অপ্রিয় প্রাক্তন পর্ব -১০

0
116

#অপ্রিয়_প্রাক্তন
১০ম_পর্ব
~মিহি

-“ভালোই উঠছে ছবি। সিগারেট খেতে দেখতে ভালোই লাগে আপনাকে।”

-“খোঁচা মারতেছো?”

-“আরে নাহ!”

তিরা মুচকি হাসলো। কলিং বেল বাজলো তৎক্ষণাৎ। তারান্নুম বেগম এসেছেন বোধহয়। তিরা চটজলদি ফোনটা রাখলো। ফোন এখন তার কাছেই থাকে তবুও সে চেষ্টা করে সেফ জোনে থাকার। তারান্নুম বেগম একবার সন্দেহ করলে তার আর রক্ষে নেই। দরজা খুলে ঘরে এসে বসলো তিরা। আশফাক আলম এখনো আসেননি। তারান্নুম বেগম ফ্রেশ হয়ে টিভি দেখছেন। তিরার আচমকা মনে পড়লো আজ ‘রকস্টার’ মুভি দিবে টিভিতে। তিরা এই মুভিটা খুব পছন্দ করে। মায়ের থেকে রিমোট নিয়ে মুভিতে দিল সে। রনবীর কাপুরকে দেখেই তারান্নুম বেগম নাক শিটকালেন।

-“এসব কী যা তা! ফালতু চুল! চ্যানেল পাল্টা। ছেলে মানুষ এমন বড় চুল রাখবে কেন আজব! বিশ্রি লাগে দেখতে। বাদ দে এইটা।”

-“আচ্ছা তুমিই দেখো।”

তিরা মন খারাপ করে রিমোট রেখে চলে গেল। চুলের বিষয়টা তার বড্ড বিরক্ত লেগেছে। তারান্নুম বেগম খোঁটাটা যেন নিয়নকেই দিলেন। তিরার প্রচণ্ড মন খারাপ হলো। নিয়নের চুল নিয়েই কেন যেন তাকে সবার কথা শুনতে হয়। তিরার খানিকটা রাগও হলো। রাগের মাথাতেই নিয়নকে টেক্সট করলো সে।

-“আপনি চুল কেটে ফেলেন তো। আপনার বড় চুল নিয়ে সবাই এমন করে! চুল ছোট করলে কী সমস্যা আপনার?”

-“তিরা কী হয়েছে? মাথা ঠাণ্ডা করো আগে।”

-“আপনি চুল কাটাবেন ব্যস!”

তিরা আর কিছু না বলেই অফলাইনে গেল। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তার। আজ বছরের শেষ দিন অথচ সে নিয়নের সাথে এতোটা রাগারাগি করলো। একটু পর তিরার রাগ কমলো। রাত তখন দশটা। তিরার প্রচণ্ড খারাপ লাগছে নিয়নের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। তিরা তৎক্ষণাৎ অনলাইনে গেল। নিয়নকে ‘স্যরি’ মেসেজ দিল।

-“স্যরি কেন? শান্ত হয়েছে মন?”

-“হুম। আপনাকে বড় চুলেই ভালো লাগে, আমি রাগের মাথায় বলেছিলাম চুল কাটতে। স্যরি।”

নিয়ন তিরাকে একটা ছবি সেন্ড করলো। তিরা ছবিটা দেখে যারপরনাই অবাক হলো। সেলুনের আয়নাতে তোলা মিরর সেলফি। নিয়ন চুল কেটেছে! এই রাতের বেলা তিরার কথা শুনে সে চুল কাটাতে গিয়েছিল! তিরার একবার মনে হলো নিয়ন বুঝি রাগ করে করেছে এসব।

-“আমি স্যরি নিয়ন। আমি সত্যিই রাগের মাথায় বলেছিলাম। আপনি কেন চুল…”

-“শশশ! চুপ, চুল বড় রেখেছিলাম বাবার ইচ্ছেতে, একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সে সময় অনেক আগেই পেরিয়েছে। এখন চুল কাটাতে কোনো সমস্যা নেই। আমি মোটেও তোমার উপর রাগ করিনি।”

-“সুন্দর লাগতেছে চুল কাটায়ে। আন্টি-আঙ্কেলকে ভিডিও কল করেন।”

-“আম্মা দেখলে তো অজ্ঞান হয়ে যাবে। আচ্ছা শোন তুই খেয়ে নিস। আমি এখনো বাইরে। বাসায় ফিরতে লেট হবে। তুই ঘুমিয়ে পড়িস, আমি বাসায় পৌঁছে একটা টেক্সট দিয়ে রাখবোনি।”

-“আচ্ছা। শুভ রাত্রি, “তিরা ড্রিমস”।

-“এটা আবার কী?”

-“সুইট ড্রিমস বলে সবাই কিন্তু আপনার স্বপ্নে তো আমি আসবো তাই তিরা ড্রিমস!”

-“আচ্ছা? ওকে, হ্যাভ নিয়ন ড্রিমস!”

লজ্জায় তিরার গাল লাল হয়ে আসলো। ফোনটা রেখে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিল সে। নিয়নকে ছোট চুলেও বড্ড মানিয়েছে। সবকিছুতেই ছেলেটাকে মানায়। তিরা কি আদৌ নিয়নের যোগ্য? নিয়ন এত সুন্দর! তিরা নিজেকে নিয়ে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগে। নিয়নের পাশে তাকে মানায় না এ চিন্তা তাকে প্রতিমুহূর্তে পীড়িত করে। পরক্ষণেই নিয়নের ভালোবাসা জড়ানো কথার মোহে সে এই ইনসিকিউরিটি ছেড়ে বেরিয়ে আসে। নিয়নের ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র কমতি সে দেখেনা। সবসময় তিরার মন বুঝে চলে ছেলেটা। তিরা বুঝে উঠতে পারে না নিয়ন কিভাবে এত ভালো করে বোঝে তাকে! যাদু জানে নাকি ছেলেটা?

____________

এবারের ফেব্রুয়ারি মাসটা একটু অন্যরকম। এবার তিরার এই মাসটা নিয়ে অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছে। অবশেষে ভালোবাসার মাস ভালোবাসার মানুষের সাথে কাটানোর সুযোগ সে পেয়েছে কিন্তু নিয়ন কি আসতে পারবে? এটা ভেবেই তিরার মন খারাপ হলো। নিয়ন আসলেও সোজাসুজি তাকে বলবে না এটা নিশ্চিত। তিরা নিয়নের বন্ধু আবিরকে নক দিল।

-“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”

-“ওয়ালাইকুম সালাম ভাবী। কী অবস্থা?”

-“ভাইয়া আপনার বন্ধু কি বগুড়া আসার কথা কিছু বলেছে?”

-“না তো।”

-“আচ্ছা ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনি ভালো আছেন?”

-“আলহামদুলিল্লাহ।”

তিরা কথা বাড়ালো না এখন তবে আবির ভাইয়া তাকে ছোট বোনের মতো দেখে। বিষয়টা তিরার ভালো লাগে। তিরার সবসময়ই একজন বড় ভাইয়ের আফসোস ছিলই। কাজিনদের মধ্যে থাকলেও সেভাবে কারো সাথে খাতির নেই। সেদিক থেকে আবির ভাইয়া তার কাছে নিজের ভাইয়ের মতোই। তিরা অপেক্ষা করতে লাগলো নিয়ন কখন মুখ ফসকে কিছু একটা বলবে। নিয়ন মুখ ফসকে কিছু বললো না। কাপড় গুছিয়ে ব্যাগের ছবিটা দিয়ে জানালো সে আসছে। সবে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ। তিরাদের অ্যাসাইনমেন্টের প্যারা চলছে দিনরাত। এস.এস.সি কবে হবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই আপাতত। স্কুল, কলেজ এখনো অফ। তিরা অ্যাসাইনমেন্টে ব্যস্ত ইদানিং। নিয়ন আগামীকাল আসবে জেনেও তিরা খুশি হতে পারলো না। আগের ভয়টা এখনো কাজ করছে মনে। যদি আবার কোনো ঝামেলা হয়, তিরা নিশ্চিত এবার তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

আজ অ্যাসাইনমেন্ট সাবমিট করার দিন। তিরা ভেবেছিল অন্য কারো হাতে পাঠিয়ে দিবে কিন্তু নিয়ন দেখা করতে চেয়েছে। তিরা মনে ভয় নিয়েই দেখা করতে রাজি হয়েছে। অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে স্কুল থেকে বেরিয়ে আশেপাশে নিয়নকে খুঁজলো তিরা। দেখা যাচ্ছে না কোথাও। ফোনটাও আনেনি তিরা। এখন নিয়নকে খোঁজা মুশকিল হলো আরো। তিরার নিজের উপরেই রাগ লাগলো। অযথা জেদ করে ফোনটা আনলো না। তিরার সাথে থাকা বান্ধবী এসব জানেনা। অল্প দূর যেতেই সে গাড়ি ধরলো। না চাইতেও তিরার গাড়িতে উঠে বসতে হলো। প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে বাড়িতে ফিরেই নিয়নকে কল করলো সে। নিয়ন তৎক্ষণাৎ রিসিভ করলো।

-“কোথায় তুই?”

-“বাসায়।”

-“মানে কী? আমি এক মিনিটের জন্য আইসক্রিম নিতে গেছি, এর মধ্যেই তুই নাই! এখন এই আইসক্রিম আমি কী করবো?”

-“খেয়ে ফেলেন।”

-“ফাজলামি করিস না! আরো কিছু জিনিস আছে, সেসবও খেয়ে ফেলবো? তোকে যে কী করবো আমি! রাখ, তিয়াসের সাথে দেখা হইছে। ওকে দিয়ে দিলাম এসব। তুই ওর থেকে নিতে পারবি না?”

-“হু।”

তিয়াস তিরার বন্ধু, বলতে গেলে একমাত্র ছেলে বন্ধু এবং ছোট ভাইয়ের মতো। নিয়নের কথা তিয়াস জানে। নিয়ন তিয়াসের সাথে দেখা করে আইসক্রিম এবং তার সাথে যা যা ছিল দিল তিয়াসকে। তিয়াসকে চা খাওয়ালো, খানিকক্ষণ গল্প করে নিয়ন বাড়িতে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিল। বাড়িতে ঠিকমতো কারো সাথে দেখা না করেই তিরার জন্য এসেছিল সে অথচ তার প্রেমিকাটা এত্ত বোকা যে দেখা করারও সাহস করতে পারলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়িতে ফিরলো নিয়ন।

বিকেলবেলায় তিরার প্রাইভেট ছিল। প্রাইভেট শেষ করে তিয়াসকে কল দিল সে। তিয়াস মোড়েই দাঁড়িয়ে ছিল। তিরার সাথে তার বান্ধবী আফরা। আফরা নিয়নের কথা জানিনা। তিরা কেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে তাও জানেনা সে।

-“তুই কার জন্য অপেক্ষা করছিস বল তো!”

-“আরে তিয়াস আছে না? আমার ছোট ভাই আর কী! ওকে ইয়ার্কি করে বলেছিলাম আইসক্রিম খাওয়াতে, ও সত্যি সত্যি এনেছে।”

তিরার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিয়াস এলো। এক হাতে পলিথিনে দুইটা আইসক্রিম, অন্য হাতে ফাইল। তিয়াস সেসব তিরার হাতে ধরিয়ে দিল। তিরা দেখলো আইসক্রিম গলে যা তা অবস্থা, তার উপর কোণ আইসক্রিম! আইসক্রিম দুটো কিভাবে বাসায় নিয়ে যাবে বুঝে উঠতে পারলো না তিরা। বাড়িতে আজ তার বাবা আছে। আইসক্রিম নিয়ে গেলে জবাবদিহি করতে হবে। শেষমেশ আইসক্রিম দুইটা আফরার বাসার ফ্রিজে রাখতে বললো তিরা এবং বললো আগামীদিন তারা একসাথে খাবে। আফরার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে ফিরে গোপনে ফাইলটা খুললো তিরা। অনেকগুলো সাদা কাগজের আড়ালে তিরার জলরঙা পোট্রেট এবং নিচে নিয়নের সাইন। এককোণে বড় করে লেখা,”উইল ইউ ম্যারি মি?” তিরা মুচকি হেসে মনে মনে সম্মতি জানালো। ফাইলের সাথে এটাচ করে দুইটা নুপুর রাখা। দেখতে ভারি সুন্দর। তিরা মুগ্ধ নয়নে নিয়নের পাঠানো উপহারগুলো দেখতে লাগলো।

চলবে…