#অপ্রিয়_প্রাক্তন
১২তম_পর্ব
~মিহি
জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়। নিয়নের জন্মদিন আগামীকাল। তিরা তার নানিবাড়িতে বেড়াতে এসেছে। আজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, তিরা গেল না। বাড়িতে ফিরলে নিয়নকে রাত বারোটায় উইশ করা যাবে না। এখানে থাকলে সহজেই উইশ করা যাবে। তিরার মন বেশ প্রফুল্ল। দরজা ভালোমতো লাগিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে সে। এখন কেবল বারোটা বাজার অপেক্ষা। এখন সবে ছয়টা। নিয়ন টেক্সট করেছে তাকে।
-“আইডি ডিএক্টিভ করো।”
-“কেন?”
-“যা বলছি সেটা করো। আমি চাইনা আমার বন্ধুরা তোমাকে ট্যাগ করে কিছু বলুক। আমার জন্মদিন নিয়ে আমাকে পচাক ঠিক আছে কিন্তু ওরা তোমায় টানতে পারে। তুমি আইডি অফ করো।”
তিরার প্রচণ্ড রাগ হলো। সারাদিন কথা হয়নি। এখন একটু ভালো কথা বলবে তা না, নিয়ন কিনা এসব নিয়ে পড়ে আছে? তিরার আর সোজা কথায় উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না। মনে অল্প ভয় রয়ে গেল যদিও। নিয়নের বন্ধুদের তিরা চেনে। আবির ভাইয়া হয়তো কিছু করবে না কিন্তু দীপ্ত ভাইয়া, অন্যরা খোঁচা দিতেই পারে। তবুও তিরা ভয় পেল না। নিয়নের বন্ধুদের ভয়ে সে কেন আইডির ডিএক্টিভ করবে?
-“আমি পারবো না আইডি ডিএক্টিভ করতে। আপনার বন্ধুরা উইশ করবে করুক, এর মধ্যে আমাকে টানা লাগবে কেন?”
-“তোমাকে টানা লাগবে কেন মানে? তুমি আমার প্রেমিকা তিরা আর এটা ওরা জানে। এটা নিয়ে অবশ্যই ওরা মজা করবেই! অযথা কেন তোমার ঝামেলা ঘাড়ে নিতে হবে? যেটা বলতেছি করো।”
-“পারবো না।”
-“তিরা তুমি জেদ করতেছো এখন।”
-“জেদ হলে জেদই, আমি আপনার বন্ধুদের জন্য নিজের আইডি ডিএক্টিভ কেন করবো?”
তিরা খেয়াল করলো নিয়ন তার টেক্সট সীন করছে না। তিরা কল করলো কিন্তু নিয়ন কল কেটে দিল। তিরা বুঝতে পারলো না কী হচ্ছে। তিরা একটানা কল করে গেল। নিয়নের যুক্তি তার বেলায় খাটে না। পনেরো মিনিট অপেক্ষা করে কল করার ধৈর্য তার নেই। তিরা মিনিটে কতবার কল করলো হিসেব নেই। অবশেষে নিয়ন কল রিসিভ করলো।
-“কী সমস্যা? এতোবার কল করতেছো কেন? ব্যস্ত আমি!”
নিয়ন কল কেটে দিয়ে ফোন সুইচড অফ করলো। তিরা বেশ কয়েকবারই ডায়াল করেও নম্বরে খোলা পেল না। তিরার প্রচণ্ড খারাপ লাগতে লাগল। সে অযথাই জেদ করলো, নিয়নের কথা শুনলেই পারতো। নিয়নকে প্রথম উইশ করবে ভেবেছিল তিরা অথচ এখন ছেলেটাকে রাগিয়ে ফেলেছে। মন খারাপের মাত্রা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে লাগলো। টানা কল করতেই থাকলো তিরা। বারোটার আগ মুহূর্তে নিয়নের ফোন অন পাওয়া গেল। তিরা এতোক্ষণে প্রায় কান্না কান্না অবস্থা করে ফেলেছে নিজের। কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে এসেছে কয়েকগুণ।
-“এতবার কল দেওয়ার দরকার ছিল?”
-“আপনি ফোন অফ করে রেখেছেন কেন?”
-“এমনি। কী হয়েছে বলো।”
-“কী হয়েছে মানে? আপনার জন্মদিন কাল, আমি কি উইশ করবো না?”
-“করো।”
-“শুভ জন্মদিন।”
-“ওকে। পরে কথা হবে, টাটা।”
নিয়ন কল কেটে দিল। তিরা এক মুহুর্তের জন্য বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে উপনীত হলো। নিয়ন এভাবে কল কেটে দিল কেন? নিয়ন কি রেগে আছে তিরার উপর? তিরা কল করতেই থাকলো। প্রত্যেকবার নিয়ন প্রশ্ন করে কী বলতে চায় সে কিন্তু তিরা কিছুই বলতে পারে না। কান্না দলা পাকিয়ে আসে তার। নিয়নকে বোঝাতে পারে না সে নিজের মনের কথাটুকু। নিয়নের আইডি ডিএক্টিভ । তবুও তিরা অনলাইনে আসলো। নিয়নের বন্ধুরা ছবি পোস্ট করেছে জন্মদিনের। নিয়নকেবেশ হাসিখুশিই দেখাচ্ছে কিন্তু অদ্ভুত এক যন্ত্রণায় বিদ্ধ তিরা। নিয়ন কেন তাকে অবহেলা করছে বুঝে উঠতে পারছে না সে। নিয়ন তো কখনো ডমিনেটিং ছিল না তবে এখন হঠাৎ কেন? তিরার মাথায় নানান বিষয় ঘুরপাক খায়। তিরার জীবনের মোটামুটি সব সত্যিই নিয়নের জানা। খুব ছোট বয়সে তিরা অ্যাবিউজ হয়েছিল এটা নিয়নকে জানিয়েছে সে। এটা সে প্রপোজ করার পরপরই জানিয়েছিল তিরা। অন্য কোন কারণে নিয়নের মন খারাপ হতে পারে বোঝার চেষ্টা করলো তিরা। আরেকটা বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তিরার স্কুললাইফে একজন টিচারের উপর ক্রাশ ছিল। নিয়নকে জ্বালানোর জন্য তিরা বলেছিল সে ঐ টিচারের প্রোফাইল চেক করেছে। এটা নিয়ে যথেষ্টই ঝামেলাত হয়েছে দুজনের, শেষমেশ মিটেও গেছে। তিরা কেবলমাত্র চেয়েছিল নিয়ন একটু জ্বলুক, একটু অধিকার ফলাক, রাগ দেখাক। এ রাগের মাত্রা যে এতদূর যাবে তা তো ধারণা করেনি তিরা। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো তিরা। ফ্যান চলছে সশব্দে, কান্নার আওয়াজ বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। তিরা কল করা অব্যাহত রাখলো। শেষমেশ ভোর চারটায় নিয়ন তিরার কল রিসিভ করলো। তিরা কথা বলতে পারছে না, কিছু বলতে গেলেই কান্না পাচ্ছে তার।
-“তিরা কান্না থামাও। সারারাত ঘুমাওনি, এখন ঘুমাও। সকালে কথা বলবো আমরা।”
-“শুভ জন্মদিন মি.আবরার।”
-“তিরা, মার খাবি এখন। কতক্ষণ ধরে কাঁদছিস গাধার বাচ্চা! ফ্রেন্ডরা সবাই আসছে, ঐজন্য তোকে বললাম পরে কথা হবে। তুই এত বোকা কেন হ্যাঁ? এখন কিছু বলবি না, চুপচাপ ঘুমা।”
-“আচ্ছা।”
তিরা কল কাটার আগে শুনতে পেল ফোনের অপর প্রান্তে সবাই ‘ভাবী’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো। তিরা আনমনে হাসলো। এতক্ষণের কান্না যেন ক্ষণিকেই মুছে গেল তার। দু’চোখে ঘুম নেমে এলো তৎক্ষণাৎ।
সবকিছু আবার স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকলো। নিয়নের কাজের ব্যস্ততা বাড়লো, ছেলেটা টেনশনে থাকে ইদানিং। ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস, ঢাকায় একা সব ম্যানেজ করা- সব মিলিয়ে নিয়নের ক্লান্তি চলে এসেছে। তবুও ছেলেটা কেন যেন তিরার সাথে কথা বলার সময়টুকুতে সব ভুলে যায়। কখনো বাসের উপচে পড়া ভীড়, কখনো অফিসের চাপ, ক্লায়েন্টের প্যারা সবকিছু উপেক্ষা করে নিয়ন তিরাতে সীমাবদ্ধ থাকে তখন। আজ আচমকা সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ তিরাকে কল করেছে নিয়ন। অফিস থেকে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে নিয়নের আটটা বাজে। এ সময়টুকুতে নিয়ন কখনো তাকে কল করে না, দরকার পড়লে টেক্সট করে। তিরা চটজলদি কল রিসিভ করলো।
-“কী করো?”
-“আপনি এই অসময়ে কল করলেন যে? বাস মিস করেছেন নাকি উবারে ফিরেছেন?”
-“মাঝরাস্তায় নেমে পড়েছি বাস থেকে।”
-“কেন?”
-“বাস কন্ডাক্টর একটা বয়স্ক লোকের সাথে ভাড়া নিয়ে ঝামেলা করতেছিল। আমি তার ভাড়া দেওয়ার পরেও লোকটাকে অযথা বিরক্ত করতেছিল। রাগ করে ঘুষি মারছি দুইটা নাক বরাবর। তারপর বাস থামায়ে মাঝরাস্তায় নেমে পড়ছি। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল, বাসে থাকলে আরো কয়েকটা খাইতো ঐ শালা!”
-“আচ্ছা মাথা ঠাণ্ডা করেন।”
-“তুমি আমায় সবসময়ই মারামারি করতে নিষেধ করো তিরা কিন্তু তুমি আসলে বোঝো না কিছু ক্ষেত্রে মারামারি করাটাই উচিত। মারামারি করা মানুষগুলো সবসময় ভুল হয় না।”
-“বুঝলাম।”
-“কাজী নজরুল ইসলামের ভক্ত ম্যাম, বিদ্রোহ রক্তে মিশে আছে।”
-“খুব হয়েছে, এখন কি হেঁটে বাসায় ফিরতেছেন?”
-“হ্যাঁ।”
-“ভালোই! আপনি যে কী!”
-“আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর।”
-“আরে বাহ! আবৃত্তির গুণটা এতদিন পর জানলাম।”
-“সবাই পারি ম্যাম, আপনি কেবল একবার পদার্পণ করুন আমার গৃহে।”
তিরা হাসে। এই লোকটার প্রেমে প্রতিমুহূর্তে নাজেহাল হয়ে পড়ছে সে। কিভাবে যেন দিনকেদিন তার ভালোবাসা কেবল বেড়েই চলেছে, কমার কোনো সুযোগ নেই। এ ভালোবাসা সইবে তার কপালে নাকি অকাল ঝড়ে সব তছনছ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে? তিরার ভাবনার মাঝেই কানে এলো নিয়নের গুনগুন স্বরে গেয়ে ওঠা,
“আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন
দিল ওহি মেরা ফঁস্ গয়ি
বিনোদ বেণীর জরীন ফিতায়
আন্ধা এশ্ক্ মেরা কস্ গয়ি।”
চলবে…