আমাদের কুঁড়েঘর পর্ব-০৬

0
225

#আমাদের কুঁড়েঘর
Sumon Al-Farabi
#৬ষ্ঠ_পর্ব

সকাল ১০টা বাজে। জাহিনের এখন অফিসে আসার কোনো নামগন্ধ নেই। এদিকে বস একটু পর পর এসে জাহিনের কেবিন দেখে যাচ্ছে ।
পকেটে মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠলো জাহিনের।
– হ্যালো।
– ভাইয়া কোথায় আপনি?
জাহিনের এক জুনিয়র কলিগ কল দিছে।
– আমি বাইরে আছি।
– আপনি অফিস আসবেন কখন?
– আমি তো অফিস যাবো না। কোন দরকার কি?
– বস বার বার এসে আপনার কেবিনে খুঁজে যাচ্ছে । মনে হচ্ছে খুব রেগে আছে। আজ যদি আপনাকে সামনে পায় তাহলে কাঁচায় চিবিয়ে খাবে।
– আমি তো কয়েক দিনের ছুটিতে আছি। বসকে বলাই হয় নি।
– বস কে না বলেই আপনি কিসের ছুটিতে আছেন?
– সেটা পরে তোমায় বলবো এখন রাখছি।

গত কয়েকদিনে নীলার( বস) সাথে অনেক সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে । আসার সময় তাকে বলে আসা উচিত ছিলো। এদিকে প্রিয়ন্তী তো মানহার বেষ্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেছে কিন্তু প্রিয়ন্তী কে ও বলা হয়নি। নীলাকে কল দিতেই নীলা রেগেমেগে বললো- আপনার কি এখনো অফিসে আসার সময় হয়নি?
– আপনি কি খুব বেশি রেগে আছেন?
– আজ আপনি শুধু অফিসে আসুন ।
– কিন্তু আমি তো আজ অফিসে আসবো না।
– আসবেন না মানে।
– আমি তে কয়েকদিনের ছুটিতে আছি। আমি আমার বাড়িতে যাচ্ছি ।
– আপনি কার থেকে ছুটি নিয়েছেন? আমি তো আপনাকে কোনো ছুটি দেইনি ।
– গত পরশু স্যারের সাথে দেখা করেছিলাম ওনাকে ছুটির জন্য বলেছিলাম । উনি বলেছিলো আপনাকে বলবে হয়তো ভুলে গেছে।
– মানে আপনি আমায় বস মানেন না তাই তো?
– তেমনটা নয়।
– তো কেমনটা শুনি আপনি তো সেটাই বুঝালেন। আসুন দেখি আপনার চাকরিটা কেমনে থাকে।
নীলা রেগে কল কেটে দিলো। নীলা কল কাটতেই জাহিন প্রিয়ন্তী কে কল করলো। দুই বার কল করার পরে যখন রিসিভ করলো না তখন ভাবলো হয়তো স্কুলে আছে তাই আর কল দিলো না।
ফোনটা পকেটে রাখতে যাবে সেই সময় নীলা আবার কল দিলো।
– সারাদিন ফোনে এতো কার সাথে কথা বলেন শুনি?
– আমি তো কারো সাথে কথা বলি নি।
– আবার মিথ্যা ও বলতে পারেন দেখছি। এইমাত্র তো আপনার মেবাইল ব্যাস্ত দেখালো।
– ওহ আচ্ছা । মানহার ম্যাম কে কল দিচ্ছিলাম।
– মানহার ম্যামকে আপনার কল দিতে হবে কেন? তার সাথে আপনার এতো কিসের কথা?
– মানহার সাথে ওনার অনেক ভালো সম্পর্ক ওনাকে জানানো হয়নি যে আমরা দশ দিনের জন্য বাসায় চলে যাচ্ছি । সেটা জানানোর জন্য কল দিচ্ছিলাম।
– দশ দিনের ছুটি দিয়েছে আব্বু আপনাকে?
– স্যার বলছে তোমার যতদিন ইচ্ছে থেকে আসো।
– আজ বাসায় যাই আগে তারপর আব্বুর হচ্ছে । দেখুন এতো দিন ছুটি পাবেন না । তাড়াতাড়ি ঘোরাঘুরি শেষ করে চলে আসবেন।
– আমার চাকরি তো এখনই চলে গেলো আবার আসলো কেমনে?
– বেশি কথা বলবেন না একদম। আর হ্যাঁ গতকাল আসলেন না কেন আমার বার্থডে পার্টিতে? আপনাকে তে আমি ইনভাইট করছিলাম তাই না?
– হ্যাঁ । কিন্তু কাল রাতে আমি আর আমার মেয়ে মিলে কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছিলাম।
– ভালো। আচ্ছা সাবধানে যাবেন।
– হুম । আল্লাহ হাফিজ ।

মানহা ঘুমিয়ে গেছে । অনেক টা দূরের রাস্তা । এখন যদি মানহার আম্মু থাকতো তবে এটা কি ওটা কি ঐ দেখো জায়গাটা সুন্দর না? আমরা একদিন এখানে ঘুরতে আসবো কেমন? তুমি তো শুধু হুম বলো কিন্তু কখনো নিয়ে তো আসো না। এসব বলে পাগল বানিয়ে দিতো। তার চলে যাওয়ার এক বছর হচ্ছে কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আমার সেই ছেলেমানুষী করা প্রিয় মানুষটি যাকে নিজের থেকে বেশি বিশ্বাস করতাম সে আমার বিশ্বাসের গাছের শিকড় কেটে চলে গেছে । মানুষ গুলো ক্ষণস্থায়ী হলেও স্মৃতি গুলো দীর্ঘস্হায়ী । একটা বিষয় খুব গভীর ভাবে চিন্তা করে দেখবেন আমাদের হারিয়ে যাওয়া মানুষ গুলোর সেইসব স্মৃতি বার বার মনে পড়ে যেগুলোতে তারা আমাদের আনন্দে রাখতো। সম্পর্কের মাঝে এমন অনেক সময় আসছে যখন তারা আমাদের কষ্ট দিয়েছে কাঁদিয়েছে কিন্তু সেই সময়গুলো খুব কম পড়বে । খুশির সময়গুলো মনে পড়বে আর আফসোস হবে ইশ যদি সে আমার সাথে থাকতো তবে কতই না ভালো হতো আমার জীবনটা কতই না সুন্দর চলতো। না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে অনায়াসে একটা জীবন পার করে দেওয়া যায় কিন্তু আফসোস নিয়ে সেটা কখনোই সম্ভব হয় না।

হঠাৎ ফোনের রিংটোন বাজতেই কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসলো। আমাদের অতীত ভাবনাগুলো সব সময় শুরু হয় হাসি মুখে কিন্তু শেষ হয় চোখের জলে। জাহিন চোখ মুছে ফোন হাতে নিলো। মানহার ম্যাম কল দিছে ।
– হ্যালো।
– কল দিছলেন আপনি?
– হ্যাঁ । আমরা কিছু দিনের জন্য আমাদের বাড়িতে ঘুরতে যাচ্ছি তো সেটাই আপনাকে জানাতে।
– ওহ আচ্ছা । কবে ফিরবেন?
– সেটা এখনো ঠিক করিনি।
– মানহা কি করছে?
– ও ঘুমিয়ে গেছে ।
– আচ্ছা সাবধানে যাবেন।
– হুম ।

যতই বাসার কাছে আসছি ততই মনের মাঝে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আব্বুর সামনে কি করে দাড়াবো? আব্বুকে কি বলবো? আব্বু কি আমার সাথে কথা বলবে!

বিকেলের দিকে এসে নামলাম । বাস স্টান্ড থেকে খুব বেশি দূরে নয় আমাদের বাসা। যখন স্কুলে পড়তাম তখন এই রাস্তা দিনে দুই বার হেঁটে যাওয়া আসা করছি। অনেক বছর পর আজ নিজের মায়ের কোলে ফিরে যাচ্ছি । মনের মাঝে কোথায় যেন একটা সুপ্ত আনন্দ অনুভব করছি।
মানহা হাঁটবে না জন্য রিকশা নিলাম । মেয়েটাও একদম মায়ের মতো হয়েছে অলস ।
আমরা এক বাসাতেই সবাই থাকি। আমাদের পরিবার আর দুই চাচ্চুর পরিবার। বাসার সামনে নামতেই গেইটের বাইরে থেকেই বুঝতে পারছি বাসার ভিতরে অনেক মেহমান আসছে । যদিও বা বিয়ের এখনো দুই দিন আছে ।

বাসায় কেউ মানহার আম্মুর ব্যাপারে জানে না। এমনিতেই তাদের সবার অমতে বিয়ে করছি। এরপর যদি জানতে পারে আমি ও তাকে রাখতে পারিনি তবে তাদের সামনে মুখ দেখানোর অবস্থায় থাকবো না। যদিও বা শুধুই আম্মুর সাথে কথা হতো। কিন্তু আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সবার প্রোফাইলে ফলো করতাম যার জন্য আাসার সকল পরিস্থিতি সব সময় আমার জানা ছিলো।

– বাপি এটা কার বাড়ি?
পুরো রাস্তা মানহার একটাই প্রশ্ন ছিলো বাপি আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমি সব সময় শুধু বলেছি যেখানে যাচ্ছি সেখানে তোমায় আদর করার জন্য অনেক মানুষ আছে । আমরা এমন একটা জায়গায় যাচ্ছি।
– এটা আমার বাড়ি আম্মু ।
– এটাও আমাদের বাড়ি?
– হ্যাঁ এটা তোমার দাদু বাড়ি।
দাদু বাড়ি শুনতেই মানহা গেইট খুলে ভিতরে গেলো। মেয়েটা কতবার জিজ্ঞেস করেছে বাপি আমার দাদু বাড়ি নানু বাড়ি নেই কেন তাকে কখনো এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য পরিবার সন্তান সবার কাছেই অপরাধী হয়ে ছিলাম এতোদিন । অনেক প্রশ্নের উত্তর থাকা সত্বেও কখনো মুখ ফুটে উত্তর দিতে পারিনি। গেইটের একটু ফুক দিয়ে দেখত পাচ্ছি বাসার সামনে আলপনা আঁকছে কয়েকজন । মানহাকে দেখে কেউ একজন বললো
– এই মেয়ে কে তুমি? আলপনা নষ্ট হয়ে যাবে তো।
কেউ একজন মানহার খুব কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো
– তোমার নাম কি?
কন্ঠটা শুনে কলিজা শান্ত হয়ে গেলো। আব্বু এখনো বাচ্চা ততটাই পছন্দ করে আগে যতটা করতো। সামনে থেকে কেউ একজন বললো- মেয়েটার চোখ গুলো একদম জাহিনের মতো তাই না। তোমার আব্বুর নাম কি?
এটাই ছিলো আম্মু । আজ কত বছর হচ্ছে তবুও আমার মেয়ের মাঝে আমায় ঠিক খুঁজে নিয়েছে । মায়েদের চোখ ফাঁকি দেওয়া আর পৃথিবীর যেকোনো কঠোর জেলখানা থেকে পালিয়ে আসা ঠিক একই কঠিন কাজ। জাহিন গেইটের এপাশে থেকে দাঁড়িয়ে শুধু তাদের কথা শুনছে । ভিতরে মানহা কাকে কি বলবে না বুঝতে পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ।

To be continue…..