আলোকবর্ষ পেরিয়ে পর্ব-০৭

0
414

#আলোকবর্ষ_পেরিয়ে ( সপ্তম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৬>
এরপর পাঁচটা মাস যেন এই অন্ধকার কালো রাতটার মতনই কেটে গেল চোখের পলকে! একটা এক্সিডেন্ট আসলে সব কিছু ওলট পালট করে দিল হঠাৎ। অভীক এই দিনগুলোতে যতবার নিজের বোনকে দেখতো; ওর হুইল চেয়ারে বসা প্রতিবন্ধী জীবনটা, ততোবার যেন অজান্তেই ঐশীর ওপর রাগ হতো ভীষণ। মনে হতো ওর একটা ভুল ডিসিশন এর জন্য আজ মেঘার এই অবস্থা! সেদিন যদি ও ড্রাইভিং কোর্সের টাকা না দিত, তাহলে আজ হয়ত দিনগুলো অন্য রকম হতো।
আর এই ভাবনার জন্যই ঐশীর সাথে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছিল একদম অভীক। খুব প্রয়োজন না থাকলে দুটো শব্দব্যায়ও করতো না ও। এমনকি ঐশীর হাতের রান্না খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিল অভীক। এটা বেশ স্পষ্ট ভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিল ওকে একদিন। ঐশী সেই রবিবার রান্না করেছিল রাতের ডিনারটা। কিন্তু ডাইনিং টেবিলে বসে ঐশীর সামনে অভীক মুখের ওপর বলেছিল বাড়ির কটা কাজের লোককে ডেকে,
——-” তোমাদের এত করে টাকা স্যালারি দিই কিসের জন্য,! বসে থাকবে বলে? কাল থেকে যা রান্না করার তোমরা করবে। যেরকম আগে করতে। বাড়ির কারোর আর রান্না করার দরকার নেই।”
কথাগুলোকে যে সেদিন অভীক ঐশীকে শুনিয়ে বলেছিল, এটা ও খুব সহজেই বুঝেছিল। সেদিন খাবারটা যেন কিছুতেই আর এরপর গলা থেকে নামেনি ঐশীর। এত ভালোবেসে রান্না করতো ও! অভীক আর মেঘার পছন্দের জিনিস করে ওদের মুখের হাসিটা দেখতে চাইতো শুধু! আর আজ সেটাও অভীক বন্ধ করে দিল! এমনকি এটাও বুঝিয়ে দিল যে ঐশীর হাতের কিছু খেতে চায় না ও আর! কথাগুলো মনে হতেই শরীর মন দুটোই যেন নিস্তেজ হয়ে গেল এই মুহূর্তে ঐশীর। এতদিনের এত সুন্দর সুন্দর মূহুর্ত গুলো আজ ভীষণ আবছা আর পুরনো মনে হলো ওর। এত অপলকা ভাঙা চোরা সম্পর্ক ছিল ওর অভীকের সাথে! যে একটা ধাক্কা আসতেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল! কথাটা যেন আজ খুব বেশি করে মনে হলো ঐশীর।
কিন্তু সেদিনের পর আরেকটা ঘটনা ঐশীকে সব থেকে বেশি কষ্ট দিল। সেদিন মেঘা একটু নিজে নিজে ওঠার চেষ্টা করছিল হুইল চেয়ার থেকে। আসলে এই অসহায়, অন্যের ওপর নির্ভরশীল জীবনটা যেন আজকাল ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। কেমন কালো মেঘে ঢাকা মনে হয় চারিদিকটা। সেদিন তাই কিছুটা জোর করেই ও নিজে নিজে হুইল চেয়ার থেকে ওঠার চেষ্টা করছিল। তবে পারলো না মেঘা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। এই মুহূর্তে পাশের ঘর থেকে ওর চিৎকারের আওয়াজটা ঐশী শুনেছিল। ও এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে দৌড়ে গেছিল মেঘার ঘরে। তারপর তাড়াতাড়ি করে মেঘাকে মাটি থেকে তুলেছিল ও, শক্তভাবে আঁকরে। কিন্তু তখনই অভীক চলে এসেছিল মেঘার ঘরে, আর ঐশীর হাতটা মেঘার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজে আঁকরে ধরেছিল বোনকে। ও যেন বোঝাতে চেয়েছিল ঐশীকে আজ, যে এই ঘরে ওর আসার কোন দরকার নেই। ঐশী সেই মুহূর্তে আর চুপ করে থাকতে পারেনি সেদিন। ও অভীক কে মেঘার সামনেই বলে উঠেছিল,
——” এখানে আমি মেঘার কোন ক্ষতি করতে আসিনি অভীক যে এরকমভাবে বিহেভ করছো! মেঘার পড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনে আমি এসেছিলাম।”
এই কথায় অভীক ওকে সেদিন বেশ তীক্ষ্ম গলায় বলেছিল,
——” তুমি ওর যা ক্ষতি করার অলরেডি করে দিয়েছ। আর কিছু বাকি আছে বলে তোমার মনে হয়! আর কি করবে ওর? প্লিজ যাও এবার এখান থেকে। নিজের কাজ করো গিয়ে।”
এই কথায় ঐশী সেই মুহূর্তে থমকে গেলেও মেঘা বেশ রেগেই বলেছিল ওর দাদাকে,
—–” কি বলছিস এইসব তুই! বৌদিভাইকে কেন শুধু শুধু দোষ দিস আমার এক্সিডেন্ট এর জন্য!”
এটা শুনে অভীক সেই কঠিন স্বরেই বলেছিল,
—–” কারণ ও ই রেসপনসিবেল এই সব কিছুর জন্য। আমি হাজার বার বারণ করেছিলাম এই ড্রাইভিং ক্লাসে জয়েন করার ব্যাপারে তোকে। কিন্তু ঐশী সেটা শোনেনি। ও পাঠিয়েছিল তোকে ওই ক্লাসে। এই কথাটা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না! আর অনেস্টলি আমার তো আজকাল এই বিয়েটাকেই ভুল মনে হয় নিজের লাইফে। আমার কখনো উচিত ই হয়নি তোর আর আমার মাঝে অন্য কাউকে নিয়ে আসার!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেছিল অভীক। কিন্তু মেঘা এবার ওকে চুপ না করিয়ে পারেনি। ও অভীকের কথার মাঝেই বলে উঠেছিল,
——” প্লিজ দাদা, থাম তুই এবার। কেন এইসব বলছিস তুই? কেন নিজের সম্পর্কটাকে এইভাবে নষ্ট করছিস? একদিন দেখবি, এসবের জন্য আফসোসের শেষ থাকবে না তোর।”
কথাটা শুনে অভীকের কিছু বলার আগেই এই মুহূর্তে ঐশী বলে উঠেছিল, কেমন নিস্তেজ গলায় অভীকের দিকে তাকিয়ে,
——-” তুমি কি আর আমার সঙ্গে থাকতে চাও না? এই বিয়েটা শেষ করতে চাও তুমি?”
এর উত্তরে অভীক সঙ্গে সঙ্গেই অল্প কথায় বলেছিল ভারী গলায়,
—–” না থাকতে চাই না। যার জন্য আজ আমার বোনের এই অবস্থা, তার সাথে একই ছাদের তলায় থাকা; সত্যি আমার পক্ষে সম্ভব না।”
কথাগুলো বলেই অভীক বেরিয়ে গেছিল সেদিন ঘরটা থেকে। কিন্তু ঐশীর মনে যেন দাগ লেগে গেছিল হঠাৎ। অভীক এতদিন যেটা নিজের ব্যাবহারে বোঝাত, আজ সেটা মুখে বলে দিল। একদিকে সুবিধাই হলো ওর যদিও! অন্তত একটা উত্তর তো পেল! এবার সেই মতনই মনকে বোঝাবে ও। সম্পর্কটাকে খাতায় কলমে শেষ করে দেওয়ার সব রকম ব্যাবস্থাও করবে ঐশী। শুধু মনের ক্ষত টা থেকেই যাবে। ভালোবেসে অপমান পাওয়ার ক্ষত।
তবে এই মুহূর্তে মেঘা যদিও ঐশীর হাতটা শক্ত করে ধরে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল,
—–” প্লিজ বৌদিভাই, তুমি দাদার কথাটাকে সত্যি ভেবো না। ও আসলে এই এক্সিডেন্ট টা র জন্য ভীষণ আপসেট। মাথার ঠিক নেই ওর। তাই কি থেকে কি বলছে! কিন্তু ও সত্যি তোমাকে খুব ভালোবাসে। আমি জানি।”
কথাগুলো খুব জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছিল মেঘা। কিন্তু ঐশী ওর কথায় মলিন হেসেছিল শুধু।আসলে সত্যি টা তো ওর এই কদিনে বোঝা হয়েই গেছে! তাই আর আলাদা করে কিছু বিশ্বাস করার নেই। তবে আজ ঐশী মেঘাকে একটা অন্য কথা বলেছিল হঠাৎ। ভীষণ স্থির গলায় বলেছিল ও,
—–” তুমি এইসব নিয়ে ভেবো না। আমি তোমাকে সুস্থ্য না করে এই বাড়ি থেকে কোথাও যাচ্ছি না! আমার একজন চেনা খুব ভালো ফিজিও থেরাপিস্ট আছে। আমি তাকে কাল থেকে আসতে বলেছি। তোমার দাদার অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর। আসলে তোমার দাদা জেনে শুনে আমার রেকমেন্ড করা কোন লোককেই তোমার ট্রিটমেন্ট এর জন্য এলাও করবে না! কিন্তু আমি জানি, তোমার রিকভারি পসিবেল। আর আমাদের শেষ অব্দি চেষ্টা করতে হবে। শুধু এসব করার আগে তোমার কাছ থেকে একটাই কথা জানার আছে আমার, ডু ইউ ট্রাস্ট মি মেঘা? না কি তুমিও এটাই বিশ্বাস করো যে তোমার যা ক্ষতি হয়েছে সবটা আমার জন্য?”
শেষ কথাগুলো কেমন কেটে কেটে বলেছিল ঐশী। কিন্তু মেঘা এর উত্তরে কিছু আর বলতে পারেনি। শুধু খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল ঐশীকে নিজের কাছে। শব্দহীন ভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিল ভালোবাসাটা।
<১৭>
সেদিনের পর ধীরে ধীরে ৬ টা মাস কেটে গেছিল ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে। সেদিন ছিল উনিশে ফেব্রুয়ারি। মেঘার জন্মদিন। অভীক সকালবেলা উঠে নিজেই গেছিল মন্দিরে পুজো দিতে। ও ইউএসএর একজন ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কিছুদিন আগে। মেঘার ট্রিটমেন্টের জন্য এপয়মেন্ট পেয়েছে নেক্সট উইকে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই এপয়মেন্টটা জোগাড় করেছে অভীক। এখানকার থেকে ইউএসএর ইনফ্রাস্ট্রাকচার তো অনেক ভালো। মেঘা ওখানে গেলে বেস্ট ট্রিটমেন্টটাই পাবে। এইসব ভেবেই ছ মাস অপেক্ষা করেছে এই ডক্টর হোমস এর এপয়মেন্ট এর জন্য। এবার শুধু ভালোয় ভালোয় ট্রিটমেন্ট টা শুরু হোক মেঘার! পুজো দিতে দিতে এইসব কথাই মন থেকে ভাবছিল অভীক।
যাইহোক, তারপর প্রসাদ নিয়ে যখন বাড়ি পৌঁছেছিল তখন ঘড়িতে সকাল দশটা। ও সেদিন প্রথমেই এসেছিল এরপর মেঘার ঘরে। আজ মেঘা খুব সুন্দরভাবে সেজে বসে আছে হুইল চেয়ারে। জন্মদিন বলেই এত সুন্দর করে রেডি হয়েছে ও। কথাটা মনে হতেই হাসি চলে এলো একটা অভীকের মুখে। ও এরপর প্রসাদ নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল মেঘার কাছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে মেঘা অভীক কে দেখে এক গাল হেসে উঠে দাঁড়িয়েছিল হঠাৎ হুইল চেয়ার থেকে। তারপর আলতোভাবে দু পা এগিয়ে ওকে এসে জড়িয়ে ধরেছিল নিজে থেকে। অভীক তো যেন এই দৃশ্যটা দেখে থমকে গেছিল একদম! ওর চোখের পলক পড়ছিল না আর। মেঘা নিজে উঠে দাঁড়িয়ে ওর কাছে এলো! এটা কি ও স্বপ্ন দেখছে! না কি সত্যি! কথাটা ভাবতেই মেঘা ওকে দু হাত দিয়ে একটু ঝাঁকিয়ে দিল এবার, ওর ঘোরটা কাটানোর জন্য। অভীক সেই মুহূর্তে বাস্তবের মাটিতে ফিরে এসে মেঘার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
——” তুই ঠিক হয়ে গেছিস! সত্যি! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। কিভাবে হলো এইসব?”
প্রশ্নগুলো এক নিঃশ্বাসে করে গেল অভীক। মেঘা এবার হাসি মুখে বলে উঠলো,
—–” যা হয়েছে সব বৌদিভাই এর জন্য হয়েছে। ওর চেনা ফিজিও থেরাপিস্ট রোজ সকালে এসে আমার ফিজিওথেরাপি করতো, তুই অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর। সমরেশ মিত্র। কলকাতার নাম করা ফিজিও থেরাপিস্ট দের মধ্যে একজন। বৌদি ভাই তো এর জন্য নিজের চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছিল, আমার সঙ্গে প্রত্যেকদিন সেশনে থাকবে বলে। বিশ্বাস কর দাদা, আমি অনেক সময়ই হার মেনে নিতাম। ক্লান্ত হয়ে যেতাম। মনের জোর হারিয়ে ফেলতাম। কিন্তু বৌদিভা ই সব সময় বুঝিয়ে গেছে সেই সময়গুলোতে। আমাকে ধরে ধরে হাঁটানো প্র্যাকটিস করানো থেকে আমার মনের জোর বাড়ানো, সব করেছে সেই মানুষটা। আর তার রেজাল্ট তুই আজ দেখতেই পাচ্ছিস। আমি এতটা রিকভার করেছি এই ক মাসে! হ্যাঁ, এখন হয়ত কদিন ওয়াকার নিয়ে হাঁটতে হবে আরো। কিন্তু সমরেশ দা বলেছে, আর এক দেড় মাসের মধ্যেই আমি আবার আগের মতন নর্মাল হাঁটা চলা করতে পারবো।”
কথাগুলো ভীষণ উজ্জ্বল মুখে বলেছিল মেঘা। আর অভীকের চোখে জল চলে এসেছিল হঠাৎ, আনন্দে। মেঘা যে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, এটা যেন স্বপ্নের মতন লাগছিল ওর। মনে হচ্ছিল অনেকদিন বাদে বুক থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেছে যেন! শরীরটা হালকা লাগছে তাই।

তবে এই আনন্দের মুহূর্তে আরেকজনের কথা মনে হচ্ছিল অভীকের খুব। যার সাথে এতগুলো মাস ঠিক করে কথা বলেনি কখনো, ফিরে তাকায়নি একবার! তার কথা। ঐশীর কথা। যার জন্য মেঘা আজ উঠে দাঁড়িয়েছে, সেই মানুষটার মুখোমুখি হতে ইচ্ছে হচ্ছিল খুব। তাই ও আর দেরি না করে মেঘাকে বলেছিল,
——” আমাকে ঐশীর সাথে কথা বলতে হবে। আমি একটু ওর সঙ্গে দেখা করে আসছি।”
এই কথায় মেঘা ঘাড় দুলিয়ে উত্তর দিয়েছিল,
——-” আমিও তোকে এটাই বলছিলাম। তোর সত্যি বৌদিভাইয়ের কাছে গিয়ে সরি বলা উচিত। তুই কতদিন ঠিকভাবে কথা অব্দি বলিসনি! প্লিজ যা এবার।”
কথাটা শুনে অভীক আর সেদিন দেরি করেনি। জোরে পা চালিয়ে বেরিয়ে এসেছিল মেঘার ঘর থেকে। ঐশী নিশ্চয়ই এখন ঘরে থাকবে; কথাটা ভেবেই এগিয়ে গিয়েছিল ঐশীর কাছে।
সেদিন এরপর কিছু সময়ের ভিড়ে অভীক এসেছিল ঐশীর কাছে। তবে ঘরে এসে ও থমকে গেছিল কয়েক সেকেন্ড। ঐশীর সাথে এই কমাস ও যেভাবে ব্যাবহার করেছে, রাগ দেখিয়েছে, এমনকি কথা অব্দি বলা বন্ধ করে দিয়েছে এতদিন, তারপর ঠিক কোন মুখে ঐশীর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে ভেবে পাচ্ছিল না। তবে ঐশী সেই মুহূর্তে খেয়াল করেনি ওকে। আলমারি তে কিছু একটা জিনিস খুঁজছিল মনে হয়! যাইহোক, অভীক সেসবের মধ্যেই ধীর পায়ে এগিয়ে এসেছিল ঐশীর কাছে, তারপর ডেকেছিল ওকে পেছন থেকে, কিন্তু সেই মুহূর্তে হঠাৎ খেয়াল করেছিল অভীক ফাঁকা আলমারিটা কে! অদ্ভুত তো! ঐশীর জামা কাপড় সব কোথায় গেল! প্রশ্নটা মনে আসতেই অভীকের চোখে পড়েছিল আলমারির পাশে রাখা দুটো ব্যাগের দিকে। তবে এই সময়ে ও কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ঐশী ওর গলার আওয়াজটা শুনে আচমকা পেছনে ফিরে তাকিয়েছিল। অভীক এটা দেখে একটু ইতঃস্তত হয়ে বলেছিল,
—–” ঐশী, আমি মেঘাকে দেখে এলাম। আমি কি বলে যে তোমাকে থ্যাংকস জানাবো! ”
না, কথাটাকে ওর শেষ হতে না দিয়েই ঐশী বলেছিল নিজের মনে,
——” দরকার নেই থ্যাঙ্কস এর। যাইহোক, আমার তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
কথাটা বলেই ও আলমারির মধ্যে রাখা নিজের পার্স থেকে একটা কাগজ বার করে অভীকের দিকে এগিয়ে দিয়ে ছিল। অভীক সেটা দেখে কিছুটা যেন অবাক হয়েই বলেছিল,
—–” কিসের পেপার এটা?”
অভীকের এই প্রশ্নে ঐশী এক কথায় উত্তর দিয়েছিল,
——” ডিভোর্সের নোটিশ।”
কথাটা শুনে অভীক যেন নির্বাক হয়ে গেছিল হঠাৎ! তবে ঐশী খুব স্বাভবিক গলায়ই বলেছিল,
——” সরি, তুমি অনেকদিন আগেই চেয়েছিলে আলাদা থাকতে। কিন্তু মেঘা ঠিক না হওয়া অব্দি আমার পক্ষে এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। যাইহোক, মেঘা এখন অনেকটাই সুস্থ্য। আর কোন কারণ নেই আমার এখানে থাকার। তুমি এই ডিভোর্সের নোটিশটা সাইন করে দিও। উকিলের সাথে আমার কথা হয়েই গেছে। মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স তো। প্রবলেম হবে না। আসছি। ”
কথাটা বলেই ঐশী ব্যাগগুলো নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে, অভীকের চোখের পলকে। ওর কোন কিছু বলার অপেক্ষা করেনি আর! আসলে অভীকের সাথে ওর সব কথা, সব সম্পর্কই তো শেষ। আর এতদিন এত কিছু শোনার পর, এত অপমান পাওয়ার পর কিছু শোনার মতন ও আর নেই ঠিক। তাই যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব সেদিন বেরিয়ে এসেছিল বাড়িটা থেকে । তবে অভীক যেন মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে ছিল স্থির হয়ে বেশ কিছুক্ষণ। হাতে ধরা ডিভোর্সের নোটিশটা কেমন কাঁটার মতন বিধছিল শরীরে। কিভাবে ঐশীকে আটকাবে; কি বলে ওর হাতটা ধরে ওকে নিজের কাছে রাখবে ভেবে পাচ্ছিল না! এতদিনের ব্যাবহার, মুখ ফিরিয়ে থাকা, একই বাড়িতে থেকে অচেনার মতন থাকা, সব যেন খোলা চোখে দেখতে পাচ্ছিল ও! আর মনে পরে যাচ্ছিল নিজের সেই পুরনো কথাগুলো; কিভাবে ঐশীর সাথে দিনের পর দিন কথা না বলে থেকেছে ও! কিভাবে এই বিয়েটাকে বার বার একটা ভুল বলে স্বীকার করেছে রাগের মাথায়। ঐশীর সাথে এক ঘরে অব্দি কতদিন শোয়নি অভীক। এমনকি ওর হাতের রান্না করা খাবার খায়নি পর্যন্ত! নিজের বোনের প্রতি কনসার্ন দেখাতে গিয়ে, এত রাগ দেখিয়েছে অন্ধের মতন ঐশীকে, যে রোজ একটু একটু করে নিজের সম্পর্কটাকে নিজের হাতে শেষ করেছে অভীক। আর আজ তারই একটা উত্তর যেন ঐশী দিয়ে গেল ওকে। অভীকের রাগের মাথায় বলা কথাটা; যে ও আর থাকতে পারবে না এক ছাদের তলায় ঐশীর সাথে, সেটাকেই সত্যি করে দেখালো মেয়েটা। অভীককে ওর এই কথার, এতদিনের ব্যাবহারের চরম শাস্তি দিল ঐশী! নিজেকে সত্যি সত্যিই দূরে সরিয়ে নিয়ে। অভীক আজ প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেল এক মুহূর্তে। নিজের প্রতি লজ্জায়, রাগে মাথা নিচু হয়ে এলো ওর। যাকে ভালোবেসে নিজের জীবনে নিয়ে এসেছিল, তাকে কিভাবে এত হার্ট করলো অভীক! কিভাবে এতগুলো দিন এইভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকলো যে সে আজ চলে যেতে বাধ্য হলো অবশেষে! কথাটা ভেবে কেমন চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো জলে। অনুশোচনার জলে। আর চারিদিকটা অন্ধকারে ঢেকে গেল অভীকের হঠাৎ।

চলবে।