অপেক্ষিত প্রহর পর্ব-০৭

0
323

#অপেক্ষিত_প্রহর
#আফসানা_মিমি
|৭ম পর্ব |

শীতকালীন সকাল। একদিনের বৃষ্টিপাতে শীত নেমে গিয়েছে। ঘড়িতে টুংটাং আওয়াজে বুঝা যাচ্ছে সময় হয়ে গিয়েছে, এবার উঠতেই হবে বিছানা ছেড়ে। আড়মোড়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে বিছানা ছাড়লাম। বাহিরে কিছু মানুষজনের কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম কিছু লোক তার দিয়ে কি যেন করছে। ব্যাপারটা বেশ আশ্চর্যজনক। এত সকালে লোকদের কাম-কাজ নাই নাকি! ঘর থেকে বের হয়ে মা সামনে পড়লো। হাতে চায়ের ট্রে। আমাকে দেখে তাড়াহুড়ো করে হাঁক ছাড়লো,

– আহিবা মা আমার, যা তো আঙ্কেলদের এই চা গুলো দিয়ে আয় তো! আবার ফিরে এসে বিস্কুট নিয়ে যাবি।

মা আমাকে ঠেলে বাহিরে পাঠিয়ে দিলো। চা বিস্কুট দিয়ে আসার পর মায়ের সামনে কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়ালাম। আমাকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে মা ভ্রু যুগল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,

– কি হয়েছে তোর? এভাবে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সর সামনে থেকে, আজ অনেক কাজ আমার। এই যে এত মানুষ এসেছে তাদের দু’মুঠো ভাত-ডাল খাওয়াতে হবে তো!

মায়ের তাড়াহুড়ো দেখে এবার সত্যিই বিরক্ত লাগছে। মায়ের উদ্দেশ্যে চিল্লিয়ে বললাম,

– তুমি আমাকে বলবে, বাড়িতে এসব কি হচ্ছে? এত মানুষ তার দিয়ে কি করছে? আমাদের এ প্বার্শে কি কারেন্ট চলে এসেছে? কই আশেপাশের বাড়িতে তো ঋসব কিছু দেখছি না। উফ মা! বলো না কি হচ্ছে বাড়িতে?
আমার এমন অধৈর্যতা দেখে মা স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,
– ইফাজ আমাদের বাড়িতে এই লোকগুলোকে পাঠিয়েছে, আমাদের বাসায় সৌর বিদ্যুৎ দাগানোর জন্য। বুঝলি আহিবা, ইফাজ ছেলেটা খুব ভালো। এখানে ইফাজের সাথে সাথে আমাদেরকেও সৌর বিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ইফাজ তো পারতো একা নিজের জন্য সৌর বিদ্যুৎ আনতে কিন্তু দেখ আমাদের কথা কত ভাবে ছেলেটা।

মায়ের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার আঁখিদ্বয় রসগোল্লার ন্যায় বড়ো বড়ো হয়ে গিয়েছে। মায়ের কথা শুনে আমি মনে মনে নিজেই বকছি,” তুমি তো জানো না মা, এই বদ শিল্পীটা তোমার মেয়ের জামাই লাগে। আমার জীবন ত্যানা ত্যানা করার জন্য ইফাজ এখানে এসেছে। আমাকে জ্বালাতন করার জন্যই এই কাজ করছে। এই ছেলের মতি গতি আমার ভালো লাগছে না। কবে না যেন তোমার মেয়েকে ফুড়ুৎ করে নিয়ে পালিয়ে যায় ” মনে মনে এসব ভাতেই খেয়াল হলো; ঘরের বাহিরে বা ভিতরে কোথাও ইফাজকে দেখতে পাইনি। এতক্ষণে তো আমাকে জ্বালাতন করার জন্য উঠেপড়ে লাগতো। বেটা গেল কোথায়? মায়ের কাছ থেকে চলে এসে দোতলায় পা বাড়ালাম। পুরো দোতালা ফাঁকা হয়ে আছে। ঢোল-তবলা, গিটার, হারমোনিয়াম সব যার যার জায়গায় আছে কিন্তু ঘরের কোথাও শিল্পী সাহেবের দেখা পেলাম না। দোতলা থেকে নিচে আসতেই মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
– কোথায় গিয়েছিলি?
– উপরে, শিল্পী সাহেবের খোঁজে। আজ খেতে আসলো না যে?
মা মাটির কলস থেকে চাল বের করছিলেন। আমার কথা শুনে কাল নামাতে নামতে উওর দিলেন,

– আরে, শিল্পী তো শহরে গিয়েছে; সেই সকালে। আজ নাকি গানের রেকর্ডিং আছে। গতকাল-ই তো আমাদের জানিয়েছে। তুই পড়তে বসছিলি তখন তাই জানিস না।
চাল নেয়া শেষ হতে মা রান্না ঘরে চলে গেলেন। আর আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। গতকাল মধ্যেরাত পর্যন্ত ইফাজ গান গেয়েছেন। কোন ষ আলে বের হলেন? আমি এতোই ঘুমে বিভোর ছিলাম যে বলতেই পারি না!
আমার ভাবনার মাঝেই মা রাননা ঘর থেঈএ চিল্লিয়ে বলতে লাগলেন,

– কিরে আহিবা! আজ কলেছে যাবি না? খাবার খেয়ে কলেজে যা। আজ খাইয়ে দিতে পারব না। আমার অনেক কাজ আছে।

মায়ের খাইয়ে দেয়ার কথা শুনে ইফুর কথা মনে পড়ে গেল।

_ তুই কি কখনোই জুতা ঠিক করে পরবি না?

হিবারাণীর মা ভাতের লোকমা হিবারাণীর মুখে পুরে দিতে দিতে প্রশ্ন করলেন। প্রত্ততুরে আমাদের হিবারাণী মুখের ভেতর ভাত রেখেই বলল,

_ ইফু বলেছে, জুতা সোজা করে পেত্নীরা পরে আর উল্টা করে রাণীরা পরে। আমি পেত্নী না আমি হচ্ছি ইফুর রাণী। আমি কখনোই জুতা সোজা করে পরব না।

ছোট্ট হিবারাণীর বোকা নোকা কথা শুনে হিবারাণীর মা তেতে গেলেন। হাতের খাবারের বস্তুখানা শব্দ করে রেখে শলার ঝাড়ু হাতে নিয়ে বলতে লাগলেন,

_ সব দোষ ঐ ইফু ছেলেটার। আমার মেয়েকে উল্টা পাল্টা যা পারছে শিখাচ্ছে। আজ দুইটাকে ধরে বেঁধে পিটাবো। আসছি আমি।

——–
কলেজে ঢুকতেই কোথায় থেকে খড়কুটো আর লতাপাতা আমার মাথার উপর এসে পড়লো। আচমকা এমন হওয়ায় স্তব্ধ বনে যাই আমি। মিনিট দুয়েক লাগলো বুঝতে যে আমার সাথে এইমাত্র কি হয়েছে তা। এতক্ষণে কলেজের অধিকাংশ শিক্ষার্থী আমার সন্নিকটে এসে উপস্থিত হয়েছে। অনেকেই হাসা হাসি করছে আমার এই অবস্থা দেখে আবার অনেকেই কানাঘুষো করছে। হেনা, রাজ আমার এই অবস্থা দেখে দৌঁড়ে আমার কাছে আসে। আমি বুঝতে পেরেছি এটা কার কাজ। কোন কথা না বলে চুপচাপ শরীরের ময়লাগুলো পরিষ্কার করজি আর আমার সাথে হেনাও লতাপাতা ছাড়িয়ে দিতে সাহায্য করছে।

– উপস লিটল লিলিপুট, তোমার কাছে তো যাওয়া-ই যাচ্ছে না দুর্গন্ধে! বাসা থেকে পারফিউম ব্যবহার করে আসোনি নাকি? অবশ্য তোমার সাথে এই অবস্থায় তোমাকে মানিয়েছে। যেমন তুমি তেমন এই আবর্জনাগুলো। দু’টাকার মেয়েরা কি আর পরতে পারবে। কোন স্মার্টনেস নেই যত্তসব গাইয়া মেয়ে হয়ে গাইয়া গান গেয়ে মানুষের সামনে নিজেকে পেশ করতে চায়। কিন্তু এইসব মেয়েরা একদম নির্লজ্জ হয়। নিজের সৌন্দর্য সবার সামনে দেখিয়ে পাগল করতে চায় ছেলেদের। শুনেছি কালচারাল প্রোগ্রামে কি যেন হয়েছিল এই মেয়ের সাথে। সত্যি নাকি মিথ্যা কে জানে।

কানিজের কথা শেষ হতেই কানিজের গালে পরপর দুইটা থাপ্পড় পড়ে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাপ্পড় দেওয়া মানুষটাকে দেখছি। চারপাশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পিনপতন নীরবতা। কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে ফারদিন ইফাজ বলে চুপ হয়ে আছে। সবার মত আমিও শিল্পী সাহেব বলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এই লোকটা না শহরে চলে গিয়েছে রেকর্ডিংয়ের জন্য! এখন এখানে কি? নাকি সাভনে যে আছে সে ইফাছের জমজ ভাই!
আমার ভাবনার মাঝেই ইফাজ এসে আমার হাত শক্ত করে ধরলেন। কানিজের সাভনে দাঁড় করিয়ে শান্ত কন্ঠস্বরে বললেন,

– সরি বলে মেয়েটাকে।
ইফাজের কথায় কানিজ গালে হাত দিয়েই পাল্টা প্রশ্ন করল,
– মানে?
কানিজের বলতে দেরি কিন্তু আরেকটা থাপ্পড় কানিজের গালে পড়তে দেরি হয়নি। ইফার আবারও শান্ত কন্ঠস্বরে বলল,
– সরি বলো। সরি বলা ছাড়া অন্য কথা বললেই গালে থাপ্পড় পড়বে।
আমি সহ উপস্থিত সকলে হতভম্ব হয়ে ইফাজের কর্মকান্ড দেখছি। পুরো কলেজের কারোর সাহস হয় না কানিজকে কিছু বলার এই প্রথম ইফাজ বলা তো না সোজা থাপ্পড় মেরে দিলো কানিজের গালে।

কানিজের অবস্থা দেখে আমার পাশ থেকে হেনা বলে উঠে,
– একদম ঠিক হয়েছে। আমার বন্ধুকে অপমান করা! আজ তোর সব দেমাগ ভেঙ্গে গুড়ো হবে। শয়তান, শাকচুন্নি মাইয়া সরি বল?
হেনার কথা শুনে কানিজ হেনার দিকে তেড়ে আসতে নিলে আবারও ইফাজ কানিজের গালে থাপ্পড় মারে। কানিজ কটমট চোখে আমার পানে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

– সরি।
কানিজের কথার প্রত্তুত্তরে ইফাজ আবারও বললেন,
– ভালোভাবে বলো। নয়তো!
– সরি আহিবা। আমাকে ক্ষমা করে দাও।

কানিজের কথা শুনে ইফাজ আমার হাত ছেড়ে দেন। সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
– শুধু আহিবা নয়, কলেজে আর কারোর সাথে যদি এই মেয়েটা আবার খারাপ ব্যবহার করে তো এর অবস্থা বারোটা বাজাবো আমি।
কলেজে পড়াশোনা করতে আসো, গুন্ডামি করতে না। তুমি কার মেয়ে, কার বোন তা আমার দেখার বিষয় না। তুমি এই কলেজের ছাত্রী। আর এই কলেজের গানের শিক্ষক হওয়ায় আমি এই অধিকার রাখি তোমাকে শাস্তি দেয়ার। মনে থাকে যেন।

সকলের সামনে থেকে আমাকে টেনে হত ধরে নিয়ে চলে আসলেন শিল্পী সাহেব। কলেজের বাহিরে দণ্ডায়মান প্রাইভেট কারের ভেতর ঢুকিয়ে নিজেও ঢুকে পড়লো ইফাজ।

ইফাজ বর্তমানে রীতিমতো রাগে কাঁপছে। ইফাজের পানে আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এই লোকটা আমাকে নিয়ে এত সিরিয়াস কেন? ইফাজের সাথে বিয়ে হওয়ার আগে তো এই লোকটা আমাকে চিনত না, জানতো না! বিয়ে হওয়ার পর এই লোকটা আমার ব্যাপারে এত সিরিয়াস কেন? যার জন্য সে আমার বাড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছে এবং আমাদের এত সাহায্য করছে! ইফাজের রাগান্বিত অবস্থায দেখে আমি সোজা হয়ে বসে প্রশ্ন করলাম,

– আপনি না শহরে চলে গিয়েছিলেন রেকর্ডিং এর জন্য? ফিরে আসলেন কেন? আর কেনই বা আপনি আমার ব্যাপারে এতটা সেনসিটিভ?

বর্তমানে আমার বলা কথা হয়তো ইফাজের পছন্দ হয়নি। আমার দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে চিল্লিয়ে বলতে লাগল,

– কেউ যখন তোমাকে আঘাত করে তার পাল্টা প্রতিঘাত করতে শিখোনি? আজ কলেজের সকলের সামনে মেয়েটা তোমাকে অপমান করল আর তুমি চুপ ছিলে কেন? বলো, জবাব দাও আমাকে; কেন চুপ ছিলে তুমি। মুখ কোথায় ছিল তোমার? আজ আমি যদি এখানে না আসতাম তাহলে কি হতো! এই মেয়েটার লোক মুখের সামনে তোমাকে বিবস্ত্র করতেও হাত কাঁপতো না তা তুমি জানো? এখন বলো কি সমস্যা তোমার?

আমি ইফাজকে বললাম কি! আর আমার সারিন্দা বাজায় কি। আমি যা জিজ্ঞেস করলাম আমার কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা আমাকে বলছে জবাবদিহিতা করতে।
আজ আমি এই শিল্পীর মুখ থেকে কথা বের করে ছাড়বো। ইফাজের কথার প্রত্যুওরে এখন আর কিছু বলব না। তাহলে বুঝতে পারবে যে আমি রেগে আছি।

কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর যখন ইফাজ আমার থেকে কোনো উত্তর পেলো না, তখনই ইফাজ গাড়ির চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হয়তো রাগ কমানোর প্রচেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে শান্ত কণ্ঠে বললেন,

– আমি আজ শহরে যাইনি। যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু পথিমধ্যে প্রিন্সিপাল স্যারের কল আসে। কলেজে নাকি সমস্যা হয়েছে তার জন্য কলেজে আসা। কলেজে ঢুকতেই তোমার সাথে ঐ অসভ্য মেয়েটার কান্ড দেখে রেগে গেলাম আমি।

ইফাজের কথার প্রত্তুত্তরে কিছু বলার নেই আমার। এর লোকটার মাথায় কি চলে তা এই লোকটাই জানে। আমার জীবনটা শেষ করে ফেলবে লোকটা যা আমার জানা হয়ে গিয়েছে।

– কোথায় যাবে বলো। বাসায় যাবে নাকি অন্য কোথাও?

ইফাজ আমাকে কি বলছে তা আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করাচ্ছি না। আপাতত আমি ব্যস্ত আছি গাড়ির ভেতরের সবকিছু দেখতে। এতদিন টেলিভিশনের দেখে আসতাম প্রাইভেটকার। আজ জীবনের প্রথম প্রাইভেটকারে বসলাম। যার জন্য খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সবকিছু দেখছি। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে ইফাজ মুচকি হেসে বলে,

– পরেও দেখতে পারবে আমার হিবারা,, আহিবা! এখন চলো বাসায় যাই।

ইফাজের আটকে যাওয়া কথা শুনে আঁতকে উঠলাম। হিবা তো আমাকে একজনের ডাকতো আর হচ্ছে ইফু। কিন্তু এখন ইফাজ কীভাবে ডাকছে তা কিছুই মাথায় ঢুকছে না। ইফুর কথা মনে হতেই তরতর করে ঘামছি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন করলাম,

আপনি আমাকে কি বলে ডাকলেন এখন? আমি স্পষ্ট শুনেছি আহিবা ডাকেন নি বরঞ্চ হিবা ডেকেছেন। সত্যি করে বলুন তো আপনি কে?

চলবে…….