাঁধা আসলো। খালি পায়ে বড়ই কাঁটা বিঁধে নিচে বসে পড়েছিলাম সেদিন। আমি চিৎকার করে কাঁদছিলাম আর মাকে ডেকে যাচ্ছিলাম। আমার কান্না দেখে সেদিন ইফুও কান্না করে দিয়েছিল।

– আরে হিবারাণী, থামো এবার। তোমার কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না। এই যে আমি এখনই কাঁটা বের করে দিচ্ছি। তুমি কান্না করো না। দাঁড়াও দাঁড়াও চোখ বন্ধ করো তো তোমার?

– কেন চোখ বন্ধ করবো ইফু? তুমি দেখছো না, আমি কান্না করছি! চোখ বন্ধ করলে কান্না করব কীভাবে?

– ওরে আমার পাকারানী, চোখ খোলা রাখলে আমি যদি কাঁটা বের করতে যাই তা দেখে তুমি ভয় পাবে। বরঞ্চ তুমি চোখ বন্ধ করো তাহলে তুমি ভয় পাবে না।

– না চোখ বন্ধ করলে তুমি অনেক ব্যাথা দিবে আমি চোখ বন্ধ করব না।

– হিবারাণী, একটা কাজ করো তুমি। তোমার দুই হাত দিয়ে আমার মাথার চুলগুলো টেনে ধরো তো! তাহলে তুমি বুঝতে পারবে না কখন তোমার পায়ের কাঁটা আমি সরিয়ে ফেলেছি।

সেদিন আমি তাই করেছিলাম। ইফুর মাথার চুল শক্ত করে টেনে ধরে ছিলাম, যার ফলে বুঝতেই পারিনি যে আমার পায়ের কাঁটা সেদিন কিভাবে টেনে বের করে ফেলেছিল।

ছোট বেলার কথা গুলো মনে করে একাই হাসছি আমি। আমি সেই ছোটবেলা থেকেই কতটা ছিঁচকাঁদুনে ছিলাম। ইফু আমাকে সব সময় চোখে চোখে রাখতো। আমার সেই ইফু আমার কাছে এসেও আমার কাছে ধরা দিল না । খুব অভিমান হয়েছে তোমার উপর ইফু! আর কখনো তোমার সাথে কথা বলব না।

আমার ভাবনার মাঝেই কেউ এসে আমার মাথায় টোকা মারলো।

– কি ব্যাপার মিসেস ইফাজ! এত সকালে এখানে কার সাথে দেখা করতে এসেছো শুনি? কেউ আছে নাকি! কার জন্য অপেক্ষা করছো? বলো বলো!

সুখের দিন শেষে দুঃখের দিন শুরু!
এবার তোর কি হবে রে আহিবা,
ইফাজের দিন শুরু।

ইফাজের সারা শরীর ঘামে ভিজে রয়েছে। ললাটের ভাজে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। ইফাজ আমাকে কথাগুলো বলে হাতে থাকা পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি পান করে নিলো। কেন যেন এই বদ শিল্পীটাকে আমার বিন্দুমাত্র সহ্য হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে কোন এক পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে।
– আমাকে মারার চিন্তা বাদ দিয়ে এখন বলো, এত সকালে এখানে কি করছো?
– আপনার কলিজা কীভাবে আপনার শরীর থেকে আলাদা করবো তা ভাবছি।

আমার কথা শুনে ইফাজ ভীষম খেল। কয়েকবার কেশে আবারও আমার উদ্দেশ্যে বলল,
– বড্ড বেয়াদপ তো তুমি মেয়ে! গুরুজনদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানা নেই তোমার? তোমার বাবার কাছে আবার বিচার দিতে হবে দেখছি।

পৃথিবীতে যদি কাউকে ভয় পাই তিনি হলেন আমার বাবা। মায়ের সাথে যা ইচ্ছে তা করতে পারি ছোট বেলা থেকেই। ছোটবেলা থেকে এই পর্যন্ত যতবারই বাড়াবাড়ি করতে গিয়েছি ততবারই মা আমাকে বাবার ভয় দেখিয়ে আটকে দিতো। এখন এসেছে অরো একজন। কীভাবে যেন এই বদ শিল্পীটা আমার দুর্বলতা জেনে গিয়েছে। ইফাজের কথার প্রত্যুওরে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

– তাহলে কীভাবে কথা বলবো শিল্পী সাহেব! গানে গানে?
– ইয়েস! গুড আইডিয়া। গানে গানে কথা হবে আমাদের চেন্নাই এক্সপ্রেস সিনেমার মত।

– অসম্ভব! এমন আজগুবি গানে আমি কথা বলবো না। আপনি থাকেন। আমার স্নিগ্ধ সকালের ঘোরাফেরা মাটি হলো আপনার জন্য। অসভ্য বদ শিল্পী কোথাকার।

আমার কথা শুনে বদ শিল্পীটা বাঁকা হাসলো। নিজের হাত দ্বারা মাথার চুলগুলো পিছনে নিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বলল

– তুমি কি চাচ্ছো! তোমার বাবাকে রাগাতে? তুমি কি চাচ্ছো! আমি বলে দেই যে, আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে তাও আবার কলেজে? তোমার বাবাকে অবশ্য শ্বশুর বাবা বলে সম্মোধন করাতে আমি এক পায়ে রাজি আছি, কোন সমস্যা নেই আমার তরফ থেকে। কিন্তু আমি চিন্তা করছি তোমার কথা! তোমার কি হবে? শ্বশুর বাবা কি আদৌ তোমাকে উনার বাড়িতে জায়গা দিবে? ভেবে দেখো মিস ধাক্কাওয়ালী, আমার কথা মত চলবে নাকি নিজের মন মত কাজ করবে!

– আপনি কি চান আমি সবকিছু ছেড়ে দেবদাসীনি হয়ে যাই?

– তা হতে যাবে কেন? আমি আছি না! তুমি আর আমি মিলে মিশে দেবদাস এবং দেবদাসীনি হয়ে যাবো চিন্তা করো না আপাতত আমাকে একটা গান গেয়ে শোনাও। খুব সুন্দর মিষ্টি গান শুনাবে। যেই গান শুনলে আমি মুগ্ধ হয়ে যাবো এবং সারাদিনে আমার কানে গুনগুন করে বাজতে থাকবে তোমার কণ্ঠস্বরে সেই গানটি।

বদ শিল্পীটার কথা শুনে মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি আসলো। শক্তভাবে শিল্পীর উদ্দেশ্যে বললাম,

– ঠিক আছে, ঠিক আছে আমি গান গাইবো। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে!

– কি এমন শর্ত আছে আপনার, শুনি?

– আমি গান গাইলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুরেফিরে গান গাইবো। আয আপনি, এখানে বসে বসে আমার গান শুনবেন।

আমার কথা শুনে এই ইফাজ হু হা করে হেসে বলল,

– ব্যাস এতটুকুই কাজ! আগে বলবে না! এই যে এখনি আমি বসছি। তুমিও ভদ্র মেয়ের মত গান গেয়ে শোনাও তো দেখি!

ইফাজের কথায় বাঁকা হেসে গান গাইতে শুরু করলাম,

” ও সকিনা গেছস কিনা ভুইলা শিল্পীরে,
এখন শিল্পী ঘুরে বেড়ায় গ্রামে-গঞ্জে।
আরে ও টুনি কলেজে যাইবো,
টুনি বাড়িতে থাকবো!
দিনের রাইতে চব্বিশ ঘন্টা শিল্পীরে জ্বালাইবো।
ও শিল্পী ও শিল্পীরে তুই কথা শুনিস না!
চব্বিশ ঘন্টা আমায় জ্বালাস,
কাম পাস না।

গলা ফাটিয়ে চিল্লিয়ে গান গাইলাম। আমার গান শুনে শিল্পী সাহেব হা করে তাকিয়ে আছে আমার পানে। হয়তো আশ্চর্যিত হয়ে আছে আমার গান শুনে। শিল্পী সাহেবের অবস্থা দেখে আমাকে আর পায় কে! শিল্পীকে সেখানে রেখে আমি দিলাম ভোঁ দৌড়। আজ বদ শিল্পীটাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে এসেছি। আজ আর আমার পিছু লাগবে না আশা করি। আজ সারাদিনই আমার এই গান শিল্পীর মাথায় চলতে থাকবে রেডিওর মত।

বাড়িতে এসে ঝটপট গোসল সেরে মাকে বলে তাড়াহুড়া করে খাবার খেতে বসলাম। আমি জানি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বেটা বদ শিল্পী বাসায় চলে আসবে। আর এসেই আমি যা করে এসেছি তার জন্য শায়েস্তা করতে চাইবে। কিন্তু আজ আমি তা হতে দেব না। নাকে মুখে খাবার খেয়ে দুটি বই হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। গন্তব্য কলেজ।

—————
কলেজে এসেই আমার জানের জান হেনাকে খুঁজতে শুরু করলাম। ঐতো হেনা গাছের ঐখানে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয়ই রাজের সাথে প্রেম করছে! আজ এই দুইটাকে আমি মেরে ফেলবো। দুইটার একটাও আমার কথা শুনে না।

– এই রাজ তোকে একদিন মানা করেছিলাম না! আমার বান্ধবীর থেকে দশ হাত দূরে থাকতে! আবারো তুই এখানে এসেছিস?

– ও মেরে জান, মেরে আহিবা। তোর বান্ধবী এত কিউট! কাছে না এসে পারিনা। তোর বান্ধবী ও তো আমাকে বলতে পাগল। আমার জন্য যদি বলি মরুভূমিতে চলে যাও সেখানিও চলে যেতে পারবে।

– ভালো হয়ে যা রাজ! হেনা কিন্তু তোকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে। এমন মেয়ে কখনো পাবি না কোথাও। তোর বেপরোয়ার জন্যই হয়তো উপরওয়ালা তোকে ভালো হওয়ার জন্য হেনাকে পাঠিয়েছেন তোর জীবনে। আমি জানি, তুইও হেনাকে খুব ভালোবাসিস। কিন্তু তোর এই বাজে কথাগুলো বন্ধ করবি নয়তো আমার বান্ধবীকে তোর কাছ থেকে মাইলের পর মাইল দূরে নিয়ে চলে যাবো। বদ কোথাকার!

– আরে বান্ধবী রাগ করিস কেন? মানছি আমি একটু বেপরোয়া কিন্তু তোর বন্ধুর প্রেমিক তো! দুলাভাই হয়ে কি তোর সাথে দুষ্টুমি করতে পারবো না? আমি তো তোর সাথে দুষ্টুমি করছিলাম। আমি তোর বান্ধবীকে খুবই ভালোবাসি। আর আগে যা ছিলাম তার জন্য আমি সত্যিই অনুতপ্ত। তোর বান্ধবী আমার জীবনে এসে আমাকে পাল্টে দিয়েছে। চিন্তা করবি না এই রাজ কখনো হেনাকে অবহেলা করবে না।

রাজের উদ্দেশ্যে আর কিছু বললাম না। ভালোবাসাটা এমন এক জিনিস যা ধরে বেঁধে রাখা যায় না, আবার ছাড়াও থাকা যায় না।

——————
হেই মিস লিটল লিলিপুট, শুনলাম তোমার জন্য নাকি কালচারাল প্রোগ্রাম সেদিন শেষ হয়ে গিয়েছিল? তা কাহিনী কি! কি এমন করেছিলে যার জন্য পুরো কলেজের আনন্দ মাটি হয়ে গিয়েছিল? অবশ্য পুরো কলেজ জানে তোমার কথা শুধ আমিই জানি না। সকলে তোমার অগোচরে সমালোচনা করছে। কিন্তু প্রিন্সিপাল স্যারের ভয়ে তোমাকে কেউ কিছু বলছে না। একটা কথা মনে রেখো আহিবা, আমি কিন্তু প্রিন্সিপাল স্যার কে ভয় পাই না।
তোমাকে আমি কখনো উপরে উঠতে দিবো না। পনেরো দিন আমি অনুপস্থিত ছিলাম এজন্য শান্তিতে ছিলে। কিন্তু এখন আমি এসে গিয়েছি তোমাকে শান্তিতে থাকতে দিবো না। তোমার জন্য আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে, যার ক্ষতিপুরণ আমি এখনো দিয়ে যাচ্ছি। তোমার জীবন আমি নরক বানিয়ে ছাড়বো। এসে গিয়েছে তোমার জীবনে কানিজ নামের ঘূর্ণিঝড়ের আগমন।

চলবে………