আলোকবর্ষ পেরিয়ে পর্ব-০৪

0
480

#আলোকবর্ষ_পেরিয়ে ( এই উপন্যাসটি সম্পূর্ন পোস্ট হবে অক্ষরের পেজে) ( চতুর্থ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৮>
তবে এই দিনগুলোতে মেঘা রোজ খেয়াল করছিল ওর দাদার বদলটা । ডিনার করতে করতে মাঝে মাঝেই মেসেজ আসার শব্দে মুখে একটা হাসি চলে আসা ; ঐশীর কথা অনেক সময়ই নিজের কথার মধ্যে বলে ওঠা , আর মেঘার মুখে ঐশীর নামটা শুনলেও হঠাৎ হঠাৎ থমকে যাওয়া , এইসবই যে ভালো লাগার লক্ষণ কাউকে , এটা মেঘার বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি । তাই এই পঞ্চমীর দিন মেঘা আর অপেক্ষা করলো না । সোজা নিজের দাদার কাছে গিয়ে বলে উঠলো ,
—— ” তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে আমার । ”

অভীক এই মুহূর্তে ব্যাপারটা কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো ,
—– ” হ্যাঁ , কি কথা ? বল ।”
এই প্রশ্নে মেঘা সরাসরিই বললো ,
—– ” তুই কি ঐশী দি কে লাইক করিস ? দ্যাখ , আমার কাছে লুকিয়ে লাভ নেই । আমি তোর বোন । তুই হা বললে আমি হাওড়া বুঝি । আর আজকাল তোকে দেখলেই বোঝা যায় , ঐশী দি তোর কাছে কতটা স্পেশ্যাল । ”
এই কথায় অভীক ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছিল না । নিজের মুখে ‘ ভালোবাসি ‘ কথাটা কিছুতেই আসছিল না ওর । অদ্ভুত একটা সঙ্কোচ ঘিরে ধরছিল ওকে । কিন্তু নিজের বোনকে মিথ্যা কথাও ঠিক বলতে ইচ্ছে করছিল না যেন ।
তবে এই চুপ থাকার মাঝেই মেঘা বলে উঠলো ,
—- ” দাদা , তুই যদি ভালোবাসিস তাহলে বলছিস না কেন নিজের মনের কথা ! তোরা তো এখন ভালো বন্ধু ও হোস ।”
এর উত্তরে অভীক কিছুটা কিন্তু কিন্তু করে বললো ,
—- ” আসলে ঐশী আমাকে একবার বলেছিল যে ও নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে কোন বিজনেস ম্যান কে চায় না । ও একটা সাধারণ দশটা পাঁচটার চাকরি করা ছেলে চায় নিজের জন্য , যে ওকে অনেক সময় দিতে পারবে । আর এইসব জানার পর আমি কিভাবে ওকে আমার কথা !”
না , কথাগুলোকে আর শেষ করতে পারলো না অভীক । নিজের খেয়ালে চুপ করে গেল হঠাৎ । কিন্তু মেঘা বলে উঠলো এই মুহূর্তে কিছুটা জোর দিয়ে ,
—— ” দ্যাখ , ঐশী দি কিন্তু তোকে পছন্দ করে । ইভেন তোরা তো এখন ভালো বন্ধুও হয়ে গেছিস । তোর মনে আছে , তুই সেদিন বলেছিলিস হসপিটাল এ যতক্ষণ তোর ব্লাড দেওয়া কমপ্লিট হয়নি ; ঐশী দি ওয়েট করছিল তোর জন্য । ও তোকে আজকাল এত মেসেজ করে , কথা বলে , এইসব থেকে কিছু তো বোঝা যায় ! তুই ওর সাথে দেখা করে এবার নিজের ফিলিংসটা বলে দে । একবার চেষ্টা অন্তত কর নিজেকে এক্সপ্রেস করতে ! ঐশী দি হয়ত অপেক্ষা করছে এটার জন্যই !”
কথাগুলো এতটা দৃঢ় গলায় বললো মেঘা যে অভীক কোনভাবেই না বলতে পারলো না । হয়ত সত্যি ওর একবার ঐশীর সামনে নিজের মনের কথা বলা উচিত । একটা চেষ্টা অন্তত করা উচিত গল্পটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার । সেদিন এইসব ভাবনার মাঝেই ও মেসেজ টাইপ করেছিল একটা ঐশীকে ,
” ষষ্ঠীর দিন বিকেল পাঁচটায় দেখা হচ্ছে । আমি তোমাকে বাড়ি থেকে পিক করে নেব ।”
তারপর কিছু না ভেবেই সেন্ড বটন টা ক্লিক করে দিয়েছিল ফোনের । সত্যি জানে না এরপর কি হবে অভীক ! এই দেখাটা কোন মন ভাঙার গল্প শুরু করবে , না কি নতুন একটা চ্যাপ্টার শুরু হবে লাইফের ! তবে অভীক কে ঐশীর মুখোমুখি হতেই হবে , নিজের সমস্ত ফিলিংস গুলোকে একসেপ্ট করার জন্য ।

সেদিনের পর একটা সপ্তাহ পাড় করে পুজো চলেই এলো বাঙালির জীবনে । মা দুর্গা দশ হাতে সেজে ছেলে মেয়েকে নিয়ে মণ্ডপে মণ্ডপে হাজির । ঐশীর এই সময়টা বছরের সেরা সময় লাগে যেন , সেই ছোট থেকেই । সারাটা বছর অপেক্ষা করে ও , পুজোর এই চারটে দিনের জন্য । এই ঢাকের আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে ওঠা সকাল গুলোর জন্য । তবে এইবারের ষষ্ঠীর দিনটা যদিও একটু আলাদা ওর কাছে । আজকাল যে মনের অনেকটা জুড়ে আছে , তার সঙ্গেই ঠাকুর দেখার প্ল্যান আজ । কথাটা ভেবেই সকাল থেকে একটা হাসি এসে উঁকি দিচ্ছিল ঐশীর মুখে আনমনে । তবে এই আলতো হাসির আড়ালে দিন পেরিয়ে বিকেল চলেই এলো অবশেষে , আর অভীক ওদের দরজায় কলিং বেল বাজলো একদম ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে , পাঁচটার সময় । ঐশী যদিও আগে থেকেই রেডি হয়ে ছিল । মেরুন রঙের আনারকলি সালোয়ারের সঙ্গে খোলা চুলে নিজেকে বেশ কয়েকবার দেখেছিল আয়নায় । হয়তো অন্য কারোর কথা ভেবে সাজছিল আজ ! কিন্তু দরজা খুলে তাঁর থমকে যাওয়া দৃষ্টি দেখে ঐশীর মনেও একটা না বলা আনন্দ হলো ।
যাইহোক , এরপর অভীকের সঙ্গে বেরিয়েছিল ও কলকাতার রাস্তায় । শর্ত অনুযায়ী চিকেন রোল , মোমো ও খাইয়েছিল ঐশী ছেলেটাকে । তবে আইসক্রিম পার্লারে ঢুকে একটু নিরিবিলি তে বসে অভীক হঠাৎ অন্য কিছু কথা বলে উঠেছিল ওকে । কিছুটা স্থির গলায় অভীক বলেছিল সেদিন ,
—— ” ঐশী , আই ওয়ান্ট টু শেয়ার ইউ সমথিং .. জানি না তুমি কিভাবে নেবে ! বাট আই লাইক ইউ .. মোর দ্যান আ ফ্রেন্ড ..”
কথাগুলো বলেই অভীক চুপ হয়ে গেছিল আনমনে , আর খেয়াল করেছিল ঐশী ও কথাহীন হয়ে গেছে যেন ! আচমকা এরকম একটা কথার জন্য তৈরি ছিল না হয়ত মেয়েটা । কথাটা ভেবেই অভীক আবার বলে উঠেছিল একটু থেমে থেমে ,
—– ” আসলে আমার একটা পাঁচ বছরের রিলেশন ছিল । কিন্তু অঙ্কনার সাথে একটা সময়ের পর সম্পর্কটা পুরো এক তরফা হয়ে গেছিল । ও তো আমার টাকার জন্য , নিজেদের ব্যবসায় কনট্যাক্ট স বাড়ানোর জন্য ইউজ করছিল জাস্ট ! এমনকি মেঘার সঙ্গে আমার ডিসটেন্স তৈরি করার ও চেষ্টা করেছিল একটা । আমাকে না জিজ্ঞেস করে মেঘাকে একটা হোস্টেলের ফর্ম ধরিয়ে দিয়েছিল এটা বলে যে আমি চাই মেঘা আমাদের থেকে দূরে থাকুক । মা বাবা মারা যাওয়ার পর আমি না কি ক্লান্ত হয়ে গেছি মেঘার দেখাশোনা করতে করতে ! কথাগুলো যেদিন শুনেছিলাম , তারপরই আমি একটা ফোন কলে সব কিছু শেষ করে দিয়েছিলাম অঙ্কনার সঙ্গে । পাঁচ বছরের সম্পর্ক একদিনে জাস্ট ডিলিট করে দিয়েছিলাম নিজের লাইফ থেকে ! এরপর সত্যি মনে হতো আর কোনদিন কারোর জন্য ফিল করবো না আমি । ভালোবাসা ওয়ার্ড টা ও মিথ্যে ছিল আমার কাছে ।”
কথাগুলো একসাথে বলে থামলো এবার একটু অভীক । হয়ত পুরনো সময় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কিছুটা সময় নিল ও ! তারপর আবার বলে উঠলো , স্থির গলায় ,
——- ” কিন্তু আমার এই থিঙ্কিং টা চেঞ্জ করে দিয়েছো তুমি । প্রথম দিন থেকে , তোমাকে আলাদা লেগেছে ভীষণ । সবার থেকে আলাদা ! আর আস্তে আস্তে কিভাবে আমি ফিল করতে শুরু করেছি তোমার জন্য ; নিজেও বুঝিনি ! আমি জানি , আজ হয়ত আমাকে না ই শুনতে হবে । আসলে তুমি যেরকম লাইফ পার্টনার চাও , আমি তো সেরকম নই ! দশটা পাঁচটার চাকরি নেই আমার । কিন্তু তাও বললাম নিজের কথা । আমি জানি না এক্সপ্রেস করতে পারলাম কি না ! বোঝাতে পারলাম কি না কিছু ! তবে একটাই রিকুয়েস্ট , যা বলেছি সেটা শোনার পর বন্ধুত্ব টা ভেঙ্গো না প্লিজ । আমি সেটা একসেপ্ট করতে পারবো না !”
কথাগুলো কেমন এক মনে বলে গেল অভীক । যেন নিজের সমস্ত জমানো ফিলিংস গুলো কে ঐশীর সামনে রেখে দিল জড়ো করে । জানে না যদিও , এরপর উত্তরটা কি হবে ! হয়ত কিছু স্বান্তনা , মন ভাঙার স্মৃতি নিয়ে ফিরবে বাড়ি ! কিন্তু তাও কথাগুলো বললো , নিজেকে এক্সপ্রেস করার একটা চেষ্টা অন্তত করলো আজ ।
এইসবই ভাবছিল অভীক এক মনে । ভিড় আইসক্রিম পার্লারে লোকের আওয়াজটাও যেন কেমন স্তব্দ হয়ে গেছে এই মুহূর্তে ওর চারপাশে ! কিন্তু সেই সময়েই হঠাৎ অভীক একটা স্পর্শ অনুভব করলো । ঐশী নিজের থেকে ওর হাতটা ধরলো আজ , খুব শক্ত করে । তারপর স্থিরভাবে ওর দিকে তাকিয়ে বললো ,
—— ” আমি তোমার মতন মানুষ পাবো না কখনো । এই কদিনে এটা অন্তত বুঝেছি । তবে বিয়ের পর সময় দিতে হবে কিন্তু । সারাক্ষণ কাজ কাজ করলে চলবে না । আগে থেকেই বলে দিলাম ।”
কথাগুলো বলে আলতো হাসলো ঐশী । আর এই মুহূর্তে অভীকের মুখেও আচমকা একটা হাসি । এতক্ষণের থমথমে পরিস্থিতিটা কাটিয়ে কাউকে নিজের করে পাওয়ার হাসি । ঐশী যে ওকে হ্যাঁ বলবে আজ , সেটা একদম ভাবেনি আসলে ! তবে ঐশী ও ভাবেনি ঠিক , যে যাকে আস্তে আস্তে ভালোবাসতে শুরু করেছিল , সেও সমানভাবে ফিল করে ওর জন্য ! গল্পটা যে শুধু ওর না , দু তরফা , এটা জেনে আজ অন্য রকম একটা ভালো লাগছিল মনে । অভীক এর সঙ্গে নতুন দিনগুলোর স্বপ্ন এসে ভিড় করছিল চোখে ।

<৯>
এই স্বপ্ন গুলো ধীরে ধীরে সত্যি হলো জীবনে । অভীকের হাত ধরেই শুরু হলো নতুন পথ চলা ঐশীর । বাইশে জানুয়ারি বিয়ে হলো দুজনের । সাত পাকে বাঁধা , উলু ধ্বনি , সিঁদুর দানের মাঝে এক হলো দুটো মন ।
এরপরের দিন গুলো বেশ রূপকথার মতন ছিল দুজনের কাছে ! ঐশী অভীকের জীবনে এসে নতুন করে চিনছিল যেন ছেলেটাকে । মেঘা ওর জীবনে কতোটা ইম্পর্টেন্ট এটা প্রথম দিন থেকেই বুঝেছিল যদিও । কিন্তু অভীক যে মেঘা কে নিয়ে কতটা ভাবে , সেটা জানলো ফুলসজ্জার রাতে । অভীক সেদিন ওকে খুব নিজের ভেবেই বলেছিল আসলে ,
—– ” মা বাবা মারা যাওয়ার সময় মেঘার ক্লাস এইট ছিল । ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়ে ! আমি বুঝতে পারছিলাম না সেই সময় ওকে সামলাবো কি করে ! আমারও তখন কলেজের ফাইনাল ইয়ার । ব্যাবসার সমস্ত রেসপনসিবিলিটিও তখন হঠাৎ করে আমার ওপর ! এত কিছু যে সেই সময় কি করে একসাথে সামলিয়েছিলাম , আমিই জানি । তারপর থেকেই আমি মেঘাকে নিয়ে একটু বেশিই প্রটেকটিভ হয়ে গেছি ! ওর ছোট ছোট ব্যাপারে ডিশিশনস , সব আমি নিই । ওকে আগলে রাখাটা স্বভাব হয়ে গেছে যেন । যাইহোক , জানি তুমি এটা বুঝবে । ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে খুব বিশ্বাস নিয়ে তাকিয়েছিল অভীক ঐশীর দিকে । ঐশী বুঝেছিল এই দৃষ্টির মানে । আজ থেকে মেঘা শুধু অভীকের না , ঐশীরও রেসপনসিবিলিটি , এটাই বলতে চেয়েছিলো ছেলেটা । ঐশী সেই মুহূর্তে আস্তে গলায় উত্তর দিয়েছিল ওকে ,
—— ” আমি বুঝেছি । আর তুমি চিন্তা কোরো না । মেঘার জীবনে আর কখনো কিছু খারাপ হবে না । আমিও তো আছি এখন।”
কথাটা বলে আলতো হেসেছিল ঐশী ; আর অভীক হঠাৎ জড়িয়ে ধরেছিল ওকে , ভীষণ শক্ত ভাবে । হয়ত একটা আশ্রয় খুঁজে পেতে চাইছিল ঐশীর মধ্যে । এতদিন একা একা সমস্ত দ্বায়িত্ব , কাজের চাপ , সবটা সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত হয়ে গেছিল মনে মনে । তাই ঐশীকে পেয়ে খুব নির্ভর করতে ইচ্ছে করতে ইচ্ছে করছিল যেন হঠাৎ অভীকের । তাই খুব শক্ত করে আঁকরে ধরেছিল ওকে । নিজের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে ।

এরপর দিন যত এগিয়েছে , ঐশী যেন জড়িয়ে গেছে আস্টে পৃষ্টে অভীক আর মেঘার জীবনের সঙ্গে , এই নতুন সংসারে । যদিও নিজের একাউন্টেন্ট এর চাকরিটা ছাড়েনি ও । তবে বাড়িতে তিন চারটে কাজের লোক থাকা সত্বেও ঐশী রান্না করতো রোজ ওদের পছন্দের জিনিস , তারপর নিজের হাতে খেতে দিত সবাইকে , তারপর অফিস যেত । যদিও অভীক বার বার বারণ করতো ঐশীকে এত কিছু করতে ! এই যেমন সেদিন মাছ ভাজতে গিয়ে তেলের ছিটে লেগে ঐশীর যখন হাতটা পুড়ে গেছিল , সেই দেখে অভীকের কি চিন্তা ! ও তো পারলে ডাক্তারকেই কল করে দিচ্ছিল সেই মুহূর্তে । ঐশী কোন রকমে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করেছিল ছেলেটাকে । তারপর অভীক খুব জোর দিয়েই বলেছিল ,
—- ” বাড়িতে এত কাজের লোক ! তোমার সত্যি কি দরকার বলো তো এত কষ্ট করে রান্না করে ? হাতটা পুড়ে গেল তো ! ইশ , কত লাগছে এখন !”
কথাগুলো মাথায় এক গাদা চিন্তার ভাঁজ নিয়ে বলেছিল অভীক । ঐশী সেই মুহূর্তে আলতো করে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে । তারপর শান্ত গলায় বলেছিল ,
—- ” আমার ভালো লাগে তোমাদের জন্য রান্না করতে । আর এই টুকু লাগা তে কিছু হয় না । রান্না করতে গেলে এরকম একটু আধটু তেলের ছিটে লাগে । এই নিয়ে এত চিন্তা করার কিছু হয়নি , বুঝলে ।”
কথাটা বলে ঐশী নাকটা টিপে দিয়েছিল অভীকের মজা করে । যদিও অভীকের চিন্তা তারপরেও কমেনি । ও তো এরপর থেকে মাঝে মাঝেই রান্না ঘরে এসে হাজির হতো ঐশীর রান্না করার টাইমে , পাহারা দেওয়ার জন্য ।
তবে এইসবের মাঝে মেঘা একটা নতুন বেস্ট ফ্রেন্ড খুঁজে পেয়েছিল নিজের । ঐশী এখন ওর শপিং , সিনেমা দেখা , রেস্টুরেন্ট এ খাওয়া , সবের সঙ্গী । নিজের ছোট ছোট কথাগুলো মেঘা আজকাল ঐশীর সাথে শেয়ার করে । কলেজে কি হলো , কোন বন্ধু কি বললো , কোন স্যার ম্যাম কিরকম , এইসব নানারকম এলোমেলো কথা বলে ও ওর বৌদিভাইকে । হ্যাঁ , এই নামটা বিয়ের প্রথম দিন থেকেই ঐশী পেয়েছে মেঘার কাছ থেকে । তবে মাঝে মাঝে মেঘা একটু অন্য কথাও বলে কিছুটা বেহিসেবী হয়ে । এই যেমন অভীক ওকে নিয়ে সেই ছোটবেলা থেকেই ভীষণ প্রটেকটিভ ; মা বাবা মারা যাওয়ার পর মেঘাকে আঁকরে ধরেই তো বাঁচে আসলে ! তাই সারাক্ষণ ওকে আগলে আগলে রাখে । কিন্তু অনেক সময়ই এই জন্য মেঘাকে নিজের ছোট ছোট ইচ্ছে গুলোর সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করতে হয় । যেমন ওর কলেজে নিজের পার্সোনাল কারে যেতে ভালো লাগে না একটুও । বন্ধুদের সঙ্গে বাসে করে সাধারণের মতন যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু অভীক সেটা একদিনের জন্যও এলাও করে না । এই গাড়িতে যাওয়ার জন্য কলেজের অনেকেরই ধারণা হয়েছে মেঘা সবার থেকে একটু আলাদা । বড়োলোকের কষ্ট না করতে পারা মেয়েরা যেমন হয় আর কি । সেই নিয়ে কেউ কেউ তো মুখের ওপর বলেও দেয় ! কিন্তু অভীক এইসব শুনেও গুরুত্ব দেয় না কখনো । অভীক নিজে সাধারণের মতন জীবন যাপন করলেও মেঘাকে সব সময় একটা কাঁচের পৃথিবীর মধ্যেই রাখতে চায় ; যেখানে কোন কষ্ট , কোন প্রতিকূলতা ওকে ছুঁয়েও দেখবে না কোনভাবে । মেঘার তবে অন্য স্বপ্ন । ও তো একা ড্রাইভ করে কোন রোড ট্রিপে যেতে চায় , ট্রেকিং এর কোর্স করে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতে চায় , একটা বাস্তবে ভরা রঙিন জীবন চায় ও , যেখানে প্রত্যেকটা দিন নতুন নতুন এক্সপিরিয়েন্স নিয়ে আসবে জীবনে ! কিন্তু অভীক ওর এই মনের কথাগুলো বুঝতে পারে না বিশেষ । ট্রেকিং তো দূরে থাক , এমনকি ওকে কলেজ এক্সকারশনেও যেতে দেয়নি কখনো ।
ঐশী এই কথাগুলো যখন শোনে , খুব অদ্ভুত লাগে ওর অভীক কে তখন । আসলে ঐশীর মনে হয় প্রত্যেকেরই নিজের নিজের মতন করে বাঁচার অধিকার আছে । একটাই তো জীবন ! সেখানে নিজের সমস্ত ইচ্ছেগুলোকে পূরণ করার চেষ্টা সবারই করা উচিত । অভীকের এই খুব আগলে রাখার জন্য মেঘা হয়ত নিজের ছোট ছোট আনন্দগুলো হারিয়ে ফেলছে কোথাও ! যেগুলো আর ও কোনদিন ফিরে পাবে না ।

যাইহোক , এই এলোমেলো দিনগুলোর মাঝে মেঘা একটা সারপ্রাইজ দিয়েছিল ওর দাদা আর বৌদি ভাইকে । নিজে দুটো কাশ্মীর এর ফ্লাইটের টিকিট কেটে মেল করে দিয়েছিল অভীকের কাছে । যদিও অভীক প্রথমে একদমই যেতে রাজি ছিল না ! বোনকে একা বাড়িতে রেখে ঘুরতে যাওয়ার কথাই মাথায় আসেনি ওর । কিন্তু মেঘা এইসব দেখে সেই পুরনো থিওরিটাই এপ্লাই করেছিল অভীকের ওপর । একদিনের জন্য খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে অনশন শুরু করে ছিল এমন যে অভীক কে রাজি হতেই হয়ে ছিল অবশেষে হানিমুন ট্রিপের জন্য ।
তবে এরপর কাশ্মীর এ গিয়ে যদিও মূহুর্ত গুলোর মধ্যে জড়িয়ে গেছিল অভীক ঐশীর সাথে ! পাহাড়ের কোলে ওদের ছোট্ট কটেজটায় যেন হারিয়ে গেছিল দুজন দুজনের মধ্যে । বাইরে যখন ঝুরো ঝুরো বরফ পড়ছিল , অভীক ঐশীকে কাঠের কটেজের বারান্দায় যেন আঁকরে ধরে ছিল নিশ্চুপ ভাবে , আর নিস্পলক চোখে দেখছিল সাদা চাদরে মোড়া শহরটাকে । তারপর ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিল ঐশীর নরম শরীরে , ঠোঁটের উষ্ণতায় ।

চলবে