আলোকবর্ষ পেরিয়ে পর্ব-০৫

0
434

#আলোকবর্ষ_পেরিয়ে ( এই উপন্যাসটি সম্পূর্ন পোস্ট হবে অক্ষরের পেজে ) ( পঞ্চম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১০>
এই রঙিন দিনগুলো কাটিয়ে এরপর যখন ওরা শহরে ফিরেছিল তখন ফেব্রুয়ারি মাস পরে গেছে। শহর জুড়ে হালকা কুয়াশা , আর মিষ্টি শীতের আমেজ ছড়িয়ে । এইসব এর মাঝে দিনগুলো ভালোই কাটছিল বেশ ; কিন্তু সেই রবিবার একটা ঘটনা ঘটলো । ঐশী মেঘাকে নিয়ে শপিং এ গেছিল সেদিন । মেঘার সামনেই জন্মদিন। তাই কিছু কেনাকাটি করতে গেছিল দুজনে। তবে কোন প্রাইভেট কারে নয়, বাসে, যাকে বলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। আসলে গাড়িটা বেরোনোর সময় খারাপ হয়ে যাওয়ার জন্য মেঘাই জেদ করছিল নিজে। এইরকম সুযোগ তো সব সময় আসে না! গাড়ির কাঁচের বদ্ধ পৃথিবীর বাইরে সাধারণের পৃথিবীটা দেখার সুযোগ। তাই জোর করেই ঐশীকে রাজি করিয়েছিল বাসে যাওয়ার জন্য। তবে ঐশী ও শেষে না করেনি আর। মেঘাকে নিয়ে খুব মজা করেই শপিং করতে গেছিল সেদিন। তারপর ফেরার পথে আবার প্রিন্সেপ ঘাটে ঘুরে ফুচকা খেয়ে ফিরেছিল সন্ধ্যের সময়। কিন্তু কথাটা যখন অভীকের কানে গেছিল, তখনই বিপত্তি। যদিও মেঘা ঐশী দুজনের কেউই বলেনি কিছু ওকে প্রথমে, কিন্তু ড্রাইভারের কাছ থেকে গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ার কথাটা শুনে অভীক নিজেই এসেছিল ঐশীর কাছে, তারপর আনমনে জিজ্ঞেস করেছিল,
——” গাড়ি আজ খারাপ হয়ে গেছিল শুনলাম! গেলে কি করে তোমরা দুজন তাহলে? ওলা উবের কিছু একটা করে নিয়েছিলে না কি?”
এই প্রশ্নে ঐশী খুব সহজ ভাবে বলেছিল,
——” না, বাসে করে গিয়েছিলাম আমরা।”
এটা শুনে অভীক যেন আকাশ থেকে পড়েছিল সেই মুহূর্তে! ও অবাক হয়ে বলেছিল ঐশীকে,
——” কি! তুমি মেঘাকে নিয়ে বাসে উঠেছিল! ”
এই কথায় ঐশী নির্বিকার ভাবেই উত্তর দিয়েছিল,
—– ” কেন? না ওঠার কি আছে! ”
এটা শুনে অভীক বেশ সিরিয়াস হয়ে গেছিল সেই মুহূর্তে। ও কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বলেছিল,
—– ” মেঘার কি বাসে ট্রেনে চড়ার অভ্যাস আছে! ওই ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে ওঠা, নামা; যদি পরে যেত মাঝ রাস্তায়, বা বাসের ভেতরে, তাহলে কি হতো?”
এই কথাগুলো শুনে ঐশী কিছুটা অবাক হয়েই বলেছিল,
—–” এত ওভার রিয়্যাক্ট করছো কেন! পৃথিবী শুদ্ধু লোক পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এ যাতায়াত করে। আজ মেঘাও করেছে। এই নিয়ে এত চিন্তা করার কিছুই হয়নি। ”
কথাটা বেশ শান্ত গলায় বলেছিল ঐশী। কিন্তু অভীক এটা শুনে কেমন রেগে গেছিল হঠাৎ। ও বেশ কঠিনভাবে ই উত্তর দিয়েছিল এক কথায়,
—–” সবাই আর মেঘা এক নয়। সবাই যেটা করে আমার বোনকেও সেটাই করতে হবে, এরকম কোন মানে নেই! আর আমার কাছে ওর সেফটিটাই সবার আগে। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই অভীক রাগে উঠে চলে গেছিল ঐশীর সামনে থেকে। কিন্তু এই প্রথম ঐশীর এই ব্যাবহারটা খারাপ লেগেছিল কেমন। অভীক এই সাধারণ কথায় এতটা রেগে যাবে যে, ভাবেনি আসলে।
সেদিন এসবের পর ঐশী কিছুটা চুপ করে গেছিল নিজের মনে। চাইলেও কোন কথা আসছিল না ওর অভীকের সাথে। তবে সেই রাতে অভীক ব্যাপারটা খেয়াল করে ছিল। তাই নিজেই এসেছিল ঐশীর কাছে। তারপর একটু আস্তে গলায় বলেছিল,
—— ” কি হয়েছে? এত চুপ?”
এই প্রশ্নে ঐশী একটু সময় নিয়ে বলেছিল,
—— ” এমনি, কি বলবো আর! ”
এই কথাটা শুনে অভীক বলে উঠেছিল কিছুটা থেমে থেমে,
—— ” সরি.. আমি রুডলি কথা বলেছি আজ। ওইভাবে বলাটা আমার ঠিক হয়নি। ”
এটা শুনে ঐশী হঠাৎ নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
—– ” তোমাকে আমি অন্য রকম ভেবেছিলাম। যে সাধারণের মতন থাকতে ভালোবাসে! এত বড় বিজনেস ম্যান হওয়া সত্বেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খায়, হেঁটে ঠাকুর দেখে! কিন্তু আজ একটা সাধারণ বাসে চড়া নিয়ে তুমি যেভাবে রিয়্যাক্ট করলে; আমি ঠিক যেন মেলাতে পারলাম না তোমাকে সেই আগের মানুষটার সাথে! ”

ঐশীর এই কথাগুলো শুনে অভীক চুপ ছিল কিছুক্ষণ সেই মুহূর্তে। আসলে কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছিল না। তাও নিজেকে স্পষ্ট করার জন্য কিছু কথা ভেবে বললো,
—— ” আমি মেঘাকে নিয়ে খুব প্রোটেক্টটিভ মা বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই। আর এটা আমি আগেও বলেছিলাম। মেঘার কোন ব্যাপারে কোন অসুবিধা হোক, কষ্ট হোক, এটা আমি চাই না। আর ওকে যখন আমি একটা ভালো লাইফস্টাইল দিতে পারছি, তাহলে কেন ও জীবনে কোনরকম কষ্ট করবে! আর ওর তো এইভাবে যাতায়াত করার অভ্যাসও নেই। কোনভাবে যদি লেগে যেত, বা ভিড়ের মধ্যে উঠতে গিয়ে পড়ে যেত তাহলে!”
কথাগুলো বেশ জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছিল অভীক যেন। কিন্তু ঐশী এই মুহূর্তে ওকে থামিয়ে নিজে থেকে বলে উঠেছিল দৃঢ় গলায়,
—– ” মেঘা আজ নিজে যেতে চেয়েছিল বাসে। ইনফ্যাক্ট শুধু আজ না, ও তো রোজ কলেজ বাসে যেতে চায়। বন্ধুদের সঙ্গে হই হই করে এক্সকার্শন এ যেতে চায়, ট্রেকিং করতে চায়। আসলে কাউকে নিয়ে প্রটেকটিভ হওয়ার মানে এটা না যে তার কাছ থেকে নিজের মতন করে বাঁচার অধিকার টা কেরে নেওয়া! মেঘা যদিও এইসব কোনদিন নিজের মুখে তোমাকে বলবে না, কিন্তু এই কথাগুলো ওর মনে রয়ে যাবে ঠিকই, হয়ত সারা জীবন।”
কথাগুলো বলে ঐশী খেয়াল করেছিল অভীকের নিঃস্তব্ধতাকে। কিন্তু সেই মুহূর্তে ও আর কথা বাড়ায়নি কোন। ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পরেছিল চুপচাপ, আর কথাহীন হয়েই কেটে গেছিল রাতটা।
কিন্তু এরপর আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল। মেঘাদের কলেজের থার্ড ইয়ারের এক্সকার্শনের ডেট দিয়েছিল সেই মাসে। আর মেঘা কথাটা এসে বলেছিল ওর বৌদিভাইকে। এই একমাত্র মানুষই ওর ভরসা। যদি কোনভাবে দাদাকে রাজি করাতে পারে!
ঐশীও এবার নিজে থেকে চেষ্টা করেছিল। ও অভীক অফিস থেকে ফেরার পর মেঘাকে সাথে করে অভীক এর কাছে নিয়ে এসে বলেছিল,
—–” মেঘার কলেজে এক্সকারশনের ডেট দিয়েছে। আর মেঘা এই ট্রিপটায় যেতে চায়। ”
কথাটা শুনে অভীক সঙ্গেই সঙ্গেই বলেছিল,
—–” মানে? কোথায় এক্সকার্শন? আর মেঘা , তুই ঘুরতে যেতে চাস, এটা আমাকে আগে বলিসনি কেন?”
প্রশ্নটা শুনে মেঘা একটু ইতঃস্তত করে বলেছিল,
—–” না, মানে! দাদা..”
ওর কথাটাকে এবার শেষ হতে না দিয়েই অভীক বলেছিল,
——-” তুই একদম ভাবিস না। আমি এক্ষুনি ফ্লাইটের টিকিট বুক করছি। তোর আমার আর ঐশীর। কোথায় ঘুরতে যেতে চাস বল, আমি সেখানকারই টিকিট বুক করছি।”
কথাগুলো বেশ হাসি মুখেই বলেছিল অভীক। কিন্তু ঐশী এসব শুনে মাথায় হাত দিয়েছিল নিজের। তারপর অভীকের পাশে বসে নরম গলায় বলেছিল,
——-” মেঘা এইভাবে বেড়াতে যেতে চায় না। ও বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যেতে চায়। এক্সকারশন আর ফ্যামিলি ট্রিপ এক না অভীক।”
এটা শুনে অভীক বেশ উত্তেজিত হয়ে উত্তর দিয়েছিল,
——” সেটাই। এক্সকারসন আর ফ্যামিলি ট্রিপ এক না! ওদের কলেজ থেকে হয়ত ট্রেনে করে নিয়ে যাবে নন এসিতে, তারপর কি না কি হোটেলে রাখবে! এমনকি রুম পর্যন্ত শেয়ার করতে হবে। এইভাবে তো ওর অভ্যাসই নেই ঘোরার!”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল অভীক। কিন্তু এবার মেঘা আস্তে গলায় বলে উঠেছিল,
—–” আমি ম্যানেজ করে নেব দাদা। কোন অসুবিধা হবে না আমার। ”
এটা শুনে অভীক আর কি বলবে বুঝতে পারেনি ঠিক। তখন ঐশী বলে উঠেছিল নিজে থেকে,
—– ” বন্ধুদের সঙ্গে মিলে কলেজ লাইফে আনন্দ করবে না তো কবে করবে! এই স্মৃতিগুলো তো সারা জীবন থেকে যায়। আর এরকম এক্সকারশনে এত মজা হয়, যে ছোট ছোট কম্প্রোমাইজ গুলোর কথা মাথায়ও থাকে না তখন। তুমি এবার পার্মিশনটা দিয়ে দাও। ওকে আর না বোলো না।”
এই কথার সাথে মেঘাও এবার তাল মিলিয়ে বললো, ——” প্লিজ দাদা, আর না বলিস না। এমনিও এটা আমার কলেজের লাস্ট ইয়ার। আগের দু বছর তো যেতে দিসনি। এই থার্ড ইয়ারে প্লিজ রাজি হয়ে যা। ”
কথাগুলো বলে ও অভীকের হাত দুটো ধরেছিল শক্ত করে।
না, এই মুহূর্তে অভীক আর অরাজি হতে পারেনি কিছুতেই। এত করে যখন সবাই বলছে তখন না বলবে কি করে আর! কথাটা ভেবেই ও একটু অন্ধকার মুখেই বলেছিল,
——-” ঠিক আছে, যা। এত যখন যাওয়ার ইচ্ছা, আমি আর কি বলি!”
কথাটা বেশ ভারী গলায় ই বলেছিল ও, কিন্তু মেঘা তখনই আনন্দে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে। আর ঐশীর মুখেও হাসি এসে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে। যাক, অবশেষে মিশন সাকসেসফুল। রাজি হলো তাহলে অভীক ওদের কথায়!
<১১>
কিন্তু মেঘার এই ট্রিপ টায় যাওয়ার দিনের পর থেকে ঐশী খেয়াল করলো অভীকের নিঃস্তব্ধ তা কে। মেঘাকে এইভাবে একা একা ছেড়ে যে অভীক শান্তিতে নেই, এটা বুঝতে পারছিল ঐশী। আর হয়ত একটা হালকা রাগ ওর ঐশীর ওপরও ছিল, মেঘার সাথে তাল মেলানোর জন্য। তাই ওর সাথেও একটা মাপা দূরত্ব রেখে চলছিল এই কদিন। প্রয়োজনের বেশি একটা কথাও বলছিল না অভীক। এর মধ্যে ঐশী নিজে থেকে এসেছিল ওকে বোঝাতে। রাত্রিবেলা ঘুমনোর সময় ঐশী আলতো করে অভীকের হাতটা ধরে বলেছিল,
—–” মেঘা ভালো আছে। কেন তুমি এত চিন্তা করছো! আমরাও তো আমাদের কলেজ লাইফে এরকম ঘুরতে গেছিলাম। মেঘাও সেরকম!”
কথাগুলো বেশ শান্ত স্বরে বলছিল ঐশী, কিন্তু অভীক ওকে মাঝখানে থামিয়ে দিল হঠাৎ। তারপর নিজের হাতটা ঐশীর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো কিছুটা কঠিন গলায় ,
—–” আমি এই নিয়ে কোন কথা বলতে চাই না। রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পরো।”
কথাটা শেষ করেই অভীক ঐশীর থেকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পরলো সেই মুহূর্তে। কিন্তু ঐশী আজ কিছুতেই ঘুমোতে পারলো না যেন। অভীকের এই অকারণ রাগ, মুখ ফিরিয়ে থাকাটা যেন মনে মনে বিঁধছিল ওকে। এই নীরব অশান্তিতে এই কটা দিন কেমন অসহ্যকর লাগছিল ওর।
যাইহোক, তবে মেঘা ঠিকঠাকভাবে ফেরার পর অভীকের যেন শান্তি হয়ে ছিল মনে। মেঘার হাসি মুখটা, ওর কাছে এই ট্রিপের নানা রকম মজার এক্সপিরিয়েন্স এর কথা শোনার পর ধীরে ধীরে রাগটা চলে গেছিল অভীকের। মনে হয়েছিল হয়ত ঐশীর কথাটাই ঠিক; ও এই কদিন একটু বেশি ভেবে ফেলেছে সব কিছু নিয়ে। শুধু শুধু টেনশন করেছে এত।
সেই রাতে কথাগুলো ভেবেই ও নিজে থেকে এসেছিল ঐশীর কাছে। কিন্তু ঘরে ঢুকেই থমকে গেছিল হঠাৎ। ঐশী একটা ব্যাগ গোছাচ্ছিল জামা কাপড় এর। ও কিছুটা অন্যমনস্ক ছিল, তাই ঠিক খেয়াল করেনি অভীক কে। কিন্তু অভীক এই মুহূর্তে ওর কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিল অবাক হয়ে, —–” এখন ব্যাগ গোছাচ্ছ কেন তুমি? কোথায় যাবে?”
ঐশী এই প্রশ্নে অল্প কথায় ই বলেছিল,
——” বাবার কাছে। অনেকদিন যাওয়া হয়নি তো, তাই।”
এটা শুনে অভীক ক্লু লেস হয়েই জিজ্ঞেস করেছিল আবার, —— ” তুমি বাবার কাছে যাবে আগে বলোনি তো আমাকে!”
এই প্রশ্নে ঐশী কিছুটা স্থিরভাবে উত্তর দিয়েছিল,
—– ” এই কদিন কত টুকু কথা হয়েছে আমাদের! যাইহোক, আজ রাতে আমি মেঘার সঙ্গে শোবো। ওর অনেক গল্প জমে আছে আমার সঙ্গে। কাল থেকে তো থাকবো না! আজ রাতে তাই আমরা এক সাথে গল্প করতে করতে ঘুমোবো।”
কথাগুলো সেদিন বলে ঐশী আর অপেক্ষা করেনি। ব্যাগের চেনটা টেনে বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। হয়ত একটা আড়াল খুঁজছিল ও অভীকের থেকে; আসলে কারোর ব্যাবহারে খারাপ লাগলে ঐশী সোজাসুজি যদিও কিছু বলতে পারে না, কিন্তু মনের দিক থেকে দূরে সরে যায় হঠাৎ।
সেই রাত পেরিয়ে এরপর ভোর যখন হয়েছিল, ঐশী অভীক কে ঘুম থেকে আর ডাকেনি, নিজেই গাড়ি বুক করে চলে এসেছিল বাবার বাড়ি। এই কদিনের নিঃস্তব্ধ তা, কথাহিন সময়টাকে পেরিয়ে আজ যেন একটু নিজের সঙ্গে থাকতে চাইছিল ও। আর এই একলা থাকার ভিড়ে বাবাই তো ওর একমাত্র ঠিকানা!
কিন্তু সকালে উঠে অভীক ঐশীকে দেখতে না পেয়ে বুঝেছিল সবটা। এই কদিন ওর দূরে দূরে থাকা, চুপ থাকা, এইসবের জন্যই ঐশী চলে গেছে এইভাবে। হয়ত একটু বেশিই রিয়্যাক্ট করে ফেলেছিল অভীক এই কদিন! কথাটা ভেবে ওর নিজের ওপরই রাগ হলো কেমন। ঐশীর সামনে ওইভাবে চুপ করে যাওয়াটা সত্যি ঠিক হয়নি ওর। কথাগুলো মনে হতেই অভীক কল করেছিল ঐশীকে। কিন্তু ফোনের ওপার থেকে শুধু প্রয়োজন মতন উত্তর টুকু এসেছিল সেদিন। ঐশী কেমন যেন বেশি কথা বাড়াতেই চাইছিল না নিজে। আর তারপর থেকে অভীক কে ও কোন ফোন করেনি আর। এইসব এর মাঝে দিনগুলো যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করেছিল অভীকের। দুটো দিন এই মন খারাপের ভিড়ে চোখের পলকে কেটে গিয়েছিল ওর। কিন্তু মেঘা ব্যাপারটা খেয়াল করে আর চুপ করে থাকেনি। ও সেদিন এসে অভীক কে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেছিল,
——- ” কি হয়েছে রে দাদা? আমি আসার পরের দিনই কেন বৌদিভাই চলে গেল! আর তোকে ঘুম থেকে ডাকলো অব্দি না! নিজেই গাড়ি বুক করে চলে গেল! কি করেছিস তুই? নিশ্চয়ই বৌদি ভাই এর কোন কিছু খারাপ লেগেছে, নইলে এইভাবে চলে যেত না।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল মেঘা। অভীক এই কথায় একটু সময় নিয়ে বলেছিল,
——- ” আসলে তুই এক্সকার্সনে যাওয়ার পর আমি তোকে নিয়ে খুব টেনশনে ছিলাম। একা একা কিভাবে সব ম্যানেজ করছিস, কিভাবে থাকছিস সবার সাথে এডজাস্ট করে, সেই জন্য ওই কদিন আমি ঐশীর সঙ্গে কথা বলিনি ঠিক। মানে মাঝে মাঝে একটু রুডলিও বিহেভ করে ফেলেছি। তার জন্যই হয়ত!”
কথাটাকে ওর শেষ করতে না দিয়েই মেঘা এবার বলে উঠেছিল কঠিন গলায়,
——- ” বুঝতে পেরেছি। তুই এই কদিন নিজের মধ্যে ছিলিস। নিজের চিন্তার জগতে। আর আমি জানি, বৌদিভাই আমার হয়ে এই ট্রিপটায় যাওয়া নিয়ে কথা বলেছে বলে তোর একটা রাগ ছিল বৌদিভাই এর ওপর। সেই জন্য নিশ্চয়ই তুই খারাপভাবে কথা বলেছিস। সত্যি! তুই কি রে দাদা? বৌদিভাই এর মতন মানুষ কে হার্ট করলি তুই কি করে! ”
কথাগুলো শুনে অভীক ঠিক আর কিছু বলতে পারেনি। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। কিন্তু মেঘা এরপর অর্ডার করার মতন সুরে বলেছিল,
——-” তুই কালই যাবি বৌদিভাইদের বাড়ি। তারপর যেভাবেই হোক ওকে মানিয়ে বাড়ি নিয়ে আসবি। দরকার হলে ওদের বাড়িতে থেকে যাবি দাদা, কিন্তু বৌদিভাইকে সাথে নিয়েই ফিরবি।”
কথাটা বলেই মেঘা আর কোন উত্তরের অপেক্ষা করলো না। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কিন্তু অভীক স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলো এই মুহূর্তে কিছুক্ষণ। সত্যি, ঐশী এইভাবে নিজের বাড়ি না গেলে ও বুঝতেই পারতো না যে ঐশীকে ছাড়া দিনগুলো কতটা খালি খালি লাগে ওর! তবে মেঘা আজ ঠিকই বলেছে। ওর ঐশীদের বাড়ি যাওয়া উচিত। ঐশীর সাথে এই মনের দূরত্বটা এবার ওকে মেটাতেই হবে; যেভাবেই হোক।
সেদিন নিজের ভাবনা মতনই কাজ করেছিল অভীক। রাত তখন আটটা। অভীক অফিস থেকে সোজা এসে হাজির হয়েছিল ঐশীদের বাড়ি। তারপর কিছুটা ইতঃস্তত হয়েই কলিং বেলটা বাজিয়েছিল বাড়ির। এরপর কিছুক্ষণ সময়ের ভিড়ে ঐশী এসেই দরজা খুলেছিল ওকে, আর থমকে গেছিল যেন কয়েক সেকেন্ড! অভীক এখানে কি করছে! যার কাছে কিছু দিনের দূরত্ব চেয়েছিল ঐশী, সে কেন এসেছে আজ ওর কাছে! কথাটা ভেবেই মুখটা ওর অন্ধকার হয়ে গেছিল হঠাৎ; আর অভীক খেয়াল করেছিল এই অন্ধকারটা মন দিয়ে।

চলবে।