#অপ্রিয়_প্রাক্তন
৯ম_পর্ব
~মিহি
তিরার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় বসালেন তারান্নুম বেগম। অনেক সহ্য করেছেন। মেয়েটার মুখ কাঁচির মতো চলছে। এটাকে থামানো আবশ্যক ছিল। তিরা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। মায়ের মাঝে আজ সে অসম্ভব নির্দয় একজন মহিলার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পারছে। অতএব নিয়নের সাথে এ সম্পর্কের পরিণতি কখনোই সরলগতিতে চলবে স্পষ্টরূপে বুঝলো তিরা।
তিরার ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হলো। কেবল সকাল আর রাতের বেলা ক্লাসের সময় ফোন হাতে পায়। সেটুকু সময়ই নিয়নের সাথে কথা হয় তাও মাঝে মাঝে মা আসলে সেটাও ভেস্তে যায়। এ সময়টা তিরার বেশ ভয়ে ভয়ে কাটছে। দরজা লাগানোর অনুমতি নেই তার, নিয়নের কণ্ঠ শোনেনা কতদিন! ছেলেটাকে দেখার জন্য মন চাতক পাখির মতো ছটফট করছে। তিরার অবস্থাও ভালো নেই। বাড়িতে বাবা-মা ঠিকমতো কথা বলে না। তিরার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছা করে। চোখমুখ শুকিয়েছে তার, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। এ বাড়িতে কান্নার অনুমতিও নেই। তিরার চোখ ভেজা দেখলেই তারান্নুম বেগমের মাথায় রাগ চড়ে বসে। আজকেও তিরা কান্না করেছে। নিয়নকে নিয়ে তার ভবিষ্যৎ কতটা অনিশ্চিত এটা ভেবে নিজেকে আটকে রাখতে পারছিল না তিরা। তারান্নুম বেগম অফিস থেকে ফেরার আগেই চোখমুখ মুছল ভালোমতো। তাতে বিশেষ লাভ হলো না। তিরার কণ্ঠস্বর অনেকখানি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তারান্নুম বেগম অফিস থেকে ফিরেই তিরার দিকে আড়চোখে তাকালেন।
-“চোখ লাল কেন?”
-“ঐতো তরকারি বেশি নিয়েছিলাম, ঝাল লেগেছে তাই।”
-“ওহ….ঐ ছেলের জন্য কান্নাকাটি করা বাদ দাও। চুপচাপ ভুলে যাও ওকে।”
-“আমি কিছু ভেবেই কান্নাকাটি করিনি, ঝাল লেগেছে আমার।”
-“আমাকে এসব শিখাতে আসিও না! তোমাকে কি চিনিনা আমি? এক সপ্তাহ হয়ে গেছে, তারপরেও ঐ ছেলের জন্য মন আনচান করতেছে? এত আহ্লাদ কোত্থেকে আসে?”
তারান্নুম বেগমের কথার মাঝখানেই তিরার বাবা আশফাক আলম এলেন। তারান্নুম বেগমের চেঁচামেচিতে তিনি ইতোমধ্যে ঘটনা বুঝতে পেরেছেন।
-“তিরার হয়তো সত্যি ঝাল লেগেছে, অযথা ওকে দোষারোপ করা বন্ধ করো!”
-“তোমার মেয়েকে আমি কি কম চিনি? আমি জানি ওর মনে কী চলছে। তিরা যাও, ক্লাস আছে সেটা করো।”
তিরা ফোন হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। তার আবার কান্না করতে ইচ্ছে করছে। তারান্নুম বেগম কি কখনোই আর বিশ্বাস করতে পারবে না তাকে? নিয়নের ব্যাপারটা এখন কি একটু ভুললে হয়না?
তিরা যা ভেবেছিল, হলো তার বিপরীত। সে চেয়েছিল সবাই নিয়নের ব্যাপারটা ভুলে যাক অথচ তার পরেরদিনই তিরার ফুপ্পি এবং দাদী এলেন নিয়নের ব্যাপার নিয়ে আরো জল ঘোলা করতে। তিরাকে কাঠগড়ায় তুললেন আবারো।
-“দেখ তিরা, ছেলে ভালো হলে আমিই বিয়ে পড়িয়ে রাখতাম এখনি কিন্তু ঐ ছেলের সাথে তোর সম্পর্ক মানার মতোই না! বিয়ের দিন দেখলি না সবাই ওকে কত কথা শোনালো! ওর বাবা মা যথেষ্ট ভালো কিন্তু সে? ছেলেই যদি ভালো না হয়, তবে কেমনে কী হবে বল!” আঞ্জুমান আরা বিজ্ঞের স্বরে বোঝাতে লাগলেন।
-“তিরা, তুমি যথেষ্ট বুঝদার! এই ছেলের থেকে দূরে থাকাই তোমার মঙ্গলের। ঐ ছেলের চুলটাও তো জাতের না! কেমন নেশাখোরদের মতো বড় বড় চুল!” তিরার দাদী আঞ্জুমান আরার কথার সাথে নিজ মন্তব্য যোগ করলেন।
তিরা তাদের এই আলাপচারিতা শুনে গেল কেবল। অপরদিকে নিয়ন প্রতিমুহূর্তে তার জন্য ভেঙে পড়ছে। তিরার কিছুই ভালো লাগছে না। সময় এত ধীরে যাচ্ছে কেন কে জানে!
সেদিন বিকালে নিশাত এলো তিরার সাথে দেখা করতে। তিরা যেন ইদের চাঁদ হাতে পেল তবে তিরার অবস্থা দেখে নিশাত বিমর্ষ হয়ে পড়লো। তিরাকে এতটা ভেঙে পড়তে কখনো দেখেনি সে। তিরা নিশাতকে নিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলো। তিরার বাড়ির দোতলায় একটা কাঠের সিঁড়ি আছে যেটা দিয়ে তিনতলার ছাদে উঠা হয়। তিনতলায় ছোটখাটো একটা বাগান করা আছে, সেখানে কেউ থাকে না। তিরা নিশাতকে নিয়ে সেখানেই দাঁড়ালো।
-“তোর এই অবস্থা কেন? তোকে না ভাইয়া নিষেধ করছে টেনশন করতে?”
-“তোর ভাইয়াকে কল কর তো।”
-“নে ফোন, তুই কল কর!”
তিরা ফোন হাতে নিয়ে চটজলদি নিয়নকে ভিডিও কল করলো। নিচে তার দাদী এবং ফুপ্পি আছে। কেউ জানার আগেই নিয়নের সাথে কথা বলতে হবে। নিয়ন কল রিসিভ করলো। নিয়নের চোখ লাল, অনেকখানি শুকিয়েছে সেও। তিরার মন খারাপ হয়ে এলো।
-“আসসালামু আলাইকুম।”
-“এত শুকাইছিস কেন তুই? আমার শাশুড়ি কি ভাত দেওয়াও অফ করে দিছে?”
-“না! আপনি নিজেই তো শুকাইছেন।”
-“প্রচণ্ড মিস করতেছি তোকে। বগুড়ায় থাকতেও বিরক্ত লাগতেছে। তোর ফুপ্পিকে পাইলে আমি মার্ডার করবো বিশ্বাস কর। ঐ ভদ্রমহিলা আমার বাবাকে কল দিয়ে বলছে মানলাম কিন্তু ওনার নিজের পাড়াসুদ্ধ বলে বেড়ানোর দরকার ছিল তোর কথা? তোর তো ফুপ্পি হয়, বোঝেনা কোনটা তার ভাতিজির জন্য অসম্মানের?”
-“মানে?”
-“মানে আর কী, বলে বেড়াইছে যে তুই আমার সাথে দেখা করছিস। সেটা নিয়ে ঝামেলা চলতেছে। ঐ মহিলা আর কোনদিন আমার কাছে যথাযথ সম্মান পাবে না, যে নিজের কাছের মানুষদেরই সম্মান করতে জানেনা তাকে নিয়নও সম্মান দেয় না।”
-“বাদ দেন ঐসব কথা।”
-“দিলাম।”
-“আম্মু আপনার দেওয়া বই ফেরত পাঠাইছে।”
-“আংটিটা যদি ফেরত আসে তাহলে তোর খবর আছে।”
-“আমি আংটিটা খুঁজে পাচ্ছি না নিয়ন। আ’ম স্যরি! আমি অনেক খোঁজার চেষ্টা করছি কিন্তু আমি বুঝতেছি না আংটিটা কোথায় গেল। আমি সত্যিই …”
-“চুপ! এত প্যারা নেও কেন বউ? হারাইছে হারাক, তুমি থাকলেই চলবে আমার।”
-“তাও আমার খারাপ লাগতেছে খুব।”
-“আমারো। আপনাকে দেখার জন্য গিয়েছিলাম যেদিন ঝামেলা হলো। জানালাই খুললেন না!”
-“মানে?”
-“এগারোই ডিসেম্বর আপনার রুমের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম তিন ঘণ্টা। নিশাত আপুকে বলেছিলাম জানালা খুলতে বলতে।”
তিরা নিশাতের দিকে তাকালো। নিশাত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তিরা মাথায় হাত দিল। এই লোকটা আস্ত পাগল! ঐদিন এত ঝামেলা হলো, সেদিন কিনা এই লোকটা তার জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। ভাগ্যিস কেউ দেখেনি নাহলে আরো বিপদ হতো তাদের।
-“আপনি আস্ত একটা পাগল!”
-“হুম, তুই ডাক্তার হয়ে চিকিৎসা করিস!”
তিরা হাসলো। এই লোকের কথা অদ্ভুত, এই আপনি, এই তুমি আবার হঠাৎ তুই, কখন কী বলে ডাকে ঠিক নেই তবে ‘তুই’ ডাকটা ভালো লাগে তিরার। নিজেকে আপন আপন মনে হয়।
-“এই তিরা, স্যরি! একটা ভুল করে ফেলেছি।”
-“কী?”
-“প্রমিজ করেছিলাম সিগারেট খাবোনা আর কিন্তু …”
-“কয়টা খেয়েছেন?”
-“অনেকগুলো।”
-“ঠিকই আছে, প্রেমিকার সাথে বিচ্ছেদ হওয়া হওয়া ভাব! সিগারেট তো খেতেই হবে।”
-“আরে রাগ কোরো না সোনা প্লিজ। আমি খুব টেন্সড ছিলাম। আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলাম সত্যি।”
-“আপনি ঢাকায় ফিরবেন কবে?”
-“আজ রাতেই।”
-“ঢাকায় ফিরে সিগারেট খেতে খেতে ফটোশ্যুট করবেন এবং ছবিগুলো আমাকে পাঠাবেন।”
-“মানে কী? তুমি এখনো রেগে আছো?”
-“আরে নাহ! আমি সিরিয়াস। আমি দেখতে চাই আপনাকে সিগারেট খাওয়ার সময় কেমন লাগে দেখতে। একটা কালো রঙের শার্ট পড়বেন, বড় চুলগুলো মোরগ ঝুঁটি করবেন আর সুন্দর করে সিগারেট খেতে খেতে ছবি তুলবেন।”
-“মাথা গেছে তোমার!”
-“না। যা বলছি করবেন, এখন আমি আসি। আপনার মামী আসছে বাসায়। বেশি কথা বলা যাবেনা। টাটা।”
-“যাও আল্লাহ হাফেজ!”
তিরা কল কেটে দিল। ঠোঁটে অনেকদিন পর হাসি ঝুলছে। নিশাত তা দেখে হালকা কাশির অভিনয় করলো।
-“নিশু! অমন করে তাকাস কেন?”
-“তোমাদেরই দিন ভাই! আজ সিঙ্গেল বলে!”
তিরা মুচকি হাসলো। আজ নিয়ন ঢাকা চলে যাবে। তার মানে দেখা সাক্ষাৎ হবেনা। তিরা নিজের গালে নিজেই আলতো করে চড় মেরে মনে মনে ‘তওবা’ পড়লো। একবার দেখা করতে গিয়েই যে যুদ্ধ বেঁধেছে, দ্বিতীয়বার দেখা করতে গেলে কোন তাণ্ডব বাঁধবে আল্লাহ মালুম!
চলবে…