#অপ্রিয়_প্রাক্তন
৫ম_পর্ব
~মিহি
তিরা ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। আজ ষোলোই অক্টোবর। গতকালের তারিখটা মাথা থেকে বেরোতে চাইছে না। প্রেমপর্ব শুরু হওয়ার পর প্রথম নিয়নের মুখোমুখি হয়েছে সে। এ অনুভূতিটা তার কিশোরী মনে অন্যরকম আলোড়ন তুলছে।
-“কখন থেকে ডাকতেছি তিরা? ধ্যান কোথায়?”
-“হ্যাঁ …হ্যাঁ আম্মু বলো।”
-“তোমার আব্বু কল করেছিল। তোমার ফুপ্পির শ্বশুরবাড়ি থেকে দাওয়াত করেছে। তোমার চাচারা সবাই যাচ্ছে। তোমাকেও যেতে বললো।”
-“আমি? না যাবোনা।”
-“কেন? ঘুরে আসো যাও।”
তিরাকে কথাটুকু বলে তারান্নুম বেগম ভেজা কাপড় নিয়ে ছাদে গেলেন নাড়িয়ে দিতে। তিরা ভাবতে বসলো। ওখানে গেলে নিয়নের সাথে দেখা হতে পারে আরেকবার কিন্তু দাওয়াত মানেই মানুষজনের ভীড়। এই জিনিসটা তো তার সহ্য হবে না। কিছু বুঝতে না পেরে নিয়নকে কল করলো সে।
-“হ্যালো…”
-“বলেন।”
-“ফুপ্পি দাওয়াত করেছে। আম্মু যেতে বলছে।”
-“আসবা?”
-“কী করবো বুঝতেছিনা!'”
-“আসবি কিনা ঐটা বল!”
-“কেন আমি গেলে আপনি আসবেন?”
-“নাহ! অত সময় নাই। আমার মেজ বোন নিরাকে তো চেনো, ওর কাছে তোমার জন্য একটা জিনিস দিয়েছি। ওর থেকে নিয়ে নিও মনে করে।”
-“আচ্ছা।”
তিরার মন খানিকটা খারাপ হয় তবুও কেন যেন মনে হচ্ছে নিয়ন আসবে। দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝেই তিরা তৈরি হলো ফুপ্পির শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার জন্য। ছোট চাচা এবং চাচাতো ভাইদের সাথে সেখানে পৌঁছালো সে। মূল দরজায় চোখ পড়তেই দেখল নিয়ন দাঁড়িয়ে। তিরা তাকাতেই নিয়নের চোখে চোখ পড়লো তিরার। তৎক্ষণাৎ চোখ নামিয়ে নিলো সে। অবনমিত চোখেই বাড়িতে প্রবেশ করলো তিরা। কোনোদিকে না তাকিয়ে ফুপ্পির ঘরটাতে এসে বসলো। বিছানার এক কোণে বসে রইলো সে। প্রথমদিন ঠিক এভাবেই বসেছিল যখন নিয়ন এসেছিল ঘরটাতে। কথাটা মনে পড়তেই তিরার ঠোঁটে হাসি খেলে গেল। ভাবনার পসরা বন্ধ হলো নাইমুর রহমানের উপস্থিতিতে। নিয়নের বাবার সাথে তিরার খুব বেশি কথা হয়নি। তিরা সালাম দিল, তিনি সালাম গ্রহণ করে খোঁজ খবর নিলেন। এর বেশি কথা বাড়ানোর সাহস পেল না তিরা। তার ব্যস্ত দৃষ্টি সকলের অলক্ষ্যে নিয়নকে খুঁজে বেড়ালো কিন্তু নিয়ন আশেপাশে নেই। তিরার ফুপাতো বোন, চাচাতো ভাই সবাই সে ঘরে এসেই বসলো। একটু পর নিয়নও এলো নাফসীকে নিয়ে। খেলার বাহানায় বিছানার অপর কোণে বসলো দেয়ালে হেলান দিয়ে। তিরার মনে আছে প্রথমদিনও ঠিক এভাবেই বসেছিল সে। তিরা চোখ তুলে তাকালো না। একটু পর খাওয়া দাওয়ার জন্য ডেকে পাঠানো হলো সবাইকে। তিরাও নিজের চাচাতো ভাইদের নিয়ে উঠলো খেতে বসার জন্য। বাড়ির আঙিনাতে ছাউনি দিয়ে চেয়ার-টেবিল বসানো হয়েছে। খেতে বসে তিরার দুয়েকবার মনে হলো কেউ তার দিকে ছোট পাথর ধরনের কিছু ছুঁড়ছে। তিরা আশেপাশে তাকিয়ে কিছু বুঝলো না। খাবারটুকুও পুরোপুরি শেষ করতে পারলো না। কোনরকম হাতটা ধুয়ে ঘরে এসে বসে ফোন অন করে নিয়নকে মেসেজ করলো।
-“কোথায় আপনি?”
-“খাইলি না কেন পুরোটা? খাবার নষ্ট করা ঠিক?”
-“আপনি কিভাবে জানলেন? আশেপাশে তো…”
-“ছাদ থেকে আপনার উপর পাথর বর্ষণ করতেছিলাম। কানা! দেখিসওনি। তোর চক্করে আম্মুর গায়ে ছোট একটা পাথর লাগছে। আম্মু আমাকে জিজ্ঞাসা করতেছে তোকে কিছু বলবো কিনা, ছাদে পাঠাবে কিনা! আমি লজ্জায় কিছু বলতে পারলাম না।”
-“এমন কাজ করেন কেন যাতে লজ্জায় পড়া লাগে?”
-“ফাজলামি করিস না, ছাদে আয়!”
-“যাবো না।”
-“আসবি তুই?”
তিরা কী বলবে বুঝতে পারলো না। বাড়িতে মানুষজন আছে, এখন হঠাৎ ছাদে গেলে কেমন দেখাবে! তিরা কোনো উপায় না পেয়ে নিজের এক চাচাতো ভাইকে নিয়ে ছাদে উঠলো। চাচাতো ভাই যথেষ্ট ছোট। ছাদে উঠতেই দেখল নিয়ন দাঁড়িয়ে আছে অপর প্রান্তে। তিরা তার চাচাতো ভাইকে নিয়ে নিয়নের বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে রইল। নিয়নের দিকে না তাকিয়েও তিরা বুঝতে পারছে ছেলেটা নিশ্চিত রেগে আছে। আচমকা নিয়ন এসে তিরার চাচাতো ভাইয়ের সামনে দাঁড়ালো।
-“তুমি রাহাত না? তোমাকে নিচে ডাকতেছে!”
-“আমাকে? আচ্ছা যাচ্ছি।”
কোনদিকে না তাকিয়ে রাহাত তৎক্ষণাৎ নিচে চলে গেল। ছাদে কেবল তিরা এবং নিয়ন দাঁড়িয়ে। তিরা খানিকটা লজ্জা পাচ্ছে, ভয়ের মাত্রাটাও বেশি। আচমকা যদি কেউ ছাদে উঠে কেবল তাদের দুজনকেই দেখে তবে বিষয়টা নিশ্চয়ই ভালো দেখাবে না! নিয়ন আশেপাশে তাকিয়ে তিরার খানিকটা কাছে এলো। হকচকিত তিরা পিছু হটতে ভুলে গেল যেন। নিয়নের শরীর থেকে মাদকতা মিশ্রিত এক ধরনের ঘ্রাণ আসছে যা তিরাকে বশ করে রেখেছে।
-“কিছু করবেন না?” নিয়ন ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে প্রশ্ন করলো।
-“কী করবো?”
-“থাক কিছু করা লাগবে না। পান খাইছি এমনিতেও, কিস তো আর করবেন না!”
তিরাকে প্রত্যুত্তর দেওয়ার সময়টুকুও দিল না নিয়ন। তৎক্ষণাৎ তিরার চোখজোড়া এক হাত দিয়ে ঢেকে ন্যানোসেকেন্ডের জন্য তিরার ঠোঁট স্পর্শ করেই সরে এলো তড়িৎ গতিতে। তিরা যেন বুঝেই উঠতে পারলো না কী হলো। কিছু বলার মতো অবস্থা নেই তার। কেবল শক্ত করে নিয়নের বাহু জড়িয়ে ধরলো।
-“নিচে যাও তিরা।”
-“নিয়ন….”
-“নিচে যাও!”
তিরা কোনো কথা না বলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। একটু আগে যা ঘটলো তা যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না সে। ঐ মুহূর্তটা কি বাস্তব নাকি সবটাই কেবল কল্পনা! ঘরে এসে বসলো তিরা। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তার, নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে।
-“তুমি নিয়নের প্রেমিকা?” আচমকা প্রশ্নে সামনে তাকালো তিরা। প্রশ্নকর্তা মেয়েটিকে সে চেনেনা।
-“না। আপনি কে?”
-“মিথ্যে কেন বলতেছো? ছাদে ওর জন্যই তো গেছিলা। ছেলেটা ভালো না, দূরে থাকো তার থেকে! সাবধান করে দিচ্ছি।”
-“আপনি ভুল ভাবতেছেন আপু। আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।”
-“লজ্জা করে না এত মিথ্যে বলতে? সাবধান করতেছি শোনো, অযথা মিথ্যা বলে কী লাভ ভাই?”
মেয়েটি আর কিছু না বলেই চলে গেল। তিরার রাগ উঠলো। হঠাৎ কেউ এসে কেন তাকে নিয়নের নামে উল্টোপাল্টা বলে গেল? তিরা নিয়নকে টেক্সট করলো।
-“আপনার এত শত্রু কেন? আর তাদের আমার সাথেই কী সমস্যা? আমাকে এসে কেন আপনার নামে উল্টোপাল্টা বলে?”
নিয়ন টেক্সট সীন করলো ঠিকই কিন্তু রিপ্লাই করলো না। তিরার চিন্তা ক্রমশ বাড়তে থাকলো। ছেলেটা কি রাগ করলো কোনভাবে? আসলেই ওর শত্রুর অভাব নেই! প্রতিটা বিষয় নিয়ে ছেলেটাকে জাজ করে সবাই, গুজবের তো অভাব নেই বললেই চলে। মিডিয়ায় কাজ করা মানুষদের বাঁকা চোখে দেখাটা কেন যেন বড্ড স্বাভাবিক তবে নিয়নের স্বপ্ন সে একটা ফিল্ম ডাইরেক্ট করবে। তিরা সেই মুহূর্ত আসা অবধি নিয়নের পাশে থাকবে এবং তারপরেই তাদের সম্পর্কের পূর্ণতা নিশ্চিত করবে।
তিরার যাওয়ার সময় হলো। নিয়ন আশেপাশে কোথাও নেই। তিরার মন খারাপ হয়ে আসলো। যাওয়ার সময় একবার অন্তত ছেলেটাকে দেখে যেতে পারতো! বের হওয়ার সময় নিয়নের মা এবং নিজের ফুপ্পির কথা কানে আসলো তিরার। নিয়ন বাইক নিয়ে বেরিয়েছে। তিরার মনে ভয় দানা বাঁধলো। তখনকার ঘটনাটা নিয়েই আবার রেগে নেই তো নিয়ন? এভাবে না বলে বাইক নিয়ে কেন বেরোলো? দুশ্চিন্তা করলেও তা প্রকাশ করতে পারলো না তিরা। ফুপ্পির বাড়িতে থাকার সুযোগ তো নেই, যেতে তো তাকে হবেই। আর নিয়নকে না দেখেই ফিরতে হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবার সাথে বাড়ি থেকে বেরোলো তিরা। ফুপ্পিকে বিদায় জানিয়ে মূল রাস্তার দিকে হাঁটতে লাগলো। ফুপ্পির বাড়ি থেকে মূল রাস্তায় উঠতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগে। তিরা মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে হাঁটছে। নিয়নের ব্যাপারটা বড্ড ভাবাচ্ছে তাকে। ছেলেটা তাকে না বলে এভাবে বেরিয়ে গেল কেন? তিরা চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো নিয়ন বাইক নিয়ে আসছে তাদের দিকেই। বাইক স্লো করে তিরাকে পাশ কাটিয়ে গেল নিয়ন। চোখাচোখি হলো অল্পক্ষণের জন্য তবে নিয়নের চোখের দিকে তাকিয়ে তিরার মন আরো বিষণ্ণ হয়ে পড়লো। ছেলেটা কি এখনো রেগে আছে?
চলবে…