অপ্রিয় প্রাক্তন পর্ব-০৬

0
96

#অপ্রিয়_প্রাক্তন
৬ষ্ঠ_পর্ব
~মিহি

-“বাসায় পৌঁছেছো?”

-“হুম। আপনি কি এখনো রাগ করে আছেন?”

-“আমি কখন বললাম আমি রেগে আছি? যে মেয়েটা তোমাকে কথাগুলো বলেছে সে দিয়া, আমার খালার ননদ। আমায় পছন্দ করতো, এখন তোমাকে এসব কেন বললো তা তো বুঝতেই পেরেছো।”

-“হুহ। আপনি কোথায়?”

-“বাড়িতে ফিরবো একটু পর।”

-“দুপুরে আমাকে না বলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন কেন? যদি দেখা না হতো?”

-“যে মেয়ে আমার প্রেম প্রস্তাব গ্রহণ করতেই দ্বিধায় ছিল, আজ সেই মেয়েটাই আমায় কিছুক্ষণ না দেখতে পেয়ে পাগলপ্রায়! অদ্ভুত না?”

-“না!”

তিরা আর কিছু বললো না। নিয়ন তাকে লজ্জা দিতে চাইছে তবে সত্যি বলতে গেলে সে নিয়নের প্রেমে মারাত্মকভাবেই ডুবেছে।

লকডাউন এখনো আছেই। স্কুল, কলেজ সব অফ। তিরা এস.এস.সি ২১ ব্যাচ। যে অবস্থা দেশের তাতে ওদের পরীক্ষা হবে কিনা সন্দেহ। এমন দীর্ঘসময়ের ছুটি কখনো পায়নি তিরা। পড়াশোনা যে শিকেয় তুলেছে বলাবাহুল্য। এর উপর আবার নিয়নের আগমন তার জীবনে। সব মিলিয়ে আগের জীবনটার পুরোপুরি রদবদল হয়েছে বলা চলে। নিয়নের উপস্থিতি তিরাকে যে প্রশান্তি দেয় তা বোধহয় সে উপলব্ধি করতে পেরেই তৃপ্ত হয়।

-“একটা কাজ করো তিরা।”

-“কী?”

-“তোমার মাকে বলো যে আমি তোমায় বলেছি আমি তোমাকে পছন্ করি।”

-“এখন?”

-“হ্যাঁ। আমার সম্পর্কে ওনার ধারণা জানা দরকার। ভবিষ্যতের কথা তো ভাবতে হবে আমাদের।”

তিরার মনে ভয় ঢুকে যায়। নিজের মাকে চেনে সে। তারান্নুম বেগম শীতল রাগবিশিষ্ট মানবী। সহজে রাগ দেখান না, একদম ঠাণ্ডাভাবে অগ্নিবর্ষণ করেন। তিরা বুঝে উঠতে পারছে না কিভাবে বলবে। তিরা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে প্রস্তুত হলো। আল্লাহ জানে কপালে কী আছে। তারান্নুম বেগম তখন অফিস থেকে ফিরে টিভি দেখছেন। তিরার বাবা আসেনি এখনো। তিরার ছোট বোন তার দাদীর সাথে গ্রামের বাড়িতে গেছে। বলতে গেলে বাড়িতে এ মুহূর্তে তিরা এবং তার মা ছাড়া কেউ নেই। কুলকুল করে ঘামছে তিরা। ফোন থেকে ফেসবুক ডিলিট করে মায়ের পাশাপাশি গিয়ে বসলো।

-“আম্মু!”

-“বলো, পড়াশোনা তো ছেড়ে দিছো। লকডাউন দেখে যে এক্সাম হবে না ঐ চিন্তা বাদ দাও।”

-“একটা কথা ছিল।”

-“বলো।”

-“নিয়ন ভাইয়া আছে না? ফুপ্পির ননদের ছেলে? যার সাথে আমার ফেসবুকে কথা হয়েছিল বলেছিলাম না?”

-“হ্যাঁ, কী হয়েছে?”

-“উনি নাকি আমাকে ভালোবাসে, অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে আর পারিবারিকভাবে…”

-“মাথা খারাপ? খবরদার ওর সাথে আর কথা বলবি না তুই! বেয়াদব ছেলে কোথাকার! শোন, ওর থেকে দূরে থাকবি তুই।”

-“আচ্ছা আম্মু।”

তিরার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোতে চাচ্ছে না, অনেকটা জোর করেই সম্মতি জানিয়ে নিজের ঘরে ফিরলো তিরা। নিয়নকে জানাবে কিভাবে? ছেলেটা যদি মন খারাপ করে? কিন্তু বলতে তো হবেই। নানা কথা ভেবে তিরা নিয়নকে মেসেজ দিল।

-“আম্মুকে জানালাম।”

-“কী বলেছে আন্টি?”

-“আপনার থেকে দূরে থাকতে!”

-“তো থাকো।”

-“ইয়ার্কি পাইছেন আমাকে নিয়ে? কী দরকার ছিল এখনি আম্মুকে জানানোর? পরে বলা যেত না?”

-“আগে থেকে জেনে রাখা ভালো। তোমার আম্মু আমাকে অপছন্দ করেন, কখনো মেনে নিবেন কিনা সন্দেহ।”

-“মানবে ইনশাআল্লাহ। আমরা মানিয়েই ছাড়বো।”

কথাটা বলেই তিরার মনেই অন্যরকম যুদ্ধের বাজনা বেজে উঠলো। তার মা একবার যে কথা বলেন, তার নড়চড় হয়না। একবার যখন বলেছেন নিয়নকে তার পছন্দ না, তখন এ কথারও নড়চড় হবে না। তিরার মন অনেকটা খারাপ হয়ে আসে কিন্তু নিয়নকে আর সেসব বললো না তিরা।এমনিতেও ছেলেটা ঢাকা ফিরে যাবে, অন্তত মন খারাপ নিয়ে না ফিরুক। তিরার মাঝেমধ্যে মনে হয় নিয়নের জীবনে সে যন্ত্রণা হয়েই এসেছে। ছেলেটার জীবন বোধহয় তাকে ছাড়া বড্ড ভালোই কাটতো। এসব কথা নিয়নকে বলতে পারেনা সে। ভয় হয় প্রতিমুহূর্তে, প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার ভয়।

নিয়ন তিরাকে পছন্দ করে এ কথা তিরার নানীর কানেও গেল। তিনিও এসে তিরাকে পরামর্শ দিলেন ছেলেটার থেকে দূরে থাকতে। কারণ দিলেন দুইটা। ছেলের চুল বড়, দেখতে অভদ্র লাগে। দ্বিতীয়ত, সে নাকি আগেও একজন মেয়েকে বাড়িতে এনে বলেছিল তারা বিয়ে করেছে। তিরা সবটাই শুনলো এবং নানীর হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলালো কিন্তু তার মনে ততক্ষণে অন্য ঝড় বয়ে চলেছে। অনলাইনে এসে কী ভেবে যেন স্প্যাম চেক করছিল সে। আচমকা এক মেয়ের মেসেজ নজর কাড়লো তার। মেয়েটা একটা ছবি পাঠিয়েছে। তিরা ছবিটাতে ক্লিক করলো। নিয়ন বসে, পাশে তার হাত ধরে একটা মেয়ে বসে। নিয়নের ছবিটাতে মার্ক করা। নিচে মেয়েটা একটা মেসেজ লিখেছে,

-“আপু, তুমি যাকে ভালোবাসো, তাকে একসময় আমি পছন্দ করতাম। ভয় পেয়ো না, তোমার কোনো ক্ষতি আমি করবো না। আমায় তোমার বন্ধু ভাবতে পারো।”

মেসেজটুকু পড়ে তিরার সমস্ত পৃথিবীই যেন স্থবির হয়ে এলো। এসব কী হচ্ছে তার সাথে? তিরা অনুভব করছে তার বুকে কেউ হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছে। তিরা নিশাতকে টেক্সট করলো তৎক্ষণাৎ।

-“নিশু!”

-“বল।”

মেয়েটার টেক্সটের স্ক্রিনশট নিশাতকে দিল তিরা। নিশাত মেসেজগুলো দেখলো। তিরা এখন অবধি মেয়েটার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না।।তার মন বলছে এটাও দিয়ার মতোই কারো কাজ কিংবা নিয়নই তার কোনো বান্ধবীকে দিয়ে এমনটা করাচ্ছে।

-“তুই ভাইয়ার সাথেই কথা বল।”

-“তোর কি মনে হচ্ছে মেয়েটা সত্যি বলতেছে একটুও?”

-“না!”

-“আমারো নাহ! এখন নিয়নই বলবে সত্যিটা কী!”

তিরা স্ক্রিনশটগুলো নিয়নকে পাঠালো। নিয়ন দেখেও উত্তর দিল না। তিরা বুঝতে পারলো না নিয়ন এমন করছে কেন। তবে কি মেয়েটার কথা কোনভাবে সত্যি? মনে ভয় দানা বাঁধলো তার।

-“আপনি কিছু বলবেন না?”

-“তুমি আমায় বিশ্বাস করো?”

-“বিশ্বাস করি বলেই সরাসরি জিজ্ঞাসা করছি এসব কী। মেয়েটা আপনার সাথে ছবি তুলেছে! আপনি নিশ্চয়ই চেনেন তাকে।”

-“হ্যাঁ। ও আমার আত্মীয় হয়, চরিত্রহীন মেয়ে! ওর সাথে ঐ ছবিটা তোলা আমার লাইফের সবচেয়ে বড় ভুল। ও বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, আমি ওকে ফেরত আনতে গিয়েছিলাম শুধু। আত্মীয় হিসেবে যেটুকু সাহায্য করা উচিত আর কী! ছবি তোলার জেদটা ঐ করেছিল। আমি বুঝতে পারিনি ছবিটা এভাবে ইউজ করবে ও।”

-“এখন কী করবো আমি?”

-“ব্লক করো মেয়েটাকে।”

তিরা সাত-পাঁচ না ভেবে ব্লক করে দিল মেয়েটাকে। সব মিলিয়ে তার সম্পর্কটা এখন জলে ভাসা কচুরিপানার ন্যায়। কোনদিকে যে যাবে তা সে নিজেও জানে না। নিয়নকে আদৌ তার পরিবার কখনো মানবে? নিয়নের বাবা-মা জানে তিরার কথা। সে হিসেবে ঐদিক থেকে কোনো ঝামেলা হবে না। ঝামেলা হবে তিরার পরিবারে। কিভাবে রাজি করাবে সে নিজের পরিবারকে? প্রেম করার সময় এ চিন্তাটা মাথায় না আসলেও এখন এ ভাবনা তিরাকে ঘুমাতে দেয়না। মনুষ্য প্রবৃত্তি বড্ড অদ্ভুত। এরা সেই জিনিসের প্রতিই আকৃষ্ট হয় যা পাওয়া প্রায় অসম্ভব বললেই চলে! তিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিয়নকে সে ঠিক কী পরিমাণ ভালোবেসে ফেলেছে তা যদি সে একটু বোঝাতে পারতো কাউকে! নিয়ন কেবল একজন প্রেমিক নয়, বন্ধু হয়ে তিরার পাশে ছিল। এবার তিরা উপলব্ধি করলো কেন নিয়ন বন্ধুত্ব উপেক্ষা করে ভালোবাসা বেছে নিয়েছিল।

ভালোবাসার সুখকর মুহূর্তের সাগরে ভাসমান নিয়ন-তিরার জীবনে তখনো কোনো বড়সড় ঢেউয়ের আগমন ঘটেনি। কিন্তু ঘটতে চলেছে অতি শীঘ্রই যা তারা তখনো কল্পনা করেনি। তিরার প্রতি তারান্নুম বেগম ইদানিং সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। তিরা অবশ্য আফসোস করে কেন যে সে নিয়নের ব্যাপারটা মায়ের সামনে তুলেছিল! ঐ একটা কথাতেই মায়ের সমস্ত সন্দেহ নিজের দিকে টেনে নিয়েছে যেন তিরা। অবশেষে সেই অশুভ ক্ষণ এলো তিরার জীবনে। এগারো’ই ডিসেম্বর, তিরার প্রেমপর্বের প্রথম খারাপ দিন।

চলবে…