অপ্রিয় প্রাক্তন পর্ব-১১

0
121

#অপ্রিয়_প্রাক্তন
১১তম_পর্ব
~মিহি

আফরার ফ্রিজে রাখা আইসক্রিম তিরার আর খাওয়া হলো না। লকডাউনে প্রাইভেট আবার অফ হলো। দেখতে দেখতে রোজাও চলে এলো। এর মধ্যে আফরার সাথে তিরার আর দেখা হলো না, আইসক্রিম সেই ফ্রিজেই রয়ে গেল।

তিরার সময় ভালোই কাটছিল কিন্তু কপালে সুখ জিনিসটা বোধহয় তার জন্য ক্ষণস্থায়ী। বাবা-মায়ের মধ্যে আচমকাই ঝামেলা শুরু হলো। তিরার বাবা জব ছেড়ে দিলেন অনেকটা হুটহাট। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে আচমকা এমন সিদ্ধান্তগুলো যে ঝামেলা বয়ে আনে তা তো বলাবাহুল্য। বাবা-মায়ের ঝামেলায় তিরার মুখের হাসি হারিয়ে গেল। দুজনের মাঝে এক প্রকার কথাবার্তা বন্ধ। তিরা কিছু বলতে গেলেও দ্বিধায় পড়ে। অনলাইন ক্লাসের জন্য এমবি তোলার কথাও কিভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারে না। নিয়নের সাথে মাঝেমধ্যে বাবা-মায়ের ঝামেলা নিয়ে কথা বলতে গেলে নিজেরই খারাপ লাগে। তিরার বাবা-মা এমনিতে সুখী দম্পতি কিন্তু তিরার বাবার এ হঠাৎ সিদ্ধান্ত তাদের সুখ শান্তিকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলেছে।

ফোনে এমবি শেষ। তিরা তারান্নুম বেগমকে বলেছিল দেড়শো টাকা দিতে। উনি সেটাই পাঠিয়েছে। কিন্তু তিরা খেয়াল করলো দেড়শো টাকার অফার আর কাজ করতেছে না। তিরা দুশ্চিন্তায় পড়লো। এখন আবার কিভাবে কিছু বলবে মাকে? এমনিতেই সবকিছু তাকেই সামলাতে হচ্ছে। এসব চিন্তার মাঝেই নিয়নের কল আসলো। তিরা রিসিভ করলো না। এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। নিয়ন একবার কল দিয়ে আর দিল না। আবার ঠিক পনেরো মিনিট পর একবার কল দিল। নিয়নের এ অভ্যেসটা বেশ। কাউকে কল করলে টানা কল করে না। একবার কল করার ঠিক পনেরো মিনিট পর কল করে। তিরা একমাত্র এটার কারণ জিজ্ঞাসা করেছিল। নিয়ন তাকে বুঝিয়েছিল, কাউকে এভাবে টানা কল করা উচিত না। হতে পারে সে ব্যস্ত অথবা ওয়াশরুমে আছে। সবকিছু বিবেচনা করে একটা নির্দিষ্ট টাইম পর কল করা উচিত। নিয়নের এ কথাগুলোই তিরাকে মুগ্ধ করে বারবার। দ্বিতীয় কলটা রিসিভ করলো তিরা।

-“কল ধরছো না যে? আবার কিছু হয়েছে বাড়িতে?”

-“তেমন কিছু না। আম্মুকে ফোনে টাকা দিতে বলেছিলাম, এখন দেখতেছি ঐ অফার নাই আর।”

-“এইটার জন্য এত প্যারা নেওয়া লাগবে কেন? আন্টিকে জানাও সেটা।”

-“ইচ্ছে করছে না। থাক আপাতত ক্লাস না করি। এমনিতেও তো সেরকম কিছু হয়না ক্লাসে।”

-“পরীক্ষার ডেইট দিবে হুট করে, তখন বুঝবা। আচ্ছা দাঁড়াও, আমি নিচে যাচ্ছি একটু। এসে কল করতেছি।”

-“আচ্ছা।”

তিরা কল রেখে ফোনে গেম খেলতে লাগলো। এই মার্ক জুকারবার্গ ফ্রি ফেসবুকও অফ করে দিছে। নিয়নের সাথে আপাতত বেশ কিছুদিন কথা হবে না হয়তো। বাড়িতেও মন টিকছে না, নিয়নের সাথেও কথা হবে না। এসব ভেবে তিরার মন খারাপ হয়ে এলো। আচমকা ফোনের মেসেজ টোনে সেদিকে চোখ গেল তিরার। ফোনে একশো টাকা এসেছে। তিরা চমকালো। এই কাজটা নিয়নের? এই ছেলেটা কি সত্যিই পাগল! তিরা কিছু ভেবে ফেলার আগেই নিয়নের কল এলো।

-“টাকা পেয়েছেন? এবার এমবি তোলেন এবং মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করেন।”

-“এটা কিন্তু ঠিক না। আমার কিছুদিন ক্লাস না করলে কী এমন হবে!”

-“থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিব। বাড়িতে ঝামেলা হইছে তো তোমার দরকারের কথা তুমি বলবা না বাড়িতে? দেখো তিরা, আমার সাথেও যদি কখনো ঝামেলা হয়, তুমি নিজের প্রয়োজনের কথা লুকিয়ো না প্লিজ! রাগারাগি-ঝামেলা এসব সব পরিবারেই হয় কিন্তু তুমি তোমার পরিবারের সাথে শেয়ার করতেছো না কিছু এটা কিন্তু একটা সমস্যা। তোমার শারীরিক-মানসিক বিষয়গুলো এটলিস্ট তোমার মায়ের জানা উচিত। এসবও যদি শেয়ার না করো তুমি নিজের টেক কেয়ার করতে শিখবে কী করে? তোমায় টাকা পাঠিয়েছি বলে এত দ্বিধায় পড়তে হবে না। আমি আমার কাছের মানুষকে সাহায্য করতেই পারি! পরে সুদে-আসলে দিয়ে দিও বিয়ের পর।”

-“আপনি এত ভালো করে কথা কেন বলেন?”

-“তুমি শুনতে ভালোবাসো তাই। আর তাছাড়া তোমায় না দেখে আমি থাকতে পারতাম না। স্বার্থ বিবেচনা করেই খরচ করেছি, বুঝছো পিচ্চি?”

-“হুম। বুঝছি মি.আবরার!”

বিদায় জানিয়ে ফোন রাখলো নিয়ন। তিরা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিয়নকে পাওয়া বোধহয় তার জীবনের অন্যতম একটা ভালো মুহূর্ত। একটা ছেলে প্রতিমুহূর্তে তার পাশে রয়েছে। তিরা জানে নিয়নের জন্য ঢাকায় একা সব ম্যানেজ করা সহজ নয়। নিজের রান্না-বান্না, সব কাজ নিজের করতে হয় আবার সব সামলে ক্যারিয়ারের পেছনে পরিশ্রম করা আর এতকিছুর পর কাজের ফাঁকে ফাঁকেই তিরাকে অগণিত সময় দেওয়া- এতসব কিভাবে ম্যানেজ করে ছেলেটা? তিরা নিয়নের এই বৈশিষ্ট্যের প্রেমেই বারবার পড়ে। নিয়ন একজন ভালো সন্তান, ভালো ভাই, ভালো বন্ধু এবং সেরা প্রেমিক। তিরা চোখ বন্ধ করতেই নিয়নের হাস্যোজ্জল মুখটা ভেসে উঠে। কল্পনার জগতটা বড্ড রঙিন তিরার, বাস্তবটাও এখন কল্পনার মতো মনে হয় তার। এত রঙ কেন জীবনে? হঠাৎ হারিয়ে যাবে না তো এসব?

___________________

-“আমি আর একটা টাকাও খরচ করবো না। সবকিছু আমারই কেন সামলাতে হবে?”

-“চাকরি খুঁজতে সময় তো লাগবেই একটু।”

-“চাকরি ছাড়ার সময় মনে ছিল না সেটা?”

-“আস্তে কথা বলো, তিরা-তন্বী ঘুমিয়ে আছে।”

-“কেন আস্তে বলবো? তোমার আদৌ চিন্তা হয় ওদের জন্য? তিরার সামনে পরীক্ষা, ক’দিন বাদেই কলেজে উঠবে। তখন খরচ বাড়বে আরো অথচ তুমি!”

-“আমার সময় দরকার একটু।”

-“বেশ, তিরাকে বলো যে ওকে বিয়ে দিব আমি। যে খরচ নিতে পারবে তার সাথে যেন চলে যায়!”

-“তারান্নুম!”

বাবা-মায়ের চেঁচামেচি সবটাই কানে আসছে তিরার তবে মায়ের বলা শেষ কথাটা এখনো কানে বাজছে তার। ইতোমধ্যে চোখের কোণ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করেছে অবিরত। তিরা চোখের পানি মুছে ফোনের দিকে তাকালো। ক্লাস শেষ হয়েছে একটু আগেই। তিরা এলার্ম সেট করছিল ঘুমোতে যাওয়ার আগে। তখনি নিয়ন কল করেছিল। তিরা ফোনের দিকে খেয়াল করার আগেই বাবা-মায়ের চেঁচামেচির দিকে ধ্যান যায় তার। এখন ফোনের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করে কল কাটার জায়গায় রিসিভ করে রেখেছিল সে। তৎক্ষণাৎ কল কাটলো তিরা। এ মুহূর্তে বাড়ির এ পরিস্থিতি নিয়নের জানা উচিত হয়নি। তিরার নিজের উপরেই রাগ হলো। এত বোকা কেন সে? চোখ ভিজে এলো আবারো। নিয়নের মেসেজের শব্দ হলো তখনি।

-“শাশুড়ি আম্মাকে বলেন যে তার মেয়ের দায়িত্ব নেওয়ার মানুষ আছে। সসম্মানে যেন তোকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয় এখনি।”

-“আম্মু রাগের মাথায় বলেছে।”

-“তো? আমি সিরিয়াস।”

-“বাদ দেন।”

-“তুই কান্নাকাটি কম কর একটু। আর দেখ, পুরুষ মানুষ অর্থ ছাড়া অনেকটাই মূল্যহীন। শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি। আঙ্কেলের জব হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখবি দুইজন আবার আগের মতো থাকবে, মাঝখান দিয়ে তুই একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিস। নিজেকে স্ট্রং কর। আঙ্কেলের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারতেছি। এরকম সিচ্যুয়েশন পুরুষ মানুষের জন্য যথেষ্ট কমপ্লিকেটেড। চাইলেও তারা বোঝাতে পারেনা কেমন দুর্বিষহ অনুভূতি এটা!”

তিরা নিয়নের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু তার মন এ মুহূর্তে কিছুই বুঝতে চাচ্ছে না। সে কেবল একটু শান্তি চায়। বাবা-মায়ের এই কথা কাটাকাটিগুলো তিরার হৃৎপিণ্ডকে ইতোমধ্যে কত খণ্ডনে খণ্ডিত করেছে তা যদি তিরা একটু বোঝাতে পারতো তাদের! এই সময়টাতে নিয়ন পাশে না থাকলে তিরা একা নিজেকে সামলাতে পারতো? বোধহয় পারতো না। তিরার জীবনের এই অল্প সময়টুকুতে কিয়দংশ সাহস এবং বাস্তবমুখী শিক্ষা সে নিয়নের থেকে পেয়েছে। ছেলেটা তিরার জন্য লাকি অথবা তিরার কোনো এক ভালো কাজের ফল সে। সবসময়, প্রতিমুহূর্তে পাশে থাকার মতো একজন মানুষ থাকলে বোধহয় সত্যিই জীবনের অর্ধাংশ সমস্যার সমাধান আপনাআপনি হয়ে যায়। তিরাও অপেক্ষা করছে তার সমস্যাগুলোও নিশ্চয়ই দ্রুতই সমাধান হবে।

চলবে…