অপ্রিয় প্রাক্তন পর্ব-০৪

0
98

#অপ্রিয়_প্রাক্তন
৪র্থ_পর্ব
~মিহি

তিরার হাত পা কাঁপছে। রাত এগারোটার বেশি বাজে। এত রাত অবধি সে কখনো জাগে না। তিরা কী করবে বুঝতে না পেরে নিয়নের টেক্সটগুলোর স্ক্রিনশট নিশাতকে দিল। নিশাত তৎক্ষণাৎ সীন করলো।

-“আমার মনে হচ্ছে ভাইয়াটা ভালো, তাছাড়া তুইও তো পছন্দ করিস।”

-“এটা কি সঠিক সময়?”

-“ভাইয়া তো বলছেই অপেক্ষা করবে। তোকে তো এখনি কিছু বলা লাগতেছে না।”

নিশাতের কথাটা ভেবে দেখলো তিরা। আসলেই তো তার এখনি উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই, পরে ভেবেচিন্তে উত্তর দিলেই হবে। তিরা চোখ বন্ধ করে নিয়নের চেহারাটা কল্পনা করে। বাবরি চুলগুলো নিয়নকে বড্ড মানায়। অথচ এটা নিয়েই ছেলেটাকে এত কথা শুনতে হয়! তিরা বুঝে উঠে না সামান্য সুন্নতি বাবরি রাখার জন্য কাউকে এভাবে জাজ করতে পারে মানুষ! তিরার মনে পড়ে প্রথমদিন কথা বলার সময় তাদের আলাপে কিছু কথা উঠে এসেছিল নিয়নের চুল নিয়েই।

-“ও মাই গড! এই তিরা, এক্ষুণি একটা মেয়ে আমাকে চোখ টিপ মেরেছে।”

-“ভালো তো, আপনিও চোখ টিপ মারেন।”

-“না না, আমি ভদ্র। আব্বুকে বলে দিব একটা মেয়ে আমায় চোখ টিপ মেরেছে।”

-“বাহ!”

-“আচ্ছা শোনো, আমার চুল নিয়ে তোমার মন্তব্য কী?”

-“মন্তব্য করার কী আছে? ইউর লাইফ, ইউর রুলস! আপনার চুল, আপনি যেমন ইচ্ছে রাখবেন।”

-“আ’ম ইমপ্রেসড! আমাকে এক মেয়ে প্রপোজ করেছিল, বলেছিল চুল কেটে ছোট করতে। ব্লক করছি।”

-“আহারে বেচারী মেয়েটা!”

তিরা বেশ হেসেছিল এ কাণ্ডে তবে নিয়ন বোধহয় নিজের ভরসার স্থলটা খুঁজে পেয়েছিল তিরার মাঝেই। তিরা যে অন্য সবার মতো তাকে জাজ করবে না এটা নিয়ন উপলব্ধি করেছিল। ভালোলাগাটাও বেড়েছিল বহুগুণ।

তিরা সময় নিল। দীর্ঘসময় না, অল্প কিছুদিন। নিয়ন এই অল্প কয়েকদিনেই তিরার খুব কাছের একজন হয়ে উঠলো। অন্তরালে থাকা এক কাছের জন। নিয়ন দ্বিতীয়বার ভালোবাসার কথা বললো নিজের আঁকা ছবির মধ্য দিয়ে। ছেলেটা মারাত্মক সুন্দর ছবি আঁকে তা বুঝতে সময় লাগেনি তিরার। তিরার একটা জলরঙা পোট্রেট আর নিচে সুন্দর করে লেখা,”উইল ইউ ম্যারি মি?” তিরা মৃদু হাসলো। ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি।

-“বুদ্ধু! এভাবে কেউ প্রপোজ করে? ফিল্ম দেখেন না?”

-“আমি তো এভাবেই ভালোবাসার কথা বলতে পারি। আপনি কি রাজি হবেন না?”

-“হবো।”

নিয়নের ঠোঁটে হাসি ফুটলো। দুজন ফোনের দুই প্রান্তে বসে নানান রঙিন অনুভূতির জাল বুনছে। সুন্দর এ মুহূর্তটা আংশিক যান্ত্রিক হয়ে যাওয়াতে কেউ কারো ঠোঁটের হাসি দেখতে পারছে না। তিরার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সত্যিই সে নিয়নের প্রথম ভালোলাগা? তাও আবার সেই ছোটবেলার! লকডাউনকে সাক্ষী রেখে সম্পর্ক শুরু হয় দুজনের। নিয়ন তখন ঢাকায়। লং ডিসট্যান্স রিলেশিনশীপ শব্দটার সাথে তিরার খুব বেশি পরিচয় না থাকলেও সে মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে শুরু করেছিল। নিয়নের প্রতি অবিশ্বাস করার ন্যূনতম কোনো জায়গা ছিল না। নিয়নের ফেসবুকের পাসওয়ার্ড থেকে শুরু করে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পিন নম্বর অবধি নিয়ন তিরাকে জানিয়ে রেখেছিল। তিরার প্রতি নিয়নের এ অগাধ বিশ্বাসটা তিরার ভয় বাড়িয়ে দিত। কোনোভাবে নিয়নকে হারিয়ে ফেলবে না তো সে? শেষমেশ এটা নিয়ে প্রশ্ন করে বসলো তিরা।

-“আপনি আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পিন আমাকে দিয়ে রেখেছেন কেন? আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি! আমার অদ্ভুত লাগে, আপনি আমার উপর এতটা বিশ্বাস করেন যে আমার ভয় হয়।”

-“ব্যাংকে টাকা তোমার মোহরানার জন্যই জমাচ্ছি, তোমার টাকার উপর তো তোমারই অধিকার থাকবে তাইনা? এত ভয় পেয়ো না। আমি সবসময় আছি তোমার কাছে।”

-“হ্যাঁ! ঢাকা তো খুব কাছে!”

-“ঢাকা কাছে না তবে আমি কাছে। আমি তোমার এলোমেলো চুলের ভাঁজে মিশে আছি, তোমার ভাবুক চোখের মাঝখান জুড়ে আছি, তোমার বক্ষপিঞ্জরের সবটুকু জুড়ে আছি।”

-“খুব হয়েছে কাব্য রচনা! বগুড়া আসবেন কবে?”

-“এখন তো সময় নাই সোনা, তাছাড়া অনেকদিন বাড়িতে ছিলাম। এখন ব্যস্ততা বেশি।”

-“ওহ!”

লং ডিসট্যান্স রিলেশনশীপের এই মুহূর্তটাই বড্ড যন্ত্রণাদায়ক। তাকে দেখতে মন চায় অথচ দেখার উপায় নাই! নিয়ন অনেকটা দূরে, চাইলেই দু’চোখ ভরে দেখা যাবে না, আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দেওয়া যাবে না তাকে। তিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। অন্তত এত ব্যস্ততার মাঝে সারাক্ষণই কথা তো বলে ছেলেটা! কখন কী করছে সব কথাই তিরাকে জানায়। এটুকুর বেশি কী-ই বা চাইবে তিরা?

নিয়নের সাথে কথা বলতে বলতেই আচমকা নিয়নের আইডিতে লগ-ইন করলো তিরা। নিয়নের আইডিতে ঘুরতে তার ভালো লাগে। আইডিতে মেয়ে জাতি নাই বললেই চলে, নিউজ ফিড জুড়ে সব টেক রিলেটেড কথাবার্তা। তিরা বোঝেনা এসব, নিয়নকে জিজ্ঞাসা করলে সে বুঝিয়ে দেয়। আচমকা তিরার নজর পড়লো নিয়ন এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কথোপকথনে। কথোপকথন দেখে তিরা আশ্চর্য হলো কেননা নিয়ন বগুড়া আসছে! তিরাকে জানায়নি সে। সারপ্রাইজ দিতে চাইছে? তিরা মুচকি হাসলো! গাধা! নিজের আইডির পাসওয়ার্ড তিরাকে দিয়ে তাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার প্ল্যান ফেসবুকেই করছে।

-“এই তিরা, আমি কাল ব্যস্ত থাকবো। কথা হবে না।”

-“তা তো থাকবেনই। লম্বা জার্নি আছে যে।”

-“মানে?”

-“ঢাকা টু বগুড়া! লম্বা জার্নি না?”

-“শীট! তুমি কিভাবে জানলে? তোমাকে কে বললো?”

-“আপনার আইডির পাসওয়ার্ড!”

-“আমি আসলে একটা গাধা! তোমার জন্য কী আনবো বলো।”

-“আইসক্রিম।”

-“গলে যাবে না? আচ্ছা আনবোনি।”

তিরা হাসতে লাগলো। নিয়ন বড্ড বোকা বোকা আচরণ করে মাঝে মধ্যে। তিরার এখনো মনে পড়ে তাদের প্রথম কলের কথা। নিয়ন কল করেই গম্ভীর গলায় বলেছিল,” আম্মু বলে কলে আমার কণ্ঠ নাকি অন্যরকম শোনায়!” তিরা সে কণ্ঠের প্রেমে পড়েছিল গভীরভাবে। তিরার বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, আপনার কণ্ঠের এ অন্যরকম মাদকতা শোনার অধিকারটা আমার থাকুক আজীবন। ভালোবাসার সূচনা বরাবরই রঙিন হয়ে থাকে, বিবর্ণ তো কেবল হয় উপসংহার। তিরা সেই রঙিন সূচনার সাগরে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছিল।

পরদিন নিয়ন ঠিকই বগুড়া এলো। বিপত্তি হলো তিরার বেলায়। সে দেখা করবে কিভাবে? তিরা বড্ড ভীতু স্বভাবের। নিয়নের সাথে দেখা করতে গিয়ে যদি আত্মীয় স্বজন কেউ দেখে! এই ভয়ে তিরা কিছু বলতেও পারছে না নিয়নকে। ছেলেটা এত দূর জার্নি করে এসেছে তার জন্য এখন যদি সে-ই মানা করে তবে নিশ্চিত মন খারাপ হবে নিয়নের। এসব ভেবে শেষমেশ রাজি হলো তিরা তবে তারা দেখা করবে রাস্তায়। নিয়ন বেচারা আর কী বলবে! কোন পাগলের প্রেমে যে সে পড়েছে! রাস্তায় দেখা করা যে বেশি রিস্কি এটা তিরাকে কোনভাবেই বোঝাতে না পেরে নিয়ন শেষমেশ রাজি হলো।

অক্টোবর মাসের পনেরো তারিখ।
তিরা সকাল থেকেই চিন্তায় নাজেহাল হয়ে আছে। নিয়ন যথাসময়ে কল করলো। তিরাও বাড়ি থেকে বেরোলো। যে রাস্তায় দেখা করার কথা, সেখানে গেল সন্তর্পণে। নিয়ন দাঁড়িয়ে আছে, সাথে তার এক বন্ধু। তিরার ভয়ে হাত পা কাঁপতে লাগলো এ মুহূর্তে। নিয়নের মুখোমুখি দাঁড়ালো সে।

-“কেন আসলেন আপনি?” ভয়ের কারণে অনেকটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো তিরা।

-“পাশে গুরুজন আছে, সালাম না দিয়েই আমার সাথে ঝগড়া লাগতেছো?”

-“স্যরি! আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।” তিরা পাশে থাকা নিয়নের বন্ধুকে সালাম দিল।

নিয়ন তিরার হাতে আইসক্রিম আর ডেইরি মিল্ক সিল্কের প্যাকেটটা ধরিয়ে দিল এবং বললো,”এখন যাও। আবার কেউ দেখে ফেলবে!” নিয়নের খোঁচাটা দিব্যি বুঝলো তিরা। হালকা হেসে রাস্তা পার হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কী যেন হলো তার। সবসময় আগে আগে রাস্তা পার হওয়া মেয়েটা যেন রাস্তা পেরোনো ভুলে গেল। আবারো নিয়নের সামনে দাঁড়ালো তিরা।

-“রাস্তা পার করে দেন।”

-“আস্ত পাগলের প্রেমে পড়ছি! চলেন ম্যাম!”

তিরার হাত ধরে তাকে রাস্তা পার করে গাড়িতে তুলে দিল নিয়ন। রাস্তায় অসংখ্য তীক্ষ্ম চক্ষু এ দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করলেও তিরার সেসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে হলো না। নিয়নের সাথে কাটানো এ একটা মুহূর্তই তার কাছে বিশাল কিছু মনে হচ্ছে! শুধু এ কয়েক মুহূর্তের জন্য নিয়ন এত দূর এলো ভাবতেও তিরার মনে অন্যরকম এক অনুভূতি খেলে উঠলো।

চলবে…