#অপ্রিয়_প্রাক্তন
৩য়_পর্ব
~মিহি
তিরার কথা শেষ হওয়ার আগেই তার গালে সজোরে আরেকটা থাপ্পড় আঘাত হানলো। তাল সামলাতে না পেরে খানিকটা দূরে ছিটকে গেল সে। মায়ের অগ্নিদৃষ্টির সামনে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার। বড়সড় ঝড়ের আভাস পাচ্ছে সে। নির্ঘাত আজ একটা তুফান আসবে এ বাড়িতে।
তিরার ভাবনা ভুল হলো। বাড়ি নীরব আলয়ে পরিণত হলো যেন। তারান্নুম বেগমও এ নিয়ে কথা বাড়ালেন না। পরদিন যথারীতি অফিসে গেলেন তিনি। তিরা বাড়িতে একা। একাকীত্বটা ইদানিং আনন্দ দেয় তিরাকে আবার নানান কুবুদ্ধিও। এই যেমন দীর্ঘক্ষণ সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসিটা হাসছে সে। অতঃপর ড্রয়ারের কোণে লুকিয়ে রাখা ছোট ব্যাগটা বের করলো তিরা। ব্যাগটাতে একটা নুপুর, একটা জলরঙে আঁকা তিরার পোট্রেট, ডেইরি মিল্ক সিল্কের র্যাপার আর একটা ডায়েরি রয়েছে। তিরা পায়ের দিকে তাকালো, পায়ের নুপুরটা নেই। নিয়নের দেওয়া একটা নুপুর হারিয়ে ফেলেছে সে। কোথায় পড়লো নুপুরটা? হাসপাতালে? তিরা বেশিক্ষণ ভাবতে চাইলো না এটা নিয়ে। ডায়েরিটা খুললো। এ ডায়েরিটা তিরার জীবনে নিয়নের আগমনের প্রতিটা মুহূর্তের সাক্ষী। চোখ বন্ধ করে এলোমেলো স্মৃতিগুলোর ভীড়ে পাড়ি জমালো অতীতে।
_______________
৮ই আগস্ট, ২০২০||
তিরা একটা ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। নিয়নকে মেসেজ দেওয়ার দুঃসাহস করেই ফেলল সে।
-“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। আপনি মেইবি আমাকে চেনেন না তবে আপনার লেখাগুলো খুব ভালো আর আপনাকে বড় চুল ভালো মানায়।”
টেক্সটটা করার পর থেকেই তিরার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। এমন অনুভূতির সাথে তো সে পরিচিত নয়। সপ্তদশী তরুণীর মনে যে প্রজাপতিরা পাখনা মেলে উড়ছে তা যেন সে টের পাচ্ছে গভীরভাবে। নিয়ন সেই টেক্সট দেখলো বিকেলবেলা। তিরা প্রত্যুত্তরের আশা করেনি তবে প্রত্যুত্তর সে পেল।
-“ওয়ালাইকুম সালাম। ধন্যবাদ কিন্তু আপনি কে?”
-“আমি আপনার মামীর ভাতিজি!”
-“ওহ আচ্ছা। স্যরি চিনতে পারিনি।”
-“না চেনাই স্বাভাবিক।”
-“বাসার সবাই ভালো আছে?”
-“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
কথার সূচনা হলো তখন, বলতে গেলে তাদের গল্পের সূচনাও তখন থেকেই। লকডাউনের কারণে পড়াশোনার চাপ নেই। কথা চললো দীর্ঘক্ষণ। দিনের অর্ধেক সময় কাটে তাদের দুজনের নানান আলাপে। দুজন দুজনের সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানতে শুরু করে। নিয়ন মাছ ধরতে পছন্দ করে, তিরার বই পড়তে ভালো লাগে। নানান প্রশ্নের ভীড়ে সম্পর্কটা এগোয়।
-“তোমার কাছে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ? বন্ধুত্ব নাকি ভালোবাসা?”
-“বন্ধুত্ব!”
-“কেন?”
-“ভালোবাসা হারায়, বদলায় কিন্তু বন্ধুত্ব সবসময় একইরকম থাকে।”
-“আমি হলে ভালোবাসা বলতাম। আমি যাকে ভালোবাসি, সে-ই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সে-ই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।”
তিরার মনে তখনো ভালোবাসা শব্দটার আবির্ভাব হয়নি। তার জীবনে বন্ধুত্বটাই ছিল সবকিছু। তার ফ্রেন্ড সার্কেল জুড়েই ছিল তার পৃথিবী। সে জীবনে নিয়নের উপস্থিতি নিয়ম ভাঙার কারিগর হিসেবে। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কিছু নিয়ম থাকে যা আমরা বিশেষ একজনের জন্য ভাঙি। তিরার জন্য সেই বিশেষ একজন ছিল নিয়ন যে তাকে নিয়ম ভাঙতে শেখালো।
এক সপ্তাহ পেরোলো আলাপের মাঝেই। নিয়নের ঢাকায় ফেরার সময় ঘনিয়ে এলো। আগামীকাল রাতে সে ঢাকা ফিরবে। এখনো তিরাকে জানায়নি সে।
-“তিরা, আমি একজনকে খুব ভালোবাসি। আমার সাথে একই স্কুলে পড়তো। আমার চেয়ে ছোট ও। ওকে কি আমার মনের কথা বলে দেওয়া উচিত?”
-“হ্যাঁ, মনের কথা মনে রেখে কী লাভ?”
-“ঠিক বলেছো। ধন্যবাদ তোমাকে। আমার আইডির পাসওয়ার্ড “*******” এটা। আমার কিছু হলে তাকে জানানোর দায়িত্ব তোমায় দিয়ে যাবো।”
-“পাসওয়ার্ড দেওয়ার প্রয়োজন নেই! আমি তো আপনার খুব কাছের কেউ না। তাছাড়া আপনার কী হবে? যাকে ভালোবাসেন, তাকে জানায়ে দিন।”
নিয়নের সাথে তিরার সে রাতে আর কথা হলো না। নিয়ন কাউকে ভালোবাসে জানার পর তিরার মন বিষাদে আবৃত হয়ে এলো, অকারণ চোখের জলগুলো গড়াতে লাগলো অবিরত। তিরা নিজেও বুঝলো না কেন সে এমন করছে। নিয়ন তাকে কতটুকুই বা চেনে, সেও তো নিয়নকে ঠিকমতো চেনে না। নিয়নের জীবনে কেউ একজন থাকতেই পারে, এটা নিয়ে কান্না করার কিছুই নেই। নিজেকে বোঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও বিশেষ লাভ হলো না তিরার, অর্ধরাত্রি অতিবাহিত হলো চোখের জলের সাথে যুদ্ধ করতে করতে।
নিয়নের ঢাকা ফেরার দিন আজ। রাত এগারোটার বাস। নিয়ন কেবল তিরাকে জানিয়ে রাখলো রাত এগারোটায় বাস, সে যেন অনলাইনে থাকে তখন। তিরার মন তখনো বিষণ্ণ। নিয়নের সাথে কথা বললেই নিজেকে দুর্বল মনে হয় তার। ছেলেটার প্রতি দুর্বলতা বাড়িয়ে কী লাভ? সে তো অন্য কারো! এগারোটা অবধি এসব ভাবনাই তাড়া করে বেড়ালো তিরাকে।
-“তিরা, আছো?”
-“হু।”
-“ঢাকায় ফিরছি এখন।”
-“ওহ।”
-“মন খারাপ?”
-“একটু! ঢাকা গিয়ে হয়তো কাজের ব্যস্ততায় আমাকে ভুলে যাবেন। ভবিষ্যতে চিনবেন কিনা!”
-“একটা কাজ করবে?”
-“কী?”
-“ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমাকে জানাবে।”
-“আজ নাকি রোজ?”
-“রোজ!”
-“আচ্ছা।”
-“একটা কথা বলবো। আগে আমার সম্পূর্ণ কথা শুনবে, তারপর উত্তর দিবে। আমার কথা শেষ হওয়ার আগে কিছু বলবে না!”
-“আচ্ছা। আপনার কথা শেষ হলেই আমি বলবো।”
-“আর কত আপনি আপনি করবেন? মিসেস.আবরার হলেও আপনি করেই ডাকবেন? মিসেস.আবরার হলে কয়টা বেবী নিবেন?”
-“মানে?”
-“বলছিলাম না কথা শেষ করতে দিতে! গাধা! কালকে যে মেয়ের কথা বলছি সেটা তুমি। তুমি আমার স্কুলেই পড়তে। আমি সেই ২০১০ সালে তোমায় দেখেছিলাম। ঐ বাচ্চাটাকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম। আমার জীবনের প্রথম ভালোলাগা তুমি ছিলে। মামীর বাড়িতে তোমাকে দেখার পর আমি কতটা খুশি হয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু তুমি একটা কথাও বললে না! আম্মুর সাথে যখন কথা বললে ঐ একটা কথাই। আমার দিকে তাকালে না অবধি! রাতে লেইট করে ফিরে কলিং বেল দিচ্ছিলাম বারবার। ভেবেছিলাম তুমি আসবে দরজা খুলতে। এলে না। আমি তোমাকে দেখার পর থেকে কতটা পাগল হয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারবো না।”
তিরার কলিং বেলের কথাটা মনে পড়লো। ফুপ্পির বাড়িতে নিয়নরা আসার রাতেই সে শুয়ে পড়েছিল এমন সময় বেশ কয়েকবার কলিং বেল বেজেছিল। সে দরজা খুলতে যেতে চেয়েছিল কিন্তু ফুপ্পি নিষেধ করে।
-“আপনি ২০১০ থেকে আমাকে পছন্দ করেন? ঐ বয়সে?”
-“পাকনা ছিলাম ম্যাম ছোট থেকেই। তুমি তার উপর বাসের সীট নিয়ে নিয়ে ঝগড়া করতা! তোমার বাচ্চামির প্রেমে পড়েছিলাম আমি এক নিষ্পাপ বাচ্চা। তখন ভাবিনি তুমি আমার লাইফে আসবে। তারপর তোমার ফুপ্পির সাথে মামার বিয়ে ঠিক হলো। এসব কিছু হয়তো ভাগ্যে ছিল। এখন এই যে তোমায় সবকিছু বলতে পারছি এটা আমি সত্যি বিশ্বাস করতে পারছি না। দেখো তুমি সময় নাও, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি আছি।”
তিরার হাত পা কাঁপছে। কী উত্তর দিবে সে? নিয়নের কাছে মনের কথা কিভাবে প্রকাশ করবে? লুকিয়ে রাখতে তো পারবেই না, বলাটাও দুঃসাধ্য মনে হচ্ছে।
-“রিল্যাক্স! টেনশন নিয়ো না। তুমি চাইলে আমি এসব নিয়ে আর কখনো কিছু বলবো না কিন্তু আমি আমার অনুভূতি লুকাতে চাইনা। আমার মনে যা ছিল তা আমি বলেছি। দশ বছর আগের ভালোলাগা আমি আমার জীবনে ফিরে পেয়েছি, তা আমি হারাতে চাইনা।”
-“আমার সবকিছু এলোমেলো লাগতেছে।”
-“চিল! প্যারা নিও না। এখনি বিয়ে করতে বলিনি তো। শুধু বাচ্চার হিসেবটা করে রাখো আগেভাগে। আচ্ছা সিরিয়াস কথা, মামীর ওখানকার একটা কাহিনী বলি। বিয়ের দিন তুমি রুমের বারান্দার সাথের জানালার সাথে হেলান দিয়ে বসেছিলা মনে আছে?”
তিরা মনে করার চেষ্টা করলো। বিয়ের দিন সবাই ব্যস্ত ছিল। তিরার ভালো লাগছিল না বলে ঘরেই ছিল। তার ফুপ্পির ঘরটা রাস্তামুখী। বারান্দার সাথেই ঘরের একটা থাই জানালা রয়েছে। সেটাতে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে ছিল তিরা। এটা নিয়ন খেয়াল করেছে?
-“হ্যাঁ, বসে ছিলাম।”
-“কয়েকটা ছেলে তোমাকে নিয়ে উল্টোপাল্টা বলছিল। আমি গিয়ে শুধু এটুকু বলেছি তুমি মিসেস.আবরার। এখন ওদের কাছে আমার মান সম্মান রক্ষার দায়িত্ব তোমার। দোয়া করো ইন ফিউচার যেন তোমাকে তাদের ভাবী হিসেবে নিয়ে যেতে পারি।”
তিরার হৃদস্পন্দনের কম্পন বাড়তে থাকলো। এই ছেলেটার একেকটা কথা তার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে তুলছে। নিয়ন সত্যিই তাকে সেই ছোটবেলা থেকে পছন্দ করতো? তিরা কী উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না।
চলবে…