#অপ্রিয়_প্রাক্তন
১৩তম_পর্ব
~মিহি
১২ই আগস্ট, ২০২১||
তিরার জীবনের সবচেয়ে অভিশপ্ত দিন। তিরার জন্মদিন। গতকাল রাত থেকেই তিরার মনে উত্তেজিত কাজ করছিল নিয়ন তার জন্মদিনে কী করবে এটা ভেবে কিন্তু সকালটা হলো তিক্ত অভিজ্ঞতায়। নিশাত তাকে কিছু মেসেজের স্ক্রিনশট পাঠিয়েছে। তিরা সেসব চেক করলো। রাত দশটা থেকে এক ঘণ্টা পরপর নিয়ন নিশাতকে টেক্সট করেছে, এমনকি পছন্দ করার কথাও অকপটে স্বীকার করেছে। নিশাত কিছুই বলেনি। তিরা কোনোরকম কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। সে জানে নিয়নের নাটক এসব তবুও তীব্র ব্যথায় চিনচিন করে উঠলো তার বুকের বা পাশ। তিরা ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। নিয়নকে কিছু বলতেও ইচ্ছে করছে না তার আর। একটু পর নিশাতের মেসেজ আসলো।
-“আমার আর ওনার বিয়ে হলে আমাদের বিয়ের গেইট তুই ধরিস।”
-“আচ্ছা।”
তিরা খুব অকপটে কথাটা বললেও নিজের ক্ষতটুকুর একাংশও নিশাতকে বোঝাতে পারলো না। সে জানে নিয়ন ইচ্ছে করে নিশাতকে দিয়ে এটা বলিয়েছে তিরাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। তিরা এক মুহুর্তের জন্য ভুলেই গেল আজ তার জন্মদিন। তার মনে হলো আজ বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ দিন তার জন্য। তিরার কেন যেন নিশাতের উপরেও অনেকখানি রাগ হলো, নারীজাতির সহজাত প্রবৃত্তি বলে কথা। তিরা ঐ অল্প সময়টুকুতে কতখানি ভাঙলো নিজেকে তা কেউ অনুধাবন করলো না। নিয়নের সাথে সে বেলা কোনো কথাই হলো না তিরার। রাত নয়টা নাগাদ নিয়ন নিজ থেকে মেসেজ করলো। একটা ভিডিও পাঠিয়েছে সে। অ্যানিমেটেড ভিডিও যেখানে একটা ছেলে খুব সুন্দর করে একটা মেয়েকে প্রপোজ করছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে আতিফ আসলামের গান বাজছে,”শুন মেরে হামসাফার।” ভিডিওর শেষে স্ক্রিণে বড় করে লেখা উঠে,”উইল ইউ ম্যারি মি, তিরা?” তিরা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। সারাদিন একটা মানুষকে কাঁদিয়ে এখন তাকে সারপ্রাইজ দিয়ে কী লাভ? ভালোবাসার মানে কি সারপ্রাইজ নাকি প্রিয় মানুষকে ভালো রাখা? তিরার মাথায় রাগের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে।
-“আমি কখনো নিজেকে তুলনা করার চেষ্টা করিনি কিন্তু আজ প্রথম মনে হচ্ছে আমি বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত নারী। নিজের শ্যামবর্ণ কিংবা আপনার মতো যোগ্যতা বোধহয় আমার নেই। আমাদের মধ্যে হয়তো কিছু সম্ভবই না।”
-“এসব উল্টোপাল্টা কথা কেন বলতেছিস? আমি শুধু এটা চাচ্ছিলাম তুই জন্মদিনের ব্যাপারটা থেকে ডিসট্রাক্ট হ একটু।”
-“প্রচুর ডিসট্র্যাক্ট হয়েছি আমি। আপনাকে ধন্যবাদ আমাকে ডিসট্র্যাক্ট করার জন্য সারারাত জেগে থেকে অন্য কাউকে টেক্সট করার জন্য।”
-“তিরা প্লিজ, আমাকে ভুল বুঝো না।”
-“আমি একটু একা থাকতে চাই।”
সত্যিই সেদিন তিরা বড্ড একা হয়ে গেল। নিশাতের সাথে সম্পর্কে দূরত্ব বাড়লো, বলতে গেলে নিজের সম্পূর্ণ ফ্রেন্ড সার্কেল ছেড়ে বেরিয়ে এলো তিরা। নিয়নের বলা কথা আজ খুব মনে পড়ছে। ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের বাছাই পর্বটা। ভালোবাসা মানুষকে কেন যেন বন্ধু থেকে দূরে সরিয়ে দেয় সবসময়। তিরার ভালোবাসা তো তাকে নিঃস্ব করে ছেড়েছে। তিরা ভেবেছিল সমস্যা বোধহয় কমবে। মোটেও না, এক সমস্যার মধ্যে বোঝা হয়ে এলো পারিবারিক সমস্যা। বড় চাচা এবং ছোট চাচার মধ্যে জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদ নিয়ে একরকম দুইজন কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছে। তিরা কেবল নির্লিপ্ত চোখে দেখে যায় তার জীবনের অধঃপতন। এই পরিবারটা সবসময় একসাথে ছিল। তিরার মনে আছে গ্রামে তাদের একটাই বাড়ি ছিল। বিশাল সে বাড়ি। এক মাথা থেকে আরেক মাথা দৌড়ে গেলেও দেড় মিনিটের মতো লাগতো। সেই একটা বাড়ি আজ তিনটে ভাগ হয়ে গেছে। আগের মতো মিল কোনোদিকেই নেই। এ সময়টাতে নিয়নের টেক্সট তিরার মেজাজ আরো খারাপ করে তোলে।
-“তিরা প্লিজ, আ’ম স্যরি। তুমি বিশ্বাস করো এসব নাটক ছিল।”
-“আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এত সুন্দর নাটক সাজানোর জন্য তো ধন্যবাদ জানিয়েছি আপনাকে। আর কী চান?”
-“ক্ষমা! আমি ভালোবাসি তোমায় তিরা।”
-“আমার দরকার নেই কারো ভালোবাসা। আমার লাইফে ভালোবাসা পাওয়ার আর কিছু অবশিষ্ট নাই। না আপনার থেকে, না বন্ধুদের থেকে আর না পরিবারের থেকে।”
-“তিরা শান্ত হও। আমায় বোঝার চেষ্টা করো। আমি মরে যাবো তোমাকে ছাড়া।”
তিরা কিছু বললো না। নিয়নের কথার উত্তর দিতেও বিরক্ত লাগছে তার। ফোন রেখে চুপচাপ বসে রইলো সে। রাত দশটা নাগাদ অর্ণব ভাই নক দিল তাকে। অর্ণব হলো নিয়নের রুমমেট।
-“ভাবী, কিছু হয়েছে আপনাদের? ভাই অনেকক্ষণ বের হইছে, বাসায় আসেনি এখনো। ফোন করলে ফোন ধরছে না। এত রাতে বাইরে একা ঘোরা তো সেইফ না। ভাবী কিছু হলে আমাকে বলেন।”
-“কিছু না ভাইয়া। আমি দেখছি।”
না চাইতেও দুশ্চিন্তা ঠিকই ভর করলো তিরার মাথায়। নিয়নের নম্বরে কল করলো সে। কল রিসিভ হলো না। তিরা একবার ভাবলো হয়তো ব্যস্ত আছে অফিসে কিন্তু মন কু ডাকছে তার। নিয়নের পনেরো মিনিট পর কলের থিওরি উপেক্ষা করে আবার কল করলো সে। এবার নিয়ন কল রিসিভ করলো। তিরা ঘরের দরজার বন্ধ করে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসলো বিছানায়।
-“ফাজলামি শুরু করছেন? রাত-বিরাতে বাড়িতে না থেকে বাইরে কী? আপনার এসব সামলানো আমার দ্বারা হবে না। বিয়ে করা বউ না আমি।”
-“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
-“আজব তো!”
-“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
-“মাথার তার ছিঁড়ছে সব কয়টা?”
-“আলহামদুলিল্লাহ কবুল। এখন তুমি বলো কবুল।”
-“আপনি কি পাগল?”
-“তাড়াতাড়ি ঢাকায় আসো তো। একটা ছোট ঘর নিব তোমার আর আমার। তুমি সকালে ভার্সিটি যাবে, আমি রান্না করে রাখবো। ভালোবাসি তিরা প্রচণ্ড! আমায় একটু ভালোবাসবি প্লিজ?”
নিয়নের কান্নারত স্বরে তিরার মন গললো তবুও ক্ষীণ অভিমান এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে সে। সেসব নিয়নকে বুঝতে দিল না।
-“বাসায় যান চুপচাপ। তারপর নক দেন আমাকে।”
-“আচ্ছা।”
ভদ্র বাচ্চার মতো তিরার কথামতো বাসায় ফিরলো নিয়ন। ফ্রেশ না হয়েও তিরাকে ভিডিও কল করলো। তিরা তখন পড়ছিল। তার উপর ঘরের দরজা খোলা। তিরা কল রিসিভ করে মিউট করলো এবং সাউন্ড কমিয়ে দিল। ব্যাক ক্যামেরা অন করে খাতায় লিখলো,”কোনো কথা বলার দরকার হলে টেক্সট করেন নাহলে খাতায় লেখেন।” তিরার এ কাজে নিয়ন হাসলো। এ কেমন প্রেম? মর্ডান যুগ মিক্সড উইথ নব্বই দশক?
পরের সপ্তাহে ঘটলো আরেক বিপত্তি। নিয়ন বন্ধুদের সাথে বেরিয়েছিল। তিরা নিয়নের নম্বরে কল করে পাচ্ছিল না। শেষমেশ আবিরের নম্বরে কল করলো সে। আবির বরাবরই তিরার সাথে একটু-আধটু মজা করে। সেও মজা করে বললো ভিডিও কল না করলে নিয়নকে দেখাবে না। তিরা হাসলো তবে অডিও কলেই থাকলো। আবির নিয়নকে ফোনটা দিল। নিয়নের কণ্ঠে রাগের আভাস পেল তিরা।
-“কী হয়েছে?”
-“কিছু হয়নি। আমি বাসায় ফিরে কল করছি।”
-“আচ্ছা।”
তিরা তখনো জানতো না কোন ঝড় বয়ে গেছে সেদিকে। সন্ধ্যায় যখন নিয়ন বাড়িতে ফিরলো তখন তিরা নিয়নের মধ্যে অদ্ভুত আচরণ খেয়াল করলো। নিয়ন কিছু একটা লুকোচ্ছে টের পেল তিরা। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই নিয়নের আইডিতে লগইন করলো তিরা। আবির এবং নিয়নের কথোপকথনে বিশেষ কিছু বুঝলো না। কেবল এটুকু ধারণা হলো বন্ধুদের সাথে থাকাকালীন কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে যেটা নিয়ে নিয়ন প্রচণ্ড রেগে আছে। তিরা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই নিয়ন তাকে কল করলো।
-“তুই আর আবিরের নম্বরে কল করবি না, আমাকে না পেলেও না।”
-“আচ্ছা কিন্তু কী হয়েছে?”
-“তুই আমাকে কল না করে আবিরের নম্বর কল করছিস এটা নিয়ে কয়েকটা ছাগলের বাচ্চা উল্টোপাল্টা বলতেছিল।”
-“ওহ।”
-“স্যরি! তোর কথা আবার রাখিনি। ওদের মারছি আর যা মার খাইছে তাতে নিয়ন আবরারের নাম মনে পড়লেও মেয়েদের প্রতি সম্মান অটোম্যাটিকালি আসবে।”
তিরা সামান্য হাসে। অনেকদিন পর নিয়নের প্রতি আগের মতো একটা টান অনুভব হয়। এ টানটা চিরস্থায়ী হবে তো নাকি আবার কোনো ঝড়ে বাঁধনহারা হবে এ টান?
চলবে…
#অপ্রিয়_প্রাক্তন
১৪তম_পর্ব
~মিহি
সেপ্টেম্বরে তিরার এস.এস.সি পরীক্ষার রুটিন দিল। পরীক্ষা ভালোমতোই দিল তিরা যদিও পড়াশোনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সে একরকম। অনেকটা ভয় নিয়ে পরীক্ষা দিলেও এখন সে ভয় কেটেছে। তিরা ভেবেছিল পরীক্ষার পরের সময়টুকু ভালো কাটবে। তেমন কিছু ঘটলো না। কোনো তলব ছাড়াই নিয়ন তার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিল। তিরা কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারলো না নিয়ন কেন করছে এমন। তিরার মানসিক অবস্থা আবারো খারাপ হয়ে এলো। শেষবেলায় বোধহয় নিয়নের একটু দয়া হলো।
-“নিয়ন, ইগনোর কেন করতেছেন আমাকে?”
-“আমার কিছু সমস্যা আছে, সময় হলে জানাবো। আপাতত এসব নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করো না।”
-“আচ্ছা কিন্তু …”
-“ছেলেদের লাইফে টাকা খুব ইম্পর্টেন্ট তিরা! টাকা ছাড়া সে কারো কাছেই মূল্য পায় না, নিজের পরিবারের কাছেও না!”
তিরা আর কিছু বলতে পারার আগেই নিয়ন অফলাইন হলো। তিরার মন আবারো খারাপ হয়ে এলো। তার মনের অবস্থাটা যেন নিয়নের কথা বলা না বলার উপর পুরোপুরিই নির্ভরশীল হয়ে গেছে। না চাইতেও অশ্রুকণা গড়াতে লাগলো গাল বেয়ে। তিরার ইদানিং মনে হয় সে তার সারাজীবনেও এতটা কান্না করেনি যতটা কান্না সে বিগত কয়েক মাসে কেঁদেছে। নিয়নের জন্মদিনে, নিজের জন্মদিনে আবার এখন! জেনেবুঝেই কি কষ্টকে বুকে জড়িয়ে ছিল সে?
নিয়নের অবহেলা বাড়তে লাগলো। নিয়নের আইডিতে কোনো মেয়ে ছিল না। আচমকা তার পোস্টে এক নতুন মেয়ের রিএক্ট বাড়তে লাগলো। মেয়েটার নাম তেহযীব। তিরার নামে নাম মেয়েটার। তিরার বড্ড অসহায় লাগতে লাগলো। কে এই মেয়ে? নতুন কোনো ঝড় আসছে না তো তিরার জীবনে? নিয়ন তিরার পরবর্তী সব মেসেজগুলো ইগনোর করলো। তিরার মনের ভয় বাড়তে লাগলো। সবচেয়ে ভয়াবহ মুহূর্তের সাক্ষী হলো সন্ধ্যেবেলা। নিয়ন তাকে ব্লক করেছে! তিরার মস্তিষ্ক শুণ্য হয়ে এলো। সবকিছু মরীচিকা মনে হতে লাগলো সে সময়টাতে।
নিয়নের কথায় ব্লক করা মেয়েটার কথা আজ হঠাৎ মনে পড়লো। মেয়েটার নাম আশা। তিরা তৎক্ষণাৎ মেয়েটাকে আনব্লক করে নক দিল।
-“আমি তো নিয়ন ভাইয়াকে ভালোবাসি না আপু।”
মেয়েটার রিপ্লাই এলো ঘণ্টা দুয়েক পরে।
-“মিথ্যে বলো না আপু। আমি জানিই সবটা। নিয়ন তোমার সাথে ভালো থাকলে থাকুক, আমাদের তো ডিভোর্স হয়েই গেছে।”
-“ডিভোর্স?”
-“হ্যাঁ, উনি আমার এক্স হাজবেন্ড। একটা বিয়েবাড়িতে পরিচয় হয়েছিল। আঠারোর পহেলা জানুয়ারি আমরা বিয়ে করি। খুব ইনসিকিউর থাকতাম ওকে নিয়ে। দূরে থাকতো, ভয় পেতাম। ওর জন্য পরিবারের বিপক্ষে গেছি। এখন তো সে-ই নাই আর। এখন চেষ্টা করতেছি ভুল শুধরানোর।”
-“তোমাদের বিচ্ছেদ কেন হলো? আর সত্যিই তোমাদের সম্পর্ক ছিল আপু?”
-“নিয়নের টাইমলাইনের অনেক কিছুতেই আমি আছি। দেখাই দাঁড়াও।”
আশা দেখালো একটা ‘কোটস’, নিয়নের ছবি দিয়ে বানানো যেখানে ‘আশা’ শব্দটা উল্লেখ আছে।
-“এটা আমার জন্য ছিল। ওর নিকনেমটাও আমার দেওয়া।”
আশা আরেকটা ছবি দেখালো। নিয়ন হাত মুঠো করে গালে রেখেছে।
-“ওর হাতে মেহেদী দিয়ে লাভ করা। আমার হাতেও করেছিলাম।দুজন একসাথে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম তখন।”
তিরা খেয়াল করলো সত্যিই নিয়নের হাতে সেরকমই কিছু। তিরা গলা শুকিয়ে আসলো। টাইপ করার সময় অনুভব করলো হাত অবশ হয়ে আসছে ক্রমশ।
-“তিরা, দোয়া করি নিয়নকে নিয়ে সুখে থাকো। ও তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তোমরা ভালো থেকো।”
-“আমাদের মধ্যে কিছু নেই।”
-“মিথ্যে বলতে হবে না। তুমি তো ওর প্রথম ভালোবাসা। সেই স্কুল লাইফে তোমাকে দেখে প্রেমে পড়েছিল, আমার সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন বলেছিল আমাকে। কী ভাগ্য দেখো, ঠিকই তোমাকে পেয়ে গেল। ভালো থাকো তোমরা, আমাকে এসবে আর জড়িয়ো না। ব্লক করলাম তোমাকে।”
তিরার কিছু বলার থাকলো না। আশার কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছে না সে। একটা মানুষ এত সহজে নিজের স্বামীর সাথে অন্য কাউকে মেনে নিবে যতই ডিভোর্স হয়ে যাক! আর বিয়ে-ডিভোর্স এত সহজ? তিরা মেয়েটার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না কোনভাবেই। নিয়নকে জিজ্ঞাসা করে লাভ হবে না। সে বলবে সময় আসলে বলবো। অদ্ঢুত দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লো তিরা।
সপ্তাহ দুয়েক পর নিয়ন নক দিল।
-“আশার সাথে কথা বলছেন? বাহ! যাক ভালো।”
-“আমার আইডি চেক করেছেন? কেন? আপু যা বলছে সেসবের মানে কী?”
-“বলছিলাম সময় হলে বলবো। যাই হোক, আমার গার্লফ্রেন্ডকে দেখবেন?”
তিরার ভঙ্গুর মনটাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে নিয়ন একটা ছবি পাঠালো। একটা মেয়ে, বোরকায় আবৃত শরীর, নিয়নের ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে। তিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলালো। এভাবে ভেঙে পড়া যাবে না।
-“ও কত সুন্দর জানো? আজ সারাদিন ওর সাথে ছিলাম। এক নৌকায় ওর কোলে মাথা রেখে একটা বিকেল, আর কিছু বলবো না থাক।”
-“এসব কেন করলেন আপনি?”
-“তোমার বাবার কেনা গোলাম আমি? টাকা দাও, প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি!”
-“নিয়ন প্লিজ সত্যি বলেন।”
-“এটাই সত্যি!”
-“আপনি কেন এমন করতেছেন?”
-“একটু জড়িয়ে ধরবি? তোকে ছাড়া আমার মোটেও ঘুম হয়না।”
-“আপনি কি ইয়ার্কি করতেছেন আমার সাথে? ভালো থাকেন আপনার নতুন তেহযীবকে নিয়ে!”
-“আমার আর ভালো!”
নিয়ন এ পর্যায়ে অশ্রাব্য ভাষায় যা তা বলতে লাগলো। তিরা আবারো শেষবারের মতো বললো, ভালো থাকবেন। প্রতিদানস্বরূপ নিয়ন তাকে তৎক্ষণাৎ ব্লক করে দিল। তিরা এতক্ষণ ধরে নিজেকে যথেষ্ট সামলেছিল কিন্তু এ মুহূর্তে তার মাথা বনবন করে ঘুরছে। নিয়নের কোন কথা সত্যি, কোনটা মিথ্যে তিরা বুঝে উঠতে পারলো না। নিয়ন কি তাকে কষ্ট দেওয়ার নতুন কোনো প্ল্যান করেছে? তাকে কষ্ট দিতে এতই ভালো লাগে নিয়নের?
নিয়ন অবশ্য সফলই হলো, মারাত্মকভাবে সফল। অক্টোবর, বিচ্ছেদের মাস। তিরা উপলব্ধি করলো বিচ্ছেদের যন্ত্রণা। অন্য একটা আইডি দিয়ে নিয়মিত নিয়নের আইডি চেক করাটা অভ্যেসে পরিণত হলো। কিছু কিছু সময় নিয়নের ছবি সেভ করে রেখে দেওয়া, সব মিলিয়ে তিরার জীবন থমকে গেল বলা চলে। তিরা ভেঙে পড়লো খুব ভয়ানকভাবে। নিয়নের জন্য বন্ধুত্ব থেকে সরে এসেছিল সে। এখন না নিয়ন আছে, না বন্ধুত্ব। তিরা অনুভব করলো সে প্রচণ্ড একা, একাকী যেন কোনো মরুভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটুকু জলের তল্লাশে পিপাসার্ত সে। একেকটা দিন কাটলো চরম মানসিক যন্ত্রণায়।
_________________________________________________________________________________
কলিংবেলের টানা শব্দে ঘুম ভাঙলো তিরার। লাফ দিয়ে উঠে আশেপাশের সবকিছু গুছিয়ে তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলল সে। চোখ ভিজে উঠেছে। মাঝে মাঝে পুরোনো স্মৃতির ভাবনাগুলোও যন্ত্রণা দেয়। চটজলদি দরজা খুলল তিরা। তার মা ফিরেছে, রাত হয়ে গেছে! তিরা অনুভব করলো সে দীর্ঘক্ষণ ঘুমিয়েছে। মাথাটা ভারি ভারি লাগছে। তারান্নুম বেগম তিরার সাথে কোনো কথাই বললেন না। তিরাও আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে গেল না। আবারো বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো সে। নিয়নের চিন্তা মাথায় ভর করলো হঠাৎ। জানতে ইচ্ছে করছে খুব ছেলেটা কেমন আছে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলালো তিরা। তারান্নুম বেগম ডাকলেন তাকে।
-“তিরা!”
-“জ্বী আম্মু।”
-“নিয়ন কি তোমাকে কিছু বলেছে?”
-“না।”
-“মানুষকে চেনা-জানা এতটা সহজ নয়। আমরা বাবা-মায়েরা একটা ছেলের চোখ দেখলেও বুঝি তার নিয়ত কী! তোমরা তা কখনো বুঝবে না। বাবা-মা যা করে সন্তানের ভালোর জন্য এ বুঝটা তোমাদের আসে কষ্ট পাওয়ার পর। আশা করি এক কষ্ট বারবার পেতে চাইবে না তুমি।”
তিরা মাথা নিচু করলো। সে তারান্নুম বেগমকে নিজের মনের কথা বলতে পারবে না। তিরা কোনো নায়কের প্রেমে পড়েনি, সে এক খলনায়কের প্রেমে খুব বাজেভাবে পড়েছে। এতটাই বাজেভাবে যে আজ তিন বছর হয়ে গেছে সবকিছুর শেষ হওয়ার অথচ তিরা এখনো ঐ লোকটার কথা ভেবে মুভ অন করতে পারছে না।
চলবে…