অপ্রিয় প্রাক্তন পর্ব-০৮

0
113

#অপ্রিয়_প্রাক্তন
৮ম_পর্ব
~মিহি

তারান্নুম বেগমের কথায় তিরার সমস্ত পৃথিবীই থমকে গেল। নিয়ন তাকেই দোষ দিল? একবারও বুঝলো না তিরার পরিবারে কী অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে তার এ কাজে? তিরার ভয় আরো বাড়লো কারণ তার ফোনটাও তার কাছে নেই। ওটা তারান্নুম বেগমের হাতে পড়লে আজ তিরার মৃত্যু নিশ্চিত। তিরা ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেল ক্ষণিকের মাঝেই।

তারান্নুম বেগম নিচে নেমে গেলেন। তিরা এতক্ষণ অশ্রু আটকে রাখলেও এবার নিজেকে সামলাতে পারলো না। প্রচণ্ড কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। পরক্ষণেই নিজেকে প্রস্তুত করলো, ফোন থেকে সব মেসেজ ডিলিট করতে হবে নাহলে আরো বিপদ বাড়বে। তিরা চটজলদি নিচে নেমে ফোনটা খুঁজতে লাগলো। কী ভেবে যেন ওয়ারড্রোবে খুঁজতেই ফোনটা পেল। কাঁপা হাতে ফোন অন করে কললিস্ট থেকে নিয়নের নম্বরটা ডিলিট করে হোয়াটসঅ্যাপ আনইনস্টল করলো সে। নিয়নকে কিভাবে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না তিরা। তৎক্ষণাৎ মনে হলো নিয়ন যদি সত্যিই তিরার সম্পর্কে এসব বলে থাকে তবে এসব নিয়ে তার বন্ধুর সাথে নিশ্চয়ই কথা বলেছে। নিয়নের আইডি লগইন করতে গিয়ে দেখল পাসওয়ার্ড ইনকারেক্ট। তিরার পৃথিবী সত্যিই থেমে গেল এবার। নিয়নের নামে শোনা কথাগুলোই তবে সত্যি! তিরা কেন বিশ্বাস করেনি এতদিন? নিয়নকে শেষবারের মতো টেক্সট করলো তিরা।

-“আপনি আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না।”

মেসেজটা দিয়েই তিরা নিজের ফেসবুক আইডি পার্মানেন্টলি ডিলিট করে দিল। এখনো ষাট দিন লাগবে ডিলিট হতে, এসব বিষয় কোনভাবে তারান্নুম বেগমকে বোঝানো যাবে। তিরা ফোনটা রেখে বাইরে এলো। বাড়ির পরিবেশ এখনো থমথমে। কখন কোন ঝড় উঠবে বলা যাচ্ছে না। তিরা নিয়নের দেওয়া আংটিটা ব্যাগে রেখেছে। নিয়নের গিফট করা বইটাও ব্যাগে। তারান্নুম বেগম তার ব্যাগ চেক করলে আরেক বিপদ! তিরার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসলো। এ মুহূর্তে কাউকে জানানোর মতো পরিস্থিতিও নেই। এর মধ্যে তারান্নুম বেগম ডাকলো তাকে। স্তিমিত হৃদস্পন্দন নিয়ে তার মুখোমুখি হলো তিরা।

-“নিশাত কল করেছে। রিসিভ করো।”

তিরা কল রিসিভ করে কানে ধরলো। নিশাত কেন কল করেছে আন্দাজ করার চেষ্টা করলো তিরা।

-“এই তীর, কিছু হয়েছে?”

-“হুম।”

-“বাড়িতে জানতে পেরেছে?”

-“হুম।”

-“ঝামেলা হচ্ছে?”

-“সম্ভাবনা আছে!”

-“ভাইয়া কল করছিল। তোকে নিষেধ করছে টেনশন করতে। তুই প্যারা নেস না।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে।”

তিরা কল কেটে দিল। তারান্নুম বেগম তিরার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তিরা আসন্ন ঝড়ের আভাস পেল।

-“তোমার ফোনটা আনো তো।”

-“এই যে।”

তারান্নুম বেগম তিরার ফোন নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলেন। ফেসবুকে ঢোকা যাচ্ছে না। তিনি তিরাকে বললেন পাসওয়ার্ড বলতে। তিরা আগেকার পাসওয়ার্ড বললো। পাসওয়ার্ড ইনকারেক্ট দেখাচ্ছে।

-“পাসওয়ার্ড ঠিক করো বলো।”

-“এ..এটাই ছিল। নি…নিশাতের কাছে ছিল, ও বোধহয় চেঞ্জ করছে।”

-“আচ্ছা, নিশাতকে কল করো।”

তিরার ভয় বাড়লো। নিশাতকে আইডির কাহিনী তো বলেনি তিরা। ভয়ে ভয়ে নিশাতের নম্বরে কল করলো তিরা। তারান্নুম বেগম কল লাউড স্পিকারে রাখলেন। নিশাত কল রিসিভ করলো।

-“নিশাত, আমি তিরার মা। তুমি কি তিরার আইডির পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করছো?”

-“পাসওয়ার্ড! আগেরটাই তো ছিল আন্টি, এরপর তো আমি ঢুকিনি ওটাতে।”

-“আচ্ছা মা রাখো।”

তিরা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। পরবর্তী প্রশ্নটা যে তার দিকেই ছুটে আসতে চলেছে তা বোঝার বাকি নেই তার।

-“নিশাত কী বলেছে শুনতে পেয়েছো?”

-“সম্ভবত নিয়ন ভাইয়া চেঞ্জ করেছে। উনি আমাকে ই-মেইল আইডি খুলে দিছিলেন।”

-“তুমি ইয়ার্কি করতেছো আমার সাথে? মানুষের অভাব ছিল যে ওর থেকে তোমার ই-মেইল আইডি খুলে নিতে হয়েছে? তুমি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।”

তিরার চোখ শুষ্ক হয়ে এলো। সত্যিই তার কিছু বলার নেই এখন। বাবা-মায়ের বিশ্বাসকে খুব খারাপভাবে ভেঙেছে সে। তিরা বোধহয় কখনো এই বিশ্বাসটা আর অর্জন করতে পারবে না। ফোনটা রেখে তিরা চুপচাপ নিজের ঘরে ফিরলো। ব্যাগ থেকে নিয়নের দেওয়া বইটা চুপচাপ মায়ের পাশে রেখে আসলো। তারান্নুম বেগম দেখলেন কিন্তু কিছু বললেন না। রাতে জুম ক্লাস ছিল তিরার। সেটুকু সময় ফোন দেওয়া হলো তাকে। তিরা জুমে লগ-ইন করে ক্লাস ব্যাকগ্রাউন্ডে চালিয়ে ফেসবুকে লগ-ইন করলো। নিয়নকে টেক্সট করলো।

-“আপনি আমার সাথে এমন না করলেও পারতেন!”

-“তিরা, আমি কিছু করিনি। তুমি দয়া করে ভুল বুঝো না আমায়।”

-“আপনি কিছুই করেননি? ওহ হ্যাঁ তাই তো, আমিই তো আপনাকে ডেকেছিলাম। জোর করে আসতে বলেছিলাম। সব তো আমিই করেছি। এসবই তো বলেছেন ফুপ্পিকে?”

-“মাথা খারাপ? আমি মামীকে এসব কেন বলতে যাবো? মামীর সাথে আমার কথাই হয়নি! মামী আব্বুকে কল করেছিল, আমার সাথে মামীর কোনো কথাই হয়নি যখন তখন এসব বলা তো দূর। মামী এসব কেন বলছে? তিরা, বিশ্বাস করো এটা মামী ইচ্ছে করে করেছে।”

-“আমার মা তো তা-ই মানে। সত্যি তো সেটাই যেটা তিনি শুনেছে।”

-“আন্টির নম্বর দাও, আমি কথা বলি।”

তিরা খানিকটা চমকালো। নিয়নকে নম্বর দিল। সে দেখতে চায় নিয়ন কী করে। তিরা আবারো ফেসবুক ডিলিট করে দিল। ক্লাস শেষ হয়েছে ততক্ষণে। তিরার কানে আসলো ফোনের রিংটোনের আওয়াজ। তারান্নুম বেগমের ফোন বাজছে। তিরা ওয়াশরুমে ঢুকলো। বুক কাঁপছে তার। নিয়ন সত্যিই কল করেছে! তিরা ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলো না। সে চুপচাপ ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে কথা শোনার চেষ্টা করতে লাগলো। সাউন্ড বেশি দেওয়ায় কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেল সে।

-“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

-“ওয়ালাইকুম সালাম। কে?”

-“আন্টি আমি নিয়ন।”

-“আমার নম্বর কোথায় পেয়েছো?”

-“আন্টি, আমি টেকনোলজি নিয়েই থাকি চব্বিশ ঘণ্টা। আপনার নম্বর খুঁজে বের করা আমার জন্য কঠিন কিছু না। আমার কথাটা প্লিজ শুনুন আপনি আগে।”

-“বলো।”

-“আন্টি আমাদের দেখা হওয়াটা জাস্ট একটা অ্যাক্সিডেন্ট। হঠাৎ দেখা হয়েছিল, তাই খোঁজ নিয়েছিলাম।”

-“আচ্ছা।”

-“আন্টি প্লিজ ভুল বুঝিয়েন না আমাদের। আমার সাথে ওর কোনোরকম সম্পর্কই নাই। আমি মামীকেও কিছু বলিনি এসব নিয়ে। আপনারা দয়া করে তিরার উপর কোনো প্রেশার দিয়েন না আন্টি।”

-“দেখো ও তোমার বোনের মতো, ওকে সেরকমই ভাবো। দয়া করে অন্য কোনো সম্পর্ক নিয়ে ভেবো না।”

-“আচ্ছা আন্টি, আমি এখন এসব নিয়ে ভাববো না।”

তারান্নুম বেগম কল কাটলেন। তিরাও ওয়াশরুম থেকে বেরোলো। অনেকটা না জানার ভান করে প্রশ্ন করলো,

-“কে কল করেছিল মা?”

-“ভূত! ভুতুড়ে আলাপ করলো!”

-“মা, সত্যি কথা ভুতুড়ে আলাপ হয়না। আমরা দুইজনই বলতেছি আমাদের মধ্যে কিছু নাই। তুমি আর তোমার ননদ মিলে যা তা বানাইতেছো ক্যান? ভাইয়া যদি ফুপ্পিকে ঐসব বলে থাকতো তাহলে এখন তোমাকে কল করে এসব কেন বললো?”

-“আমাকে গাধা মনে হয়? তোমাদের এসব প্ল্যান আমি বুঝিনা?”

-“মা! তুমি আর তোমার ননদ আমাকে কেন বিশ্বাস করছো না? এতটা খারাপ কেন মনে হয় আমাকে? কখনো কোনোকিছু নিয়ে তো এতটা বাড়াবাড়ি করিনি তবে এখন কেন এত অবিশ্বাস আমার প্রতি?”

-“চুপচাপ ঘুমোতে যাও। তোমার বাবা বাইরেই আছেন। আমি চাইনা এসব নতুন করে তার কানে যাক।”

-“কারো কানে যাওয়ার বাকি রেখেছো? বংশশুদ্ধ বলে রাখো আরো, আমায় তো মানুষই ভাবো না তোমরা। তোমাদের হাতের পুতুল আমি,।যেভাবে ইচ্ছে নাচাবে আমায়!”

তিরার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় বসালেন তারান্নুম বেগম। অনেক সহ্য করেছেন। মেয়েটার মুখ কাঁচির মতো চলছে। এটাকে থামানো আবশ্যক ছিল। তিরা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। মায়ের মাঝে আজ সে অসম্ভব নির্দয় একজন মহিলার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পারছে। অতএব নিয়নের সাথে এ সম্পর্কের পরিণতি কখনোই সরলগতিতে চলবে না তা স্পষ্টরূপে বুঝলো তিরা।

চলবে…