অপ্রিয় প্রাক্তন পর্ব-০৭

0
101

#অপ্রিয়_প্রাক্তন
৭ম_পর্ব
~মিহি

সকাল সবে সাতটা। তিরা রাস্তায় একাকী দাঁড়িয়ে, নিয়নের জন্য অপেক্ষা করছে। নানিবাড়িতে বেড়াতে এসেছিল সবার সাথে। শুক্রবার প্রাইভেট ছিল সকালে বিধায় একাই বেরিয়েছে প্রাইভেটের জন্য। নিয়ন বগুড়া এসেছে গতকাল। তিরার সাথে দেখা করার চিন্তাভাবনাটা হঠাৎই। তিরা নিষেধ করতে পারেনি, তার ইচ্ছে করেনি নিষেধ করতে। লং ডিসট্যান্স রিলেশনশীপের ছয় মাসে বড়জোর তিনবার দেখা হয়েছে তাদের। তিরা প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। নিয়নের সাতটার মধ্যে আসার কথা থাকলেও সে এখনো আসেনি। বেশ কয়েকটা গাড়ি তিরাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তিরার হাত পা কাঁপছে। নিয়নকে কল করেছিল একটু আগে। সে বললো আর পাঁচ মিনিট লাগবে। তিরা ধৈর্য ধরতে পারছে না। তার নানিবাড়ির রাস্তার মোড় এটা। এখানে হুট করে কেউ চিনে ফেললে রক্ষে নেই তার। নিয়নও আজব! জেদ করলো দেখা করবেই! তিরার বেহায়া মনটাও গলে গেল। কী আর করার! মিনিট পাঁচেকের মাথায় নিয়ন এসে তিরার পাশে দাঁড়ালো। তিরার হৃদস্পন্দন আরো বাড়লো। ভয় এবং প্রশান্তির অদ্ভুত এক যুগ্ম মিলন অনুভব করতে পারছে সে। নিয়ন একটা গাড়ি দাঁড় করালো। সি.এন.জিটাতে উঠতে নিয়ে তিরা খেয়াল করলো ড্রাইভার তার পরিচিত। তিরা সালাম দিয়ে পরিচয় জানিয়ে উঠলো সেটাতে। নিয়ন মাথায় হাত দিয়ে এ দৃশ্য দেখলো। গাড়িতে উঠে ফোন বের করলো। তিরার নজর গেল ফোনের স্ক্রিনে। নিয়ন টাইপ করছে,

-“গাধার বাচ্চা, ওনারে পরিচয় জানানোর খুব দরকার ছিল? প্রেম করা শেখান লাগতো তোরে আগে!”

তিরার মন খারাপ হলো কিয়ৎক্ষণের জন্য। পরক্ষণেই আবার সব ভুলে নিয়নের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। ছেলেটাকে কতদিন পর দেখছে! ইচ্ছে করছে দু’গালে হাত রেখে নাকে নাক ঘষতে। ইচ্ছেটাকে দমিয়ে নিয়নের চোখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলো তিরা। নিয়ন আবারো ফোনে টাইপ করলো,

-“আমি জানি তোমার এখন আমাকে কিস করতে মন চাইতেছে বাট কন্ট্রোল করো।”

তিরা হেসে ফেলল। এই ছেলেটা এমন কেন? একটু শান্তিতে তার দিকে তাকানোও যাবে না? নিয়ন তিরার কোল থেকে তার ব্যাগটা নিল। নিজের ব্যাগ থেকে তিরার ব্যাগে একটা বই ঢুকালো। তিরা বইটা চিনতে পারলো। এই বইটা কেনার তার খুব ইচ্ছে ছিল। নিয়নকে বলেছিল বইটা সে কিনবে। নিয়ন সেটাই গিফট করলো তাকে। তিরা অবশ্য নিয়নকে বলেছিল বইটা যেন আগে সে পড়ে তারপর তিরাকে দেয়। নিয়ন ‘মাফ এবং দোয়া’ চেয়ে প্রস্থান করেছে। বই পড়ার ধৈর্য তার নেই। তিরার অদ্ভুত লাগে। মানুষ কেন যেন বিপরীতধর্মী মানুষের প্রতিই আকৃষ্ট হয়। তিরার বই পড়তে ভালো লাগে, নিয়ন বই পড়তে পছন্দ করে না। নিয়ন টেকনোলজি নিয়ে দিনরাত কথা বলতে পারে, তিরার সেসব বিরক্ত লাগে। দুই মেরুর এই দুই মানুষ কী অদ্ভুতভাবে যে মিলে গেল ভাবতেও অবাক লাগে তিরার!

-“কী ভাবছেন জান?” নিয়ন ফিসফিস করে বলে উঠলো।

-“কিছু না।”

-“হাতটা দাও তো!”

বলেই নিজেই তিরার হাতটা নিজের মুঠোয় নিল নিয়ন। তিরা কিঞ্চিত কেঁপে উঠলো। আগেরবার এত শক্ত করে হাতটা ধরেনি নিয়ন। নিয়ন পকেট থেকে একটা রিং বের করলো। তিরার কোন আঙুলে পড়াবে বুঝতে পারলো না। বৃদ্ধাঙ্গুলে পড়ালেও আংটি খুলে পড়বে এতটাই চিকন তিরার হাত। শেষমেশ উপায় না পেয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলেই আংটি পড়ালো নিয়ন।

-“খেয়েদেয়ে একটু মোটা হ যাতে বিয়ের আগে আংটিটা ফিট হয়। বুঝছিস?”

-“হুহ!”

-“আচ্ছা শোনো, এই আংটিটা আমার কাছে ২০১০ সাল থেকে আছে। অনেক বেশি যত্নে রেখেছি। দেখতে খুব সিম্পল এটা, দাম হয়তো পঞ্চাশও না! বুঝতেই পারতেছো সেটা কিন্তু এই আংটিটার সাথে আমি দশ বছর অতিবাহিত করেছি। সেটা আমি তোমায় পড়িয়ে আজ এটা জানিয়ে রাখলাম যে এই আংটিটাকে দশ বছর যতটা যত্ন আমি করেছি, তার দশগুণ যত্নে তোমায় রাখবো।” ফিসফিস করেই কথাটুকু তিরার কানের কাছে বললো নিয়ন।

তিরার চোখ অশ্রুসজল হয়ে এসেছে। শীতের সময় এমনিতেও। সারা শরীরে চাদর জড়ানো তবুও এক শীতল হাওয়া যেন ক্ষণে ক্ষণে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। তিরার এক হাত এখনো নিয়নের হাতের মাঝে আবদ্ধ। তিরা অপর হাত দিয়ে চাদরটা আষ্টেপৃষ্টে গায়ে জড়িয়ে নেয়।

-“ঠাণ্ডা লাগছে? জ্যাকেট নিবা আমারটা?”

নিয়নের বলা এই ছোট্ট বাক্যটাও বিশাল মনে হয় তিরার। এই ছোট ছোট কেয়ারগুলো তাকে নিশ্চয়তা দেয় যে নিয়ন তাকে কখনো ছেড়ে যাবে না। পরিস্থিতি যেমনই হোক, তারা পাশাপাশি থাকবেই। নিয়ন তিরার হাতটা খুব সন্তর্পণে নিজের বুকের বা পাশে নিয়ে যায়। কোলের উপর থাকা ব্যাগটা বুক অবধি আড়াল করে ঢেকে নেওয়ায় কারো নজরে আসে না বিষয়টা। তিরা নিয়নের বুকের বা পাশে অল্পক্ষণ হাত রাখে। অনুভব করে হৃদস্পন্দনের ঊর্ধ্বগতি। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিরা। তার নামার সময় এসেছে। নিয়নকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। এই আধঘণ্টা সময়টুকু সে বোধহয় কখনো ভুলতে পারবে না। এই রাস্তাটুকুর স্মৃতিই তার মনে দাগ কেটে রবে। লজ্জারাঙা মুখখানি আড়াল করে ড্রাইভারকে টাকা দিয়ে নামলো তিরা। নিয়নের দিকে আর তাকালো না ড্রাইভারের সন্দেহ হবে ভেবে।

প্রাইভেট শেষ করতে করতে সকাল দশটা বাজলো। তিরার বাবা-মা, বোন আসবে বিকালে। তিরা প্রাইভেট শেষ করে বাড়িতে ফিরে নিজের জন্য ভাত চড়িয়ে ডিম ভাজলো। এর মধ্যেই নিয়নের কল এলো একবার। রিসিভ করে কানে ধরলো তিরা।

-“হুম বলেন।”

-“ড্রাইভারটা জিজ্ঞাসা করেছিল আমি তোমার কে। বললাম খালাতো ভাই। ঝামেলা করবে নাকি?”

-“উনি আমার নানিবাড়ির এলাকার লোক। জানিনা কিছু করবে কিনা।”

-“ভয় পেয়ো না। আমি রাস্তায় আছি এখনো। বাসায় ফিরে কল করবো তোমাকে।”

-“আচ্ছা!”

তিরা ফোন রেখে রান্নায় মনোযোগ দিল। এরই মধ্যে কলিং বেল বেজে উঠলো। তিরা বুঝতে পারলো না এ অসময়ে কে আসলো। মশলামাখা হাত নিয়েই দরজা খুলতে উদ্যত হলো তিরা। দরজা খুলে যারপরনাই অবাক হলো। তার বাবা-মা এবং ছোট বোন দাঁড়িয়ে।

-“তোমাদের তো বিকালে আসার কথা।”

-“এখন আসাতে তোমার সমস্যা হচ্ছে?” মায়ের কথায় ঢোক গিলল তিরা।

তারান্নুম বেগম কিছু না বলেই ভেতরে ডুকলেন। পেছন পেছন তিরার বাবা আশফাক আলম তার ছোন বোন তন্বীকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। তিরা রান্নাঘরে খাবার ঠিকঠাক করতে গেল। এরই মধ্যে আশফাক আলম প্রশ্নবাণ ছুঁড়লেন।

-“প্রাইভেটে যাওয়ার সময় চেনা কেউ ছিল গাড়িতে?”

তিরার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। আচমকা এমন প্রশ্ন কেন করছে তার বাবা? কোনো সমস্যা হলো না তো? তিরা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো।

-“হ্যাঁ, ফুপ্পির ননদের ছেলে ছিল।”

-“ওহ!”

আশফাক আলম আর কিছু বললেন না। তিরা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে ফোন খুঁজতে লাগলো। নিয়নকে বলতে হবে যেন কল না করে। বাড়ির পরিস্থিতি মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না তার। যেকোন সময় যেকোন ঝড় উঠতে পারে। এরই মধ্যে তারান্নুম বেগম তাকে ছাদে ডেকে পাঠালেন। তিরার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। ক্ষীণপ্রাণ নিয়ে ছাদে এসে দাঁড়ালো সে। তারান্নুম বেগম বেশ শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন।

-“নিয়নকে কেন ডেকেছিস তুই?”

-“আ..আমি ডাকিনি মা। আমি জানিনা উনি কী করে এলেন ওখানে!”

-“অন্ধকে হাইকোর্ট দেখাও? ফাজলামি পাইছো? ঐ কিভাবে জানলো তুমি তখন ওখানে?”

-“উনি আমায় ফলো করে মা। উনি আগেও বলেছে এই কথা!”

-“এক থাপ্পড় দিয়ে দাঁত সবগুলো ফেলে দিব। আমার সাথে ফাজলামি করতেছো? ঐ ছেলের থেকে দূরে থাকতে বলছিলাম না? খুব ডানা গজাইছে?”

তিরার চোখ দিয়ে অশ্রুবর্ষণ হতে লাগলো ক্রমাগত। কী বলবে বুঝতে পারছে না সে।

-“তোমার প্রেমিককে কল দিয়েছিল তোমার ফুপ্পি। সে কী বলেছে জানো? তুমি না ডাকলে সে সেখানে কিভাবে গেল? তুমিই নাকি ডেকেছো তাকে! এবার বলো কী বলবে।”

তারান্নুম বেগমের কথায় তিরার সমস্ত পৃথিবীই থমকে গেল। নিয়ন তাকেই দোষ দিল? একবারও বুঝলো না তিরার পরিবারে কী অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে তার এ কাজে? তিরার ভয় আরো বাড়লো কারণ তার ফোনটাও তার কাছে নেই। ওটা তারান্নুম বেগমের হাতে পড়লে আজ তিরার মৃত্যু নিশ্চিত। তিরা ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেল ক্ষণিকের মাঝেই।

চলবে…